Recent Tube

সর্বশেষ ও চূড়ান্ত আসমানী গ্রন্থ কুরআন মাজীদের হকঃ মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।


সর্বশেষ ও চূড়ান্ত আসমানী গ্রন্থ কুরআন মাজীদের হকঃ
-----------------------------

 ইসলাম একটি পরিপূর্ণ ও গতিশীল জীবন ব্যবস্থার নাম। নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত যেমন ফরজ তেমনি উপার্জন নীতি, ব্যয়নীতি, ব্যাংকনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, যুদ্ধনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি ও বিশ্বনীতি সহ সকল নীতিই কুরআন মুতাবেক পরিচালনা করা ফরজ। আল কুরআন আমাদের জীবন বিধান। যার মধ্যে মানবজীবনের সম্ভাব্য সকল সমস্যার সমাধান নিহিত। কিন্তু আমরা যথাযথভাবে কুরআনের হক আদায় না করার কারণে কুরআন নিঃসৃত বিধিবিধান থেকে বঞ্চিত ও পাপিষ্ঠ হচ্ছি। আমি সংক্ষেপে কুরআন মাজীদের হকের উপর আলোচনা করছি।

 ১. কুরআন মাজীদের উপর ঈমান আনাঃ
কুরআন মাজীদের প্রথম ও প্রধান হক হলো, এ কিতাবের উপর ঈমান আনা। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, وَآمِنُوا بِمَا أَنْزَلْتُ. আমি যা (কুরআন) নাযিল করেছি তার প্রতি তোমরা ঈমান আন।" (সূরা বাকারা ২/৪১)
তিনি আরো বলেন, 
قُولُوا آمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنْزِلَ إِلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَىٰ وَعِيسَىٰ وَمَا أُوتِيَ النَّبِيُّونَ مِنْ رَبِّهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ.
তোমরা বল, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর উপর এবং যা নাযিল করা হয়েছে আমাদের উপর ও যা নাযিল করা হয়েছে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের সন্তানদের উপর আর যা প্রদান করা হয়েছে মূসা ও ঈসাকে এবং যা প্রদান করা হয়েছে তাদের রবের পক্ষ হতে নবীগণকে। আমরা তাদের কারো মধ্যে তারতম্য করি না। আর আমরা তাঁরই অনুগত’। (সূরা বাকারা ২/১৩৬)

 ২. বিশুদ্ধ ভাবে কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করাঃ
ঈমানের পর কুরআনের দ্বিতীয় হক হলো, সহীহ শুদ্ধভাবে তিলাওয়াত করা।
وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا
সুস্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে, সুন্দর করে কুরআন আবৃত্তি কর। (সূরা মুযাযম্মিল ৭৩/০৪)

 ৩. কুরআন মাজীদের অর্থ বুঝা ও গবেষণা করাঃ
 কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য হলো যেন মানুষেরা তা বুঝে, চিন্তা গবেষণা করে এবং তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করে। সুতরাং কুরআন মাজীদের গুরুত্বপূর্ণ হক বা দাবি হলো, কুরআন বুঝা ও গবেষণা করা। আল্লাহ তা'আলা শপথ করে বলেন:
ص ۚ وَالْقُرْآنِ ذِي الذِّكْرِ.
সোয়াদ; কসম উপদেশপূর্ণ কুরআনের। (সূরা সোয়াদঃ ৩৮/০১)
كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَتَفَكَّرُونَ.
অনুরূপ ভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা গবেষণা কর। (সূরা বাকারাঃ ২/২৬৬)
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ.
আর আমি তো কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য। অতএব কোন উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি? (সূরা কামারঃ৫৪/১৭, ২২, ৩২, ৪০)

 অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:
كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ.
আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা সোয়াদঃ ৩৮/২৯)

 যারা কুরআন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে না, তাদের ধমক দিয়ে মহান আল্লাহ তা'আলা বলেন, 
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا.
তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা- ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ? (সূরা মুহাম্মাদঃ ৪৭/২৪)

  ৪. কুরআন মাজীদের অনুসরণ করাঃ
পবিত্র কুরআন আল্লাহ তা'য়ালার বাণী ও বিধান। আর মহান আল্লাহ তা'য়ালা আমাদের এবং সমগ্র বিশ্ব সৃষ্টির একমাত্র মালিক, মাবুদ, ইলাহ ও রব। আল্লাহ তা'য়ালার এই সাম্রাজ্যে আমরা স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী নই, কারোর অধীনও নই এবং আল্লাহ ছাড়া আমাদের ইবাদত, বন্দেগী, পূজা, দাসত্ব ও আনুগত্য লাভের অধিকারও আর কারোর নেই। সুতরাং আমাদের দায়িত্ব হলো, আল্লাহ তা'য়ালা আমাদের জন্য যে কিতাব বিধান স্বরূপ পাঠিয়েছেন সেই বিধানের অনুসরণ করা, এটা কুরআন মাজীদের মূল উদ্দেশ্য। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, 
اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ ۗ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ.
তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে (বিধান স্বরূপ) যা নাযিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকের অনুসরণ করো না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর। (সূরা আ'রাফ ৭/০৩)
 
  ৫. সামগ্রিক ভাবে কুরআন মাজীদের বিধান বাস্তবায়ন করাঃ
কুরআন মাজীদের যথাযথ ভাবে হক আদায়ের সর্বশেষ ও চূড়ান্ত কর্মপন্থা হলো, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে কুরআনের বিধান বাস্তবায়ন করা। কারণ এটিই কুরআন নাযিলের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, 
إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ. 
নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি যথাযথভাবে কিতাব নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষের মধ্যে বিচার ফয়সালা কর সে অনুযায়ী যা আল্লাহ তোমাকে দেখিয়েছেন।" (সূরা নিসা ৪/১০৫) 

 আল্লাহ তা'য়ালা আরো বলেন , 
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ...الظَّالِمُونَ... الْفَاسِقُونَ.
"আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তার মাধ্যমে যারা বিচার ফয়সালা করবে না, তারাই কাফির, জালিম, ফাসিক।" (সূরা মায়িদা ৫/৪৪, ৪৫, ৪৭)

  অনেকেই মনে করেন, কুরআনের বিধান রাষ্ট্রীয়ভাবে বাস্তবায়ন করা শুধুমাত্র শাসকদের কাজ। তাই যে সকল শাসক কুরআনের বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করবে না তারা তারা পাপী হবেন এবং এর জন্য কেবলমাত্র সেসব জালিম শাসকরাই আযাব ভোগ করবেন। সুতরাং এর দায়ভার আমাদের নেই। অথচ আল্লাহ তা'য়ালা নিজেই বলেন,
وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً ۖ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ.
আর তোমরা সেই ফিতনা (আযাব) কে ভয় কর  যা তোমাদের মধ্য থেকে বিশেষভাবে শুধু জালিমদের উপরই আপতিত হবে না। আর জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ আযাব প্রদানে খুবই কঠোর। (সূরা আনফাল ৮/২৫)

  সুতরাং কেউ যদি মনে করে, কুরআন না বুঝে পড়াই কুরআনের হক আদায়ের জন্য যথেষ্ট, তাহলে সে শুধু পাপী নয় বরং কাফির হয়ে যাবে। কারণ কুরআন সহীহ ভাবে তিলাওয়াত করার পাশাপাশি কুরআনের প্রতি ঈমান ঈমান, কুরআন বুঝা, ব্যক্তিগত ভাবে কুরআনের বিধান মানা এবং সামষ্টিক ভাবে কুরআনের বিধান বাস্তবায়ন করাও ফরজ।

  আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
سَيَكُونُ بَعْدِي مِنْ أُمَّتِي قَوْمٌ يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لَا يُجَاوِزُ حُلُوقَهُمْ يَمْرُقُونَ مِنْ الدِّينِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنْ الرَّمِيَّةِ. 
  অচিরেই আমার পর আমার উম্মাত থেকে এমন কাওম আবির্ভুত হবে - যারা কুরআন পাঠ করবে কিন্তু কুরআন তাদের কন্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা দ্বীন (ইসলাম) থেকে বেরিয়ে যাবে যেমন নিক্ষিপ্ত তীর ধনুক থেকে বেরিয়ে যায়। (সহীহ মুসলিম হাঃ ১০৬৭, ইবনে মাজাহ হাঃ ১৭০, মুসনাদে আহমদ হাঃ ২১০২১, সুনান দারেমী হাঃ ২৪৩৪; আরো দেখুন সহীহ বুখারী হাঃ ৩৩৪৪, ৩৬১০, ৪৩৫১, ৫০৫৮, ৬৯৩০, ৬৯৩১, ৭৫৬২, সহীহ মুসলিম হাঃ ১০৬৩, ১০৬৪; তিরমিযী হাঃ ২১৮৮, নাসায়ী হাঃ ২৫৭৮, ৪১০১, আবু দাউদ হাঃ ৪৭৬৪, ইবনে মাজাহ হাঃ ১৭১, ১৭২, মুসনাদে আহমদ হাঃ ১০৮৯, ১০৬২৫, ১১০৯৬, ১১১৮৫, ১১২৫৪, ১১২৯৮, ১৪৩৯০, ১৫৫৪৭, সহীহাহ হাঃ ২১০১),
-------------- 
লেখক : ইসলামি চিন্তাবিদ শিক্ষক, ও অনলাইন এক্টিভিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments