Recent Tube

হেঁয়ালী; ড. আসিফ নজরুল।

      


                      হেঁয়ালী

   মুন্নীর সঙ্গে আমার দেখা হলো ২৪ বছর পর। ২৪ বছর যে বললাম, এটা আসলে আন্দাজে বলা। আমার বয়স হয়েছে। কত বছর পরপর কী হয়েছে দূরের কথা, কোন সপ্তাহে কী হয় তা–ও ভুলে যাই। বছর দশেক পর সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেব। কিন্তু আমার স্মৃতি বোধ হয় এখনই চলে গেছে বিশ্রামে। তাকে যদি জিজ্ঞেস করি কবে ঘটল? সে একটুও কষ্ট না করে বলে দেয় তিন বছর আগে বা পাঁচ বছর আগে। আমি সেটাই মেনে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
একটা বয়সে দীর্ঘশ্বাস ফেলাও অবশ্য আনন্দদায়ক। বিশেষ করে তার সঙ্গে মুন্নীর স্মৃতি জড়িয়ে থাকলে। তরুণ বয়সে কী ভালোই না বাসতাম তাকে। সে বর্ষার কদম ফুল চাইলে নিজে গাছে উঠে তা পেড়ে আনতাম, রিকশা থেকে একবার পড়ে গিয়েছিল বলে তাকে ছোট বাচ্চাদের মতো এক হাতে জড়িয়ে ধরে রাখতাম, চা খেতে ভালোবাসে বলে তার জন্য পৃথিবীর সেরা চা বানানো শিখেছিলাম। মুন্নী এসব লক্ষ করত না বোধ হয়। রাজহংসের মতো সে ঘাড় উঁচিয়ে চলত। আমি শান্ত দিঘির মতো হয়ে থাকতাম তার আশপাশে।
কয়েক বছর আগে ঢাকায় যখন বদলি হয়ে এলাম, আমার পোস্টিং হলো পরিবেশ অধিদপ্তরে। অধিদপ্তরটা মাত্র চালু হয়েছে তখন। আমি সেখানে মাঝামাঝি পর্যায়ের একটা পোস্টে যোগ দিলাম। অধিদপ্তর থেকে কিছু কর্মশালা হতো। কিছুদিন পরে আমি তার দায়িত্ব পেলাম। সরকারি অফিসে যা হয়, পরিবেশ সম্পর্কে প্রায় কিছু না জেনেই আমি পরিবেশের ছোটখাটো হর্তাকর্তা হয়ে গেলাম।
বলা বাহুল্য চাকরিটা আমার ভালো লাগল না। সারা দিন কাজ থাকত না তেমন। ফলে টেবিলে বসে ঘুমানোর অভ্যাস হলো। ভুঁড়ি বাড়ল। রাজশাহীতে প্রশাসনে কাজ করার সময় ক্লাবে গিয়ে টেবিল টেনিস খেলতাম। পদ্মার পাশ দিয়ে হাঁটতাম স্ত্রী–পুত্রকে নিয়ে। পরিবেশে এসে বন্দী হয়ে গেলাম দিন–রাত দুর্গন্ধ ছড়ানো আর বাসি বাতাস উগরে দেওয়া পুরোনো এসির একটা রুমে।
বছরখানেক আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে ইউএনডিপির একটা প্রকল্প শুরু হয়েছিল। এ জন্য দু–একবার আমাকে ইউএনডিপির অফিসে যেতে হলো। প্রকল্পের শেষ দিকে তারা পরিবেশ অধিদপ্তর আর এনজিওগুলোর সঙ্গে একটা কর্মশালার আয়োজন করল। সেখানে আমার নির্ধারিত চেয়ারে বসতে গিয়ে এমন জোরে চেয়ার টানলাম যে পাশের জামদানি প্রিন্টের শাড়ি পরা মেয়েটা আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকায়। অবাক হয়ে দেখি, সেটা মুন্নী!
থতমত খেয়ে হ্যালো ধরনের একটা শব্দ করলাম। রাস্তায় আরাম করে ঘুমিয়ে থাকা কুকুরকে হঠাৎ গুঁতো মারলে যেমন শব্দ হয় আমার মুখ থেকে বের হওয়া শব্দটা হলো সে রকম। সে এমনভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিল যে ধন্দে পড়ে গেলাম আসলেই এটা মুন্নী কি না।
