Recent Tube

চিন্তা’ নিয়ে চিন্তার কথা- জিয়াউল হক।







    
     ‘চিন্তা’ নিয়ে চিন্তার কথা-
   

 ‘চিন্তা’; ইংরেজিতে ‘থট’ (Thought) এবং আরবিতে ‘ফিকর’ হিসেবে আমরা চিনি। ছোট্ট শব্দটির পরিধি বিশাল। মনুষ্য জীবনের চাইতেও বিশাল ও ব্যাপক। মানুষ চিন্তা করে, আমরা চিন্তা করি। এই চিন্তাই নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের কর্মকান্ডকে। আমাদের চিন্তার বহি:প্রকাশ ঘটে কর্মকান্ডে। আর এই কর্মকান্ডের মাধ্যমেই প্রভাবিত হয় ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ ও রাষ্ট্র। কখনও কখনও এ প্রভাব এতটাই ব্যাপক ও বিশাল হয়ে থাকে যে, তা আমাদের নিজস্ব গন্ডী পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে কাল হতে কালান্তরে।

    এই চিন্তার নানা ধরন থাকে। নানা স্তরও রয়েছে। স্বৎ চিন্তা, অস্বৎ চিন্তা বা কু’চিন্তা নামে অভিহিত করে থাকি। গবেষক ও চিন্তাশীল ব্যক্তি এবং দার্শনিকেরা সাধারণত গভীর চিন্তা করে থাকেন। কারো কারো চিন্তাশক্তির গভীরতা অনেক বেশি হয়। চিন্তাশক্তির গভীরতা নির্ভর করে ব্যক্তির জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, বোধ-বুদ্ধি ও অনুভ‚তি শক্তির স্তরের উপর। কাল, সমাজ, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিও এক্ষেত্রে এক বিরাট ভ‚মিকা পালন করে থাকে। ব্যক্তির বিশ্বাসের উপরে ভিত্তি করে তার চিন্তা এবং চিন্তার উপরে নির্ভর করেই তার কর্মকান্ড পরিচালিত হয়।

     মনোবিজ্ঞানীরা চিন্তাকে (Thinking) সঙ্গায়িত করেছেন এভাবে; Thinking means representing things mentally and operating mentally on these representations.

    ভাবানূবাদ: চিন্তা হচ্ছে মানসপটে কোন একটা বিষয়কে স্থির করে নিয়ে তাকে ঘিরে মানসিক কার্যক্রম পরিচালিত হওয়া (সুত্র: Psychology Mind, Brain & Culture. Drew Westen, John Wiley & Sons, Inc. New York, 1996, পৃ: ২৯২)। 

     মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক ও সামাজিক জীবন এবং রাষ্ট্রীয় জীবন, এমনকি, আন্তর্জাতিক জীবনও এই ‘চিন্তা’র উপরে ভিত্তি করেই পরিচালিত হয়। এটাই হলো বাস্তবতা। চিন্তার ধরন ও মানের উপরে নির্ভর করে এইসব জীবনের সফলতা বা ব্যর্থতা নিরুপিত হয়ে থাকে। আজকের দ্বন্দমূখর, বৈষম্যপূর্ণ বিশ্বটাও কোন এক বা একাধিক চিন্তাধারাকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন; 

  The world as we have created it is a process of our thinking. It cannot be changed without changing our thinking. (যে বিশ্বকে আমরা সৃষ্টি করেছি, সেটা আমাদের চিন্তাধারারই ফল। আমাদের নিজেদের চিন্তাধারাকে পরিবর্তন না করে এ বিশ্বকে পরিবর্তন করা যাবে না।)

     সমস্যটা হলো বর্তমান পৃথিবী যে চিন্তাধারার উপরে প্রতিষ্ঠিত, তা ব্যর্থ! কথাটা আমার নয়, বিশ্বের প্রখ্যাত এক দার্শনিক পন্ডিতের। বিশ্বশ্রেষ্ঠ তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান; অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ এবং হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশ্বখ্যাত চিন্তাবীদ, বহু গ্রন্থপ্রণেতা প্রফেসর Edward de Bono  (ডি বোনো) তার সাড়া জাগানো গ্রন্থ ‘Parallel thinking ’ এর ভূমিকাতেই লিখেছেন; বিশ্ব যে দর্শন বা চিন্তাধারাকে ভিত্তি করে চলছে, তা ব্যর্থ হয়েছে। 

  ' ----In a changing world, ------ deep-seated inadequacies and dangers in the system itself. (সুত্র: Parallel thinking, From Socratic to de Bono thinking. Edward de Bono, ('পরিবর্তনশীল এ বিশ্বে পশ্চিমা দর্শন ব্যর্থ হচ্ছে। ব্যর্থ হচ্ছে এ জন্য নয় যে, এ চিন্তাধারা প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ত্রæটি রয়েছে। এ দর্শন ব্যর্থ হচ্ছে, কারণ; দর্শনটির গভীরেই রয়েছে অপূর্ণাঙ্গতা। এ দর্শনের প্রক্রিয়াতেই মিশে রয়েছে এর বিপদ। ভূমিকা দ্রষ্টব্য)'

