Recent Tube

ইতিকাফ; শামীম আজাদ।




     
        ইতিকাফ;
---------------------------------

 ইতিকাফ বলতে কী বুঝায় বা এর পরিচয় কী? 

   পবিত্র রমযান মাসে বিভিন্ন ইবাদত-বন্দেগির মধ্যে ইতেকাফ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ইতিকাফ একটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ অবস্থান করা, স্থির থাকা, কোনো স্থানে আটকে পড়া বা আবদ্ধ হয়ে থাকা।
শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় বিশেষ ব্যক্তির মসজিদের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রেখে সেখানে অবস্থান করা; তথা সকল মানুষ ও সংসারের সকল কাজকর্ম থেকে দূরে থাকা এবং সওয়াবের কাজ; নামায, যিকির ও কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি ইবাদতের জন্য একমন হওয়াকে ইতিকাফ বলা হয়।

ইতিকাফের অর্থঃ
ইতিকাফের আভিধানিক অর্থ হল, কোন জিনিসকে আঁকড়ে ধরা এবং তাতে নিজেকে আবদ্ধ রাখা (রত থাকা, মগ্ন থাকা, লিপ্ত থাকা); তাতে সে জিনিস ভাল হোক অথবা মন্দ। 

মহান আল্লাহ তা'আলা বলেন, 
مَا هَذِهِ التَّمَاثِيْلِ الَّتِيْ أَنْتُمْ لَهَا عَاكِفُوْنَ
অর্থাৎ, (ইবরাহীম তার পিতা ও সম্প্রদায়কে বলল,) যে মূর্তিগুলোর পূজায় তোমরা রত আছ, (বা যাদের পূজারী হয়ে বসে আছ) সে গুলো কি? 
সূরা আম্বিয়াঃ ৫২
অর্থাৎ, তোমরা তাদের সম্মুখে দন্ডায়মান হয়ে পূজায় রত আছ।

ইতিকাফের মানঃ
রমাযান মাসে করণীয় যে সব সওয়াবের কর্ম বিশেষভাবে তাকীদপ্রাপ্ত, তার মধ্যে ইতিকাফ অন্যতম। ইতিকাফ সেই সকল সুন্নাহর একটি, যা প্রত্যেক বছরের এই রমাযান মাসে - বিশেষ করে এর শেষ দশকে - মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বরাবর করে গেছেন। এ সব কথার দলীল নিম্নরূপঃ-

১। মহান আল্লাহ তা'আলা বলেন,
أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِيْنَ وَالعَاكِفِيْنَ وَالرُّكَّعِ السُّجُوْدِ
অর্থাৎ, (আর আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে অঙ্গীকারবদ্ধ করলাম যে,) তোমরা উভয়ে আমার (কা’বা) গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী, রুকূ ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ।
সূরা বাকারাঃ ১২৫

তিনি অন্যত্র বলেন, 
وَلاَ تُبَاشِرُوْهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُوْنَ فِي الْمَسَاجِدِ
অর্থাৎ, আর মসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় তোমরা স্ত্রী-গমন করো না। 
সূরা বাকারাঃ ১৮৭

২। 
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَعْتَكِفُ فِي كُلِّ رَمَضَانَ عَشْرَةَ أَيَّامٍ، فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الَّذِي قُبِضَ فِيهِ اعْتَكَفَ عِشْرِينَ يَوْمًا‏.‏

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি রমযানে দশ দিনের ই‘তিকাফ করতেন। যে বছর তিনি ইন্তিকাল করেন সে বছর তিনি বিশ দিনের ইতিকাফ করেছিলেন।
বুখারী ২০৪৪

৩। 
حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ يُوسُفَ، حَدَّثَنَا اللَّيْثُ، عَنْ عُقَيْلٍ، عَنِ ابْنِ شِهَابٍ، عَنْ عُرْوَةَ بْنِ الزُّبَيْرِ، عَنْ عَائِشَةَ ـ رضى الله عنها ـ زَوْجِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ، ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ‏.‏

নবী সহধর্মিণী ‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমযানের শেষ দশকে ই’তিকাফ করতেন। তাঁর ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। এরপর তাঁর সহধর্মিণীগণও (সে দিনগুলোতে) ইতিকাফ করতেন।
বুখারী ২০২৬

ইতিকাফের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : 

ইতিকাফের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো লাইলাতুল ক্বদর অনুসন্ধান করা। যে ব্যক্তি পবিত্র মাহে রমযানের শেষ ১০দিন ইতিকাফ করবেন, তিনি নিশ্চয়ই লাইলাতুল কদরের ফজিলত লাভ করবেনই।
প্রত্যেক ইবাদতের পশ্চাতে রহস্য, হিকমত ও যৌক্তিকতা আছে একাধিক। এ কথা বিদিত যে, প্রত্যেক আমল হৃদয়ের উপর নির্ভরশীল। যেমন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, 