পাশে বসে আমি ঢাকার ধুলোময় আকাশে তারা খোঁজার মতো পুরোনো দিনের মুন্নীকে খুঁজতে লাগলাম। তার চুলের ভাঁজ থেকে, সেখান থেকে সামান্য উঁকি দেওয়া কানের লতি দেখে, তার গায়ের গন্ধ শুঁকে তাকে ফিরে পেলাম। তার চুল একটু বেশি উজ্জ্বল হয়েছে, কানের লতিতে গোলাপি ভাব এসেছে, গায়ের গন্ধ ঢেকে গেছে পারফিউমের মিষ্টি সুবাসে। কিন্তু সে মুন্নীই।
সে আমার দিকে একটু পিঠ ঘুরিয়ে বসেছে। আমাদের টেবিলটা মোবাইল সেট শেপের। ছোট পাশগুলোর একটাতে ইউএনডিপির কর্মকর্তারা বসে। মুন্নী তাদের দিকে মুখ করে বসে আছে। এটা সে করতেই পারে। কিন্তু লক্ষ করে দেখলাম যখন আমি কথা বলছি, যখন ভদ্রতা করেই আমার দিকে একটু তাকানো দরকার তার, যেটা আমরা প্রায়ই করি কোনো মিটিংয়ে, সেটাও সে করল না। এমনভাবে বসে আছে ঠিক আমারই পাশে, মনে হলো আমি বলে কিছু নেই আসলে।
বহু বছর আগে সম্পর্কের একদম শেষ দিকে এমন করত সে আমার সঙ্গে। কেন করত আমি নিশ্চিত ছিলাম না। এটা ঠিক, খুব অদ্ভুত একটা সমস্যা হয়েছিল তার সঙ্গে আমার। আমাদের প্রথম বন্য দিন ছিল সেদিন, দুজনই একদম বেসামাল হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর কেন যেন হঠাৎ চুপসে গেলাম আমি। সেদিন থেকে একটা ভয় ঢুকল বুকের ভেতর। যদি আবার চুপসে যাই, যদি আবার ব্যর্থ হই—এসব ভেবে হঠাৎ আমি স্তিমিত হয়ে যেতাম সেসব মুহূর্তে। ভয়ে সেসব মুহূর্তের কাছে যাওয়াই বন্ধ করলাম। আর একটা সময় সে বন্ধ করে দিল আমার কাছে আসাই। সে নাকি আমি, ঠিক কে তা অবশ্য নিশ্চিত না আমি। গাছের পাতা শুকিয়ে যাওয়া শুরু করলে যত্ন নিতে হয়, ঠিকমতো রোদ-পানি–সার দিতে হয়। আর আমরা সেই গাছের দিকে তাকানোই বন্ধ করে দিলাম!
চাকরিতে ঢোকার তিন মাস পর ঢাকায় এসে দেখা করলাম। আমার পাশে বসেই সে কার সঙ্গে জানি নিচু স্বরে একটু পরপর কথা বলতে লাগল। আমাকে দেখানোর জন্য হয়তো। তখন বুঝিনি, কিন্তু সিলেটে ফিরে এসে তাকে ভুলতে খুব কষ্ট হয়েছিল আমার।
এসব যে এত বছর পরও মনে আছে জানতাম না। অথচ ভালোভাবেই তারা আছে আমার বুকের ভেতরে ঘাপটি মেরে। আশ্চর্য হয়ে দেখি সেই বুকটা ঝোলাগুড় রাখা গামছার মতো ভারী হয়ে আছে অভিমানে। এটা হয়তো ঠিক না, এই অভিমানের মানে নেই, এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সভায় এমন চোরা অভিমানী হয়ে থাকা লুকিয়ে নিষিদ্ধ বই পড়ার মতোই খারাপ কিছু। এসব ভেবে হাসি হাসি চেহারা করে, পানির বোতলে চুমুক দিয়ে, সামনে রাখা নোটবুকে লেখালেখির ভান করে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তার মতো হওয়ার চেষ্টা করলাম।
কিন্তু একটু পরই ধৈর্য শেষ হয়ে গেল আমার। মনে হলো, এসব ভানের দরকার কী, এসব পরিবেশনীতি, ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ডেভেলপমেন্ট এসব দিয়ে আমার কী! এসবের চেয়ে অনেক ইম্পরট্যান্ট হচ্ছে মুন্নী! কেন এভাবে অবজ্ঞা করবে সে আমাকে? কী দোষ ছিল আমার? সামান্য ভদ্রতাটুকু তো সে দেখাতে পারত আমাকে। সামান্য সৌজন্য—যেটা যেকোনো মানুষ দেখায় যে কারও সঙ্গে এমন মিটিংয়ে।
ক্লান্তিকর মিটিংয়ে বিরতি হলো। পাশের একটা রুমে গেলাম আমরা। সেখানে বুফের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব লাঞ্চের খাবার খেতে খেতে গল্প করা যায় অনেক। কিন্তু আমি জানি মুন্নী একটা কথাও বলবে না আমার সঙ্গে। দূরে একটা কোণে গিয়ে মনোযোগ নিয়ে খেতে লাগলাম। মাছের একটা কাঁটা আমার মাড়িতে কীভাবে যেন আটকে গেল। মুখের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে ইতরের মতো ভঙ্গিতে কাঁটা বের করার চেষ্টা করলাম। মুন্নী দেখলে দেখুক এই ইতরটাকে।
মুন্নী তবু দেখল না। কিংবা দেখল কি না জানি না। তবে আবার খাবার নিতে গিয়ে তাকে দেখলাম আমি, সঙ্গে সঙ্গে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল।
বুফে টেবিলের সামনে ঝুঁকে সে–ও খাবার নিচ্ছে। এত বছর হলো আগের মতোই শুকনো আছে সে। আগের মতোই ঝুঁকে দাঁড়ালে কপালের দুপাশ থেকে দুগাছি চুল দোল খেতে থাকে তার। ডান ভুরুটা যেখানে শেষ হয়েছে, তার সামান্য ওপরে একটা তিল ছিল মুন্নীর, তার একটা কোণ ছিল থেবড়ে যাওয়া কাজলের মতো। একটু কাছে গেলেই হয়তো দেখব সেটা।
মুন্নী মুখ ঘুরিয়ে আমাকে দেখে। হাসে। অমায়িক হাসি। আমি বোকার মতো বলি: ভালো আছেন আপনি? আপনি শব্দটা বলে কাদায় পিছলে পড়ার মতো অনুভূতি হলো। নিজের কানে তা বারবার বাজতে লাগল। আপনি করে বললাম আমি মুন্নীকে!
মুন্নী মুখ কুঁচকে একটা হাসি হাসি ভাব করল। মানে হচ্ছে ভালো আছে সে।
আমার কি আর কিছু বলা উচিত এখন? বুঝতে পারলাম না।
খাবার টেবিলের পাশে স্যুট–টাই পরা ইউএনডিপির এক কর্মকর্তার সঙ্গে তার আলাপ জমে উঠেছে। প্লেট হাতে দেখি তাদের। তাদের আলাপে কি অংশ নিতে পারি আমি, নাকি বিরক্ত হবে সে? এই অমীমাংসিত প্রশ্নের টানাটানিতে নিশ্চল হয়ে রইলাম।
আমাদের মিটিং শুরু হলো আবার। মুন্নী একদম আগের ভঙ্গিতেই বসে আছে। আমার দিকে একটু পিঠ ঘুরিয়ে। সামান্য হলেও তার সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। এখন এভাবে বসার কী মানে আছে?
খাবার টেবিলে মুন্নীর হাসিটা অমায়িক মনে হয়েছিল। আসলে সেটা তা ছিল না। তার হাসিটা ছিল মাপা মাপা, যে হাসি এমন সভায় চোখাচোখি হলে সবার সঙ্গেই হাসবে মুন্নী। এটা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে আমার মন বিষাক্ত হয়ে উঠল। এর চেয়ে আমাকে সে পুরোপুরি অবজ্ঞা করলেই ভালো হতো। তাহলে ভাবতে পারতাম পুরোনো দিনের কথা মনে করে এমন করছে সে। এখন সেটাও ভাবার উপায় নেই।
মিটিংটা একসময় শেষ হলো। মুন্নী উঠে দাঁড়িয়ে পাশের একজনের সঙ্গে কথা বলা শুরু করে। তরুণ বয়সী একটা চটপটে ছেলে। আমি একটু অপেক্ষা করলাম। তাদের দলে ততক্ষণে আরেকজন যোগ দিল। সে বিশালদেহী একটা সাদা চামড়ার মহিলা, বড় বড় চোখ, তার কথার তোড়ে কানের ওপরের অংশে লটকে থাকা একটা রিং এমনভাবে দুলতে লাগল যে আমি চোখ সরিয়ে নিলাম ভয়ে।
 
এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার আর মানে হয় না। হয়তো আমাকে এড়িয়ে চলার জন্যই এভাবে গল্পে মেতে উঠেছে মুন্নী। পরক্ষণে মনে হলো ধুর, আমি কে!
বাইরে বৃষ্টিভেজা শহর। মনে হলো, গোসলের পর গা মোছেনি সে এখনো। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে, বিল্ডিংয়ের কার্নিশ ঘেঁষে, ল্যাম্পপোস্টের মাথায় এখনো জলের ছোঁয়া।
আমার বাসা অনেকটা দূরে। পরিবেশ অধিদপ্তরের একটা এইট সিটের মাইক্রোবাস আছে। সেটাতে আমার মতো ম্রিয়মাণ অফিসারদের চড়ার সুযোগ হয় এ ধরনের অনুষ্ঠান থাকলে। তবু রিকশা নিই।
রাস্তায় মানুষ নেই প্রায়। আকাশে বিষাদময় আলোর মাঝখানে ম্লান সূর্য। অন্য পাশ থেকে বাতাস আসছে হু হু করে।
মুন্নীকে মনে মনে বলি, কেমন আছ তুমি?
ভালো! তুমি?
আমিও ভালো।
তারপর কতক্ষণ দেখি দুজন দুজনকে। তাকে জিজ্ঞেস করি, বিয়ে করেছ?
সে হাসে। তুমি?
হু। তিনটা বাচ্চা আছে আমার। আমার নিজের। এটা বলে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। এমন কান্না পায় আমার।
আমাদের আর কথা এগোয় না। আর এগোনো সম্ভব না। আমি তবু ফিসফিস করে বলি: আমি পারি মুন্নী। তোমার সঙ্গে খুব ভয় লাগত! খুব! সেই ভয় তোমার থেকে কত দূর আছড়ে ফেলেছে আমাকে!
চোখ থেকে টপ করে পানির ফোঁটা পড়ে হাঁটুর ওপর রাখা প্লাস্টিকের ফোল্ডারে। এত জোরে শব্দ হয় যে আমি অবাক হয়ে তাকাই। আকাশে এখনো আলো আছে কিছুটা। ফোল্ডারের ওপর ছোট্ট পলিথিনের খোঁপে কর্মশালার অংশগ্রহণকারীদের নাম–পরিচয় ঢোকানো থাকে। কেন যেন সেখানে চোখ যায়। দেখি সেখানে লেখা রেহনুমা ইসলাম! আমি কি তাহলে ভুল করে মুন্নীর ফোল্ডারটা নিয়ে এসেছি? কিন্তু মুন্নীর নাম তো রেহনুমা ছিল না! তাহলে কি মিটিংয়ে আমার পাশে বসা মেয়েটা মুন্নী ছিল না!
ভালো করে ভেবে দেখি, এটা সম্ভব না, মুন্নীকে চিনতে ভুল করার কথা না আমার। সে মুন্নীই ছিল, যেভাবে হোক হয়তো অন্য কারও ফোল্ডার আমি নিয়ে এসেছি বেখেয়ালে।
আমার ফোনটা বাজছে। শারমিন ফোন করেছে। শারমিন আমার স্ত্রী, স্বামী–অন্তঃপ্রাণ ভালোবাসাময় একটা মেয়ে। ফেরার পথে প্রতিদিন সময় ধরে ধরে সে ফোন করে। জানতে চায় কী খাব আজ নাশতায়। তারপর গভীর কণ্ঠে বলে, তাড়াতাড়ি আসো। তখনই আমার মনটা আনন্দে ভরে ওঠে।
আজও হয়তো তাই হতো। কিন্তু আমি তার ফোন কেটে দিই, নীরব করে রাখি। কিছুক্ষণ থাকি আমি মুন্নী বা হতে পারে মুন্নীর কথা ভেবে, বিষাদে-বেদনায়, সজল এই সন্ধ্যায়।
প্রবল একটা বাতাস আমার সঙ্গে সায় দেয়। উড়িয়ে নিয়ে যায় আমাকে তার কাছে। একসময় সেই সব মুহূর্তে। আমি অবিকল আগের মতো করে তাকে ডাকি, মুন্নী, এই মুন্নী।
অবাক হয়ে দেখি প্রাচীন ভয়টা আবারও গ্রাস করছে আমাকে। বুঝি না, তার সঙ্গেই এত ভয় কেন আমার?
আকাশে সূর্য ডুবেছে। গাঢ় অন্ধকার নামছে চারদিকে।
(আমার লেখা এই গল্পটা প্রথম আলো-তে প্রকাশিত হয়েছে গতকাল (১ঃ৮ঃ২১ইং)। কেমন লাগলো জানাবেন আশা করি)
------------------------------------ 
লেখকঃ প্রবন্ধ লেখক কলামিস্ট গ্রন্থপ্রনেতা শিক্ষক, বিশ্লেষক ও গবেষক। 

Post a Comment

0 Comments