Recent Tube

শহীদ আবদুল মালেক একটি কালজয়ী প্রতিভার নাম"। শামীম আজাদ।



"শহীদ আবদুল মালেক একটি কালজয়ী প্রতিভার নাম"
_________________________________

  প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী প্রতিদিন রাতের আঁধার পেরিয়ে দেখা মিলে প্রভাতীর সোনালী সূর্যের। আবার সোনালী সূর্য দিনের আলো বাড়ার সাথে সাথে তার তেজদীপ্ততা বাড়াতে থাকে,আস্তে আস্তে প্রভাতের সোনালী সূর্য এসে উপস্থিত হয় গৌধুলী বেলায়। গৌধুলী বেলা পেরিয়ে পশ্চিমাকাশে অস্তমিত হয়ে রাতের আধারের আধারের আগমন বার্তা নিয়ে আসে। এভাবে পৃথিবী তার মালিকের নিয়ম অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে প্রতিনিয়ত মেনে চলছে। রাত ও দিন বেষ্টিত এই পৃথিবীর মধ্যে আগমন ঘটে নানা বিচিত্র ধরনের অনেক কিছুর,আবার অনেক কিছু হারিয়ে যায় কালের আবর্তনে। যার অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যায়না। ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীতে মাঝে মাঝে জন্ম নেয় কিছু ক্ষণজন্মা মানুষের। যারা কাল থেকে কালান্তরে হাজারো মানুষের হৃদয় জয় করে নেয়। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে প্রতিটি গোলাপের বাগানে প্রতিনিয়ত ফুটে হাজারো গোলাপ। বাগানের সব গোলাপ কিন্তু মানুষের হৃদয় আকৃষ্ট করতে পারেনা।বাগানের যে গোলাপটি সবচেয়ে বেশী প্রস্ফুটিত, সুবাসিত সেই গোলাপটিই সকলের হৃদয় কেড়ে নেয়। শুধু কি তাই!

   বাগানের মহান মালিকও সেই প্রস্ফুটিত, সুবাসিত গোলাপকে সবার আগে বেঁছে নেয়।আর সেরকম প্রস্ফুটিত, সুবাসিত একটি গোলাপের নাম শহীদ আবদুল মালেক। এটি শুধু একটি গোলাপের নাম নয়। শহীদ আবদুল মালেক একটি আন্দোলনের নাম, একটি জীবন ও একটি ইতিহাসের নাম। যিনি আজ প্রেরণার উচ্চ মীনার হিসেবে প্রেরণার প্রতিক হয়ে আছেন হাজারো যুবকের হৃদয়ে। যার প্রতিটি কর্ম পথের দিশা দিয়েছে হাজারো পথহারা তরুণ সমাজকে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ক্ষুদ্র এই ছোট্ট ভূখণ্ডে জন্ম নিয়েছে হাজারো মালেকের। শহীদ মালেক ভাই আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন এক উজ্জল নক্ষত্র হয়ে।

   " আজকে সবার কণ্ঠে ফের যার নাম, দেশের আদর্শবাদী সংগ্রামী তরুণদের মণিকোঠায় যার স্থান, বাংলাদেশে যিনি ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের ইমাম,তিনি হলেন আমাদের সকলেন প্রিয় শহীদ আবদুল মালেক ভাই।"
আজ যদি দুনিয়ার জীবন্ত জাতিসমূহের ইতিহাস পর্যালোচনা করা হয় তাহলে সাক্ষ্য মিলবে যে, তাদের অস্তিত্বের পিছনে রয়েছে একদল মানুষের জীবনাহুতি। যাদের মৃত্যুর উপর রয়েছে ঐ জাতির জীবন। একথা অস্বীকার করা যায়না যে জীবনের জন্যে মৃত্যু জীবনের চাইতে অনেক বেশী। কোন মরণাপন্ন রোগীকে বাঁচিয়ে তুলতে হলে প্রয়োজন জীবিতদের কোরবান।আজকের সম্বিতহারা মুসলিম জাতিকে বাচঁতে হলে প্রয়োজন শাহাদাতের তাজা খুন।যেদিন অগণিত শহীদের বিধবা স্ত্রীদের বিলাপ, তাদের ইয়াতিম বাচ্চাদের আর্তনাদ
আর সন্তানহারা পিতা-মাতার আহাজারী আল্লাহর আরশ কাঁপিয়ে তুলবে, সেদিনই রচিত হবে আর একটি নতুন পৃথিবীর ভিত্তিপ্রস্তর। ইক্বামতে দ্বীনের জন্যে শহীদী খুনের অপরিহার্য প্রয়োজন মিটাতে আম্বিয়ায়ে কেরামের পবিত্র রক্তে পৃথিবীর মাটি সিক্ত হয়েছে বারবার।
শহীদেরা মিল্লাতের গৌরব, দুর্যোগের রাহবার ;"As the stars that are starry in the time of our darkness ". অর্থাৎ হতাশাগ্রস্ত মুসাফিরদের জন্য তারা দিশার ধ্রুবতারা। জাতির বধির কর্ণে কানফাটা চিৎকার। শুহাদায়ে কারবালা মুজাহিদদের হৃদয়ে তাইতো সৃষ্টি করে চলছে বিপ্লবের জজবা। শহীদ মালেক ভাইয়ের শাহাদাত হাজার হাজার বিপ্লবীদের মনে সৃষ্টি করেছে শাহাদাতে খুনের জজবা।শহীদ আবদুল মালেকের খুনিরা আজ অভিশপ্ত, ঘৃণিত এবং পরাজিত। জাতি তাদের ঘৃণাভাবে প্রত্যাখান করেছে।