حَدَّثَنَا أَبُو نُعَيْمٍ، حَدَّثَنَا زَكَرِيَّاءُ، عَنْ عَامِرٍ، قَالَ سَمِعْتُ النُّعْمَانَ بْنَ بَشِيرٍ، يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏ "‏ الْحَلاَلُ بَيِّنٌ وَالْحَرَامُ بَيِّنٌ، وَبَيْنَهُمَا مُشَبَّهَاتٌ لاَ يَعْلَمُهَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ، فَمَنِ اتَّقَى الْمُشَبَّهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِيِنِهِ وَعِرْضِهِ، وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ كَرَاعٍ يَرْعَى حَوْلَ الْحِمَى، يُوشِكُ أَنْ يُوَاقِعَهُ‏.‏ أَلاَ وَإِنَّ لِكُلِّ مَلِكٍ حِمًى، أَلاَ إِنَّ حِمَى اللَّهِ فِي أَرْضِهِ مَحَارِمُهُ، أَلاَ وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ‏.‏ أَلاَ وَهِيَ الْقَلْبُ ‏"‏‏

নু‘মান ইব্‌নু বশীর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

তিনি বলেনঃ আমি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি যে, ‘হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট। আর এ দু’য়ের মাঝে রয়েছে বহু সন্দেহজনক বিষয়- যা অনেকেই জানে না। যে ব্যক্তি সেই সন্দেহজনক বিষয় হতে বেঁচে থাকবে, সে তার দ্বীন ও মর্যাদা রক্ষা করতে পারবে। আর যে সন্দেহজনক বিষয়সমূহে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তার উদাহরণ সে রাখালের ন্যায়, যে তার পশু বাদশাহ্‌ সংরক্ষিত চারণভূমির আশেপাশে চরায়, অচিরেই সেগুলোর সেখানে ঢুকে পড়ার আশংকা রয়েছে। জেনে রাখ যে, প্রত্যেক বাদশাহ্‌রই একটি সংরক্ষিত এলাকা রয়েছে। আরো জেনে রাখ যে, আল্লাহর যমীনে তাঁর সংরক্ষিত এলাকা হলো তাঁর নিষিদ্ধ কাজসমূহ। জেনে রাখ, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরা আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখ, সে গোশতের টুকরোটি হল ক্বলব (অন্তর)।

(২০৫১; মুসলিম ২২/২০ হাঃ ১৫৯৯, আহমাদ ১৮৩৯৬, ১৮৪০২) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৫০,ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৫০)
বুখারী ৫২

হৃদয়কে যে জিনিস বেশী নষ্ট করে তা হল নানান হৃদয়গ্রাহী মনকে উদাসকারী জিনিস এবং সেই সকল মগ্নতা ও নিরতি; যা মহান আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার পথে বাধাস্বরূপ। যেমন উদরপরায়ণতা, যৌনাচার, অতিকথা, অতিনিদ্রা, অতিবন্ধুত্ব, ইত্যাদি প্রতিবন্ধক কর্ম; যা অন্তরের ভূমিকাকে বিক্ষিপ্ত করে এবং তার একাগ্রতাকে আল্লাহর আনুগত্যে বিনষ্ট করে ফেলে। এই জন্য মহান আল্লাহ তাঁর নৈকট্য প্রদানকারী কিছু ইবাদত বিধিবদ্ধ করলেন; যা বান্দার হৃদয়কে ঐ উদাসকারী প্রতিবন্ধক বিভিন্ন অপকর্ম থেকে হিফাযত করে। যেমন রোযা; যে রোযা দিনের বেলায় মানুষকে পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত রাখে এবং সেই সকল স্বাদ উপভোগ থেকে বিরত থাকার প্রতিচ্ছবি হৃদয়-মুকুরে প্রতিফলিত হয়। আর তাই আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে অগ্রসর হতে শক্তি যোগায় এবং বান্দা সেই কুপ্রবৃত্তির বেড়ি থেকে মুক্তি লাভ করতে সক্ষম হয়; যা তাকে আখেরাত থেকে দুনিয়ার দিকে ফিরিয়ে দেয়।

বলা বাহুল্য, রোযা যেমন পানাহার ও যৌনাচার-জনিত কুপ্রবৃত্তির নানা প্রতিবন্ধক থেকে বাঁচার জন্য হৃদয়ের পক্ষে ঢালস্বরূপ। ঠিক তেমনি ই’তিকাফও বিরাট রহস্য-বিজড়িত একটি ইবাদত। ই’তিকাফ মানুষের সঙ্গে অতিরিক্ত মিলামিশার ফলে হৃদয়ে যে কুপ্রভাব পড়ে এবং অতিকথা ও অতিনিদ্রার ফলে মহান প্রতিপালকের সাথে সম্পর্কে যে ক্ষতি হয় তার হাত হতে রক্ষা করে। আর এতে কোন সন্দেহ নেই যে, অতিবন্ধুত্ব, অতিকথা এবং অতিনিদ্রার কবল থেকে মুক্তি পাওয়াতেই রয়েছে বান্দার বড় সাফল্য; যে সাফল্য তার হৃদয়কে আল্লাহর পথে অগ্রসর হতে শক্তি যোগায় এবং এর প্রতিকূল সকল অবস্থা থেকে তাকে নিরাপত্তা প্রদান করে।

ইতিকাফের ফজিলত ও জরুরী বিধি-বিধান
=============================

  মহান আল্লাহ মাহে রমযান দ্বারা মুসলিম জাতিকে যেমনি সম্মানিত করেছেন, তেমনি অসহায় সম্বলহীন, হতদরিদ্র, নিঃস্ব ব্যক্তির জন্যে শুক্রবার দান করে হজ্বের ছওয়াব দান করেছেন। আরবি ইতিকাফ শব্দের অর্থ অবস্থান করা, বসা, বিশ্রাম করা, সাধনা করা, ধ্যান করা ইত্যাদি। রমযানের ২১তম রাত হতে ২৯তম রাত পর্যন্ত সাংসারিক যাবতীয় ঝামেলা হতে মুক্ত হয়ে মসজিদে ইবাদতের উদ্দেশ্যে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। রমযানের শেষ ১০দিন মসজিদে ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা-ই-কিফায়া। মহল্লার কোনো একজন ইতিকাফ পালন করলে সবার পক্ষ হতে আদায় হয়ে যায়। আর মহল্লার কেউ যদি ইতিকাফ না করেন তবে সবাই সুন্নাত ত্যাগের জন্যে দায়ী থাকবেন এবং গুণাহগার হবেন। প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) পবিত্র মাহে রমযানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন।

  মহানবী (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি রমযান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করবে, সে ব্যক্তি দুটি হজ্ব ও দুটি ওমরাহর সমান সওয়াব হাসিল করবে (বায়হাকি)। 

  মহানবী (সাঃ) আরো বলেন, যে ব্যক্তি ইবাদতের নিয়তে সওয়াবের আশায় ইতিকাফ করবেন তার যাবতীয় গুনাহ মাফ হয়ে যায় (দায়লামী)। 

حَدَّثَنَا عُبَيْدُ اللهِ بْنُ عَبْدِ الْكَرِيمِ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ أُمَيَّةَ حَدَّثَنَا عِيسَى بْنُ مُوسَى الْبُخَارِيُّ عَنْ عُبَيْدَةَ الْعَمِّيِّ عَنْ فَرْقَدٍ السَّبَخِيِّ عَنْ سَعِيدِ بْنِ جُبَيْرٍ عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ فِي الْمُعْتَكِفِ هُوَ يَعْكِفُ الذُّنُوبَ وَيُجْرَى لَهُ مِنْ الْحَسَنَاتِ كَعَامِلِ الْحَسَنَاتِ كُلِّهَا

ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ই‘তিকাফকারী সম্পর্কে বলেন, সে নিজেকে গুনাহ থেকে বিরত রাখে এবং নেককারদের সকল নেকী তার জন্য লেখা হয়।  
মিশকাত ২১০৮, ইবনে মাজাহ ১৭৮১,

وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهَا قَالَتْ: كَانَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ يَجْتَهِدُ فِى الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مَا لَا يَجْتَهِدُ فِىْ غَيْرِه. رَوَاهُ مُسْلِمٌ

 আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

   তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমাযান মাসের শেষ দশ দিনে যত ‘ইবাদাত বন্দেগী (মুজাহাদাহ্) করতেন এতো আর কোন মাসে করতেন না। 
মুসলিম ১১৭৫, তিরমিযী ৭৯৬, ইবনু মাজাহ ১৭৬৭, আহমাদ ২৬১৮৮, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ২২১৫, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৪৬১, সহীহাহ্ ১১২৩, সহীহ আল জামি‘ ৪৯১০, মিশকাতুল মাসাবিহ ২০৮৯

ইতিকাফের প্রকারভেদ : ইতিকাফ ৩ প্রকার। 

যথা-
১. ওয়াজিব ইতিকাফ, 
২. সুন্নাতে মুয়াক্কাদা, 
৩. নফল ইতিকাফ। 

ওয়াজিব ইতিকাফ : যা মানত করার কারণে ওয়াজিব হয়। সে ইতিকাফ অবশ্যই পালন করতে হবে। 
وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ: أَنَّ عُمَرَ سَأَلَ النَّبِىَّ ﷺ قَالَ: كُنْتُ نَذَرْتُ فِى الْجَاهِلِيَّةِ أَنْ أَعْتَكِفَ لَيْلَةً فِى الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ؟ قَالَ: «فَأَوْفِ بِنَذْرِكَ». (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)

আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

    তিনি বলেন, একবার ‘উমার  নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলেন, (হে আল্লাহর রসূল!) জাহিলিয়্যাতের যুগে আমি এক রাতে মাসজিদে হারামে ইতিকাফ করার মানৎ করেছিলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমার মানৎ পুরা করো। 
বুখারী ২০৩২, মুসলিম ১৬৫৬, আহমাদ ২৫৫, সহীহ ইবনু হিববান ৪৩৮০, মিশকাতুল মাসাবিহ ২১০১

   আবদুল্লাহ ইবনু আমর ও ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতেও এ অনুচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছে। উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসটিকে আবূ ঈসা হাসান সহী্‌হ্‌ বলেছেন। এ হাদীস মোতাবিক কয়েকজন অভিজ্ঞ আলিম বলেছেন, যদি কোন লোক ইসলাম ক্ববূল করে এবং আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যমূলক কাজের মানত যদি তার উপর থেকে যায় তবে সে এ মানত পুরো করবে। নাবী রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামে) এর কয়েকজন সাহাবী ও তৎপরবর্তীগণ বলেছেন, তাকে রোযা সহকারে ইতিকাফ করতে হবে। তারা মনে করেন রোযা ব্যতীত ইতিকাফ সম্পন্ন হয় না। অপর কয়েকজন অভিজ্ঞ আলিম বলেছেন, ইতিকাফ আদায়কারীর জন্য রোযা রাখা জরুরী নয়। তবে সে লোক ইতিকাফের সাথে রোযা রাখার মানতও করলে তবে তাকে রোযাও আদায় করতে হবে। তাদের দলীলঃ “উমার (রাঃ) মুসলমান হওয়ার আগে কা‘বা শরীফে এক রাত ইতিকাফের মানত করেছিলেন। তাকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই মানত পুরো করার নির্দেশ দেন” (অথচ রাতে রোযা হয় না সুতরাং রোযা ব্যতীতও ইতিকাফ হয়)। এই মত দিয়েছেন ইমাম আহমাদ ও ইসহাকও। 
জামে' আত-তিরমিজিঃ ১৫৩৯

   সুন্নাতে মুয়াক্কাদা : যা মাহে রমযানে (লাইলাতুল কদরের সওয়াব অর্জনের জন্য) শেষ ১০ দিন করা হয়। যা আমাদের প্রিয়নবী (সাঃ) এবং সাহাবায়ে কেরামগণ করেছেন। বর্তমানে সারা বিশ্বের বিশেষ করে প্রায় সব মসজিদের খতিব ও ইমাম সাহেবরা করে থাকেন। এই ইতিকাফ কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। 
عَنْ أَنَسٍ قَالَ: كَانَ النَّبِىُّ ﷺ يَعْتَكِفُ فِى الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ فَلَمْ يَعْتَكِفْ عَامًا. فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ اعْتَكَفَ عِشْرِيْنَ. رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

   তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক রমাযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। কিন্তু এক বছর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তা করতে পারলেন না। এর পরের বছর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিশ দিন ‘ইতিকাফ’ করলেন। 
তিরমিযী ৮০৩, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ২২২৭, মুসতাদারাক লিল হাকিম ১৬০১, মিশকাতুল মাসাবিহ ২১০২

নফল : নফল ইতিকাফের কোনো নির্ধারিত সময় নেই। যে কোনো মাসের যে কোনো দিনের যে কোনো সময় তা করা যায়। আর এই ইতিকাফকেই নফল ইতিকাফ বলে।

  ইতিকাফের শর্ত : ইতিকাফের শর্ত ৩টি। যথা- 

১. যে কোনো মসজিদে নিয়মিত জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা হয়, এরূপ কোনো মসজিদে পুরুষদের অবস্থান করতে হবে। মহিলারা আপন ঘরে পর্দার সঙ্গে ইতিকাফ করবে। 

২. ইতিকাফের নিয়তে ইতিকাফ করতে হবে। বিনা নিয়তে ইতিকাফ হয় না। 

৩. ইতিকাফকারীকে সর্বদা পাক-পবিত্র থাকতে হবে। 

ইতিকাফের নিয়ত : ইতিকাফের জন্য মসজিদে প্রবেশের সময় নিয়ত করে নিতে হয়। 

ইতিকাফে করণীয় : ইতিকাফ অবস্থায় করণীয় হচ্ছে- 

১. বেশি বেশি আল্লাহর জিকির-আজকার করা, 

২. নফল নামাজ আদায় করা, 

৩. কুরআন তেলাওয়াত করা, 

৪. দ্বীনি ওয়াজ-নসিহত শোনা ও 

৫. ধর্মীয় গ্রন্থাবলী পাঠ করা। 

  ইতিকাফে বর্জনীয় : ইতিকাফ অবস্থায় যেসব কাজ বর্জনীয়- 

১. ইতিকাফ অবস্থায় বিনা ওজরে মসজিদের বাইরে যাওয়া, 

২. দুনিয়াবি আলোচনায় মগ্ন হওয়া, 

৩. কোনো জিনিস বেচাকেনা করা, 

৪. ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ করা, 

৫. ওজরবশত বাইরে গিয়ে প্রয়োজনাতিরিক্ত বিলম্ব করা ও 

৬. স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করা। এসব কাজ করলে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যায়। 

    মহিলাদের ইতিকাফ : পুরুষ যেমনভাবে মসজিদে ইতিকাফ করবে তেমনি মহিলারাও তাদের নিজ নিজ গৃহে ইতিকাফ করবে। নারীদের জন্য ইতিকাফ জায়েজ ও বৈধ। তবে ইসলামের প্রথম যুগে মহিলারা যেমন অবাধে মসজিদে ইতিকাফ করতেন, বর্তমান সময়ে ফেতনার আশঙ্কায় তা জায়েজ নয়। বরং মহিলারা ঘরে নিজ কক্ষে ইতিকাফ করবে।

وَعَنْهَا: أَنَّ النَّبِيَّ - صلى الله عليه وسلم - كَانَ يَعْتَكِفُ العَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ، حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ، ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ. مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ

 আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

   নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমযানের শেষ দশক ইতিকাফ করতেন। তার ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। এরপর তার সহধর্মিণীগণও (সে দিনগুলোতে) ইতিকাফ করতেন ।  
বুখারী ২০২৬, মুসলিম ১১৭২, তিরমিয়ী ৭৯০, আবূ দাউদ ২৪৬২, আহমাদ ২৩৬১, ২৩৭১৩, মুওয়াত্ত মালেক ৬৯৯

 ইতিকাফ কেন করবেন, কীভাবে করবেন? 

 নবীজি ইতিকাফকে খুব গুরুত্ব দিতেন

حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ، حَدَّثَنَا اللَّيْثُ، عَنْ عُقَيْلٍ، عَنِ الزُّهْرِيِّ، عَنْ عُرْوَةَ، عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى قَبَضَهُ اللَّهُ ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ ‏.‏

  ‘আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

   নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমাযান মাসের শেষ দশ দিন ই‘তিকাফ করতেন যতদিন না আল্লাহ তাঁকে মৃত্যুদান করেন। এরপর তাঁর স্ত্রীগণও (ই‘তিকাফ করেন)।
আবু দাউদ ২৪৬২

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَعْتَكِفُ فِي كُلِّ رَمَضَانَ عَشْرَةَ أَيَّامٍ، فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الَّذِي قُبِضَ فِيهِ اعْتَكَفَ عِشْرِينَ يَوْمًا‏.‏

  আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

  তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি রমযানে দশ দিনের ই‘তিকাফ করতেন। যে বছর তিনি ইন্তিকাল করেন সে বছর তিনি বিশ দিনের ইতিকাফ করেছিলেন।
বুখারী ২০৪৪

নবীজি ইতিকাফকে খুব গুরুত্ব দিতেন। 
وَعَنْهَا: أَنَّ النَّبِيَّ - صلى الله عليه وسلم - كَانَ يَعْتَكِفُ العَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ، حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ، ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ. مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ

 আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

 নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমযানের শেষ দশক ইতিকাফ করতেন। তার ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। এরপর তার সহধর্মিণীগণও (সে দিনগুলোতে) ইতিকাফ করতেন ।  
বুখারী ২০২৬, মুসলিম ১১৭২, তিরমিয়ী ৭৯০, আবূ দাউদ ২৪৬২, আহমাদ ২৩৬১, ২৩৭১৩, মুওয়াত্ত মালেক ৬৯৯

 ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ইতেকাফ কী? 

   মসজিদুল হারামে আদায়কৃত ইতিকাফ ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ইতিকাফ। তারপর মসজিদে নববীর ইতিকাফ, তারপর বায়তুল মুকাদ্দাস। তারপর উৎকৃষ্ট ইতেকাফ হলো কোনো জামে মসজিদে ইতিকাফ করা যেখানে রীতিমতো জামায়াতে নামাজ হয়। এরপর মহল্লার মসজিদে। 

 একজন মুসলিম কেনো ইতিকাফ করবে? 

১. ইসলামের বিধান মান্য করার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে । 

২. মানবীয় পাশবিক প্রবণতা এবং অহেতুক কাজ থেকে দূরে থাকার চর্চা। 

৩. শবে কদর তালাশ করার উদ্দেশ্যে। 

وَعَنْ أَبِىْ سَعِيدٍ الْخُدْرِىِّ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهُمْ أَنَّ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ اعْتَكَفَ الْعَشْرَ الْأَوَّلَ مِنْ رَمَضَانَ ثُمَّ اعْتَكَفَ الْعَشْرَ الْأَوْسَطَ فِىْ قُبَّةٍ تُرْكِيَّةٍ ثُمَّ أَطْلَعَ رَأسَه. فَقَالَ: «إِنِّىْ اَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الْأَوَّلَ أَلْتَمِسُ هٰذِهِ اللَّيْلَة ثُمَّ اَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الْأَوْسَطَ ثُمَّ أُتِيتُ فَقِيلَ لِىْ إِنَّهَا فِى الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ فَمَنْ كَانَ اَعْتَكَفْ مَعِىْ فَلْيَعْتَكِفِ الْعَشْرَ الْأَوَاخِرَ فَقَدْ أُرِيتُ هٰذِهِ اللَّيْلَةَ ثُمَّ أُنْسِيتُهَا وَقَدْ رَأَيْتُنِىْ أَسْجُدُ فِىْ مَاءٍ وَطِينٍ مِنْ صَبِيحَتِهَا فَالْتَمِسُوهَا فِى الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ وَالْتَمِسُوهَا فِىْ كُلِّ وِتْرٍ». قَالَ: فَمُطِرَتِ السَّمَاءُ تِلْكَ اللَّيْلَةَ وَكَانَ الْمَسْجِدُ عَلٰى عَرِيشٍ فَوَكَفَ الْمَسْجِدُ فَبَصُرَتْ عَيْنَاىَ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ وَعَلٰى جَبْهَتِه أَثَرُ المَاءِ وَالطِّيْنِ مِنْ صَبِيحَةِ إِحْدٰى وَعِشْرِينَ. مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ فِى الْمَعْنٰى وَاللَّفْظُ لِمُسْلِمٍ إِلٰى قَوْلِه: «فَقِيلَ لِىْ: إِنَّهَا فِى الْعشْر الْأَوَاخِرِ». وَالْبَاقِى للْبُخَارِىِّ

আবূ সা‘ঈদ আল্ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমাযানের প্রথম দশ দিনে ইতিকাফ করেছেন। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একটি তুর্কী ছোট তাঁবুতে ইতিকাফ করেছেন মধ্যের দশ দিন। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর মাথা (তাঁবুর বাইরে) বের করে বলেছেন, আমি ‘কদর রজনী’ সন্ধান করার জন্য প্রথম দশ দিনে ইতিকাফ করেছি। তারপর করেছি মাঝের দশ দিনে। তারপর আমার কাছে তিনি এসেছেন। মালাক (ফেরেশতা) আমাকে বলেছেন, ‘লায়লাতুল কদর’ রমাযানের শেষ দশ দিনে। অতএব যে আমার সাথে ‘ইতিকাফ’ করতে চায় সে যেন শেষ দশ দিনে করে। আমাকে স্বপ্নে ‘কদর রজনী’ নির্দিষ্ট করে দেখিয়েছেন। তারপর তা আমাকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে (অর্থাৎ- জিবরীল (আঃ) আমাকে বললেন, অমুক রাতে শবে কদর। তারপর তা কোন্ রাত আমি ভুলে গিয়েছি)।

(স্বপ্নে) নিজেকে দেখলাম যে, আমি এর ভোরে (অর্থাৎ- লায়লাতুল কদরের ভোরে) কাদামাটিতে সাজদাহ্ করছি। যেহেতু আমি ভুলে গিয়েছি সেটা কোন্ রাত ছিল। তাই এ রাতকে (রমাযানের) শেষ দশ দিনের মধ্যে সন্ধান করো। তাছাড়াও লায়লাতুল কদরকে বেজোড় রাতে অর্থাৎ- শেষ দশের বেজোড় রাতে সন্ধান করো। বর্ণনাকারী বলেন, (যে রাতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নে দেখেছিলেন) সে রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। মাসজিদের ছাদ খেজুরের ডালপাতার হওয়ায় একুশতম রাতের সকালে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কপালে পানি ও মাটির চিহ্ন ছিল। (এ হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে অর্থের দিক দিয়ে বুখারী ও মুসলিম একমত। অবশ্য এ পর্যন্ত বর্ণনার শব্দগুলো ইমাম মুসলিম উদ্ধৃত করেছেন। আর রিওয়ায়াতের বাকী শব্দগুলো উদ্ধৃত করেছেন ইমাম বুখারী।) 
বুখারী ২০২৭, মুসলিম ১১৬৭, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ২২১৯, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৫৬৭, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৬৮৪, মিশকাতুল মাসাবিহ ২০৮৬

৪. মসজিদে অবস্থানের অভ্যাস গড়ে তোলা। 

৫. দুনিয়ামুখি মানসিকতা ত্যাগ ও বিলাসিতা থেকে দূরে থাকা। 

৬. এছাড়া হাদিসে ইতিকাফ করার ফজিলতের যে সব কথা উল্লেখ রয়েছে, এইসব ফজিলত অর্জনের উদ্দেশ্যেও ইতিকাফ করা যেতে পারে। যেমন ইতেকাফের ফজিলত সম্পর্কে 
রাসুল (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি রোজার শেষ ১০ দিন ইতেকাফ করবে, সে ব্যক্তি দুটি হজ্ব ও দুটি ওমরার সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। (বুখারি ও মুসলিম)।

ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে হাদিস বর্ণনা করেন, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলেছেন, 
مَنِ اعْتَكَفَ يَوْمًا ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ جَعَلَ اللَّهُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ النَّارِ ثَلاثَ خَنَادِقَ ، كُلُّ خَنْدَقٍ أَبَعْدُ مِمَّا بَيْنَ الْخافِقَيْنِ 
“যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একদিন ইতিকাফ করে আল্লাহ্‌ তার মাঝে ও জাহান্নামের আগুনের মাঝে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন; যা পূর্ব-পশ্চিমের চেয়েও বেশি দূরত্ব”।
তাবারানী (৭৪২০), হাকিম (৪/২৬৯) ও বায়হাকী (৩/৪২৪)

ইতিকাফের সময় কি কি কাজ করা যাবে এবং কি কি কাজ করা যাবে না:এক: ইতিকাফের মধ্যে যেসব কাজ করা জায়েজ বা করা যাবে।

১. প্রস্রাব পায়খানার জন্যে বাইরে যাওয়া জায়েয। মনে রাখতে হবে এসব প্রয়োজন এমন স্থানে পূরণ করতে হবে যা মসজিদের নিকটে হয়। 

২. ফরয গোসলের জন্যেও ইতিকাফের স্থান থেকে বাইরে যাওয়া জায়েয। তবে মসজিদের বাউন্ডারীর ভেতরে গোসল করার ব্যবস্থা থাকলে সেখানেই গোসল করতে হবে। 

৩. খানা খাওয়ার জন্যে মসজিদের বাইরে যাওয়া যায়; যদি খানা নিয়ে আসার কোনো লোক না থাকে। খানা আনার লোক থাকলে মসজিদে খাওয়াই জরুরি। 

৪. জুমা ও ঈদের নামাযের জন্যেও বাইরে যাওয়া জায়েয। 

৫. যদি কোথাও আগুন লাগে, অথবা কেউ পানিতে পড়ে ডুবে যাচ্ছে অথবা কেউ কাউকে মেরে ফেলছে অথবা মসজিদ পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয় তাহলে এসব অবস্থায় ইতিতকাফের স্থান থেকে বাইরে যাওয়া শুধু জায়েযই নয় বরঞ্চ জরুরি।

৬. জুমার নামায আদায়ের জন্য বা কোনো জরুরত পূরণ করার জন্যে বের হলো এবং এ সময়ে সে কোনো রোগীর সেবা করলো অথবা জানাযায় শরীক হলো তাহলে তাতে কোনো দোষ হবে না। 

৭. যে কোনো প্রাকৃতিক অথবা শরীয়তের প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয। 

৮. যদি কেনাবেচার কোনো লোক না থাকে এবং বাড়িতে খাবার কিছু না থাকে তাহলে প্রয়োজনমত কেনাবেচা করা ইতিকাফকারীর জায়েয। 

৯. আযান দেয়ার জন্যে মসজিদের বাইরে যাওয়া জায়েয। 

১০. ইতিকাফ অবস্থায় কাউকে দ্বীন সম্পর্কে পরামর্শ অথবা চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ দেয়া জায়েয। বিয়ে করা, ঘুমানো এবং আরাম করা জায়েয।

দুই. ইতিকাফে যেসব কাজ করা না জায়েজ বা অবৈধ 

১. ইতিকাফ অবস্থায় যৌনক্রিয়া করা এবং স্ত্রীকে আলিঙ্গন করা হলে ইতিকাফ নষ্ট হবে। 

২. ইতিকাফ অবস্থায় কোনো দুনিয়ার কাজে লিপ্ত হওয়া মাকরূহ তাহরিমী। বাধ্য হয়ে করলে জায়েয হবে। 

৩. ইতিকাফ অবস্থায় একেবারে চুপচাপ বসে থাকা মাকরূহ তাহরিমী। যিকির ফিকির, তেলাওয়াত প্রভৃতিতে লিপ্ত থাকা উচিত। 

৪. মসজিদে বেচাকেনা করা। লড়াই-ঝগড়া করা, গীবত করা অথবা কোনো প্রকার বেহুদা কথা বলা মাকরূহ। 

৫. কোনো প্রাকৃতিক ও শরয়ী প্রয়োজন ব্যতিরেকে মসজিদের বাইরে যাওয়া অথবা প্রাকৃতিক ও শরয়ী প্রয়োজনে বাইরে গিয়ে সেখানেই থেকে যাওয়া জায়েয নয়। তাতে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।

কী কী কারণে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যায়? 

১. স্বেচ্ছায় বিনা প্রয়োজনে মাসজিদ থেকে বের হলে 

২. কোনো শির্ক বা কুফরী কাজ করলে। 

৩. পাগল বা বেহুশ হয়ে গেলে। 

৪. নারীদের হায়েয-নিফাস শুরু হয়ে গেলে। 

৫. স্ত্রী সহবাস বা যে কোন প্রকার যৌন সম্ভোগ করলে। 

 রাসুল (সাঃ) কীভাবে ইতিকাফ করতেন?

১. 
عَنْ عَائِشَةَ ـ رضى الله عنها ـ زَوْجِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ، ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ‏.‏

  নবী সহধর্মিণী ‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমযানের শেষ দশকে ই’তিকাফ করতেন। তাঁর ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। এরপর তাঁর সহধর্মিণীগণও (সে দিনগুলোতে) ইতিকাফ করতেন।
বুখারী ২০২৬

২. ইতিকাফরত অবস্থাতেও রাসুল (সাঃ) পাক-পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন। 

৩. ইতিকাফকালীন রাসুল (সাঃ) কোনো অসুস্থ ব্যক্তির দর্শনে যেতেন না, অংশ নিতেন না কোনো জানাজায়, বর্জন করতেন স্ত্রী সংস্পর্শ বা সহবাস। 

وَعَن عَائِشَة رَضِي الله عَنْهَا قَالَتْ: السُّنَّةُ عَلَى الْمُعْتَكِفِ أَنْ لَا يَعُودَ مَرِيضًا وَلَا يَشْهَدُ جِنَازَةً وَلَا يَمَسُّ الْمَرْأَةَ وَلَا يُبَاشِرُهَا وَلَا يَخْرُجُ لِحَاجَةٍ إِلَّا لِمَا لَابُدً مِنْهُ وَلَا اِعْتِكَافَ إِلَّا بِصَوْمٍ وَلَا اعْتِكَافَ إِلَّا فِىْ مَسْجِدٍ جَامِعٍ. رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ

  আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

তিনি বলেন, ইতিকাফকারীর জন্য এ নিয়ম পালন করা জরুরী- 
(১) সে যেন কোন রোগী দেখতে না যায়। 
(২) কোন জানাযায় শারীক না হয়। 
(৩) স্ত্রী সহবাস না করে। 
(৪) স্ত্রীর সাথে ঘেঁষাঘেষি না করে। 
(৫) প্রয়োজন ছাড়া কোন কাজে বের না হয়। 
(৬) সওম ছাড়া ইতিকাফ না করে এবং 
(৭) জামি‘ মাসজিদ ছাড়া যেন অন্য কোথাও ইতিকাফে না বসে।

  আবূ দাঊদ ২৪৭৩, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৫৯৪। 
মিশকাতুল মাসাবিহঃ ২১০৬

৪. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যাবশ্যকীয় কোনো কারণ ব্যতীত ইতিকাফগাহ হতে বের হতেন না। 

وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهَا قَالَتْ: كَانَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ إِذَا اعْتَكَفَ أَدْنٰى إِلَىَّ رَأَسَهُ وَهُوَ فِى الْمَسْجِدِ فَأُرَجِّلُه وَكَانَ لَا يَدْخُلُ الْبَيْتَ إِلَّا لِحَاجَةِ الْإِنْسَانِ. (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)

 আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

   তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফ করার সময় মাসজিদ থেকে আমার দিকে তাঁর মাথা বাড়িয়ে দিতেন। আমি মাথা আঁচড়ে দিতাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া কখনো ঘরে প্রবেশ কর তেন না।  
বুখারী ২০২৯, মুসলিম ২৯৭, আহমাদ ২৪৫২১, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৫৯২, মিশকাতুল মাসাবিহ ২১০০

৫. ইতিকাফরত অবস্থায় রাসুলের স্ত্রীগণ তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং কথোপকথন করতেন তার সাথে। 

    সাফিয়া (রা.) বলেন : রাসুল (সাঃ) ইতিকাফরত অবস্থায় আমি তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য এলাম, তার সাথে আলাপ করে অত:পর চলে এলাম। 
বুখারি ৩০৩৯

     প্রমাণ করে, ইতিকাফরত অবস্থাতেও রাসুল (সাঃ) স্ত্রী-গণের সংবাদ নিয়েছেন। ইতিকাফের ফলে যে কিছু লোকেরা তাদের পরিবার-পরিজনের কথা ভুলে যায়, তারা এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে।
--------------------------------- 
লেখকঃ ইসলামিক আর্টিকেল লেখক ও অনলাইন  এক্টিভিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments