Recent Tube

হৃদয় ফাটানো বাঁধভাঙা দু’টি কান্না; ওয়াহিদুল ইসলাম।



   
হৃদয় ফাটানো বাঁধভাঙা দু’টি কান্না;


      জীবনে বহুবার কেঁদেছি। কখনো কন্ঠ বিদীর্ণ করে হাউমাউ করে, কখনো চাঁপা কণ্ঠে বুক ফাটিয়ে হৃদয় বিদীর্ণ করে। অনেক কান্না স্মৃতিতে বিলীন হয়ে যায়। দুটি কান্না কখনো ভুলতে পারিনা। শুধু তা-ই না, যখনই নীরবে নিভৃতে কান্না দুটি মনের জানালায় উঁকি মারে, আবার কেনো যেনো অজান্তেই চোখ দিয়ে অশ্রুর ঝর্ণা ঝরে।
 
     দুটি কান্নারই উৎস এক অভিন্ন ব্যক্তি। তবে কান্না দুটি পরষ্পর বিপরীতমুখী ফলশ্রুতির। দুটি কান্নাই শিক্ষণীয়। দুটি কান্নার উৎস একই ব্যক্তি না হলে আমি অবশ্যই প্রথম কান্নার উৎস ব্যক্তির নাম সগর্বে উল্লেখ করতাম। কারণ সে কান্নাটি ছিলো অনুপ্রেরণার, অনুভূতির, চেতনার, অনুশোচনার, দায়িত্বানুভূতির, জীবনবোধের – তাই অবশ্যই মহান আল্লাহর কাছে অতি পছন্দনীয়। যে মহান ব্যক্তি শক্ত পাথুরে হৃদয়ে এমন এক উচ্ছ্বসিত প্রশান্তিময় পবিত্র কান্নার বরফ গলিয়েছেন তার নাম সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া উচিৎ, সেটাই তো স্বাভাবিক। এমন কান্নার বিনিময়ে আল্লাহ অবশ্যই ভালো প্রতিদান দিবেন তা আমার দৃঢ় বিশ্বাসের কথা, পাকা ঈমানের কথা। কাজেই সে বিনিময় ঐ উৎস ব্যক্তিও যে সমভাবে পাবেন সেটাও আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু না, তা সত্ত্বেও তার নাম এখানে উল্লেখ করাটা আমি সমীচীন মনে করছি না, কারণ আমার দ্বিতীয় কান্নার উৎসও স্বয়ং তিনিই। এই কান্নাটি অত্যন্ত দূঃখ-বেদনার, চরম দারিদ্র-ক্লিষ্ট এক ছাত্রের আলোকজ্জ্বল স্বপ্নময় জীবন সংগ্রামের পথে প্রাপ্য ও প্রাপ্ত একান্ত প্রয়োজনীয় সহযোগিতাটুকু রুঢ় মনোভাব ও কঠোর সিদ্ধান্তে আটকে দেয়ার অসহনীয় আঘাতে উতসরিত, অনুরণিত। তাই আমি এই মহান উৎস ব্যক্তিটির নাম উল্লেখ করতে চাইনা। পরিচয় গোপনই থাক।
 
      গানটা নিশ্চয় সবাই শুনেছেন, দয়াল কি সুখ তুমি পাও সুখের ঘরে আগুন দাও, যে জন তোমার দয়ার কাঙ্গাল তাহারেই কান্দাও। এটা একটা অভিমানের কান্না। মহান আল্লাহ কখনোই সুখের ঘরে আগুন দেননা, দয়ার কাঙ্গালকে কাঁদাননা। যদিওবা সুখের ঘরে আগুন লাগে অথবা দয়ার কাঙ্গাল কেঁদে থাকে, যদি তা আল্লাহর কারণে হয় তার উত্তম বিনিময় অবশ্যই তিনি দেন। এটা আল্লাহর নিয়ম। কিন্তু মানুষ আল্লাহর এই একই নিয়ম প্রচার করে যেমন অন্যদেরকে কাঁদাতে পারে আবার আল্লাহর নিয়মের বিপরীত মনোভাব বা আচরণ দেখিয়ে দয়ার কাঙ্গালকে কান্নার সাগরে ভাসাতে পারে। পবিত্র কুরআনে্র সুরা আস্‌সাফ এর একটি আয়াতে মহান আল্লাহ এরকম (কথা ও কর্মে বিপরীতমূখী) চরিত্রকে তিরষ্কার করে এটাকে তাঁর কাছে অতিশয় ঘৃণা ও ক্রোধের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন।
 
   নিশ্চয় এখন আপনার আগ্রহটা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে কান্না দুটির পেছনের ঘটনা জানার জন্য। অনেক কাটসাট্‌ করে সংক্ষেপে বলি। দুটি কান্নার সময়ের ব্যবধান ৮/৯ বছর।
 
   দ্বিতীয়টি দিয়ে শুরু করি।
১৯৯২ সাল। গ্রীষ্মকাল। কুরবানীর ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি সবেমাত্র। কয়েকদিন পরেই ঈদ। বাড়ির পাশে সুউচ্চ জাম গাছে জাম পেকে ঝুলছে। অনেক বড়ো বড়ো টলমল জাম। লোভ সামলাতে পারছিলামনা। গাছে উঠে ডালে ডালে ঘুরছি আর জাম খাচ্ছি। প্রায় দুপুরবেলা। হঠাৎ একজন হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির উঠোনে এসে সাইকেলে ব্রেক করে থামলো। গাছের উপর থেকে দেখি সে আমাকে খুঁজছে। নেমে এসে দেখি ঢাকায় আমার হোস্টেলের পাশে এক মেসে থাকে এমনই এক সমবয়সী ছাত্র, আমাদেরই এলাকার। হাতে তুলে দিলো এক চিরকুট। একটি A4 পেপার চার ভাঁজ করলে তার একভাগ সাইজের চিরকুট। একটি টেলিগ্রাফ। জীবনে এই প্রথম টেলিগ্রাফ দেখলাম। আমার নামে আমার হোষ্টেলের ঠিকানায় বিদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছে। লেখা আছে, “তোমার ভর্তির আবেদন গৃহিত হয়েছে। জুন ১৫ তারিখ থেকে অরিয়েন্টেশন সপ্তাহ শুরু হবে। এই তারিখের মধ্যেই তোমাকে ক্যাম্পাসে হাজির হতে হবে।“
 
    তার মানে ঈদের দুদিন পর! ঈদের বাকী আর দুইদিন!! কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। মা ছাড়া এমূহুর্তে কেউ বাড়িতে নেই। ঢাকায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণটা কাউকে জানাতে চাইনা। কারণ জানালে সবাই চরম অসহায় বোধ করবে। যে পরিবারের এক পয়সা যোগাড় করার সামর্থ নেই ছেলের লেখাপড়ার জন্য, সে পরিবার কিভাবে ছেলের বিদেশ যাওয়ার জন্য এতোগুলো টাকা এতো তাড়াতাড়ি সংগ্রহ করবে! টাকা আদৌ দিতে হলে জমাজমির চিলতে গুলো বিক্রি করে দিতে হবে। গতবছর যখন ভর্তির অফার পেয়েছিলাম বাবা মা সেটাই করেছিলো। দু’চিলতে জমি বিক্রি করে হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলো – বাবা যা এই টাকা নিয়ে ঢাকায় যা। আরও লাগলে জানাইস। দরকার হলে বাকী জমিগুলোও বিক্রি করে দেবো। ঢাকায় গিয়েছিলাম সে টাকা নিয়ে। বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি শুরুও করেছিলাম। হঠাৎ বিবেক বললো, না! তুমি এটা করতে পারো না। তোমার আরও সাতটা ভাই এবং একটা বোন আছে। তোমার বাপের জমিতে তাদের হক আছে, ভাগ আছে। ওরা কেউ লেখাপড়ার মুখ দেখেনি, বাড়ির গন্ডি পার হয়নি। জীবনে সুখ কি জিনিস তা তারা চিনেনি। তাদেরকে নিঃস্ব করে তুমি আজ বিদেশে পাড়ি দিচ্ছো। জানি তোমার সদিচ্ছা আছে তাদেরকে টেনে তোলার। কিন্ত সে সুযোগ যদি আদৌ তোমার জীবনে না আসে? তাই গতবার যাওয়ার সিদ্ধান্তে ছন্দেপতন ঘটিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে বাকী টাকা গুলো আব্বার হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আব্বা জমি বিক্রি করে আমি সবার হক নষ্ট করে বিদেশে যেতে চাইনা। জমি বিক্রির যে টাকাগুলো খরচ করে ফেলেছি, সেটাও ইনশা আল্লাহ আমি ফিরিয়ে দেবো একদিন। পারলে জমি দুটো ফিরিয়ে নাও। সে জমি আর ফেরানো হয়নি। টাকা গুলো অভাবী সংসারই গোগ্রাসে গিলে ফেলেছে।
 
      কিন্তু এবার কি করবো? যেতে হলে টাকা তো আমার সংগ্রহ করতেই হবে। জমি বিক্রির জন্যও তো সময় লাগে। সে সময় আমার হাতে নেই। তাই বাবা মাকে বিদেশের ব্যাপারে কিছু না বলেই অন্য একটা অজুহাত দেখিয়ে ঢাকায় চলে গেলাম। ঈদের আগেই আবার ফিরবো বলে বাড়ি থেকে বিদায় নিয়েছি। সে রাতেই ঢাকায় পৌঁছালাম। সারা পথ অসংখ্য চিন্তা আর পরিকল্পনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কিন্তু সেসময় যেমন শেয়ার করার জন্য সাথে কেউ ছিলো না আবার ফেসবুক বা মোবাইল নামক তাৎক্ষণিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোও ছিলোনা। ভাবলাম একার চিন্তা বা একার প্রয়াসে কিছুই হবেনা। তাই আমাকে যারা অত্যন্ত স্নেহ করেন এমন কিছু বড়ো ভাইদেরকে সম্পৃক্ত করতে হবে। উঠলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে এক বড়ো ভাইয়ের রুমে। উনি আরেক বড়ো ভাইকে ডাকলেন। দুজনে বললেন, তোমাকে এবার বিদেশ পাঠাবোই ইনশাআল্লাহ, তা যতো চেষ্টা সাধনা-ই লাগুক। কিন্তু ঈদের ছুটির আগে হাতে সময় আছে বা অফিস খোলা থাকবে শুধু আগামীকাল। যা কিছু করার কালকের মধ্যেই করতে হবে। হলের কয়েন বক্সে গিয়ে উনারা একে একে অনেককে ফোন দিলেন। ফোনে সাড়া দিলেন আরেক বড়ো ভাই। টাকা দিতে না, আমাদের জীবনপণ প্রয়াসে সম্পৃক্ত হতে।
 
     হিসাব কিতাব করে দেখা গেলো আমার নিদেন পক্ষে ত্রিশ হাজার টাকা লাগবে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় আঙ্গিনায় হাজির হতে। বড়ো ভাইয়েরা প্রথমে ফোন করলেন এক বিদেশী এনজিও’র এদেশীয় এক পরিচিত কর্তাকে। ভাইয়েরা তার কাছে আমার নাম উল্লেখ করেননি। তবে বর্ণনা শুনে উনি বুঝে ফেলে বললেন, “ছাত্রটা কি অহিদ? সে তো আমারই ছাত্র। সে তো আমার অনেক প্রিয় ছাত্র।“ ভাইয়েরা হাঁপ ছেড়ে বললেন, তাহলে তো আমাদের দায়িত্ব শেষ। জানতাম না আপনি ওর শিক্ষক ছিলেন। এবার তাহলে শিক্ষক তার প্রিয় ছাত্রের দায়িত্ব নিন। আমরা ছাত্র হয়ে আর কি-ই বা করতে পারি?” উনি বললেন, সেটা তো বটেই। হাতে আগামী কালই সময় আছে এবং কালই সব কিছু করে ফেলতে হবে। আমাদেরকে ভোরে উনার অফিসে যেতে বললেন।
 
     আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের অফিসে গিয়ে দেখি উনি একের পর এক ফোনে আমার ব্যাপারে কথা বলছেন। কথা শেষে আমাকে ডেকে বললেন, “জানি তোমার হাতে এখন কোনো টাকা থাকার কথা না। তোমার এমূহুর্তে বিদ্যুৎ গতিতে ছুটতে হবে। এই নাও পকেট খরচের জন্য আমার পক্ষ থেকে এই পাঁচ হাজার টাকা ব্যক্তিগতভাবে তোমার জন্য উপহার। আমার সংস্থাটি বিদেশী হওয়ার কারণে এখান থেকে টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও অনুমোদনে অনেক সময় লাগবে যে সময় আমাদের হাতে নেই। তাই আমি অন্য দুটি সংস্থাকে রাজি করিয়েছি। একটি সংস্থা দশ হাজার আর অন্যটি বিশ হাজার দিবে। আশা করি তাতে তোমার হয়ে যাবে। যদি শেষে কিছু টাকা বেঁচে যায়, তাহলে তোমার গরীব বাবা মাকে দিয়ে যেয়ো। এবার বলো, টাকা গুলো কি তুমি ধার হিসেবে নিবে না দান হিসেবে?” আমি ধার হিসেবে নেয়ার কথা বলাই আমার শিক্ষক খুউব খুশী হলেন এবং গর্বে যেনো তার বুক অনেক প্রশস্ত হলো। উনি আমাকে দুইটা আবেদন লিখতে বললেন এবং তার উপর নিজের সুপারিশ লিখে দিলেন। কোলাকুলি ও দোয়া করে বিদায়ের সময় বললেন, “সন্ধ্যার পর অফিসে বা বাসায় পাওয়া যাবেনা, ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে চলে যাবো। আশা করি সমস্যা হবেনা। কিন্তু কোনো সমস্যা হলে পথে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই আমাকে জানাবে”।
 
    প্রথমে একটি সংস্থা থেকে দশ হাজার টাকা সংগ্রহ করে অন্যটির চেয়ারম্যানের কাছে গেলাম। অত্যন্ত সম্মানী ব্যক্তি। দরখাস্তটি হাতে নিয়ে প্রথমে খচ্‌খচ্‌ করে দরখাস্ত পত্রের সাইড মার্জিনে একটু আড়াআড়ি করে লিখলেন, “তার টাকাটা আজই দরকার। আজ টাকাটা না পেলে তার বিদেশে লেখাপড়া করতে যাওয়া হবেনা। যদিও এভাবে টাকা দিতে বোর্ড রিজোলুশন লাগে। কিন্তু সে সময় তার নেই। আমি পরবর্তী বোর্ড মিটিং এ এটা পাশ করিয়ে নেবো। কাজেই টাকাটা তাকে আজই যতো দ্রুত সম্ভব দিয়ে দেয়া হোক”। এরপর সই করলেন, সংস্থার ফিন্যান্স কর্তাকে ফোন করে বিষয়টি বললেন এবং আমাকে তার কাছে পাঠালেন।
 
   ফিন্যান্স কর্তাকে খুব ভালো করে চিনলাম। ছাত্রজীবনে একজন অনুকরণীয় অনুসরণীয় ব্যক্তি হিসেবে তিনি আমাদের মতো লাখো ছাত্রের কাছ থেকে অকূণ্ঠ আনুগত্য পেয়েছেন। জীবনে যতোগুলো মানুষকে চেহারা সুরতে বিনম্র মাটির মানুষ হিসেবে দেখেছি তিনি তাদেরই একজন। এমন একজন ব্যক্তির সামনে হাজির হয়ে নিজেকে প্রথমে খুব গর্বিত ও পুলকিত মনে হলো। উনার টেবিলের সামনে গিয়ে কাচুমাচু করে দরখাস্তটি হস্তান্তর করলাম। উনি বললেন, অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। আমাকে চলে যেতে হবে। শুধুমাত্র চেয়ারম্যান সাহেব বলেছেন বলে এখনো তোমার জন্য বসে আছি। দরখাস্তটি হাতে নিয়ে বললেন, গ্যারান্টি কই? গ্যারান্টি ছাড়া আমি টাকা দিতে পারবো না। আমি ভয়ে সংকোচে দরখাস্তের মার্জিনে আঙ্গুল রেখে আমার শিক্ষকের সুপারিশ এবং উনার সংস্থারই চেয়্যারম্যানের নোটসহ স্বাক্ষরের বিষয়টি উনার নজরে আনলাম। উনি উনার সিদ্ধান্তে অনড়। আমরা অনেক অনুরোধ, অনুণয়, বিণয় করেও কাজ হলোনা। আমরা এটাও বললাম যে দেখুন, আপনি একসময় আমাদের মতো লাখো ছাত্রের অভিভাবক ছিলেন। আজ সকল অনুমোদন সত্ত্বেও যদি টাকাটা না পাই তাহলে আমার মতো একজন ছাত্রের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়া হবেনা। উনি বললেন, তাতে ক্ষতি কি? বিদেশ না গেলে কি সব অচল হয়ে যায়? আমি বিদেশ যাইনি তা আমার কি চলছে না? আমাদের অনুভূতি লোপ পেলো, হতভম্ব হয়ে, বাকশূন্য হয়ে অনেকটা অবচেতন হয়েই দাঁড়িয়ে রইলাম। আরও অনেক কথা উনি এফাঁকে শুনিয়ে দিলেন। সেসব কথা আমাদের অবচেতন কানে শুধু ভোঁ ভোঁ করেছে। আমাদের মুখে দিনের শেষে অন্ধকারের ছাঁপ। উনি চলে গেলেন, আর বলে গেলেন – এই বিশ হাজার টাকা আমি দফতরীর কাছে রেখে যাচ্ছি, যদি উপযুক্ত গ্যারান্টি আনতে পারো তাহলে সে আমাকে ফোন দিবে। তারপর আমার সম্মতি পেলে সে তোমাদেরকে টাকা দিবে, না হলে নয়।
 
   সবাই বের হলাম পথে। জানিনা কোথায় যাবো এরপর। আমরা সবাই নিশ্চিত আমার শিক্ষক ততোক্ষনে বাসা ছেড়ে গ্রামের পথে। তবুও রিক্সা নিয়ে তার বাসায় কড়া নাড়লাম যদি ভাগ্যিস এখনো উনি বের না হয়ে যান! কিন্তু না উনাকে পাওয়া গেলোনা। আবার বের হলাম পথে।
 
     আবার গেলাম সংস্থাটির চেয়্যারম্যানের বাসায়। অত্যন্ত বয়স্ক সম্মানী লোক উনি। আমাদের কথা শুনে খুব দূঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন, সে তো ছাত্র অভিভাবক ছিলো। সে তোমার প্রয়োজনটা বুঝলো না? অফিসে থাকলে তো আবার ফোন করে বলতাম। তাহলে আবার নতুন করে আরেকটি নোট লিখে সই করে দিই? আমরা ভাবলাম, তাতে কাজ হলে তো প্রথমটাই যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলো। আমরা উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। সংস্থাটির যিনি এমডি তার কাছে গিয়ে অনেক অনুণয় বিণয় করে শর্ত সাপেক্ষে তার গ্যারান্টি নিয়ে আবার ফিরে গেলাম ফিন্যান্স কর্তার অফিসে। টাকা টা নিয়ে যখন ফিরছি, তখন আমরা শুধু খিদের  যন্ত্রণা এবং শারীরিক পরিশ্রমের কারণেই ক্লান্ত না, মানসিকভাবেও একেবারেই বিধ্বস্ত।
 
    রাত তখন বেশ। অনেক কাজ হাতে বাকী। টাকা পেয়েও কাজগুলো আজকের মধ্যে না করতে পারলে তখন আক্ষেপ আরও বেড়ে যাবে। তাই এযাবত কি ঘটলো তা ব্যস্ততা ও কর্মের তাড়নায় আমাদের হৃদয় স্পর্শ করতে পারলো না। ভাইয়েরা সিদ্ধান্ত নিলেন কেউ ঈদে বাড়ি যাবেননা। বরং তারা আমাকে বাড়িতে বিদায় নেয়ার জন্য পাঠিয়ে নিজেরা আমার সবকিছু গোছগাছ করে রাখবেন। পরের দিন, ঈদের আগের দিন ঢাকা ছাড়লাম এবং ঈদের আগের রাতে বাড়ি হাজির। সবাইকে সবকিছু বলমাম। আরও বললাম ঈদের পরেই বিকেলে আবার আমাকে চলে যেতে হবে। আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের কথা মতো আব্বার হাতে পাঁচ হাজার টাকা জোর করে তুলে দিয়ে আমি বাড়ি ছাড়লাম এক অজানা অচেনা অনিশ্চিত কিন্তু অপার সম্ভাবনার দিগন্তের সন্ধানে।
 