 জন্মকথাঃ

 নাম: আবদুল মালেক
 পিতা: মরহুম  মৌলভী মোহাম্মদ আলী।
মাতা: মরহুমা মোছাম্মত ছাবিরুন নেছা।
জন্মস্থান: গ্রাম-খোকসাবাড়ি (স্থানীয় নাম বগা), থানা- ধুনট, জেলা-বগুড়া।
জন্ম তারিখ: মে ১৯৪৭ ইং।

   পারিবারিক পরিচিতি: ৫ ভাই ১ বোন। ভাইদের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ, বোনটি ছোট। ভাইয়েরা হলেন- মৃত ক্বারী মো: আবদুল রশিদ, মুন্সী মো: আবদুল কাদের, ডা. মো: আবদুল খালেক, মাস্টার আবদুল বারী মুন্সী, বোন আয়েশা খাতুন।

  পড়াশুনাঃ

  পাঁচ বছর বয়সে তার পিতা তাকে খোকসাবাড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। সাধারন ছেলেদের চাইতে তিনি ছিলেন একটু ব্যতিক্রম। শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রতিদিন নতুন কিছু না শিখে বা না জেনে তিনি কোনদিনই বাড়ী ফিরতেননা। তাই সব শিক্ষক তাকে স্নেহের সাথে দেখতেন। খোকসাবাড়ী প্রাইমেরী থেকে কৃতিত্বের সাথে পাশ করার পর তার বাবা খোকসাবাড়ী হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। ইতোমধ্যে তিনি জুনিয়র স্কলারশিপ পান এবং অষ্টম শ্রেনি কৃতিত্বের সাথে পাশ করার পর তিনি এবার বগুড়া শহরে চলে আসেন। শহরে এসে আর্থিক অসচ্ছলতার কারনে তিনি লজিং এ ওঠেন। কিছুদিন পর লজিং ছেড়ে স্কুল ছাত্রাবাসে চলে আসেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সের টগবগে কিশোর। সবুজ-শ্যামল গাঁয়ের মায়া কাটিয়ে মা বাবা ও ভাই-বোনের আদরের জাল ছিন্ন করে সে শহরের বুকে দিন কাটায়। কি দুরন্ত সাহস আর হিম্মত তার বুকে! ভাবতে অবাক লাগে ! বগুড়ায় স্কুলে ভর্তি হতে এসে বাড়ীতে চিঠিতে লিখেছেন-" বাড়ীর কথা ভাবিনা,আমার আশা শুধু এক উদ্দেশ্য
খোদা যেন আমার উদ্দেশ্য সফল করেন। কঠিন সংকল্প নিয়ে এসেছি এবং কঠোর সংগ্রামে অবতীর্ণ, দোয়া করবেন খোদা যেন সহায় হন।আমি ধন-সম্পদ কিছুই চাইনা,শুধুমাত্র যেন প্রকৃত মানুষরূপে জগতের বুকে বেঁচে থাকতে পারি।" ছোট্ট পোষ্টকার্ডে এক অসাধারন কিশোরের কয়েকটি কথা। কি বলিষ্ঠতা তার বিশ্বাসে ! সংগ্রামী এই কিশোর জীবন সংগ্রামে একে একে সফল হতে চলেছেন। বগুড়া জেলা স্কুলেও তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন এবং ১৯৬৩ সালে এস এস সি তে রাজশাহী বোর্ডে একাদশ স্থান অধিকার লাভ করেন।কিন্তু এই সময়ে তার উপর নেমে এক কঠিন বিপদ। পিতৃ স্নেহ থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়ে পড়েন তিনি। এরপর থেকে বিধবা মায়ের ছায়াই হয় তার একমাত্র সম্বল। এস এস সি এর পর তিনি রাজশাহী কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। কলেজে আসার পর ইসলামী ছাত্রসংঘের দাওয়াত লাভ করেন। এরপর থেকে তিনি ছাত্রসংঘের কাজ পুরোপুরি আরম্ভ করেন। তিনি ছাত্রদের মধ্যে ইসলামী জ্ঞান প্রসারের জন্য অনেক সাধনা করে একটি পাঠাগার স্থাপন করেন। রাজশাহী কলেজ থেকে HSC তে চতুর্থ স্থান অর্জন করেন।
HSC পাশের পর এবার তিনি ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে Bio-chemistry বিভাগে ভর্তি হন।

 তাঁর শিক্ষক: 

   মায়ের কাছে প্রাথমিক ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ, হাজী দারেস আলী-খোকসাবাড়ি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক, মাস্টার আবদুল জলিল, মৌলভী আবু বকর, ড. কামাল হোসন তৎকালীন ঢা. বি'র বায়ো-কেমিস্ট্রির চেয়ারম্যান, শামসুদ্দিন সহ. হেডমাস্টার বগুড়া জেলা স্কুল, দারেস আলী মাস্টার ও নাজির হোসনে গোসাইবাড়ি স্কুলের হেডমাস্টার।

  তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধ: 

  সংশয়ের আবর্তে আমাদের জীবন, আধুনকি বিশ্ব, প্রত্যয়ের আলোকে আমাদের জীবন, ধর্ম ও আধুনিক চিন্ত্মাধারা। এছাড়াও তৎকালীন জাতীয় ও আন্ত্মর্জাতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখছেন।

 অবসর মুহূর্তে: 

  বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতা, সাহিত্যিকদের জীবনী পড়তেন। খাবার সময় ছাড়া তাকে পড়ার টেবিলে পাওয়া যেত।

 তাঁর প্রিয় ব্যক্তিত্ব: 
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)।

 শখ: 
 টাকা জমিয়ে বই কেনা, পত্রিকা পড়া।

 পোশাক: সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী।

 দায়িত্বশীল হিসেবে শহীদ আবদুল মালেকঃ
------------------------------
   ঢাকায় আসার পর তার উপর অর্পিত হয় সংঘের গুরুদায়িত্ব। প্রথমে ঢাকা শহর দপ্তর সম্পাদক ও পরে সাধারন সম্পাদক। সর্বশেষ ঢাকা শহর সভাপতি ও পরে নিখিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। শহীদ মালেক ভাই এতবেশী পরিশ্রমী ও কঠোর অধ্যবসায়ী ছিলেন যে,তিনি সকল ব্যস্ততার মাঝেও ইসলাম, ইসলামী দর্শন ও আন্দোলন সম্পর্কে ব্যাপক অধ্যয়ন করতেন। হাজারো দায়িত্বের মাঝেও তার পড়াশুনা চলেছে অব্যাহত গতিতে।
শহীদ মালেক ভাই প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন কর্মীদের। সে ভালোবাসা ছিল নিখাদ ও নিঃস্বার্থ।

    জনাব ইবনে মাসুম লিখেছেন-"তিনি ছিলেন তাদের দুঃখ - বেদনার সাথী। তার এই আন্তরিকতার জন্য অনেক কর্মীর মাঝে তিনি ছিলেন অভিবাভকের মতো। কর্মীর যোগ্যতাকে সামনে রেখে উপদেশ দিতেন।ভাবতে অবাক লাগে প্রতিটি কর্মী সম্পর্কে তিনি নোট রাখতেন। প্রতিটি কর্মী ব্যাপারে নিজের ধারণা লিখা থাকতো তার ডায়েরীতে। এমনিভাবে ভাবতেন তিনি কর্মীদের নিয়ে। ফলে কর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় মালেক ভাই,একজন অভিবাভক, একজন নেতা। "
  নুর মুহাম্মদ মল্লিক ভাই লিখেছেনঃ "সারাদিন কাজ করে রাতের বেলায় তার নিজর হাতে ক্লান্ত শরীরে সেই একমাত্র পাজামা আর পাঞ্জাবী ধোয়া রুটিন মাপিক কাজের অংশ ছিলো। কোন এক রাতে সেটি ধোয়া সম্ভব হয়নি বলে সকালে ধোয়া পাঞ্জাবী আধা ভেজা অবস্থায় গায়ে জড়িয়ে মালেক ভাই গিয়েছিলেন মজলিসে শূরার বৈঠকে। মালেক ভাইয়ের পোশাক যেমন সাধাসিধে ছিল, দিলটাও তেমন শুভ্র মুক্তার মত ছিল। প্রাণখোলা অমায়িক ব্যবহার সকলকে মুগ্ধ করতো। এটি ছিল তার চরিত্রের আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। " আর তিনি সকল প্রতিকূলতাকে সহজে জয় করে নিতে পারতেন।
ভাষা সৈনিক মরহুম অধ্যাপক আযম স্যার লিখেছেন-"শহীদ আবদুল মালেক তরুণ বয়সে এমন এক উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন যা এদেশে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে চিরদিন প্রেরণা যোগাবে।এতগুলো গুণ একজন ছাত্রের মাঝে একসাথে বিদ্যমান থাকা তা খুব বিরল।একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে শিক্ষক ও ছাত্র মহলে তার সুখ্যাতি সত্ত্বেও তার নিকট ছাত্র জীবন থেকে আন্দোলনের জীবনই বেশী প্রিয় ছিল। যথাসম্ভব নিয়মিত ক্লাসই যেন তার জন্য যথেষ্ট ছিল।ক্লাসের বাইরে তাকে ইসলামী আন্দোলনের চিন্তা-ভাবনা ছাড়া আর কোন আলোচনায় তাকে তেমনটা দেখা যেত না।তার সহপাঠী ও সহকর্মীরা তাকে পরীক্ষায় ভালো করার দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিলে তিনি মৃদ্যু হেসে বলতেন, বেঁচে থাকার ডিগ্রী নিতে হবে যাতে আমার আয়-রোযগারের একটা পথ হয় কিন্তু এটাকে জীবনের চরম লক্ষ্য বানিয়ে নিতে চাইনা। খুব ভালো রেজাল্টেরর ধান্ধা করলে ক্যারিয়ার গড়ে তোলার নেশায় পেয়ে বসার আশংকা আছে।"
শহীদ কামারুজ্জামান ভাই লিখেছেন- "রাতে ঘুমানোর আগে দেখতাম মালেক ভাই ইংরেজী একটি ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছেন। আবার কিছু কিছু নোট করছেন। তিনি মাসিক পৃথিবীতে চলমান বিশ্ব পরিস্থিতির উপর লিখতেন। বুঝলাম সে লেখার জন্য মালেক ভাই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তখন থেকে বিদেশী ম্যাগাজিন পড়ার জন্য আমার মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়।মালেক ভাইয়ের অনেক স্মৃতি আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়"। শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা, শহীদ কামারুজ্জামান, শহীদ আবদুল মালেক রা রাসূলে কারীম সঃ
ও সাহাবায়ে কেরামের দেখানো পথে চলতে গিয়ে নিজের জীবনকে কোরবান করে দিয়েছেন। তারা আজ পৃথিবীর সকল মানবের জন্য প্রেরণার উৎস্য।শহীদ আবদুল মালেক ভাই তিনি তার চিঠিতে নিঃস্বার্থ ও নিমোর্হ সিদ্ধান্তের কথাই উল্লেখ করে বলেন-"বাইরের পৃথিবীতে যেমন দ্বন্দ্ব চলছে তেমনি আমার মনের জগতের মধ্যেও চলছে নিরন্তর সংঘাত। আমার জীবনে আমি খুঁজে নিতে চাই এক কঠিন পথ, জীবন -মরণের পথ।বৃহত্তর কল্যাণের পথে সে বন্ধনকে ছিঁড়তে হবে। কঠিন শপথ নিয়ে আমার পথে আমি চলতে চাই। দোয়া করবেন। সত্য প্রতিষ্ঠার এ সংগ্রামে যেন আমার জীবনকে শহীদ করে দিতে পারি।আমার মা এবং ভাইরা আশা করে আছেন আমি বড় কিছু হতে যাচ্ছি।কিন্তু মিথ্যা সে সব আশা। আমি বড় হতে চাইনে, আমি ছোট থেকেই স্বার্থকতা পেতে
চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র হয়ে যদি
বিলেত ফিরে যদি বাতিলপন্থিদের পিছনে ছুটতে হয় তাতে লাভ কি?। "শহীদ মালেক ভাইয়ের শাহাদাতের তামান্না খুঁজে পাওয়া যায় তার মাকে দেওয়া চিঠিতে তিনি বলেনঃ"জানি,আমার কোন দুঃসংবাদ শুনলে মা কাঁদবেন। কিন্তু উপায় কি বলুন? বিশ্বের সমস্ত শক্তি আল্লাহর দেয়া বিধানকে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে।আর আমরা মুসলমান যুবকরা বেঁচে থাকতে তা হতে পারেনা। হয় বাতিলের উৎখাত করে সত্য প্রতিষ্ঠা করবে নচেৎ সে চেষ্টায় আমাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে। আপনারা আমার জন্য প্রাণভরে দোয়া করুন,জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে যেন বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারি। কারাগারের নিরন্দ্র অন্ধকার, সরকারি যাতাঁকলের নিষ্পেষণ আর ফাঁসির মঞ্চ যেন আমাকে ভড়কে দিতে না পারে।"
১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার নতুন একটি শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এরপর গঠিত শিক্ষা কমিশন একটি শিক্ষানীতিও ঘোষণা করে।ঘোষিত শিক্ষানীতির মধ্যে কিছু ক্রটি-বিচ্যুতি থাকলেও এতে ইসলামী আদর্শের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।কিন্তু সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাদিরা তা সহ্য করতে পারেনি। তারা তা বাতিলের দাবি জানায়। এমনি প্রেক্ষাপটে শিক্ষা ব্যবস্থার আদর্শিক ভিত্তি কি হবে তা নিয়ে জনমত জরিপের আয়োজন করা হয়, তার অংশ হিসেবে ৬৯সালের ২রা আগষ্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপা (NIPA) (বর্তমান ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ) ভবনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।এতে মালেক ভাই মাত্র ৫ মিনিট বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পান। মহান রবের শোকরিয়া মালেক ভাইয়ের অসাধারন যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যে মূহুর্তের মধ্যে পুরো সভার মোটিভ পরিবর্তন হয়ে যায়।তিনি সকলের চিন্তারাজ্যে বিপ্লবের তুপান সৃষ্টি করেন। শিক্ষা ব্যবস্থার আদর্শিক ভিত্তি কি হবে তা তিনি তার বক্তব্যে অত্যন্ত চমৎকার ভাবে তুলে ধরেন সেদিন তার নিম্নরূপঃ-
"Pakistan must aim at ideological unity, not at ideological vacuum, it must impart a unique and integrated system of education which can impart a common set of cultural values based on the precepts of islam. We need common set of cultural values, not one set of cultural values ".
সেদিন উপস্থিত শ্রোতা, সুধিমণ্ডলী এবং নীতিনির্ধারকরা শহীদ আবদুল মালেকের বক্তব্যের সাথে ঐক্যমত পোষণ করে। অন্যদিকে Secular রা মালেক ভাইয়ের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।আদর্শের লড়াইয়ে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ বাদীরা পরাজয় বরণ করে।পরাজয়বরণ কারীরা আরেকটি হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ডাক'সুর নামে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার পক্ষে প্রস্তাব পাশ করার জন্য ১২ই আগষ্ট আবার ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনে আরেকটি সেমিনার করে।এতে মালেক ভাই সহ কয়েকজন ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার উপর কথা বলতে চাইলে তারা কথা বলতে দেইনি। সেমিনারের এক পর্যায়ে বামপন্থি এক ছাত্রনেতা ইসলামী শিক্ষাকে কটাক্ষ করে এমন বক্তব্য দেয় এতে উপস্থিত শ্রোতারা এর তীব্র বিরোধীতা করে ইসলামী শিক্ষার পক্ষে স্লোগান দিতে শুরু করে। ফলে বাম-রামরা ক্ষিপ্ত হয়ে ছাত্রদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।মালেক ভাই সন্ত্রাসীদের হাত থেকে ছাত্রদের উদ্ধার করে সবাইকে নিরাপদে পাঠিয়ে দেন। এরপর মালেক ভাই একা রেসকোর্স ময়দান দিয়ে (বর্তমান সোওরাওয়ার্দী উদ্যান)হেঁটে তার হলের দিকে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আগে থেকে ওৎপেতে থাকা সন্ত্রাসীরা সহজ -সরল মালেক ভাইকে প্রচণ্ড মারপিট করে শুইয়ে দিয়ে মাথার মধ্যে চার/পাঁচটি পেরেক ঢুকিয়ে দেয়। সন্ত্রাসীরা মালেক ভাইকে ফেলে চলে যায় পরে মানুষ এসে তাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠায়। মহান এই মানুষটি তিন-চার দিন হাসপাতালের বেডে চটপট করে ১৫ই আগষ্ট শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন।তার শাহাদাতের খবরে পুরো জাতি কেঁদেছে।জাতির এই মহান নেতার বিদায়ে মরহুম শেখ মজিবুর রহমান সহ সকল জাতীয় নেতৃবৃন্দ গভীর নিন্দা ও শোক জানিয়েছেন। আজও বিচার হয়নি শহীদ আবদুল মালেকের খুনীদের। খুনীরা (মন্ত্রী তোফায়েল, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু) আজ রাষ্ট্রীয় যন্ত্রে বসে বড় গলায় কথা বলছে। হে আল্লাহ তুমি তাদের কর।আজ মুসলমান যুবকদের জন্য শহীদ আবদুল মালেক এর জীবনী সবচেয়ে বড় নসিহত। কিভাবে তুমি বসে আছ? তুমি মালেক ভাইয়ের জীবনী শুননি,পড়নি?আজ মালেক ভাইয়ের উত্তরসূরী হিসেবে তোমাদেরকে দায়িত্ব নিতে হবে এদেশের পথহারা তরুণদের কাছে ইসলামের সুমহান দাওয়াত পৌছিয়ে দেওয়ার। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুন।
পরিশেষে,তার দেখানো স্বপ্ন, আগামী বিপ্লবের আকাঙ্খা আজো আন্দোলিত করে ৫৬হাজার বর্গমাইলের এই জনপদকে।শহীদ মালেক ভাই আজো জেগে আছে সবুজ ঘাসের শিশিরে আমাদের বিশ্বাসের বিশ্বাসে চিরকালের আশা জাগিয়ে বাতিঘর হয়ে।
"মালেকের স্বপ্নেরা খেলা করে রাতের আঁধার কালিমা চিরে শিখারির বুলেটে আহত পাখি।থামেনা তো হায়, উড়ে যায় নীড়ে।চাঁদের টানে জোয়ার আসে।নদীর দু-কূল ধুয়ে হাজার প্রাণে মালেক আসে বিপ্লবী সুর ছুঁয়ে।"

 শাহাদাতের তারিখ: 

১২ আগস্ট রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আহত হন। ১৫ আগস্ট ১৯৬৯ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালে শাহাদাত বরণ করেন। (আল্লাহপাক তাঁকে কবুল করুন)।

  জানাযার স্থান: 

     প্রথম বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে দ্বিতীয়বার কমলাপুর রেল স্টেশনে তৃতীয়বার ধুনটে। জানাযায় ইমামতি করেন মাওলানা সৈয়দ মাহমুদ মোস্তফা আল মাদানী। জানাযার পূর্বে মাওলানা আবদুর রহীম বক্তব্য রাখেন।

 কবরস্থান: খোকসাবাড়ি, বগুড়া।

  স্মরণীয় উক্তি: 
  'কঠিন শপথ নিয়ে আমার সংগ্রামের পথে আমি চলতে চাই আশীর্বাদ করেন, সত্য প্রতিষ্ঠার এ সংগ্রামে যেন আমার জীবনকে আমি উৎসর্গ করে দিতে পারি।'
--------------------------------- 
লেখকঃ ইসলামিক আর্টিকেল লেখক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments