Recent Tube

নূহ (আঃ) এর খিলাফাত ও ইকামতে দ্বীন: কুফুরী অভিযোগ ও দলিলভিত্তিক জবাবঃ মোহাম্মদ তানজিল ইসলাম।






নূহ (আঃ) এর খিলাফাত ও ইকামতে দ্বীন: কুফুরী অভিযোগ ও দলিলভিত্তিক জবাবঃ
------------------------------------
    আল্লাহ তা'য়ালা নমুনাস্বরূপ যে ক'জন নবীর নাম উল্লেখ করে 'ইকামতে দ্বীন' এর নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে সর্বপ্রথম হযরত নূহ (আ) এর নাম উল্লেখ করেছেন (সূরা শুরাঃ ৪২/১৩)। ইকামতে দ্বীনের শত্রু দরবারী আলেমরা এই বলে কুফুরী আকিদা পেশ করছেন যে, ইকামতে দ্বীন মানে যদি খিলাফাত কায়েম করে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করা হয় তাহলে নবীগণ সেই দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু সাধারণ নবী তো পরের কথা নূহ (আঃ) নিজেই এই দায়িত্ব পালন করেননি, যদিও প্রথমে তাঁর নাম উল্লেখ করে দ্বীন কায়েমের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেননা, তিনি খিলাফাত প্রতিষ্ঠা করেননি। দরবারী শায়খদের কথার অর্থ হল- নূহ (আ) আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা না করে, তাদের মত কুফুরী বিধানের আনুগত্য করেছিলেন, (নাউযুবিল্লাহ)! যেমন, আহলে হাদীসের শায়েখ মুযাফফর বিন মুহসীন বলেন, "দ্বীন কায়েমের অর্থ যদি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া করা হয়, তাহলে প্রমাণিত হবে যে, কোন নবী-রাসূলই তাঁদের উপরে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেননি (ভ্রান্তির বেড়াজালে ইকামতে দ্বীন, পৃঃ ২১০; ১ম প্রকাশ, মার্চ ২০১৪)। একই কথা বলেছেন, আহলে হাদীস আন্দোলনের আমীর ড. গালিব। তার দাবী, কেনো নবীই এক দিনের জন্যেও রাষ্ট্রক্ষমতার মালিক হননি (ইকামতে দ্বীন: পথ ও পদ্ধতি, পৃঃ ১৩; ১ম প্রকাশ, মার্চ ২০০৪)। অর্থাৎ হযরত নূহ (আঃ) সহ কোনো নবী-রাসূলই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করেননি, নাউযুবিল্লাহ। এটি তাদের কুরআন সুন্নাহ বিরোধী কুফুরী আকিদা, তা আমি দলিলসহ প্রমাণ করব, ইনশাআল্লাহ! 

   আবুল বাশার ছানী’ (ابوالبشرالثانى ) বা মানবজাতির দ্বিতীয় পিতা বলে খ্যাত নূহ (আ) ছিলেন পিতা আদম (আ)-এর দশম অথবা অষ্টম অধঃস্তন পুরুষ। তিনি ছিলেন দুনিয়াতে ১ম রাসূল (সহীহ মুসলিম হা ৩২৭)। যার কারণে হয়তো তাঁর নাম প্রথমে উল্লেখ করে আল্লাহ তা'য়ালা দ্বীন কায়েমের নির্দেশ দিয়েছেন। আদম (আঃ) থেকে নূহ (আঃ) পর্যন্ত দশ শতাব্দীর ব্যবধান ছিল। যার শেষদিকে শয়তানের প্ররোচনায় আল্লাহর বিধান থেকে বিমুখ হওয়ার কারণে ক্রমবর্ধমান মানবকুলে শিরক ও কুসংস্কারের আবির্ভাব ঘটে এবং তা বিস্তৃতি লাভ করে। ফলে তাদের সংশোধনের জন্য আল্লাহ নূহ (আঃ)-কে নবী ও রাসূল করে পাঠান। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিপথগামী মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের পথে আনার জন্য দাওয়াত দিতে থাকেন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন,
إِنَّا أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَىٰ قَوْمِهِ أَنْ أَنْذِرْ قَوْمَكَ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ. قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّي لَكُمْ نَذِيرٌ مُبِينٌ. أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاتَّقُوهُ وَأَطِيعُونِ
নিশ্চয় আমি নূহকে পাঠিয়েছিলাম তার কওমের কাছে (এ কথা বলে), ‘তোমার কওমকে সতর্ক কর, তাদের নিকট যন্ত্রণাদায়ক আযাব আসার পূর্বে’। সে (নূহ) বলল, ‘হে আমার কওম! নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য এক স্পষ্ট সতর্ককারী। তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কর, তাঁকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর’। (সূরা নূহঃ৭১/১-৩)
আল্লাহ তা'য়ালা অন্যত্রে বলেনঃ 
وَلَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا نُوۡحًا اِلٰى قَوۡمِهٖ فَقَالَ يٰقَوۡمِ اعۡبُدُوۡا اللّٰهَ مَا لَكُمۡ مِّنۡ اِلٰهٍ غَيۡرُهٗۤ‌ۖ اَفَلَا تَتَّقُوۡنَ‏. 
আমি নূহকে পাঠালাম তার সম্প্রদায়ের কাছে। সে বললো, “হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা! আল্লাহর দাসত্ব করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই, তোমরা কি তাকে ভয় করো না? (সূরা মু'মিনুনঃ২৩/২৩) অর্থাৎ নিজেদের আসল ও যথার্থ ইলাহ (আল্লাহ) কে বাদ দিয়ে অন্যদের বন্দেগী করতে তোমাদের ভয় লাগে না? যিনি তোমাদের ও সারা জাহানের মালিক, প্রভু ও শাসক তাঁর রাজ্যে বাস করে তাঁর পরিবর্তে অন্যদের বন্দেগী ও আনুগত্য করার এবং অন্যদের সার্বভৌম কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেবার ফলাফল কি হবে সে ব্যাপারে কি তোমাদের একটুও ভয় নেই? (তাফহীমুল কুরআন)

    নূহ (আঃ) এর সম্প্রদায়ের যেসব নেতা তাঁর কথা মেনে নিতে অস্বীকার করলো তারা বলতে লাগলো, 
مَا هٰذَاۤ اِلَّا بَشَرٌ مِّثۡلُكُمۡ يُرِيۡدُ اَنۡ يَّتَفَضَّلَ عَلَيۡكُمۡؕ 
“এ ব্যক্তি আর কিছুই নয় কিন্তু তোমাদেরই মতো একজন মানুষ। এর লক্ষ্য হচ্ছে তোমাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব (ক্ষমতা) অর্জন করা। (সূরা মু'মিনুনঃ২৩/২৪)
যে কেউ দ্বীন কায়েমের সংস্কারমূলক কাজের কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে আসার চেষ্টা করে সঙ্গে সঙ্গেই তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ এনে বলা হয়, এর উদ্দেশ্য শুধু ক্ষমতা দখল করা। এটি বিরোধীদের একটি পুরাতন অস্ত্র। অভিযোগটিই ফেরাউন হযরত মূসা ও হারুনের বিরুদ্ধে এনেছিল। সে বলেছিল, وَتَكُونَ لَكُمَا الْكِبْرِيَاءُ فِي الْأَرْضِ. দেশে তোমাদের প্রতিপত্তি (ক্ষমতা) প্রতিষ্ঠা করার জন্য এসেছো? (সূরা ইউনুসঃ১০/৭৮) এ অভিযোগ হযরত ঈসা আলাইহিসসালামের বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল। বলা হয়েছিলঃ এ ব্যক্তি ইহুদিদের বাদশাই হতে চায়। আর কুরাইশ সরদাররাও নবী (সা) সম্পর্কেও এ একই সন্দেহ পোষণ করতো। এ জন্য কয়েকবারই তারা তাঁর সাথে এভাবে সওদাবাজী করতে চেয়েছে যে, যদি তুমি কর্তৃত্ব লাভ করতে চাও, তাহলে “বিরোধী” দল ছেড়ে দিয়ে “সরকারী” দলে এসে যাও। তোমাকে আমরা বাদশাহ বানিয়ে নেবো। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে ইকামতে দ্বীনের সংস্কারকদের বিরুদ্ধে “ক্ষমতা লোভের” এ অপবাদ চিরকাল ক্ষমতাসীন লোকেরা ও তাদের তোষামোদী দরবারী গোষ্ঠীই লাগিয়ে এসেছে। অর্থাৎ তারা যেন একথা বলতে চায় যে, তারা নিজেরা ও তাদের মহান প্রভুরা যে ক্ষমতা লাভ করেছেতা যেন তাদের জন্মগত অধিকার। 

    তাদের কথার জবাবে হযরত নূহ (আঃ) তাঁর কাওমকে আল্লাহর শাস্তির ভয় দেখালে তাগুতপন্থী নেতারা হযরত নূহ (আঃ) কে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলল, 
يَا نُوحُ قَدْ جَادَلْتَنَا فَأَكْثَرْتَ جِدَالَنَا فَأْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِينَ
‘হে নূহ, তুমি আমাদের সাথে তর্ক করছ এবং আমাদের সাথে অতিমাত্রায় বিবাদ করেছ। অতএব যার ভয় তুমি আমাদেরকে দিচ্ছ, তা আমাদের কাছে নিয়ে আস, যদি তুমি সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও’। (সূরা হুদঃ১১/৩২)
চূড়ান্ত ফায়সালার জন্য হযরত নূহ (আঃ) দোয়া করলেন,
رَبِّ إِنَّ قَوْمِي كَذَّبُونِ. فَافْتَحْ بَيْنِي وَبَيْنَهُمْ فَتْحًا وَنَجِّنِي وَمَنْ مَعِيَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
'হে আমার রব, আমার কওম আমাকে  প্রত্যাখ্যান করেছে। সুতরাং আপনি আমার ও তাদের মধ্যে (গযব দিয়ে চূড়ান্ত) ফয়সালা করে দিন আর আমাকে ও আমার সাথে যেসব মুমিন আছে তাদেরকে রক্ষা করুন’। (সূরা শুআরাঃ ২৬/১১৭-১১৮)
এরপর আল্লাহ তা'য়ালা কাফিরদের বন্যার মাধ্যমে পানিতে ডুবিয়ে মারলেন। আল্লাহর ভাষায়- ثُمَّ أَغْرَقْنَا الْآخَرِينَ তারপর আমি (মুমিন ব্যতীত) অন্যদের ডুবিয়ে দিয়েছিলাম। (সূরা সাফফাতঃ৩৭/৮২)

     নাজাতপ্রাপ্ত ঈমানদারদের নিয়ে তিনি খিলাফত কায়েম করে তাদেরকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসন ও পরিচালনা করেন। আল্লাহ ভাষায়-
فَنَجَّيْنَاهُ وَمَنْ مَعَهُ فِي الْفُلْكِ وَجَعَلْنَاهُمْ خَلَائِفَ وَأَغْرَقْنَا الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا ۖ فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُنْذَرِينَ
    আমি তাকে ও নৌকাতে যারা তার সাথে ছিল তাদেরকে নাজাত দিলাম এবং আমি তাদের খিলাফাত দান করে ছিলাম। (সূরা ইউনুসঃ১০/৭৩)
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তিনি চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়াত প্রাপ্ত হন এবং মহাপ্লাবনের পর ষাট বছর জীবিত ছিলেন। (কুরতুবী, ইবনে কাসীর; সূরা আনকাবুত ১৪-১৫ আয়াত) ফলে প্লাবনের পর তাঁর সাথে নৌকারোহী মুমিন নর-নারীদের নিয়ে খিলাফাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পৃথিবীতে নতুন ভাবে আবাদ শুরু হয়, তিনি তাঁর উম্মতের মাঝে আল্লাহ প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী শাসন করেন। সুতরাং কুরআন দ্বারা অকাট্য ভাবে প্রমাণিত যে, মহাপ্লাবনের পর নূহ (আ) খিলাফাত প্রতিষ্ঠা করে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান দ্বারা তাঁর উম্মাতকে দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে শাসন করেছেন এবং তাঁর উপর অর্পিত ইকামতে দ্বীনের দায়িত্ব যথাযথ ভাবে আদায় করেছেন। অতএব, আহলে হাদীস নেতা ড. গালীব ও মুযাফফর সহ যারা নূহ (আ) সহ অন্যান্য নবী রাসূলদের খিলাফাতকে অস্বীকার করেন, তারা কুফুরীতে লিপ্ত
----------------------------------------------------------------- 
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা, শিক্ষক, আলোচক ও দাঈ। 

Post a Comment

0 Comments