Recent Tube

যে কারণে বার বার ‘পলাশী ’ আসে- (ঐতিহাসিক পলাশী দিবস উপলক্ষ্যে)। জিয়াউল হক।






  যে কারণে বার বার ‘পলাশী ’ আসে- (ঐতিহাসিক পলাশী দিবস উপলক্ষ্যে)
 --------------------------------- 

      বসর ঘুরে আবারও হাজির হয়েছে ২৩ শে জুন, পলাশী দিবস। প্রায় ২৬৪ বসর আগের এই দিনে নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে যুদ্ধ নামক এক প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতা হতে সরিয়ে বাংলার ক্ষমতা দখল করা হয়েছিল। নিরেট ক্ষমাতার হাত বদলই ভেবেছিল বরাবরই ‘রাজনীতি আমার পছন্দ নয়’ কিংবা ‘আমি ভাই অরাজনৈতিক’ বচন কপচানো বাংগালি। তারা সেদিন বুঝতেই পারেনি যে, সিরাজের পতনের মাধ্যমে ক্ষমতা নয় দেশটাই হাতছাড়া হয়ে গেছে।

     সেই থেকে রথী মহারথীরা কতো শত গবেষণা প্রবন্ধ রচনা করেছেন, কত শত বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছেন। সিরাজের জন্য কান্না করেছেন। কেউ কেউ আবার তার দোষত্রæটি খুঁজে খুঁজে হয়রাণ হয়ে গেছেন। কিন্তু একটা কাজ সম্ভবত কেউই করেননি, সেটা হলো, কোন দীর্ঘ সামাজিক, রাজনৈতিক ও আদর্শিক নৈরাজ্যের ধারাবাহিকতায় বাংলায় দেশবিক্রির এই নাটকটা মঞ্চস্থ হলো?

    নিজেদের দোষ গোপন করাটা বরাবরই মানুষের একটা বৈশিষ্ঠ। সুযোগ পেলেই মানুষ তা করবে। অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজে সাজবে নির্দোষ মাসুম! ঠিক এই কাজটাই করে চলেছি আমরা বিগত দুইশত চৌষট্টিটা বসর। কেউ নিজেদের দোষটা খুঁজে দেখছি না, সব দোষ ঐ ব্যাটা সিরাজ, মীর জাফর, ঘষেটি বেগম আর উমিচাঁদ কিংবা রাজা রায়দূর্লভ প্রমূখ ওদের। আমরা সবাই নির্দোষ।

     পলাশীর ট্রাজেডি যে পথ দিয়ে একটি সমাজে আসে, সেই পথটা চিনতে না পারলে ওরকম ট্রাজেডি বার বার আসবে দেশে বা সমাজে। কাজেই কোন পথ ধরে পলাশীর সেই নাটক মঞ্চস্থ হতে পেরেছে, সেটাকে চিনতে হবে নিজের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার স্বার্থেই। 

     পঞ্চদশ শতাব্দির শেষভাগে (১৪৯২) এসে বিষ্ময়কর আন্দালুসের ইসলামি শাসনকে উৎখাতের মাধ্যমে পুরো স্পেন থেকেই ইসলামি শাসন এবং মুসলমান সম্প্রদায়কে উৎখাত করা গেছে, এই আনন্দে পোপ এবং খৃষ্টজগত উচ্ছসিত। তারা যেন আকাশে উড়ছেন। বিশ্বময় খৃষ্টবাদকে ছড়িয়ে সকল দেশ ও জনপদ নিজেদের আয়ত্বে এনে সম্পদের পাহাড় গড়ার স্বপ্নে বিভোর। ফার্ডিনান্ড ও ইসাবেলার পরিকল্পনা ও পোপের অনুমতিতে দলে দলে পুর্তগিজ অভিযাত্রীরা বেরিয়ে পড়ে। তারই ধারাইবহকতায় আন্দালুসের পতনের মাত্র পাঁচ বসরের মাথায় ভাস্কো দা গামা এসে হাজির (১৪৯৭)।

       চোর ডাকাতকে স্বর্ণের গুদাম চেনানোর মতো ঘটনা ছিল এটা। ভাস্কো ডা গামা ভারতে প্রথম ট্রিপ শেষ করে ফেরত যাবার মাত্র বৎসর চারেকের মধ্যেই ইউরোপের বাজারে, ইটালির ভ্যালেন্সিয়াতে দাস হিসেবে ভারতীয়দের বিক্রি করা শুরু হয়। 

      পরবর্তি বসর দুয়েকের মধ্যেই আর এক পর্তুগিজ Pedro Alvarez ৩৩টি যুদ্ধজাহাজ আর ১৫০০ সৈন্য নিয়ে সদলবলে এলেন। তখন দক্ষিণ ভারতের উপকূলীয় এইসব এলাকায় মুসলিম সালতানাত প্রতিষ্ঠিত ছিল আরব নৌ বাণিজ্য রমরমা যে মুসলমানদের উৎখাত করেছে স্পেনের মাটি হতে, ভারতের উপকূলে সেই মুসলমানদের একচ্ছত্র আধিপত্য পর্তূগিজদের সহ্য হবার কথা নয়। 

      কাজেই Pedro Alvarez দেরি না করে স্থানীয় ও আরব মুসলমানদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘাটে ঘাটে নোঙ্গর করা আরব বণিকদের জাহাজগুলো ধ্বংস করে পুড়িয়ে দেয়। বহু আরব বণিকদের ধরে ধরে হত্যা করে। আচমকা এধরনের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় স্থানীয় মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়।

     কালিকটের জামুরিন রাজার যে জামুরিন রাজা দাক্ষিণাত্যে পর্তূগিজ আগমণের একেবারে শুরু থেকেই বিরোধিতা করে আসছিলেন। তিনি প্রতিরোধ গড়ে তুললেন আশে পাশের সকল মুসলমান বণিক ও যোদ্ধাদের নিয়ে। তার বাহিনীর বেশিরভাগ যোদ্ধাই ছিলেন আরব ও স্থানীয় মোপলা মুসলমান এবং কিছু হিন্দু প্রজা। বাহিনীটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মারক্কার স্থানীয় দুইজন মোপলা মুসলিম সেনাপতি; কুঞ্জ আলি এবং কুট্টি আলি। 

      এই দুই মুসলিম যোদ্ধার নেতৃত্বে ভারতীয়রা পাল্টা আক্রমণ করে বসে পর্তুগিজ বাহিনীকে। পেদ্রো আলভারেজ (Pedro Alvarez ) এর নেতৃত্বে আগত তেত্রিশটা জাহাজ বহরের মধ্যে প্রায় কুড়িটাই ধ্বংস হয় তার আসে দেড় হাজার পর্তূগিজ সৈন্যদের মধ্যে প্রায় সাড়ে আটশতজন ভবলীলা সাঙ্গ করে। পেদ্রো আলভারেজ প্রচন্ড মার খেয়ে অবশিষ্ঠদের নিয়ে কোনমতে গিয়ে আশ্রয় নেয় কোচিনের স্থানীয় হিন্দু রাজার কাছে।
ভারতে প্রেরিত বাহিনীর প্রায় অর্ধেক পর্তূগিজ সৈন্যের এই শোচনীয় পরিণতি পর্তূগালের শোকের মাতম তোলে। তারা ক্রোধে আক্রোশে ফেটে পড়ে নতুন পরিকল্পনা প্রণয়নে মাঠে নামে। মাত্র কয়েকবসর আগে ভারত থেকে ফেরত যাওয়া ভাস্কো দ্যা গামার মুখে এদেশের ঐশ্বর্য আর সম্পদের বিবরণ শুনে পর্তূগালের সরকার রোমের ভ্যাটিকানে পোপের কাছে দূত পাঠান উপহার সামগ্রীসহ। 

     এইসব উপহার সামগ্রীর মধ্যে মধ্যে অন্যতম একটা দর্শনীয় বস্তু, বস্তু ঠিক নয়, প্রাণী; ভারতীয় হাতিও ছিল। ইতোপূর্বে পোপ জীবনেও কখনও হাতি দেখেন নি, এই বিচিত্র ও প্রচন্ড শক্তিশালী প্রাণী সন্মন্ধ্যে অনেক কথা শুনেছেন বটে। জীবনে প্রথমবারের মতো প্রকান্ড শক্তিশালী ও অদ্ভূত প্রাণি হাতি দেখে পো স্ববান্ধব বিগলিত হয়ে পর্তূগিজ দূতকে জিজ্ঞেস করলেন; তিনি আগত দূতকে কিভাবে সম্মানিত করতে পারেন? 

      পর্তূগিজ দূতের বেশি কিছু না, একটা মাত্র আব্দার; মহামান্য পোপ যদি দয়া করে ঘোষণা দেন এই মর্মে যে, ‘আটলান্টিকের ওপারে দক্ষিণ আমেরিকা আর পুবের দিকের ভারতীয় অঞ্চলে পর্তূগিজ বণীকদের ব্যবসার অধিকার আছে’ তা হলেই তারা কৃতজ্ঞ থাকবে। আন্দালুসের মাটি হতে ইসলাম উৎখাতে সফল রাজা রাণী ফার্ডিান্ড ও ইসাবেলার সেই আাব্দার মেনে নিয়ে তিনি বিনাদ্বিধায় সে ঘোষণা দিয়ে ডিক্রি স্বাক্ষর করলেন। 

      এর মাত্র কয়েক বসরের মধ্যেই আলফানসো ডি আল বুকার্ক পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে আবারও এলেন ভারতে। ততোদিনে পেদ্রো আলভারেজ কোচিনের স্থানীয় হিন্দু রাজার সহায়তায় ব্যবসা জমিয়ে নিতে শুরু করেছেন। বিপরিতে অন্যান্য স্থানীয় হিন্দু বা মুসলিম রাজার তুলনায় কোচিনের রাজারও ব্যবসা ভালো জমে উঠছে, তিনিও খুশি। সবাই খুশি। খুশির জোয়ার বইছে । সেই খুশিতে যোগ দিতে স্বসৈন্যে এলেন আলফানসো ডি আল বুকার্ক। (আগামি সংখ্যায় সমাপ্য)
--------------------------------- 
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক গবেষক  আলোচক, ইংল‍্যান্ডের বেসরকারী একটি মানসিক হাসপাতালের সাবেক সহকারী পরিচালক ও লেখক, ইংল‍্যান্ড।

Post a Comment

0 Comments