   এ দর্শনের ভেতরেই লুকিয়ে রয়েছে ব্যর্থতার কারণ, তা জানিয়ে লিখেছেন;
Yet in a rapidly changing world the traditional thinking system is failing because ------ dangerous. It is complacent. ...........
  (অথচ দ্রæত পরিবর্তিনশীল এ বিশ্বে প্রচলিত চিন্তাধারাটি ব্যর্থ হচ্ছে কারণ, তা যুগ ও সময়, পরিবেশ ও পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে অক্ষম। চিন্তাধারাটিই অপূর্ণাঙ্গ, এটি ভীষণ বিপজ্জনক, আত্মতুষ্ঠিমূলক! - সুত্র: ঐ)

    তার মানে হলো; আধুনিক যতো চিন্তাধারা বা মতবাদ বিশ্বের বুকে প্রচলিত রয়েছে তা যুগের পরিবর্তনকে মোকাবেলা করার মতো চিন্তাশক্তির উদ্ভব ঘটাতে পারে না। কিন্তু ইসলাম পারে। ইসলামি দর্শনের এই শক্তিটা রয়েছে। এটাকেই আমরা ইজিতিহাদ বলে জানি। ইজতিহাদের ব্যবস্থা রয়েছে বলেই ইসলাম কখনোই বিশ্বের বুকে পুরোনো হয় না। যে কোন যুগে, যে কোন পরিবর্তিত পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়েও ইসলাম সর্বদাই আধুনিক; সর্বাধুনিক একটি মতবাদ। 

    এর কারণ কি? এর কারণ হলো ইসলাম ব্যক্তিকে চিন্তা করতে বলে। বলে; আফালা তাতাফাক্কারুন? আফালা তাদাব্বারুন? এই যে স্বাধীন চিন্তা করতে পারা, এটা ব্যক্তিমানসে জ্ঞানের ধারা উন্মোচনের পূর্বশর্ত। ইসলাম হুদুদ নির্ধারণ করে দিয়ে বলে; তোমার ইচ্ছামতো চিন্তা করো এবং কুরআনে বর্ণিত পথপন্থার সাথে সঙ্গতি রেখে চলো, তুমি চুড়ান্ত জ্ঞান ও সত্যের সন্ধান পাবে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন একজন অমুসলিম হয়েও এ সত্যটা বুঝতে পেরেছিলেন, তাই তিনি বলেছেন; 

  Imagination is more important than knowledge. For knowledge, is limited, whereas imagination embraces the entire world, stimulating progress, giving birth to evolution. (জ্ঞানের চেয়ে চিন্তা-কল্পনা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জ্ঞান তো সীমিত, কিন্তু কল্পনার কোন সীমা পরিসীমা নেই, পুরো সৃষ্টিজগতকেই ধারন করে সে জ্ঞানের প্রবৃদ্ধি ঘটায়, নতুন ত্বত্তের জন্ম দেয় (সুত্র: The Saturday Evening Post, 1929)। 

   আমাদের মুসলিম যুবপ্রজন্মের দৃষ্টি এদিকটায় আকর্ষণ করতে চাই। বিশ্বের বুকে চিন্তা ও দর্শনের ক্ষেত্রে যে শুন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, এক ইসলামী দর্শন ছাড়া সেই শুন্যতা পূরণের মতো কোন পূঁজিই কারো কাছে নেই। ইসলামের অনুসারী মুসলিম যুব ও বুদ্ধিজীবি সমাজের সামনে এক বিরাট সুযোগ এসে দাঁড়িয়েছে। 

   মুসলমান যুবকদের প্রতি আমার বিনিত আহŸান; কাঠামোগত গন্ডীর বাইরে এসে জ্ঞানচর্চা করুন। আপনারা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় যে বিভাগেই পড়াশুনা করছেন বা করেছেন সে বিভাগটাকেই কুরআনের চিন্তা ও দর্শনে সাঁজিয়ে দিন। বিদ্যমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এটাই এখন সবচেয়ে বড়ো কাজ। যুগের সবচেয়ে বড়ো চাহিদা। এই চাহিদা পূরণে আপনি আপনার নিজ অবস্থান থেকেই অবদান রাখুন, এটাই বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। বিশ্বকে বদলে দিতে নিজেকেই আগে প্রস্তুত করতে হবে বৈশ্বিক মানে, এই বিষয়টা নিয়েই একটু চিন্তা করবেন কি?
--------------------------------- 
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক গবেষক ও দাঈ। 

Post a Comment

0 Comments