    ঢাকায় এসে দেখি সব ঠিকঠাক। ভাইদের কাছে চির ঋণী, ঋণী সকলের কাছে, ওই সংস্থাটির ফিন্যান্স কর্তার কাছেও। বিমানে উঠলাম ঈদের পরের দিন। জীবনে প্রথম বিমানে ওঠা। আর কোনো ব্যস্ততা নেই। শুধু বসে থাকা আর উৎকণ্ঠার সাথে গন্তব্যে পৌঁছানোর অপেক্ষার পালা। অলস সময়; ক্লান্ত দেহ। সীটে বসে ঘুমিয়ে পড়ারই কথা। কিন্তু মন ব্যস্ত হয়ে উঠলো। ব্যস্ত হলো অনেক কিছু নিয়ে। পেছনে ফেলে আসা অনেক কিছু নিয়ে যখন মনটা ব্যস্ত, অস্থির, তখনই সজোরে সবেগে এক তীর ছুটে এসে বুক ভেদ করে হৃদয়ের গভীরে ঢুকে গেলো। আমাকে টাকা ধার দিয়ে সাহায্য করেছেন যে সংস্থাটি সে সংস্থারই ফিন্যান্স কর্তার ছুড়ে মারা এ তীর। কতো আগেই তো তীরটা ছুড়েছিলেন উনি, কিন্তু ব্যস্ততার কারণে ব্যথা এতোক্ষন অনুভব করিনি। জমে থাকা সে পাহাড়সম ব্যথায় অজান্তেই চোখে নেমে এলো অশ্রুর বন্যা। বেদনার অশ্রু বন্যা প্রতিরোধ করার জন্য ভাবলাম আসলে উনিই তো ঠিক। এমন একজন ব্যক্তি যাকে চেহারা সুরতে সব সময় অতি নম্র ও বিণয়ী হিসেবে দেখেছি, যাকে সম্মান করে আনুগত্য করে মনে পরম প্রশান্তি লাভ করেছি, তিনি তো ভুল বলেননি – তিনি বিদেশে না গিয়েও তার অচল হয়নি জীবন, বরং ভালোই চলছে, ভালোই আছেন তিনি। তাহলে আমরা নগন্য যারা তাদেরই অনুসারী আনুগত্যকারী, আমাদের কেনো বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন! বরং বিদেশ যাওয়ার খায়েশ না থাকলে আজ এমন এক সম্মানী প্রিয় অভিভাবকের তীরে হৃদয় ক্ষত বিক্ষত হতোনা, জীবনও হয়তো অচল হয়ে থাকতো না।
 
    এ কান্না আমার কখনো শেষ হবে না। আমি তো মানুষ, আমার তো হৃদয় বলে একটা জিনিষ আছে। আমার এ কান্না শুধু ব্যথা বেদনার কারণেই যার উপর আমার কোনো কন্ট্রোল নেই। কন্ট্রোল থাকলে হয়তো আর কাঁদতাম না। তবে ওই মহান ব্যক্তির প্রতি আমার ভেতরে কখনো বিদ্বেষ বা ঘৃণা জন্মায়নি। আমি কাঁদি বটে, কিন্তু তার কারণে না, আমার নিয়তির কারণে। সেটা আমার প্রাপ্য। আমি তার প্রতি বরং চিরকৃতজ্ঞ দুটি কারণে। এক, তার কাছ থেকেই আমি টাকা পেয়ে বিদেশ গিয়ে লেখাপড়া শিখে আজ এ অবস্থানে আসার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। দুই, তার কারণে আমি যে প্রথম কান্নাটি কেঁদেছিলাম সেটা আমার জীবনে এক বড়ো শিক্ষা। সে চেতনায় আমি আজও উজ্জীবিত এবং আজীবন উজ্জীবিত থাকতে চাই। কারণ সেই চেতনা ছাড়া আমরা মানুষ হতে পারিনা, পারিনা দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে, পারিনা পরকালে মুক্তি পেতে।
 
     শুনুন তাহলে সেই প্রথম কান্নাটির ঘটনা। আমি তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। প্রতিভাবান এবং নৈতিক শিক্ষালাভে আগ্রহী কিছু বাছাই করা ছাত্রদেরকে নিয়ে আয়োজিত জেলা পর্যায়ের একটা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোগদানের সোভাগ্য আমার হয়েছিলো সেসময়। এটা আমার জীবনের একটা আলোকিত সময়ই বটে। তিন দিন ব্যাপী এই প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে উন্নত নৈতিক চরিত্র গঠন ও ইসলামী আদর্শের আলোকে জীবন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ছাত্রদেরকে উদ্বুদ্ধ করা ও দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য অনেকগুলো বিষয়ের উপর হৃদয়স্পর্শী আলোচনা হয়েছিলো। যাদেরকে অনুকরণযোগ্য আদর্শ হিসেবে মনে করতাম এমন সব উন্নত নৈতিকতা সম্পন্ন পন্ডিত এবং সুবক্তারা এসে ঐ সব বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। এমনই একটি আলোচনার বিষয়বস্তু ছিলো – “কুরআন হাদীসের আলোকে আমাদের দৈনন্দিক ব্যবহারিক জীবন”। আলোচনা পেশ করেছিলেন এই একই ব্যক্তি যিনি পরে ঐ সংস্থাটির ফিন্যান্স অফিসার হয়েছিলেন। অত্যন্ত বাস্তবধর্মী, প্রাণবন্তু ও হৃদয়স্পর্শী ছিলো সে আলোচনা। এমনিতেই সুঠাম ও দীর্ঘকায় এই ব্যক্তির চেহারা সুরতে ছিলো সুউচ্চ ব্যক্তিত্ব, নম্রতা ও মায়া-মমতার ছাঁপ! আ্লোচনার সময় তিনি একেকটা আয়াত কিংবা হাদীস উল্লেখ করে তার আলোকে আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবন কেমন হওয়া উচিৎ এবং বাস্তবে আমাদের আচার আচরণ কেমন তা যেনো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছিলেন। সাহাবা (রাঃ) দের আদর্শ জীবনের আচার আচরণের উদাহরণ টেনে তার সাথে তুলনা করছিলেন আমাদের দৈনন্দিন বাস্তব জীবনের। সে আলোচনা আমাদের সবার মধ্যে এক তীব্র অনুশোচনাবোধ এবং চেতনার জোয়ার এনেছিলো। আমরা আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে ডুকরে কাঁদছিলাম জীবনটিকে ইসলামের আলোকজ্জ্বল আদর্শে ঢেলে সাজাতে না পারার বেদনায়। কান্নাটি আমার জীবনে একটা বড়ো শিক্ষা, একটা মাইলফলক হয়ে আছে। কান্নাটি আমার চির সম্বল, চির প্রেরণা এবং পরকালের মুক্তির পাথেয়।
 
      জীবনে যতো সামনে এগুচ্ছি, পথ বাড়াচ্ছি, এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি আমার এ পথ চলা আমার এ সামনে যাওয়া কি কাউকে উপকার দিচ্ছে? যদি উপকার নাও দেয় অন্ততঃ কারও জন্য আমার এ পথচলা, এ জীবনযাপন ক্ষতির কারণ হচ্ছে না তো?
 
     একই ব্যক্তির কারণে আমি যে দ্বিতীয়বার কেঁদেছি এবং এখনো বারবার কাঁদি, সেটাও আমার চলার পথের অনুপম পাথেয়, শিক্ষা, প্রেরণা। আমার জীবন যেনো না হয় কাউকে বেদনাক্লিষ্ট করার জন্য, আমার জীবন যেনো হয় মানুষের বেদনা লাঘব করার জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য।
 
    এদুটি কান্না, এদুটি শিক্ষার জন্য আমি ব্যক্তিটির প্রতি চিরঋণী, চিরকৃতজ্ঞ।
 
   [উল্লেখ্য, চার বছরে পরিশোধের শর্তে যে ঋণ নিয়েছিলাম তা দেড় বছরের মধ্যেই পরিশোধ করতে পেরে পরম প্রশান্তি পেয়েছিলাম এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি আজও, চিরদিন। ]

  Note: Many of my well-wishers became curious to know how I managed to travel abroad for education after I had posted my story "A Telex, very brief, that changed the whole course of my life!" on August 17, 2021. This post appears in gratitude and response to such a surging interest.
--------------------------------- 
লেখকঃ ইসলামিক আর্টিকেল লেখক কলামিস্ট অনলাইন এক্টিভিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments