Recent Tube

যুগশ্রেষ্ঠ এক স্বপ্নদ্রষ্টা পণ্ডিত ও উম্মাহর সুযোগ্য অভিভাবক শাহ আব্দুল হান্নান। -ওয়াহিদুল ইসলাম।



অজস্র আলোকোজ্জ্বল সৃষ্টিশীল পাণ্ডিত্য ও কর্মের অম্লান স্মৃতির মাঝে চিরভাস্বর তিনি চলে গেলেন আল্লাহর সান্নিধ্যে... 

                        --- পর্ব-৩:


যুগশ্রেষ্ঠ এই স্বপ্নদ্রষ্টা পণ্ডিত ও উম্মাহর সুযোগ্য অভিভাবক শাহ আব্দুল হান্নানের সাথে আমার কিছু সুখকর ব্যক্তিগত স্মৃতি...
--------------

      আমার বিয়ের পর বেশ কিছুদিন হান্নান চাচা নিউ জার্সিতে ইমরান-ববী দম্পতির বাসায় ছিলেন। সেসময় তিনি আমাদের দু’জনকে একসাথে সেখানে গিয়ে তার সাথে কিছূটা সময় কাটাতে অনুরোধ করলেন। আমি একা যে কোনো সময় যেতে পারি । কিন্তু আমার নববধুকে সাথে নিয়ে কেমনে যাই সেটা এক বিশাল প্রশ্ন। সবেমাত্র আমাদের আকদ হয়েছে, এখনো ঘটা করে কনেপক্ষ থেকে বউ তুলে নেয়া হয়নি। আমি তো বিয়ে করলাম, কিন্তু বিয়ে নিয়ে যে এতো সামাজিক রসম-রেওয়াজ ও বিধিনিষেধ তা এর আগে ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। তারপর আবার দেশের দুই প্রান্তের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতি-নীতির বিস্তর ব্যবধান। আগে শুনেছি সিলেট এবং চট্টগ্রামের পরিবারগুলো তাদের মেয়েদেরকে আদৌ তাদের জেলার বাইরে বিয়ে দিতে চায় না। আমার বিয়ের সময় এটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। সিলেটিরা তো তাদের বিশেষত্ব এইভাবে প্রতিষ্ঠিত করে যে যারা সিলেটি নয় তারা সবাই বেঙ্গলী। আর কোনো বেঙ্গলীর সাথে সিলেটি মেয়ের বিয়ে মানে মেয়ের পরিবারের প্রতিটা সদস্য এবং আত্মীয় স্বজন যে যেখানে আছে সবার মন জয় করার দুর্বার সংগ্রাম। পাহাড়সম বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে অনেক দঃসাধ্য সাধন করে অবশেষে সিলেটি কন্যা বিয়ে করলাম। কথায় বলে ঘুঘু দেখেছো কিন্তু ঘুঘুর ফাঁদ দেখোনি। বিয়ের আগে আর কি বাধা-বিপত্তি, বিয়ের পরে শুরু হলো রসম-রেওয়াজ, প্রথা ও নিয়ম-নীতি মেনে চলার আসল যুদ্ধ! সিলেটি প্রথা অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে বউ তুলে নেয়ার আগে স্বামী-স্ত্রী একত্রিত হলে নাকি জাত-মান কিছুই থাকেনা। আকদের প্রায় একমাস পরে আমাদের অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান এবং সে অনুষ্ঠানের পরে বউ তুলে নেওয়ার দিন নির্ধারিত হয়েছে। ততোদিন আমরা কি করবো? কঠোর সামাজিক প্রথার যাঁতাকলে পড়ে আমাদের অবস্থা ঠিক গানের মতো – “একুলে আমি আর ঐকুলে তুমি মাঝখানে নদী ঐ বয়ে চলে যায়”। আমরা সারারাত ফোনে কাটাই কিন্তু দেখা করার অনুমতি নেই। শ্বশুর পক্ষের কড়া হুঁশিয়ারি যেনো আমরা দেখা সাক্ষাত বা একত্রে মিলিত হওয়ার সুযোগ না পাই। রাতের পর রাত আমাদের নির্ঘুম ফোনালাপ দেখে বধু পরিবারের সবচে’ প্রভাবশালী ব্যক্তিটির হৃদয়ে করুণা হলো। তিনি অন্যান্য সবাইকে বুঝিয়ে সুজিয়ে আমেরিকা বা নিউ ইয়র্কের জীবনযাত্রার প্রেক্ষিতের দোহাই দিয়ে আমাদের জন্য কিছু নিয়ম-নীতির শৈথিল্য অনুমোদন করিয়ে নিলেন। এখন থেকে আমরা দেখা-সাক্ষাত করতে পারবো, একসাথে ঘুরতে পারবো। কিন্তু সবকিছ দিনের বেলায় হতে হবে। সন্ধ্যার আগেই আমার বধুকে তাদের বাসায় ঢুকিয়ে বিদায় দিয়ে আমাকে নিজ বাসায় চলে আসতে হবে। যাক, আল-হামদু লিল্লাহ। কথায় বলে “নেই মা থেকে কানা মা অনেক ভালো”। সারারাত ফোনালাপে কাটানোর পাশাপাশি সারাদিন একসাথে কাটানোর সুযোগ অনেক বড়ো বোনাস! 

    সে সুযোগ নিয়ে একদিন দু’জনে হাজির হলাম নিউ জার্সিতে ইমরান-ববী দম্পতির বাসায় হান্নান চাচার দরবারে। নিউ ইয়র্কের পেন্সিল্ভাবিয়া স্টেশন (পেন স্টেশন) থেকে ট্রেনে চেপে নামলাম নিউ জার্সির নিউ ব্রান্সউইক স্টেশনে। সেখানে নেমে যা ঘটলো তা না-ই বা বললাম। আমরা ইমরান-ববী দম্পতির বাসায় গিয়ে চাচাকে একাই পেলাম। তারা দু’জনে যার যার কাজে বেরিয়ে গেছেন এবং বিকেলে ফিরলে দেখা হবে। চাচা নিজের বাড়ির মতো করে স্বাধীনভাবে আমাদেরকে আপ্যায়ন করলেন। অবশ্য চাচা একেবারেই অনাড়ম্বর সহজ-সরল মানুষ হিসেবে খুব সোজা সাপ্টা যতোটুকু না হলে নয় ঠিক ততোটুকু আপ্যায়ন। তাও আবার শুধুমাত্র দেখিয়ে দিলেন কিছু খেতে চায়লে কোথায় কি আছে যা নিজেরা বের করে খেতে পারবো। বাসাটি আমার কাছে নতুন ছিলো না। তাই আমিই বরং চাচাকে আপ্যায়ন করলাম যথাসাধ্য। আমরা দু’জনেই চাচার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলাম। চাচা আমাদের দু”জনের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড যথা সম্ভব জানলেন। আমার সাথে চাচার অনেক কথা ইতোমধ্যে হয়েছে। এই প্রথম চাচা আমার বধুর কথা শুনলেন। চাচা তো তার সব ছাত্রীদেরকে ভাতিজি মনে করেন এবং “মা” কিংবা “আম্মু” বলে ডাকেন।  আমার স্ত্রীও উনার আম্মু হয়ে গেলো এবং মায়ের চৌকস কথা শুনে চাচা যেনো অনেক বেশী অভিভূত হলেন। চাচা আমাদেরকে দাম্পত্য জীবনে অনাবিল সুখ শান্তি ও সৌহার্দ্য বজায় রাখার ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করে তার একটি কার্যকর পন্থা হিসেবে আদর্শিকভাবে সবসময় আমাদের দু’জনকে এক নৌকায় অবস্থানের পরামর্শ দিলেন। আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে এমন বেশ কিছু বিষয়ে তিনি নিজের দাম্পত্য জীবনের কথা আমাদেরকে বললেন। সেটা ছিলো চাচার সরলতা এবং একনিষ্ঠ শুভাকাংখী ও অভিভাবক হিসেবে আমাদের প্রতি তার অগাধ স্নেহ-মমতার অনুপম নিদর্শন।  দ্বিতীয় যে কথাটি জোর দিয়ে বলেছিলেন তা হলো – আমরা আমাদের দাম্পত্য জীবনে ইসলামকে যেনো সবকিছুর উর্ধ্বে রাখি এবং যে কোনো দাম্পত্য সংকটে আমরা যেনো ইসলামের কাছে ফিরে আসি; নিজেদের যাবতীয় মান-অভিমান, আত্মম্ভরিতা এবং অহংবোধ সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলে নিজেদেরকে যেনো ইসলামের কাছে নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করি; এবং আমাদের সংকট নিরসনে ইসলামের যে সমাধান আছে তা যেনো আমরা বিনাবাক্যে মেনে নিই। আমাদের দাম্পত্য জীবনে চাচার উপরোক্ত উপদেশ দুটির সুফল আমরা পেয়েছি এবং আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস এই দুটি নীতির উপরে দাম্পত্য জীবনকে প্রতিষ্ঠিত রাখতে পারলে দাম্পত্য জীবনের যাবতীয় দ্বন্দ-কলহ ও অশান্তি এড়িয়ে এ ধরায় অনাবিল স্বর্গীয় সুখের নীড়ে বসবাস সম্ভব। 

      চাচা আমাদের দাম্পত্য জীবনে একসাথে লম্বা পথ চলাকে ঘিরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তোমরা দু’জন এখন স্বামী-স্ত্রী। তোমরা দু’জন সম্পূর্ণ দুই বিপরীত মেরুর এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত জ্ঞান, বিশ্বাস, অভিজ্ঞতা, স্বভাব-প্রকৃতি ও উপলব্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত। এসব বাস্তবতার পাশাপাশি তোমাদের আরেকটি বাস্তবতা হলো এই বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে তোমাদের “স্বামী-স্ত্রী” হিসেবে নতুন পরিচয়, নতুন জীবনে সুদীর্ঘ এক অজানা পথে একসাথে চলা এবং সে পরিচয় ও যৌথ পথচলার ফলশ্রুতিতে তোমাদের ভালোবাসা, সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার বাস্তবতা। এ সম্পর্কটি পবিত্র ও স্বর্গীয়। বৈবাহিক সম্পর্কটা শুধুমাত্র শাব্দিক অবিব্যক্তির মধ্যে সীমিত নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে এটা এমন এক বিশাল প্রতিষ্ঠান যার ভিত্তিতে পরিবার, সমাজ এবং বিশ্ব সভ্যতা গড়ে উঠেছে। তিনি বললেন, তোমাদের এই পবিত্র সম্পর্ককে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের অনেক অজানা মানুষ ও পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তোমরাও একে অপরকে চিনতে না আগে অথচ এখন একে অপরের সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে প্রিয়। এটা  মহান আল্লাহর বিশেষ পরিকল্পনা এবং খাস রহমত। যমীনের উপর তোমাদের এই নতুন সম্পর্কের পেছনে রয়েছে আসমানী সিদ্ধান্ত। আল্লাহর এ সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিবে, সম্মনা করবে। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং উভয় পক্ষের সকলকে স্ব-স্ব অবস্থানে  সম্মান করবে।  সেটা অবশ্যই করবে এবং সবাইকে যথাসম্ভব খুশী রাখার চেষ্ঠা করবে তবে তোমাদের দাম্পত্য সম্পর্ক এবং পারস্পারিক ভালোবাসাকে সবকিছু থেকে এবং সকল সম্পর্কের উর্ধ্বে সবার নাগালের বাইরে স্বতন্ত্র জায়গায় রাখবে। তোমাদের বাবা-মা হোক আর যেই হোক, কাউকেই তোমাদের দাম্পত্য সম্পর্কের ভিতরে ঢুকে সে সম্পর্কে হস্তক্ষেপ করা বা সে সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রন করার সুযোগ দিবে না। তোমাদের দাম্পত্য জীবন ও দাম্পত্য সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়কে এককভাবে তোমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখবে এবং সেখানে অন্য কারও অনধিকার প্রবেশের সুযোগ দিবে না। তার অর্থ এই নয় যে তোমাদের জীবনে তোমাদের বাবা-মা বা অন্যান্যদের স্থান থাকবে না। তাদের প্রত্যেককে ভালোবাসবে, সম্মান করবে, সকলের প্রতি দায়িত্ব পালন করবে, সবার প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবে। কিন্তু তোমাদের মধ্যকার একান্ত ভালোবাসার দাম্পত্য সম্পর্ককে কখনোই এমন পর্যায়ে নিয়ে যাবেনা যে পর্যায়ে গেলে তোমাদের আভ্যন্তরীণ বিষয় সমূহ নিয়ে অন্যান্যদের নাক গলানোর সুযোগ বা দরকার হবে। চাচার এই উপদেশটা এবং এব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গিটা অনেক গভীর। এব্যাপারে অমনোযোগী হওয়ার কারণেই অনেকের দাম্পত্য জীবনে সংকট ঘণীভূত হয়, সমস্যা আরও জটিল হয়, ধীরে ধীরে প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসায় ভরপুর একটি সংসারে ছন্দেপতন ঘটে। স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন ও দাম্পত্য সম্পর্কের উপর শুভাকাংখী বেশে অন্যদের প্রভাব, নিয়ন্ত্রণ, অনধিকার চর্চার সুযোগ থাকলে তা হিতে বিপরীত হয়। আশেপাশের অনেক ঘনিষ্টজনদের সুখী, সৌহার্দ্যপূর্ণ ও দীর্ঘদিনের ভালোবাসার দাম্পত্য জীবনে পতন বা বিচ্ছদের পেছনের যা বন্দুকের গুলির মতো ভূমিকা রাখে তা যখন অহরহ লক্ষ্য করি তখন শাহ আব্দুল হান্নান চাচার এই তৃতীয় পরামর্শটির যৌক্তিকতা ও যথার্থতা নির্ঘাত বিবেকনিষ্ঠতার সাথে অনুভব করি। 
(চলবে),
---------------------------------- 
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ কলামিস্ট গ্রন্থপ্রনেতা, এটর্নি এট ল' টেক্সাস ইউএসএ এল এল এম, হার্ভার্ড ল স্কুল। 

Post a Comment

0 Comments