Recent Tube

শেখার জগতে আমার ঋণ। ড. আব্দুস সালাম আজাদী।



                        শেখার জগতে 
            আমার ঋণ।

     আমি শেখার জগতে অনেক অনেক ঋণী। আমি জন্মেছি একাডেমিক শিক্ষা বঞ্চিত এক মায়ের কোলে, আমি বড় হয়েছি সামান্য শিক্ষিত এক বাবার ঘাড়ে ও বুকে। ওরা আমাকে ভালোবাসা শিখিয়েছে্ন, মন ও মনন ছুঁয়ে ছুঁয়ে জগত দেখিয়েছেন, কোমর সোজা করে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন, আলো এনে দিয়েছেন আধাঁরের পর্দা ছিড়ে। দুইজনে রাতে দুই পাশে থেকে আমার শরীরে হাত রেখে শুয়ে বুঝায়েছেন প্রেমের প্রকার, ধরিয়েছেন ভালোবাসার নেশা, আদরের মিষ্টতা। ওদের হাসিতে আমার জগত হাসতো, আর আমার হাসিতে ওদের মনে ফাগুন লাগতো।

      ওরা আমাকে হুজুর দেখিয়েছেন, শিক্ষক চিনিয়েছেন, স্কুলে নিয়ে জ্ঞানী করেছেন, আর আমার প্রয়োজন মিটাতে গায়ের ঘাম ঝরিয়েছেন, কিংবা আমার মুখে আহার জোটাতে শরীরের হাড় ভেঙেছেন। আমি মাঝে মাঝে আব্বার শক্ত হাতে আমার তুলতুলে হাত বুলাতাম, আর আব্বা স্মিত হাসি উপহার দিয়ে বলতেন ভেবোনা, এই সব তোমাদের জন্য শক্ত হয়ে আছে। তোমরা বড় হয়ে আমার ভার কাঁধে নিলেই তবে আমার দেহ আবার মখমলে কোমল হবে। আল্লাহ জানেন, আমি বড় হয়ে তার শরীরে কোন দিন একটু ক্রিম মাখিয়ে নরম করে দেয়ার ফুরসত পেয়েছি কিনা!!

      আমার বড় হবার পথে আমি অনে ঋণী। আমি দেখেছি আমার প্রাইমারী স্কুলের স্যারের বিকেলে বাজার করতেন। বড় বড় মাছের দিকে তাকায়ে কিনতে না পেরে ছোট চিংড়ি, ও পুঁটি মাছের ভাগা ভাগা নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। আর দেখতেন তাদের ছাত্রদের বাবারা কত রকমারি বাজার করছে, কত ভোগের সামগ্রী তাদের হাতে পায়ে, ঘরে দহলিজে, কিংবা বাইরের তোরনে। ওরা অনেক শিখিয়েছেন, মাতৃ ভাষা আয়ত্বে এনে দিয়েছেন, নানা দেশের ভাষা চোখে ও জিভে পরিচিত করেছেন, দেশ দেশান্তরের ভূগোল, অঙ্ক, বিজ্ঞান, জীবনের হিসেব নিকেশ শিখিয়েছেন। দেখেছেন তাদের সামনেই আমরা কত বড় হয়ে উঠতেছি। আর তাদের ঐ ক্ষুদ্রতায়ও আমাদের বুকে নিয়ে গর্ব করতেন। যদি হাউস-টিউটরের মত তাদের টাকা দিতে হত তাহলে তারা পেতেন লাখ লাখ টাকা। কিন্তু তারা সরকারের কাছ থেকে সামান্য কিছু নিয়ে আমাদের পড়িয়েছেন। 

    আমি সেকেন্ডারী পড়েছি মাদ্রাসায়। তখন মাদ্রাসার শিক্ষকগণ দেশবৈরি হিসেবে গণ্য হতেন। ফলে তারা সরকারি বেতন ভাতা সামান্যই পেতেন, যা দিয়ে কারোর ই তিন বেলা খাওয়া হতোনা। কিন্তু তারা আমাদের রৌল মডেল হতেন। হাসতেন, হাসাতেন, বন্ধু হতেন, বন্ধু হতে দিতেন, জ্ঞানের দশ দিগন্ত খুলে দিয়ে হাত ধরে এগিয়ে নিতেন। বিকেলে বৌ এর কাছ থেকে সময় কেটে নিয়ে আমাদের দিতেন। রাতে বৌ বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে আমাদের পড়াতেন। আমরা ওদের কাছে ঋণী হয়ে আছি। 

      উচ্চ শিক্ষার কেন্দ্রগুলোতে শিক্ষকগণকে দেখতাম, কী কষ্ট করে তারা পড়াচ্ছেন। একটা বিষয় সহজ করতে যেয়ে তাদের রাতের পর রাত জাগতে হতো। একবার শেষ রাতে টয়লেট সারতে এক উস্তাযের রূমের পাশ দিয়ে যাচ্ছি। তিনি নির্ঘুম। আমাকে দেখে ডাকলেন, বললেন, আমার জন্য এক গ্লাস পানি এনে দে তো। আমি দেখলাম তার হাতে “ঈসাগুজি” কঠিন যুক্তিবিদ্যার বই। কাল আমাদের পড়াবেন তাই নোট করছেন। তিনি কুমিল্লায় আজ কবর দেশে শায়িত। আমার জ্ঞানের গর্তে তাকালে আজো দেখি তার রাখা মণি-মুক্তা থরে থরে সাজানোচ। তাদের ঋণ আমার মাথায় মাথার উপরে, শোধ তো দূরে থাক তাদের নাম ও নেই না প্রতিদিন। 

     আমি স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি পর্যায়ে পড়েছি। দুনিয়ার নামকরা ৫টা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে স্কলারশীপ দিয়েছে। যার পরিমান লাখে নয়, কোটিতে ঠেকেছে। আমাকে ডিগ্রী দিয়েছে। আমাকে মানুষের কাতারের এনেছে। আমাকে জগতে সাধারণের কাতার থেকে একটু হলেও উঁচুতে সেঁটে দিয়েছে। আমার শরীরে রক্ত মাংস, জ্ঞান ও গরিমা সব ই তাদের। ওদের ঋণ নিয়েই আমি আজ পরিচিত। পাহাড়ের চেয়ে ভারি সেই ঋণের বোঝা। 

      আমি যে জ্ঞান মাথায় ঢুকিয়েছি। তার অনেকগুলো লেখা হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে। আদম (আ) এর ভাষা ও দুয়া আমার মুখস্ত, ইব্রাহীমের সাহিত্য আমার মুখে ও মস্তিষ্কে। হাজার হাজার বছর আগের অনেক  দার্শনিকের লেখা আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রতিটি কওমের লোকেরা আমার জ্ঞানের বৃক্ষে পানি সিঞ্চন করেছে। আফ্রিকা, আমেরিকা, এশিয়া, ইউরোপ -সারা লোকালয়ের শিক্ষিতজনদের জ্ঞান আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আমি তাদের থিউরিগুলো কপচাই, আমি তাদের লেখাগুলো আওড়াই, আমার চোখের সামনে তাদের জ্ঞানের স্রোতস্বিনী কুল কুল ধ্বনি তুলে ছুটে চলে যায়। আমি কে? আমি তাদেরই দয়ার কাছে বিপুলভাবে একজন ঋণী জ্ঞান -ভিখারী। 

      আমি মাঝে মাঝে গর্বিত হতে চাই। জ্ঞানের গর্ব। দেখি ইমাম সুয়ূতি (র) জীবনে ৯৫০টির বেশি লিখেছেন। দিনে ৩০ পৃষ্ঠার ও বেশি লিখতেন তিনি। ঐ পৃষ্ঠা আবার আমাদের দেশের ছোট ছোট বইএর চেয়ে বড় পাতার। আমি দিনে ৩০ পৃষ্ঠা পড়তেও পারিনা। পড়লেও সব বুঝতে পারিনা। কিসের গর্ব করব। আমি মাঝে মাঝে অহঙ্কারী হয়ে উঠি। পদ পদবী, মর্যাদা পদমর্যাদার বড়াই করি। কিন্তু আমি আবু হানিফা, মালেক, শাফেঈ বা আহমাদ ইবন হানবালের (রাহিমাহুমুল্লাহ) মত হতে পারার স্বপ্নও দেখতে পারিনি, যাদের কথা শুনে মন্ত্রী মিনিস্টার দূরে থাক, রাজা বাদশাহগণও তটস্ত হয়ে থাকতো। কিসের অহংকার তবে? আমার শক্তির দম্ভ মাঝে মাঝে শানিত হয়ে ওঠে অথচ নরম মাটির পাতলা আস্তরণও আমি ছিন্ন করার তাকত রাখিনা। আমি আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে মাতোয়ারা হই, অথচ পাহাড়ের শীর্ষেও আমার ঘাড় পৌঁছতে পারেনা। 

       ইনসান, আমি ছোট এক ইনসান। আমার আছেই বা কি? জ্ঞানে আমি সবার কাছে ঋণী, ধনে আমি সবার চেয়ে পেছনে, মানে আমি কত কত ক্ষুদ্র!!

    আল্লাহ যেন আমার এই ক্ষুদ্রতা বোধ দিয়েই আমার উপরে রাখা ঋণের বোঝা কমিয়ে দেন
--------------------------------------------------------
 লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা   আলোচক গবেষক ও দাঈ। 

Post a Comment

0 Comments