শাহ আব্দুল হান্নান (রহ) বিদায় নিলেন।
-----------------------------------------------
শাহ আব্দুল হান্নান চাচা আজ ০২/০৬/২০২১ বুধবার ইন্তেকাল করেছেন। তিনি ১৯৩৯ সালে মোমেনশাহীতে জন্ম গ্রহন করেন। এবং ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশেবিদ্যালয় থেকে ইকোনোমিক্স ও পলিটিক্যাল সাইয়েন্সে বি এ ও ১৯৬১ সালে পলিটিক্যাল সিয়েন্সে এম এ করেন। এরপর তিনি যোগদেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে।
আমাদের প্রজন্মে তিনি মুরুব্বি, এবং আমাদের আগের প্রজন্মে তিনি ছিলেন স্যার। পাকিস্তান আমলে তিনি সরকারের আমলা হিসেবে যোগদেন। বাংলাদেশ হওয়ার পর শেখ মুজিব সরকার থেকে শুরু করে সব সরকারের আমলে তিনি আমলা হিসেবে কাজ করেছেন। দেশ চলে যে সব সেক্টরে, তার প্রায় প্রতিটিতেই তিনি কাজ করেছেন। জাতীয় রাজস্ব বিভাগে তিনি শুধু দ্বায়িত্ব পালন করেছেন তাই না, তিনি দেশকে উন্নত করার অনেক অনেক সংস্কার সাধনের পাশাপাশি আধুনিকায়নে অগ্র নায়ক হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের ডিপুটি গভর্নর হিসেবে কাজ করে দেশের অর্থ কাঠামোকে শক্তি শালী ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে সাহায্য করেছেন। ব্যুরো অফ এন্টি করাপশনে ডাইরেক্টর জেনারেল হিসেবে কাজ করার সময় একজন প্রগাঢ় ঈমানদারের কাছ থেকে যা যা আশা করা যায়, তার সবটাই আদায় করেছেন। সমাজ কল্যান মন্ত্রণালয়ে ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে কাজ করতে যেয়ে তিনি দেশপ্রেমী কর্মকর্তা হিসেবে নিজকে প্রশংসিত করেছেন।
তিনি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ও দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। তিনি ইন্টারন্যাশনাল ইসলামি ইউনিভারসিটি চিটাগাং ও মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন।
ইসলামিক ইকোনমিক্স রিসার্চ ব্যুরো, বাংলাদেশ ইনিস্টিটিউট অফ ইসলামিক থট, ইসলামিক ইন্স্যুরেন্স, ইসলামি ব্যাঙ্ক সমূহের নানা ধরণের সেক্টরে তিনি একাধারে অর্থনীতিবিদ হিসেবে, অন্যদিকে ইসলামিক স্কলার হিসেবে যুগপত দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইবনে সিনা ট্রাস্ট, মানারাত স্কুল এন্ড কলেজ, দিগন্ত টিভি ওপত্রিকা সহ নানা সামাজিক সংস্কৃতিক প্রকল্পে তিনি মেধা ও শ্রম দান করেছেন। এইভাবে গণনা করলে দেখা যাবে তিনি সারা দেশের সব কাজেই ছিলেন যেন। আমরা একবার এক মিটিং এ বলেছিলাম, "চাচা কোথায় নেই তাই বলো"।
তার লেখা ১১টা বই আমার দেখা হয়েছে। যার প্রতিটিতে মেধা, সৃষ্টিশীলতা ও দার্শনিকতার পরিচয় ফুটিয়ে তুলেছেন এমন ভাবে, যার স্বীকৃতি আদায় করতে ঘুষ দেয়াও লাগবেনা, তেল মালিশ করাও লাগবেনা।
তিনি মুরব্বি ছিলেন। ইসলামি পরিভাষায় মুরুব্বি বুঝাতে আধুনিক “মেন্টর” শব্দটাই দাঁড় করানো যায়। আমার একজন আত্মীয়া বলেছেন, তিনি বাংলাদেশ ব্যাঙ্কে অনেকের আন্ডারে কাজ করেছেন, কিন্তু শাহ আব্দুল হান্নান ছিলেন ব্যতিক্রম। আমাদের ভুল হলে বা কোন কাজের কমতি হলে তিনি সংশোধন করতেন ভালোবাসা দিয়ে ও একটু বই পড়িয়ে। তিনি প্রশাসনের প্রতিটা অফিসে প্রতিভাবানদেরকে মেন্টরিং করতেন। তিনি বাংলাদেশের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর মেধাবি ছাত্র ছাত্রিদের সাথে তৈরি করতেন আলাদা সম্পর্ক। ঐটার নাম ছিলো “চাচা ভাতিজার” সম্পর্ক। সবাই আমরা তাকে চাচা বলতাম। আমার মনে আছে প্রথম যেদিন আমি তাকে দেখেছিলাম, স্যার বলে সম্বোধন করায় তিনি সংশোধন করে দিয়েছিলেন। এই সম্পর্ক তিনি ফাও ফাও করতেন না। তিনি এ ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার গাইডেন্স দিতেন। বই পড়াতেন। চোখ খুলতেন। বাংলাদেশ ও মুসলিম বিশ্বে যেসব মানুষের দরকার তা তৈরিতে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি আমাদের বিয়ের ব্যাপারেও নাক গলাতেন। কার সাথে কার বিয়ে হলে ভালো হয় তার ঘটকালীও করতেন। এমনকি বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর সমস্যা হলে তিনি হতেন কাউন্সিলর ও মিমাংসাকারী।
তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির খুব কমিটেড ছিলেন। যা সকল সরকারের কাছে জানা থাকলেও তার সততা, নিষ্ঠা, যোগ্যতা, নিয়মানুবর্তিতা, ঈমানদারিতা ও সর্বোপরি দেশপ্রেমের কাছে সকল সরকারই তা ধর্তব্যে আনেন নি।
দুনিয়াবি জ্ঞানের পাশাপাশি তিনি ছিলেন ইসলামি জ্ঞানে খুবই সমৃদ্ধ। আধুনিক বিশ্বের সকল স্কলারদের সাথে তার সংযোগ ছিলো, ছিলো মুসলিম বিশ্বের নামকরা দার্শনিকদের সাথে গভীর সম্পর্ক। এমনকি এই সম্পর্ক তিনি রাজনৈতিক নেতাদের সাথেও প্রলম্বিত করেছেন। এইজন্য তার প্রভাব বলয় ছিলো বহুমাত্রিক। আমি আজো বাংলাদেশে এমন ব্যক্তিত্ব শুধু বিরল মনে করিনা, অতুলনীয়ও মনে করি।
একবার কোন এক কাজে উনার অফিসে যাই। আমার শালা নুরুল্লাহ তখন মালয়েশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ক্যানাডায় যাচ্ছে। উনার সাথে দেখা করতে চাই এটা জানানোর সাথে সাথে তিনি আমাদের ডাকলেন। তার অন্য মিটিং এ যাবার মাঝে মাত্র ৫ মিনিট সময় তার আছে ঐটাই দিলেন আমাদের। আমাদের কথা শুনেলন, তবে নুরুল্লাহর ক্যানাডা যাওয়াটা পছন্দ করলেন না। বললেন, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট তোমরা না নিলে ঐখানে আর কারা পড়বে? সময়ের পরে তিনি যাওয়ার সময় এমনভাবে মাফ চাইলেন, যেন আমাদের ঐভাবে এপোয়েন্ট নিয়ে না আসাটাও আমাদের অধিকার, আর উনি আমাদের বেশি সময় না দিতে পারাটা তার অপরাধ। এত বড় মানুষের এমন বিনয় আমি জীবনে খুব কম দেখেছি।
ইসলামি দৃষ্টি দর্শনে তিনি অর্থডক্স চিন্তার বাইরেও যেতেন। যদিও আক্বীদাহ বিশ্বাসে তিনি খুবই শক্ত ভাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের ছিলেন, কিন্তু ফিক্বহতে ছিলেন কোন নির্দিষ্ট মাযহাবের গন্ডীর বাইরে। তার পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়ে আমি এক সময় ঢাকায় একটা ইন্টেলেকচুলা ডিসকোর্স ফোরামে “ফিকহুসসুন্নাহ” বই পড়ানো শুরু করেছিলাম। তিনি ডঃ ইউসুফ কারাদ্বাওয়ী দ্বারা খুবই প্রভাবিত ছিলেন। ফলে বাংলাদেশের সরকারি পরিমন্ডলে অনেক আইন রচনার ক্ষেত্রে তার মতামত আমাদের উস্তাযগণকে রাগন্বিত করে। আমি মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর মগবাজারে দারুল আরবিয়াতে আরবি ম্যাগাযিন “আলহুদা” সম্পদনায় জড়িত ছিলাম। ঐ সময় দুই তিনটা বিষয় নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্ক আসে। মেয়েদের মীরাস, তিন তালাক এক সাথে দেয়ার মাসআলাহ, মেয়েদের মুখ ঢাকা ফরদ্বিয়্যাত ইত্যাদি। দেখেছি তার আলোচনা থাকতো মাযহাবের মধ্যে সীমায়িত করা নয়, বৃহত্তর ইসলামি চিন্তা দর্শনের আলোকে এগুলোর সমাধানের প্রস্তাবনা। অনেকে এই ক্ষেত্রে পদস্খলনের শিকার হন, কিন্তু তার বিনয় ও অন্যমত সহিষ্ণুতা তাকে সে সব বিপদ থেকে রক্ষা করেছে।
কেও মারা গেলে যদি মাত্র একজন মেয়ে থাকে তা হলে স্ত্রীর অংশের পর মেয়ে অর্ধেক পাবে। বাকি অংশ চলে যাবে মৃতব্যক্তির মা বাবা ভাইবোনের দিকে। তিনি এই মতের বাইরে একটা প্রস্তাবনা দাঁড় করান। যে মেয়েই সব সম্পদের মালিক হতে পারে। এই ব্যপারে তার অনেক ঋদ্ধ একটা আর্টিকেল প্রকাশ পায়। আমি এর বিপরীতে খুব জোরালো কিছু কথা তাকে বললে, দেখলাম তিনি আমার কথায় কনভিন্সড হলেন না। কিন্তু আমার আলোচনাও দৃষ্টিভংগীর প্রশংসা করলেন, এবং তার ভুল হতে পারে সেটার ও জানান দিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথেই। এরপরেই তার প্রতি আমার ভালোবাসা বেড়ে যায় শতগুণ। মতের বাইরের লোকদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তা শাহ আব্দুল হান্নান চাচার সান্নিধ্যে না এলে জানা যেতো না।
তিনি কাজ পছন্দ করতেন। একরত্তি সময় তিনি নষ্ট করেননি। মুজিবুর রহামান মঞ্জু ভাই হস্পিটালে তিনি কেমন কাটাচ্ছলেন তার খবর দিয়েছিলেন কয়দিন আগে। সেখানে তিনি বলেছেন, শাহ আব্দুল হান্নান চাচা শরীর থেকে অক্সিজেন, ইঞ্জেকশনের নিডল, ও হার্ট বিটের চেকার খুলে ফেলতে চাচ্ছিলেন। ঐখানে তার সবচেয়ে বড় কষ্ট ছিলো তিনি কাজ করতে পারতেছেন না। অথচ তিনি মৃত্যু সজ্জায়। আজ তার মৃত্যুতে আমার মনে হচ্ছে শাহ আব্দুল হান্নান চাচা আমাদের আর জিরানোর সময় দিয়ে যাননি।
একজন মানুষের মর্যাদা নির্ধারণে সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হলো, ওই ব্যক্তির বন্ধুও ভক্তদের মূল্যায়নের পাশাপাশি আদর্শগত শত্রুদের মূল্যায়ন দেখা। আমার সুযোগ হয়েছে উভয় পাশের লোকদের কাছ থেকে শাহ আব্দুল হান্নান চাচার বিভিন্ন ব্যাপারে শোনা ও বোঝার। তাদের সকল আলোচনার মর্মার্থ হলো তিনি আসলেই একজন ভালো মানুষ, ভালো মুসলিম ও দেশ প্রেমিক তো ছিলেন ই, তিনি ছিলেন আসলে একজন সব্যসাচী ও যোগ্য মানুষ। আলহামদুলিল্লাহ, আমি গর্বিত, বাংলাদেশে আজ তার মৃত্যুতে সবাই কাতর হয়েছে। তিনি আসলেই মুত্তাক্বীনদের ইমাম ছিলেন। আল্লাহ তাকে মাফ করুন ও জান্নাতুল ফিরদাওস দান করুন, আমীন।
---------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ আলোচক গ্রন্থপ্রনেতা দাঈ গবেষক ও প্রবন্ধ লেখক।
0 Comments