Recent Tube

সলেমান পুর জ্বললে কি আর ওঝার মন্ত্রে কাজ হয়! ওহিদুল ইসলাম।

  সলেমান পুর জ্বললে কি আর  ওঝার মন্ত্রে কাজ হয়! !!?? 
----------------------------

  ওরে আমার জ্বলে গেলো রে। ওরে তোরা কিডা কনে আছিস আমার বাঁচা। আমার সব জ্বলে গেলো।“ মাটির ঘরের মেঝেই শুয়ে দাপাদাপি করে চিৎকার দিয়ে কথাগুলো বলছিলো ইছেপুরে মফিজ। দিব্যি ভালো মানুষ সাত সকালে এভাবে ছটফট করে চিকরাচ্ছে দেখে উঠোনের চারিদিক থেকে বাড়ির অন্যান্যরা ঝড়ের বেগে ছুটে এসে জড়ো হলো মফিজের চারিপাশে। “এই তুই ঐরাম চিকরোচ্ছিস ক্যান? তোর কি হয়েছে?” – জিজ্ঞেস করলো বাড়ির বড়চাচা ছবদুল। “ওগো আমার জ্বলে গেলো। ওরে আমার সব জ্বলে যাচ্ছে”, মফিজের একই চিৎকার আর হাতপা দাপাদাপি।

   কয়েকজন ছেলে সাহস করে মফিজের কাছে এগিয়ে গিয়ে তার হাতপা ঠেসে ধরলো। বাড়ির মহিলাদের কেউ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তালের পাখা দিয়ে বাতাস দেয়, কেউ মফিজের মাথায় তেল-পানি ঢালে। ছেলেদের কেউ কেউ তার গা-হাত-পা টিপতে লাগে। কিছুতেই কিছু হয়না। মফিজের দাপাদাপি আর চিৎকার আরও বেড়ে যায়। আজ যেনো অসুরের শক্তি ভর করেছে মফিজের গায়ে। এতোগুলো মানুষ কেউ তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। এতো চেষ্টা করেও কেউ তাকে শান্তি দিতে পারছে না, শান্ত করতে পারছে না। কি হলো মফিজের? “ওরে আমার সব জ্বলে গেলো”, গলা ফাটিয়ে সেই একই চিৎকার মফিজের। 

  “ওগো ওর মনে হয় সাপে কেটেছে। তোমরা যতো দেরি করবা ততো বিষ সারা গায়ে ছড়িয়ে যাবে। জ্বলা বন্ধ হবেনা। দেরি করলে জ্বলা বেড়ে যাবে। এই আব্দুল হা করে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস? যা দৌড়িয়ে গিয়ে ওপাড়ার তক্কেলের ডেকে নিয়ায়। তক্কেলের মতো ওঝা এই দিগরে নেই। ওই পারবে মফিজির বিষ নামাতি। যা তাড়াতাড়ি তক্কেলের নিয়ায়।“ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাড়ার মজিদ মাতব্বরের নির্দেশে আব্দুল সাইকেল হাকিয়ে দ্রুত চলে গেলো ওপাড়ার তক্কেলের বাড়ি। তক্কেল ততোক্ষনে লাঙ্গল-গরু নিয়ে দক্ষিণ মাঠে। আব্দুল অগত্যা হাঁপাতে হাঁপাতে সেখানে গিয়ে হাজির। “আচ্ছা তা কউদিনি, আরেকটু সকালে আসলি তো আমি লাঙ্গল নিয়ে মাঠে না এসে আগে মফিজির কাছে যাতি পারতাম। এখন লাঙ্গল শুরু করিছি তা পাই না তুলে তো যাতি পারবো না! তুমি বাড়ি যাও আমি কোনো মতে তাড়াতাড়ি পাই তুলে একঘন্টার মধ্যি চলে আসবানে।“ তক্কেলের কথায় আব্দুল সন্তুষ্ট হতে পারলো না। সে যা দেখে এসেছে তাতে একঘন্টা দেরি করলে মফিজ বাঁচবেনা। 

  “না চাচা তোমার ওই পাই তুলতি গেলি মফিজ বাঁচবে না। তুমি লাঙ্গল থামাও। গরু দুটো গাছে বেঁধে এখনই আমার সাথে চলো। মফিজির বিষ নামিয়ে তারপর এসে আবার লাঙ্গলের পাই শেষ করতি পারবানে“, আব্দুল নাছোড় বান্দা হয়ে চলন্ত লাঙ্গল-গরুর পেছনে তক্কেলের কোমর জড়িয়ে ধরলো। উপায়ান্তর না পেয়ে লাঙ্গল থামিয়ে গরু দুটো একটা গাছে বেঁধে আব্দুলের সাথে তক্কেল ছুটে গেলো মফিজের বাড়ির দিকে। বাড়ির সীমানায় পৌঁছেই তক্কেল শুনতে পেলো মফিজের গগণ বিদারী চিৎকার, “ওরে আমার জ্বলে গেলো রে, আমার জ্বলে গেলো”। 

   মফিজের চারিপাশে একবার ঘুরেফিরে তাকে ভালো করে পরোখ করে নিলো তক্কেল। এরপর মফিজের সামনে বসে তক্কেল বাড়ির লোকদেরকে নির্দেশ দিলো কাঁসার বাটিতে একবাটি দুধ আর একটি বড়ো সাইজের কাঁসার থালা দ্রুত যোগাড় করে দিতে। এই আরেক ঝামেলা বাঁধলো। তন্নতন্ন করে পাড়ার কোনো বাড়িতে কাঁসার থালাবাটি মিললো না। “ওগো এদিক ওদিক ঘুরাফেরা করে তোমরা খালি সময় নষ্ট করোনা। আজকাল কি আর কেউ বাড়ি কাঁসার বাসন কোসন রাখে? কন্টোই তোমরা কাঁসার জিনিস পাবানা। খুঁজতি খুঁজতি তোমরা হয়রান হয়ে যাবা আর ওদিকি মফিজ মারা যাবে। তাও কন্টোই কাঁসার থালবাটি পাবানা। কাঁসার জিনিস পাতি হলি হয়াত পুর ঘোষ বাড়ি যাও। পালি ওকেনেই পাতি পারো। ঘোষেরা এখনো কাঁসার বাসন ব্যবহার করে”। এক নাগাড়ে বললেন পাড়ার আরেক মুরুব্বী ছইরদ্দী। 

   মফিজের ছটফটানি আর “ওরে আমার জ্বলে গেলো” চিৎকারে বিরাম নেই। এদিকে বেলা গড়িয়ে প্রায় বিকেল এমন সময় ঘোষবাড়ি থেকে এলো কাঁসার থালাবাটি। ঘোষেরা বাটি ভরে দুধও দিয়েছে। তক্কেল মফিজকে পা লম্বা করে বসানোর নির্দেশ দিলো। মফিজকে বসানো বড়ো দায়। পাঁচ-ছয় জন শক্তিশালী ছেলে শক্ত করে ধরে মফিজকে বসিয়ে দুইজন তাকে পেছন থেকে পিঠ সোজা করে রাখলো আর চার জনে দুই পা লম্বা করে মেঝের সাথে ঠেসে রাখলো। তক্কেল দুধের বাটিটা মফিজের দুই পায়ের মাঝে রাখলো আর কাঁসার থালাটি দুজনের হাতে দিয়ে শরীরের পুরো বল প্রয়োগ করে মফিজের পিঠে ঠেসে ধরতে বললো। এরপর তক্কেল গানের সুরে কি যেনো মন্ত্র পড়তে পড়তে মফিজের চারিদিকে চক্রাকারে দ্রুতবেগে ঘুরতে লাগলো। 

   এভাবে প্রায় একঘন্টা কেটে গেলো। তক্কেল হাঁপাচ্ছে। মফিজকে যারা ধরে রেখেছে তারাও ক্লান্ত। মহিলারা তালপাতার পাখায় বাতাস অব্যাহত রেখেছে তারপরও সবাই ঘামছে। মফিজের ঐ একই চিৎকার “ওরে আমার জ্বলে গেলো। ওরে তোরা আমার ঠান্ডা কর আমার সব জ্বলে গেলো”। তক্কেল বলেই ফেললো, “কতো মারাত্মক সাপে কাটা রুগী দেখলাম জীবনে। আধঘন্টার মধ্যি বিষ নামিনি আমার জীবনে এই প্রথম ঘটনা। মফিজির সাপে কামড়ালো কনে যে বিষ এখনো নামছেনা!” মফিজের হাত-পা এবং সারা শরীর এখন সবাই মিলে ঠেসে ধরে রেখেছে। তাই সে ছটফট করতে পারছে না। কিন্তু মুখ তার বন্ধ হচ্ছে না। আবার চিৎকার দিয়ে বললো, “আমার জ্বলে গেলো রে আমার জ্বলে গেলো। তোরা আমার ঠান্ডা কর রে আমার জ্বলে গেলো”। 

   গ্রামের চানমিয়া এগিয়ে এসে বলে, “এই মফিজ, তক্কেল হলো এই এলাকার সবচে’ নামকরা ওঝা। এমন কোনো তা’বড়ো সাপে কাটা রুগী নেই যার বিষ তক্কেল নামাতি পারিনি। তুই এখনো কচ্ছিস জ্বলে গেলো জ্বলে গেলো। তা বল দিন দেখি তোর কনে জ্বলে গেলো?” মফিজের আবার চিৎকার ওরে আমার জ্বলে গেলো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নবিছদ্দি অতিষ্ট হয়ে ধমক দিয়ে বলে, “এই মফিজ তোর বলতি হবে তোর কনে জ্বলে গেলো। তালি তক্কেল সেইভাবে তোর বিষ নামাবে। বল তো তোর কনে জ্বলছে”? মফিজ এবার আরও চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো, “ওরে আমার সলেমানপুর জ্বলে গেলো রে, আমার সলেমান পুর জ্বলে গেলো”। তক্কেল অবাক হয়ে কানাঘুষা করে পাশের একজনকে জিজ্ঞেস করলো, “সলেমানপুর জ্বলে গেলো তার মানেডা কি গো?” লোকটা তক্কেলের কানের কাছে মুখ নিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, “শুনছি গত কয়মাস যাবত মফিজির উপর ছইরন বেগম নামের সলেমানপুর গ্রামের কানাই মন্ডলের মেয়ের দিষ্টি পড়েছে। সে মেয়ের নাকি আবার অন্য জাগায় বিয়ের কথাবার্তা চলছিলো”। “ও আচ্ছা, তাই কও। তালি সলেমান পুর জ্বললি ও বিষ আমি কিরাম করে নামাবো?” বলতে বলতে তক্কেল মাঠের দিকে চলে গেলো আর মফিজ অবিরাম চিৎকার দিতে লাগলো, “ওরে আমার জ্বলে গেলোরে আমার সলেমান পুর জ্বলে গেলো”।

Post a Comment

0 Comments