Recent Tube

দ্বীন সুরক্ষার ছয়টি মূলনীতি [১ম পর্ব]মূল: শাইখুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব আন-নাজদি রাহিমাহুল্লাহ ভাষ্যকার: আল্লামা সুলাইমান আর-রুহাইলি হাফিযাহুল্লাহ।





    দ্বীন সুরক্ষার ছয়টি মূলনীতি [১ম পর্ব]

·
 মূল: শাইখুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব আন-নাজদি রাহিমাহুল্লাহ

 ভাষ্যকার: আল্লামা সুলাইমান আর-রুহাইলি হাফিযাহুল্লাহ

 অনুবাদকের নিগদ:

 ‘বেটা, তুমি আল্লাহর নির্দেশনা সুরক্ষিত রাখ, আল্লাহও তোমাকে সুরক্ষা করবেন।’ কথাগুলো বলেছিলেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বালক সাহাবি ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার উদ্দেশে। (তিরমিজি, হা: ২৫১৬; সনদ: সহিহ) হাদিসের মর্মার্থ অনুযায়ী আমরা যদি আল্লাহর দ্বীনকে সুরক্ষিত রেখে তাঁর বিধিনিষেধ মেনে চলি, তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে ইহজগৎ ও পরজগতে অমঙ্গল থেকে হেফাজত করবেন। বিষয়টি নিয়ে আমাদের চিন্তা করা দরকার। স্বয়ং আল্লাহ যদি আমাদের হেফাজতের দায়িত্ব নেন, তাহলে আমাদের আর কী প্রয়োজন থাকতে পারে? এরচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি কী হতে পারে?

  আমরা যদি এরকম বড়ো পাওয়া লাভ করতে চাই, তাহলে অবশ্যই আমাদের দ্বীনকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। দ্বীন পালনে পথবিচ্যুত হওয়া চলবে না। দ্বাদশ হিজরি শতাব্দীর সংস্কারক ইমাম শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব আন-নাজদি রাহিমাহুল্লাহ বরাবরের মতোই সর্বস্তরের মুসলিম জনসাধারণের কল্যাণের নিমিত্তে রচনা করেছেন ‘আল-উসুলুস সিত্তা’ তথা ‘ছয়টি মূলনীতি’ নামের পুস্তিকা। খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হওয়ায় আমাদের সু্ন্নাহপন্থি উলামাগণ বারবার এ পুস্তিকার ব্যাখ্যা করেন এবং মানুষদের শিখিয়ে থাকেন পুস্তিকাটির রত্নতুল্য বিষয়বস্তু।

  সেসব উলামার অন্যতম আমাদের প্রিয় শাইখ, মদিনার ফাকিহ, আল্লামা সুলাইমান বিন সালিমুল্লাহ আর-রুহাইলি হাফিযাহুল্লাহ। তাঁর সারগর্ভ আলোচনা এই বইয়ে এনে দিয়েছে এক সুবর্ণ রূপ। আমরা শাইখের ব্যাখ্যাসংবলিত পুস্তিকা বাংলা ভাষায় সরল রূপান্তর করেছি। অনূদিত বইটির নাম দিয়েছি—‘দ্বীন সুরক্ষার ছয়টি মূলনীতি।’ বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে যে ছয়টি বুনিয়াদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, সেগুলো আমরা একনজরে আলোকপাত করছি।

  ১ম মূলনীতি: তাওহিদ বাস্তবায়ন করা এবং শির্ক থেকে বেঁচে থাকা।
২য় মূলনীতি: দ্বীনের ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং দ্বীনকেন্দ্রিক বিভক্তি থেকে বেঁচে থাকা।
৩য় মূলনীতি: শাসকের আনুগত্য করা এবং অন্যায়ভাবে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করা।
৪র্থ মূলনীতি: প্রকৃত ইলম ও আলিমের পরিচয় এবং আলিম ভাবাপন্ন লোকদের ব্যাপারে অবগতি।
৫ম মূলনীতি: প্রকৃত অলি-আউলিয়া আর বিপথগামী ভণ্ডদের মাঝে পার্থক্য করতে পারা।
৬ষ্ঠ মূলনীতি: কুরআন-সুন্নাহ বর্জনের নিমিত্তে শয়তানের তৈরিকৃত এক জঘন্য সংশয়ের অপনোদন। সংশয়টি হচ্ছে— উচ্চ পর্যায়ের বিদ্বান ছাড়া অন্য কেউ কুরআন-হাদিস বুঝতে পারবে না!

  বইয়ে যে শিরোনামগুলো দেওয়া হয়েছে, তা আমাদের সংযোজন। এছাড়া প্রয়োজনীয় বিবেচনায় কিছু টীকাটিপ্পনীও সংযোজন করা হয়েছে। প্রার্থনা করছি আল্লাহর কাছে, তিনি যেন আমাদের এই যৎসামান্য কাজ বরকতে ভরপুর করে দেন এবং এ কাজকে কেবল তাঁরই জন্য একনিষ্ঠ করার তৌফিক দেন। সর্বোপরি আল্লাহর কাছে চাইছি, তিনি যেন মূল লেখক, ব্যাখ্যাকার, অনুবাদক, প্রকাশক, প্রচারক ও পাঠক নির্বেশেষে সবাইকে বইটি থেকে উপকৃত করেন। আমিন, ইয়া রব্বাল আলামিন।

 রবের ক্ষমাপ্রত্যাশী— মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ মৃধা।


 [রচয়িতার মুখবন্ধ]

  যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য নিবেদিত, যিনি জগৎসমুদয়ের প্রতিপালক। পরিপূর্ণ সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরিত বান্দার ওপর। আরও বর্ষিত হোক তাঁর অনুসারীবর্গ ও সকল সাহাবির ওপর। অতঃপর:

   মুসলিম ভ্রাতৃমণ্ডলী, এই ইলমি মজলিসগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন এবং মজলিসগুলো আয়োজন করার তৌফিক দিয়েছেন। সেজন্য আমরা মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি। আল্লাহর কাছে চাইছি, তিনি যেন এসব মজলিসে ইখলাস ও সৎকর্মের তৌফিক দেন, মজলিসগুলোকে বানিয়ে দেন দুনিয়া ও আখেরাতে আমাদের জন্য সমৃদ্ধির সোপান, আর এসবের দরুন প্রাপ্তি হিসেবে প্রদান করেন তাঁরই সন্তোষ। মহান আল্লাহ চাইলে আমাদের রুটিনবাঁধা চলতি দারসগুলোর পাশাপাশি প্রত্যেক মাসে একদিন করে ইলমি দিবস অনুষ্ঠিত হবে। দিবসটি হবে মাসের মধ্যবর্তী বা তার কাছাকাছি সময়ের শনিবার। এভাবে প্রত্যেক মাসেই আয়োজিত হবে এই ইলমি দিবস, ইনশাআল্লাহ। সেই দিন আমরা যেকোনো একটি শাস্ত্রের পূর্ণাঙ্গ একটি পুস্তিকার ব্যাখ্যা করব, ইনশাআল্লাহ।

  আজকেই সেই ইলমি দিবসগুলোর প্রথম দিন, চলতি মাসের জন্য। অর্থাৎ রবিউল আখির মাসের ইলমি দিবস। এরপর প্রত্যেক মাসেই আমাদের একটি করে ইলমি দিবস আয়োজিত হবে, ইনশাআল্লাহ। আমরা ভেবে রেখেছি, আজকের এই প্রথম দিবসে আমরা কলেবরের দিক থেকে ছোটো, কিন্তু ফলের দিক থেকে বড়ো এমন দুটো পুস্তিকা ব্যাখ্যা করব। যে পুস্তিকাদ্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে প্রত্যেক মুসলিমের। আমরা ব্যাখ্যা করতে চলেছি শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহ বিরচিত ‘ছয়টি মূলনীতি’ ও ‘চারটি নীতি’ পুস্তিকা দুটো। আমরা প্রথমে ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা করব।

  এই ছয়টি মূলনীতি কুরআন-সুন্নাহর অসংখ্য দলিল থেকে গৃহীত অকাট্য ও সার্বজনিক নীতিমালা। ব্যক্তি, সমাজ, বরং রাষ্ট্রগুলোও উক্ত নীতিমালার মুখাপেক্ষী। এসবের মধ্যেই নিহিত রয়েছে দ্বীনের শুদ্ধতা, শক্তির আধার, পরিস্থিতির সুষমতা এবং ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের সাফল্য ও নিরাপত্তা। এসব মূলনীতি লঙ্ঘন করলে কিংবা এসবের কোনো একটি মূলনীতি পালনে ব্যর্থ হলে, চলে আসবে বিপর্যয় ও বিচ্যুতি। আপনি ব্যক্তি কিংবা সমাজ পর্যায়ে বিদ্যমান বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতিগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবুন। দেখতে পাবেন, এসব মূলনীতির কোনো না কোনো মূলনীতি লঙ্ঘন করার দরুনই সেসব বিচ্যুতি সংঘটিত হয়েছে।

  অনুরূপভাবে আপনি লক্ষ করবেন, উক্ত নীতিমালার কোনো একটি মূলনীতি লঙ্ঘন করলে, অবশ্যই শাইখ রাহিমাহুল্লাহর ব্যক্তীকৃত বাকি মূলনীতিগুলোতেও বিনাশ বা দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান সময়ে এসব প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে, যেহেতু এখন বেড়ে গেছে ফিতনা ও তার প্রচারকদের সংখ্যা, প্রসার লাভ করেছে সংশয় ও তার অনুসারীদের সংখ্যা। এজন্য এসব মূলনীতি পেশ করা, এসবের দারস দেওয়া এবং পুনঃপুন পর্যালোচনা করার কত দরকারই না রয়েছে! তাই উম্মতের প্রতি স্নেহপরায়ণ তালিবুল ইলমদের কর্তব্য—এই পুস্তিকার বিষয়বস্তু আলোচনা করা এবং পুস্তিকাটি পড়াতে সচেষ্ট হওয়া।

  শাইখুল ইসলাম রাহিমাহুল্লাহ উক্ত নীতিমালা আলোচনা করতে গিয়ে অত্যন্ত অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। পুস্তিকাটি সংক্ষিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও শাইখ রাহিমাহুল্লাহ প্রতিটি মূলনীতিতে কয়েকটি বিষয় আলোকপাত করেছেন। প্রথমত, তিনি কুরআন-সুন্নাহ থেকে প্রমাণিত মূলনীতি খুবই স্বচ্ছভাবে বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয়ত, উক্ত মূলনীতির বিপরীত বিষয়ও উল্লেখ করেছেন, যা থেকে কুরআন-সুন্নাহয় সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করা হয়েছে। তৃতীয়ত, এ থেকে প্রতিভাত হয়, কিতাব ও সুন্নাহ আঁকড়ে ধরার মাধ্যমেই কেবল উক্ত মূলনীতি ধারণ করা এবং তার বিপরীত বিষয় থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব।

  এরপর তিনি উম্মতের অধিকাংশ মানুষের শোচনীয় পরিবর্তন আলোচনা করেছেন। যারা কুরআন-সুন্নাহ থেকে প্রমাণিত মূলনীতি এড়িয়ে যায়, তা থেকে মানুষদের বিতাড়িত করে, এর বিপরীত বিষয় সংঘটিত করে, মানুষদের কাছে সেই বিপরীতকেই শোভনীয় ও সুশোভিত করে তোলে এবং মূলনীতির বিরুদ্ধে যারা দাওয়াত দেয় তাদেরকে ভালোবাসে। আর যারা মূলনীতির দিকে মানুষদের দাওয়াত দেয়, তাদের নিন্দা করে, তাদেরকে ঘৃণা করে এবং বিদ্রূপমাখা ট্যাগ দেয়।

  এই অবক্ষয়-অবনতির ব্যাপারটি বর্তমান যুগে খুবই উদ্ভাসিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আপনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে নজর দিলেই ব্যাপারটি স্পষ্ট দেখতে পাবেন। আপনি দেখতে পাবেন, আলোচ্য নীতিমালার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি লালন করে এমন কোনো ব্যক্তি একটি ক্লিপ আপলোড করলে একদিন-দুদিন না যেতেই দশ লাখের অধিক মুসলিম সেই ক্লিপ দেখে ফেলে! এদিকে কোনো একজন বড়ো আলিমের পরিস্থিতি দেখুন। আমি কোনো শাইখ বা তালিবুল ইলমের কথা বলছি না। কুরআন-সুন্নাহ থেকে প্রাপ্ত এই নীতিমালা সাব্যস্ত করেন এমন কোনো বড়ো আলিম যদি দলিলভিত্তিক সুস্পষ্ট ইলমি ক্লিপ আপলোড করেন, যেই ক্লিপে তিনি এই মূলনীতিগুলোর কোনো একটি সাব্যস্ত করেন, তাহলে দু-তিন সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়ার পরেও সেই ক্লিপের ভিউয়ার এক হাজার পেরোয় না!

  অবশ্যই এ বিষয়টি অনিষ্টের সতর্কবার্তা এবং মুসলিমদের সমঝ ও মননে অবক্ষয় সাধিত হওয়ার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ! এ পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী হকপন্থিদের করণীয় হবে পরিশ্রম করা, চেষ্টাপ্রচেষ্টা করা এবং ধৈর্য অবলম্বন করা। হকপন্থির উদ্দেশ্য কেবল আল্লাহর নিকটে থাকা প্রতিদান। এজন্য সে যতক্ষণ পর্যন্ত হকের ওপর রয়েছে, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ কী বলছে তাতে গুরুত্ব দেবে না। তার বক্তব্য অনুসরণকারী লোকদের স্বল্পতা তাকে নিরলস প্রয়াস ও উদ্যমতা থেকে বিচ্যুত করবে না। কারণ সে যে কেবল মহান আল্লাহর নিকটে থাকা প্রতিদান চায়। হকপন্থিদের এই কর্মপন্থার ওপর অবিচল থাকা বাঞ্ছনীয়।

  আলোচ্য ছয়টি মূলনীতির প্রতিটি মূলনীতিতেই শাইখুল ইসলাম রাহিমাহুল্লাহ এই অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। এই কর্মপদ্ধতি খুবই ভালো, সুদৃঢ় ও ফলপ্রসূ। আমরা এই মূলনীতিগুলোর পাঠ এবং সেসবের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা করতে চলেছি। বইয়ের মূলপাঠ পড়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি পুত্র নুরুদ্দিনকে। আল্লাহ তাঁকে ও শ্রোতাদেরকে সৎকর্মের তৌফিক দান করুন।


 [প্রারম্ভিকা ও ছয়টি মূলনীতির গুরুত্ব]

  মূলপাঠ: শাইখুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম; আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু।

  ব্যাখ্যা: শাইখ রাহিমাহুল্লাহ এই পুস্তিকা আরম্ভ করেছেন ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ বলে। এর কারণ নিম্নরূপ:

  প্রথমত, তিনি কুরআনুল কারিমের অনুসরণ করতে চেয়েছেন। যেই কুরআনের সকল সুরা ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ দিয়ে শুরু হয়েছে, কেবল সুরা তাওবা এর ব্যতিক্রম।

  দ্বিতীয়ত, সাহাবিবর্গের হস্তলিখিত কুরআনের মুসহাফের অনুসরণ করতে চেয়েছে। যেই মুসহাফ শুরু হয়েছে সুরা ফাতিহা দিয়ে। আর সর্বসম্মতিক্রমে সুরা ফাতিহার শুরুতে রয়েছে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম।’ চাই আমরা এ কথা বলি যে, ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিমসুরা ফাতিহার একটি আয়াত, আর চাই অগ্রগণ্য মতানুসারে এ কথা বলি যে, ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ একটি স্বতন্ত্র আয়াত, সুরা ফাতিহার অংশ নয়।

  তৃতীয়ত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠিপত্রের অনুসরণ করতে চেয়েছেন। যেসব চিঠির প্রত্যেকটি শুরু হয়েছে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ দিয়ে। উলামাগণ  নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠিপত্রগুলো অনুসন্ধান করে দেখেছেন, সবগুলো চিঠি  ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ দিয়ে শুরু হয়েছে।

  চতুর্থত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণীর সাথে সামঞ্জস্যতা বজায় রাখতে চেয়েছেন। যেখানে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, كُلُّ أمْرٍ ذِيْ بَالٍ لَا يُبْدَأُ فِيْهِ بِـبسم لِلَّه الرَّحمٰنِ الرَّحِيْمِ  فَهُوَ أبْتَرُ “প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ বলে আরম্ভ না করলে অসম্পূর্ণ (বরকতশূন্য) থেকে যায়।” হাদিসটি বর্ণনা করেছেন খতিব বাগদাদি ও সুবকি। কতিপয় আলিম হাদিসটিকে শক্তিশালী বলে অভিহিত করেছেন। আবার কতিপয় বিদ্বান হাদিসটির মান ‘হাসান লি গাইরিহি’ বলেছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে (আমার কাছে) স্পষ্ট অভিমত হলো, হাদিসটি দুর্বল।

  এজন্য আমরা বলি, পূর্বোদ্ধৃত দলিলগুলোর পাশাপাশি এ হাদিস থেকে প্রমাণগত সামঞ্জস্যতা বা মিশুক-ভাব গ্রহণ করা যায়। আর আমাদের দারসগুলোতে ইতঃপূর্বে উপর্যুপরি বিসমিল্লাহির রহমানির রহিমের ব্যাখ্যা গত হয়েছে। বিধায় তা পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন দেখছি না।


  মূলপাঠ: মহাপরাক্রমশালী সম্রাটের ক্ষমতার প্রমাণবাহী বৃহৎ নিদর্শনরাজি ও অত্যাশ্চর্য বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত—ছয়টি মূলনীতি, যা মহান আল্লাহ জনসাধারণের জন্য সুস্পষ্ট ও সুউদ্ভাসিত করে বর্ণনা করেছেন; লোকেরা যেমন ধারণা রাখে তার চেয়েও স্পষ্ট করে। অনন্তর এই মূলনীতিগুলোর ক্ষেত্রে জগতের অনেক প্রতিভাবান ও বুদ্ধিমান বনু আদম ভুল করেছে। এক্ষেত্রে ভুলে পতিত হয়নি এমন ব্যক্তিদের সংখ্যা খুবই সামান্য।

  ব্যাখ্যা: শাইখ রাহিমাহুল্লাহ এই বাস্তবতা আলোচনা করে মূলনীতিগুলো আরম্ভ করেছেন। এই পরিস্থিতিই সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য ও বিস্ময়ের উদ্রেক করে। যেমন কোনো বিষয় পূর্বাহ্ণের সূর্য এবং পূর্ণিমা রজনীতে মেঘের আড়ালবিহীন চাঁদের মতো স্পষ্ট-পরিস্ফুটিত। এমন স্পষ্ট ও সুব্যক্ত হওয়ার পরেও কিছু মানুষ সে ব্যাপারে ভুল করে বসে এবং সেক্ষেত্রে পথবিভ্রান্ত হয়। এ ব্যাপারটিই আশ্চর্যের। কিন্তু যখন অনেক মানুষ তাতে ভুলে করে এবং সেক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হয়, তখন ব্যাপারটি কেমন হতে পারে? নিঃসন্দেহে বিষয়টি অত্যাশ্চর্য, যার আশ্চর্য ও বিস্ময় শেষ হয় না।

  এ জাতীয় পরিস্থিতিরই অন্তর্গত এই ছয়টি মূলনীতি, যেগুলো মহান আল্লাহ অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে আলোচনা করেছেন। আর তা বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন পদ্ধতিতে, যার দরুন প্রত্যেকেই এগুলো বুঝতে পারে। আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও মূলনীতিগুলো অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে আলোচনা করেছেন। আর তা বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন পদ্ধতিতে, যার ফলে প্রত্যেকেই সেগুলো বুঝতে পারে। এ সত্ত্বেও আমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের বহুজনকে পেয়েছি, যারা কিনা এই মহান মূলনীতিগুলোতে ভুল করেছে।

  শাইখ এখানে বলছেন, ‘মহাপরাক্রমশালী সম্রাটের ক্ষমতার প্রমাণবাহী বৃহৎ নিদর্শনরাজি।’ ভাইয়েরা, আরবি ‘গাল্লাব (মহাপরাক্রমশালী)’ শব্দটি মহান আল্লাহর ব্যাপারে প্রদত্ত সংবাদ, তাঁর নাম নয়। মহান আল্লাহ বলেছেন, وَاللَّهُ غَالِبٌ عَلَىٰ أَمْرِهِ “আল্লাহ তাঁর কার্য সম্পাদনে পূর্ণ ক্ষমতাশীল।” [সুরা ইউসুফ: ২১] আল্লাহর নির্দেশ অবশ্য-কার্যকর; কোনো বাতিলকারী তাকে বাতিল করতে পারে না, আবার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীও পারে না তাকে পরাভূত করতে। সর্বোপরি ‘গাল্লাব (মহাপরাক্রমশালী)’ শব্দটি এখানে নাম হিসেবে বলা হয়নি, বরং তাঁর ব্যাপারে প্রদত্ত সংবাদ হিসেবে বলা হয়েছে। আর এটি একটি সুবিদিত বিষয় যে, আল্লাহর ব্যাপারে সংবাদপ্রদানের ক্ষেত্রে এমন প্রশস্ততা রয়েছে, যে প্রশস্ততার অস্তিত্ব তাঁর নাম ও গুণাবলির ক্ষেত্রে নেই।

  আলোচ্য ছয়টি মূলনীতি মহাপরাক্রমশালী সম্রাটের ক্ষমতার প্রমাণবাহী বৃহৎ নিদর্শনরাজির অন্তর্গত। কারণ এসবের মধ্যেই অকাট্য দলিল রয়েছে যে, মহান আল্লাহই হলেন সুপথপ্রদর্শক, আর আল্লাহ যাকে সুপথ দেখান সে-ই হলো সুপথপ্রাপ্ত। স্রেফ মেধা কোনো উপকার বয়ে আনতে পারে না, শুধু বুদ্ধিমত্তা কারও জন্য ফলপ্রসূ হতে পারে না। বরং এগুলো কিছু ফলপ্রসূ বিষয় মাত্র। সুপথপ্রদর্শক হলেন মহান আল্লাহ। এজন্য নিজের প্রতি দয়াপরবশ বুদ্ধিমান মুসলিমের উচিত হবে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি হেদায়েত চাওয়া, সর্বদা আল্লাহর কাছে চাইতে থাকা, তিনি যেন তাকে সরল পথের দিশা দেন। সুতরাং মানুষের এমন ভয়াবহ পরিবর্তন এ বিষয়ের প্রমাণবাহী সবচেয়ে বড়ো বড়ো নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত।

  এরপর শাইখ বলেছেন, ‘সিত্তাতু উসুল তথা ছয়টি মূলনীতি।’ উসুল শব্দটি ‘আসল’ শব্দের বহুবচন। আভিধানিক অর্থে, কোনো কিছুর সর্বনিম্ন স্তরকে আসল বলে। কিংবা ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য হোক বা অস্পৃশ্য হোক, যে বিষয়ের ওপর কোনো কিছুর ভিত্তি নির্ভরশীল হয়, তাকে আসল বলে। অথবা ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য হোক বা অস্পৃশ্য হোক, যা থেকে অন্য কোনো শাখাগত বিষয় নির্গত হয় তাকে আসল বলে। উলামাগণের পরিভাষায় ‘আসল’ শব্দটি বেশ কয়েকটি অর্থে ব্যবহৃত হয়। যথা:

  এক. আসল বলতে দলিল বোঝায়; চাই তা সংক্ষিপ্ত দলিল হোক কিংবা বিশদ। এজন্য বলা হয়, প্রথম আসল হচ্ছে কুরআন। অর্থাৎ সংক্ষেপে দলিলপ্রমাণের স্তরবিন্যাস করলে প্রথম দলিল হয় কুরআন। আবার বলা হয়, ‘এই বিধানের আসল হলো মহান আল্লাহর এই বাণী।’ অর্থাৎ এই বিধানের দলিল হলো মহান আল্লাহর এই বাণী। এটা বিস্তারিত পর্যায়ে প্রদত্ত দলিল।

  দুই. অনুরূপভাবে উলামাগণের পরিভাষায় ‘আসল’ শব্দটি ‘শাশ্বত নীতি বা নিয়ম’ অর্থে ব্যবহৃত হয়।
তিন. কোনো বিষয়ের মৌলিক অবস্থা (origin) অর্থে ব্যবহৃত হয়।
চার. অগ্রগণ্য অভিমত অর্থে ব্যবহৃত হয়।
পাঁচ. ব্যবহৃত হয় যার ওপর ভিত্তি করে কিয়াস করা হয় এমন বিষয়ের অর্থে। উলামাগণের পরিভাষায় উল্লিখিত প্রতিটি অর্থই ‘আসল’ হিসেবে পরিচিত।

  এখানে শাইখ রাহিমাহুল্লাহর কথায় ‘উসুল’ বলতে এমন সার্বজনিক নীতিমালা উদ্দিষ্ট, যা অকাট্যভাবে সাব্যস্ত, যেসবের ওপর নির্ভর করে কল্যাণ ও সফলতা।

  মর্যাদা ও প্রভাবের দিক থেকে পার্থক্য করার জন্য মৌলিক ও শাখাগত দুটো বিষয়ে দ্বীনের শ্রেণিবিন্যাস করা এমন একটি বিষয়, যা উলামাগণ বিনা বিরোধিতায় করে এসেছেন। এজন্য মর্যাদা ও গুরুত্বের বিবেচনায় দ্বীনের বিষয়াবলির মাঝে পার্থক্য করতে গিয়ে ‘এগুলো মৌলিক বিষয়’ আর ‘এগুলো শাখাগত বিষয়’ বলায় কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু উলামাগণ অন্যক্ষেত্রে এই শ্রেণিবিন্যাসের বিরোধিতা করেছেন এবং তাঁদের সেই বিরোধিতা সঠিক।

  দলিলের দিক থেকে দ্বীনের বিষয়াবলির মাঝে পার্থক্য করার বিরোধিতা করেছেন তাঁরা। উদাহরণস্বরূপ কিছু লোক বলে, ‘এগুলো মৌলিক বিষয়, এসব ক্ষেত্রে খবরে আহাদ (বিপুলসংখ্যক বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদিস নয় এমন সংবাদ বা হাদিস) গ্রহণ করা হবে না। আর এগুলো শাখাগত বিষয়, এসব ক্ষেত্রে খবরে আহাদ গৃহীত হবে।’ এটা নবউদ্ভাবিত বিষয়। সাহাবিগণ এমনভাবে ভাগ করতেন না। বরং কুরআন-সুন্নাহর দলিলকে সাহাবিবর্গ সমগ্র দ্বীনের ক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে পেশ করতেন।

  তদ্রুপ কাফির বলার বিধানগুলো সুবিন্যস্ত করার জন্য দ্বীনের মধ্যে ‘মৌলিক আর শাখাগত বিষয়’ বলে বিভাজন করাও নতুন আবিষ্কৃত বিষয়। ন্যায়নিষ্ঠ সালাফদের কাছে এ বিষয়টির অস্তিত্ব ছিল না।

  পক্ষান্তরে মর্যাদা, মর্তবা, গুণগত গুরুত্ব ও পর্যায়ের দিক থেকে পৃথক করার জন্য কৃত শ্রেণিবিন্যাস এমন একটি বিষয়, যা সকল উলামা বিনা বিরোধিতায় করে এসেছেন।

  এরপর লেখক রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘যা মহান আল্লাহ সুস্পষ্ট ও সুউদ্ভাসিত করে বর্ণনা করেছেন।’ অর্থাৎ মহান আল্লাহ অসংখ্য আয়াত দিয়ে এবং নানাবিধ পদ্ধতিতে উক্ত নীতিমালার বিবরণ দিয়েছেন। মুমিনদেরকে এসব মূলনীতি পালনের প্রতি আহ্বান করেছেন। তদ্রুপ আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও নানাবিধ পদ্ধতিতে আলোচ্য নীতিমালার বিবরণ দিয়েছেন এবং মুমিনদেরকে এসব মূলনীতি পালনের প্রতি আহ্বান করেছেন। এ সত্ত্বেও অসংখ্য প্রতিভাবান আলিম এসব মূলনীতিতে বিভ্রান্ত হয়েছেন।

  প্রখর মেধা আর প্রবল বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হিসেবে পরিচিত অনেক প্রতিভাবান রয়েছে, যারা এই মূলনীতিগুলোতে ভুল করে বসে এবং এগুলোর খেলাপ কাজ করে। এমনিভাবে এই মূলনীতিগুলোর ক্ষেত্রে অনেক বুদ্ধিমান বনু আদম ভুল করেছে। এক্ষেত্রে হককে আঁকড়ে ধরে ভুলে পতিত হয়নি এমন ব্যক্তিদের সংখ্যা খুবই নগন্য। সুবহানাল্লাহ! হকপন্থিদের ওপর যেসব বিশেষণ প্রভাব বিস্তার করেছে, তার মধ্যে অন্যতম— সংখ্যালঘুতা। কারণ হক বড়োই ওজস্বী, ভারি। আর হকের পৃষ্ঠপোষকদের সংখ্যা হাতেগোনা।

  অপরপক্ষে বাতিলের আয়ু যদিও স্বল্প, তথাপি বাতিলপন্থিদের কাছে তা এমন সহজতর হয়ে থাকে, যেন তারা কোনো কাজের দায়িত্বপ্রাপ্তই হয়নি। কিংবা প্রচণ্ড মানবীয় আবেগের সাথে তা খাপ খেয়ে যায়, আর তার পৃষ্ঠপোষকদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। এজন্য বুদ্ধিমান মানুষ সংখ্যাধিক্য দেখে প্রতারিত হয় না। সে এ ধরনের কথা বলে না, ‘ওই শাইখকে তো মিলিয়ন মিলিয়ন লোক ফলো করে, আর এই শাইখকে ফলো করে শখানেক মানুষ। সুতরাং ওই শাইখই হকের ওপর আছে, আর এই শাইখ রয়েছে বাতিলের ওপর!’ সংখ্যাধিক্য দিয়ে হক চেনা যায় না। বরং ব্যাপারটি আসলে তেমনই, আমরা যেমনটি বলেছি, ‘সংখ্যালঘুতা হকপন্থিদের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী একটি বিশেষণ।’

  তাহলে ভাবুন, এই মূলনীতিগুলোর ক্ষেত্রে যখন বুদ্ধিমান ও প্রতিভাবান লোকদের বিচ্যুতি ঘটেছে, তখন তাদের চেয়ে নিম্নপর্যায়ের লোকদের কী অবস্থা হতে পারে? নিঃসন্দেহে বিচ্যুতি ও ভুল হয়ে চলেছে। আমরা যখন জানতে পারব, ভুল হচ্ছে, বিচ্যুতি হচ্ছে, তখন কি শুধু বসে বসে বলব, খালাস, লোকেরা সব ধ্বংস হয়ে গেল? মোটেও না। বরং আমরা সঠিক বিষয় আলোকপাত করতে এবং বিচ্যুতি থেকে সতর্ক করতে সচেষ্ট হব। হক যখন পরিস্ফুটিত হবে, আর সাধারণ মানুষ ও হকের আহ্বায়ক উলামাদের মাঝে আড়াল তৈরিকারী দস্যুদের হাত থেকে মানুষজন নিস্তার পাবে, তখন হক উদ্ভাসিত হবে এবং ছড়িয়ে পড়বে দিগ্বিদিক।

  আপনি যদি নিকট অতীতের কোনো দৃষ্টান্ত চান, তবে আমি আপনাকে বলতে পারি। শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহ যখন এদেশে তাঁর দাওয়াত আরম্ভ করলেন, তখন তিনি লোকদের কাছে কী অপরিচিত আর অদ্ভুতই না ছিলেন! অনন্তর তাঁর দাওয়াতের পরিণতি হলো— তাওহিদের বিস্তার আর এ দাওয়াতের প্রসার। আর সমুদয় প্রশংসা তো আল্লাহর জন্যই নিবেদিত। এই তো কয়েক বছর আগের পরিস্থিতি, যখন শাইখ ইবনু বায, শাইখ আলবানি, শাইখ ইবনু উসাইমিন, শাইখ মুকবিল রাহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখের মতো আহলুস সুন্নাহর আলিমগণ যখন সত্যিকারের সালাফিয়্যা ও সুন্নাহর দাওয়াত দিলেন—যাবতীয় প্রশংসা ও অনুগ্রহ আল্লাহরই জন্য—তখন কীভাবেই না এ দাওয়াতের প্রসার ঘটল! অনেক মানুষ সেই দাওয়াতের অনুসরণ করতে লাগল। আলহামদুলিল্লাহ।

 সুতরাং তালিবুল ইলম ভাইয়েরা, ফলোয়ারের স্বল্পতা কিংবা পৃষ্ঠপোষকদের সংখ্যালঘুতা যেন তোমাদেরকে দাওয়াতের ব্যাপারে অলস ও হতোদ্যম করে না তোলে। কক্ষনো নয়। আমরা বরং হকের দাওয়াত প্রচার করতে সচেষ্ট হব। এর আসন্ন পরিণাম হবে কল্যাণকর, ইনশাআল্লাহ।


 [১ম মূলনীতি: তাওহিদ বাস্তবায়ন করা এবং শির্ক থেকে বেঁচে থাকা]

  মূলপাঠ: প্রথম মূলনীতি: অদ্বিতীয় শরিকবিহীন মহান আল্লাহর জন্য সকল ইবাদতকে একনিষ্ঠ করা এবং এর পরিপন্থি বিষয়ের তথা আল্লাহর সাথে কৃত শির্কের বিবরণ দেওয়া। কুরআনের অধিকাংশ জায়গায় এই মূলনীতিকে বিভিন্ন দিক থেকে এমন ভাষ্যে বর্ণনা করা হয়েছে, যা জনসাধারণের সবচেয়ে নির্বোধ লোকটিও বুঝতে পারবে। এরপর অধিকাংশ উম্মতের ওপর যা আপতিত হওয়ার তা যখন আপতিত হয়ে গেল, তখন বুজুর্গ ব্যক্তিদের সম্মানহানি এবং তাঁদের অধিকার বাস্তবায়নে অবহেলার মোড়কে শয়তান তাদের কাছে একনিষ্ঠ তাওহিদের প্রকাশ ঘটাল। আর বুজুর্গ লোকদের প্রতি ভালোবাসা এবং তাঁদের অনুসরণের সুরতে উম্মতের কাছে শির্ককে প্রকটিত করল।

  ব্যাখ্যা: শাইখ সবচেয়ে বড়ো ও গুরুত্ববহ মূলনীতি দিয়ে আলোচনা আরম্ভ করেছে। তিনি বলেছেন, ‘প্রথম মূলনীতি : অদ্বিতীয় শরিকবিহীন মহান আল্লাহর জন্য সকল ইবাদতকে একনিষ্ঠ করা (ইবাদতে ইখলাস রাখা)।’ ইখলাসের মূল অর্থ নির্মল করা, স্বচ্ছ করা, পরিশোধিত করা। ইখলাস বলতে বোঝায়, মানুষের প্রশংসা কিংবা সামগ্রী পাওয়ার কামনা ব্যতিরেকে শরিকবিহীন এক আল্লাহর ইবাদত সমাপন করা। সুতরাং আপনি আল্লাহর ইবাদত করবেন। আপনার উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর নিকটে থাকা প্রতিদানপ্রাপ্তি। শরিকবিহীন এক আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা হবে আপনার লক্ষ্য।

  আপনি মানুষের প্রশংসা পাওয়ার অভিলাষ রাখবেন না। মানুষ আপনার প্রশংসা করবে, সে আশায় সৎকর্ম প্রদর্শন করবেন না। মানুষের কাছে থাকা পার্থিব সামগ্রী লাভের ঈপ্সা রাখবেন না। বরং আপনার সমুদয় ইবাদত হবে স্রেফ মহান আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ, নির্মল। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন, قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ لَا شَرِيكَ لَهُ ۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ “বল, আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ (সব কিছুই) বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য নিবেদিত। তাঁর কোনো শরিক নেই, আমাকে এরই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আর আমিই (এ উম্মতের) সর্বপ্রথম মুসলিম।” [সুরা আনআম: ১৬২-১৬৩]

  মহান আল্লাহ আরও বলেছেন, وَمَاۤ أُمِرُوۤا۟ إِلَّا لِیَعۡبُدُوا۟ ٱللَّهَ مُخۡلِصِینَ لَهُ ٱلدِّینَ حُنَفَاۤءَ “তাদেরকে কেবল এ নির্দেশই দেওয়া হয়েছিল যে, তারা আন্তরিকভাবে আল্লাহর জন্য সমগ্র দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে আল্লাহর ইবাদত করবে।” [সুরা বাইয়্যিনাহ: ৫] আমাদেরকে ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর তাওহিদ বাস্তবায়নের নির্দেশই কেবল দেওয়া হয়েছে। সকল বিষয় এই প্রথম মূলনীতির ওপর ভিত্তিশীল।

 তাওহিদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তাওহিদ দিয়ে সকল রসুল প্রেরণ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেছেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ “আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি কেবল এ কারণে যে, তারা আমারই ইবাদত করবে।” [সুরা যারিয়াত: ৫৬] অর্থাৎ আমার তাওহিদ বাস্তবায়ন করবে। মহান আল্লাহ বলেছেন, وَمَاۤ أُمِرُوۤا۟ إِلَّا لِیَعۡبُدُوا۟ ٱللَّهَ مُخۡلِصِینَ لَهُ ٱلدِّینَ حُنَفَاۤءَ “তাদেরকে কেবল এ নির্দেশই দেওয়া হয়েছিল যে, তারা আন্তরিকভাবে আল্লাহর জন্য সমগ্র দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে আল্লাহর ইবাদত করবে।” [সুরা বাইয়্যিনাহ: ৫] মহান আল্লাহ আরও বলেছেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ “আমি প্রত্যেক জাতির মাঝেই রসুল পাঠিয়েছি, এ নির্দেশ দিয়ে যে, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুতকে (*) পরিহার করো’।” [সুরা নাহল: ৩৬]

 [(*) অনুবাদকের টীকা: যে উপাস্য, বা অনুসৃত নেতা, বা মান্যবর কারও মাধ্যমে বান্দা নিজের সীমানা লঙ্ঘন করে, তাকেই তাগুত বলা হয়। আর সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারটি সেই মানব্যর বা অনুসৃত সৃষ্টির জানা থাকে এবং সে এতে সম্মত থাকে; যদি আসলেই জানা ও সম্মত হওয়ার সামর্থ্য তার থাকে তবেই। উল্লিখিত পরিচিতি অনুযায়ী ইবলিস শয়তান, মানুষের ইবাদত পেয়ে সন্তুষ্ট থাকা পির, জনমানুষ অনুসরণ করে এমন বিদাতি মৌলবি, জনসাধারণ পাপের কাজে মান্য করে এমন ফাসেক ও কাফের নেতা, পূজিত গাছপালা, পাথর, মূর্তি প্রভৃতির সবই তাগুত। 

  তাগুতকে বর্জন করতে হলে যাবতীয় শির্ক বর্জন করে এক আল্লাহর তাওহিদ বাস্তবায়ন করতে হবে, তাগুতের কর্মকে বাতিল বলে বিশ্বাস করতে হবে, তাগুতকে ঘৃণা করতে হবে এবং তাগুতের অনুসারীদের প্রতি পোষণ করতে হবে বিদ্বেষ। আর তাগুতের অনুসারীরা যদি কাফির হয়, তাহলে তাদেরকে কাফির বলতে হবে। পক্ষান্তরে যারা কাফির নয়, তাদেরকেও ঘৃণা করতে হবে, তাদের বিরোধিতা করতে হবে; যদিও ইমানি ভ্রাতৃত্বের দরুন তাদের প্রতি অবশিষ্ট থাকবে আমাদের ভালোবাসাও। বিস্তারিত দ্রষ্টব্য: আমাদের অনুবাদ ও টীকাসংবলিত আল্লামা সুলাইমান আর-রুহাইলি হাফিযাহুল্লাহর লেখা ‘তাগুত বিষয়ে বিস্তারিত’ শীর্ষক প্রবন্ধ। টীকা সমাপ্ত।]

  আর অবশ্যই তাওহিদে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটো দিক থাকতে হবে। এজন্য বলা হয়, কালিমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর মানে আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ নেই। সুতরাং অবশ্যই তাওহিদ বাস্তবায়ন করতে হবে, তাওহিদকে সাব্যস্ত করতে হবে এবং শির্ক থেকে থাকতে হবে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন।

  লেখক রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘এবং এর পরিপন্থি বিষয়ের তথা আল্লাহর সাথে কৃত শির্কের বিবরণ দেওয়া।’ এই বিবরণের পাশাপাশি শির্কের নিষেধাজ্ঞাও মূলনীতির অন্তর্গত। একনিষ্ঠ তাওহিদের পরিপন্থি বিষয়ের বিবরণ কুরআন ও সুন্নাহয় এসেছে। একনিষ্ঠ তাওহিদের পরিপন্থি যত বিষয় রয়েছে, সবগুলোর বিবরণ কুরআন ও সুন্নাহয় আলোচিত হয়েছে এবং আমাদেরকে সেগুলো করতে নিষেধ করা হয়েছেযেমন আমাদের মহান রব বলেছেন, وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا “তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, আর কিছুকেই তাঁর শরিক করো না।” [সুরা নিসা: ৩৬] তিনি আরও বলেছেন, فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىٰ “সুতরাং যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করল এবং আল্লাহর প্রতি ইমান আনল, সে অবশ্যই দৃঢ়তর রজ্জু (ইসলাম) ধারণ করল।” [সুরা বাকারা: ২৫৬]

  সকল প্রকার শির্কের বিবরণ এবং বিভিন্ন পদ্ধতিতে শির্ক থেকে সতর্কীকরণ কুরআন ও সুন্নাহয় বিবৃত হয়েছে।

 আপনারা জানেন, শির্ক দু প্রকার। যথা:

  এক. বড়ো শির্ক: ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। বান্দা আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করে তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরিক সাব্যস্ত করা কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে বিলকুল আল্লাহর পরিবর্তে অন্যের ইবাদত করাই বড়ো শির্ক। অর্থাৎ বান্দা হয় বিলকুল আল্লাহর ইবাদত করে না, বরং গাইরুল্লাহ তথা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যের ইবাদত করে যায়; আর নাহয় আল্লাহর সাথে অন্যকে সমকক্ষ ও শরিক নির্ধারণ করে।

  দুই. ছোটো শির্ক: যা ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় না। কুরআন ও সুন্নাহয় যে বিষয়কে শির্ক বলা হয়েছে, কিন্তু দলিল থেকে প্রতীয়মান হয়েছে, তা ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় না, সেটাই ছোটো শির্ক। বড়ো শির্কের মাধ্যকেও ছোটো শির্ক বলা হয়। আবার যা মাধ্যম বা উপলক্ষ্য হিসেবে প্রমাণিত নয়, এমন বিষয়কে মাধ্যম বানিয়ে নেওয়াও ছোটো শির্ক।

  গুপ্ত শির্ক নামে আরেক ধরনের শির্ক রয়েছে। মানুষের প্রশংসা পাওয়ার আশায় তাদের সামনে ভালোকাজ প্রদর্শন করাকে গুপ্ত শির্ক বলে। এটা বড়ো শির্কও হতে পারে, আবার ছোটো শির্কও হতে পারে। এই শির্কটি যদি মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করে, ফলে তার সমস্ত কাজ কিংবা দুয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ কাজই গুপ্ত শির্কের অন্তর্গত হয়ে থাকে, তাহলে বলতেই হয়, এমন বিষয় মুমিনের নিকট থেকে প্রকাশিত হতে পারে না। পক্ষান্তরে প্রভাব বিস্তারকারী নয় এমন স্বল্প পরিমাণ গুপ্ত শির্ক আসলে ছোটো শির্কের অন্তর্ভুক্ত।

  সবগুলোর বিবরণ কুরআন ও সুন্নাহয় একেবারে স্পষ্ট, স্বচ্ছ ও পরিপূর্ণরূপে আলোচিত হয়েছে, যার মাঝে কোনো অস্পষ্টতা নেই। আলোচিত সবগুলো বিষয়ের নিষেধাজ্ঞা শরিয়তে বর্ণিত হয়েছে। তথাপি কুরআনের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে রয়েছে এই মূলনীতির আলোচনা। শাইখ যেমন বলেছেন, এটা একেবারে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ বিষয়। এমনকি কতিপয় আলিম বলেছেন, পুরো কুরআনেই রয়েছে তাওহিদের আলোচনা। কুরআনের প্রতিটি আয়াতই তাওহিদকে সন্নিবেশ করে এবং তাওহিদের প্রতি মানুষদের আহ্বান করে। যেমন ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ তা বিভিন্ন পদ্ধতিতে আলোকপাত করেছেন।

  যতগুলো পদ্ধতিতে তাওহিদের বিবরণ ও তার নির্দেশনা এবং শির্কের বিবরণ ও তা থেকে নিষেধাজ্ঞা উল্লিখিত হয়েছে, তা বিস্তারিত বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু সংক্ষেপে সেসব পদ্ধতি উল্লেখ করা যেতে পারে। সেসব পদ্ধতির অন্যতম হলো:

 ১. মহান আল্লাহ তাঁর ইবাদত করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং শির্ক থেকে নিষেধ করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেছেন, وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا “তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, আর কিছুকেই তাঁর শরিক করো না।” [সুরা নিসা: ৩৬]

 ২. শির্ককে কদর্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং শির্ককে করে তোলা হয়েছে ঘৃণ্য। মহান আল্লাহ বলেছেন, إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ “নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরিক স্থাপন করাকে ক্ষমা করবেন না। এছাড়া অন্য সব (গুনাহ) যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন।” [সুরা নিসা: ৪৮]

 ৩. অসংখ্য আয়াতে সাব্যস্ত করা হয়েছে, কেবল আল্লাহই ইবাদত পাওয়ার হকদার। এমন আয়াত অনেক রয়েছে। এজন্য মহান আল্লাহ বলেছেন, فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ “সুতরাং জেনে রেখ, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোনো উপাস্য নেই।” [সুরা মুহাম্মাদ: ১৯] অর্থাৎ তুমি সুনিশ্চিতভাবে জেনে রেখে। এ বিষয়ের প্রমাণবাহী আয়াতের সংখ্যা প্রচুর।

 ৪. অনেক আয়াত আছে, যেসব মহান আল্লাহর কর্মাবলির স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছে; যা থেকে অপরিহার্যভাবে প্রতীয়মান হয়, আল্লাহই হলেন প্রকৃত মাবুদ ও উপাস্য, তিনি ব্যতীত আর কেউ ইবাদতের হকদার নয়।

  উল্লিখিত পদ্ধতিগুলো কুরআনেই আলোচিত হয়েছে। তদ্রুপ সুন্নাহতেও নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওহিদের সকল প্রকারের বিবরণ দিয়েছেন এবং তাওহিদপরিপন্থি বিষয় শির্কের সকল প্রকারের সুস্পষ্ট, স্বচ্ছ ও পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দিয়েছেন তাঁর কথা ও কাজের মাধ্যমে। বরং নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শির্কের সকল মাধ্যম ও পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। এমনকি জনৈক ব্যক্তি তাঁর উদ্দেশে বলে, مَا شَاءَ اللهُ وَشِئْتَ فَقَالَ لَهُ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم أَجَعَلْتَنِي للهِ نِدًّا بَلْ مَا شَاءَ اللهُ وَحْدَهُ “আল্লাহ ও আপনি যা চেয়েছেন তাই হয়েছে।’ এ শুনে তিনি বললেন, ‘তুমি কি আল্লাহর সাথে আমার সমকক্ষ নির্ধারণ করলে? না; বরং আল্লাহ একাই যা চেয়েছেন, তাই হয়েছে’।” [আহমাদ, হা: ১৮৩৯; ইবনু মাজাহ, হা: ২১১৭; সিলসিলা সহিহা, হা: ১৩৯; সনদ: সহিহ]

  লোকটি কী বলেছিল, লক্ষ করুন, ‘আল্লাহ ও আপনি যা চেয়েছেন তাই হয়েছে।’ এ শুনে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন, ‘তুমি কি আল্লাহর সাথে আমার সমকক্ষ নির্ধারণ করলে?’ এ ধরনের কথা তিনি বলেছেন! কারণ আরবি ‘ওয়াও (ও/এবং)’ অব্যয়টি সমতাবিধানের দাবি করে। এজন্য নবিজি বললেন, ‘না। বরং আল্লাহ একাই যা চেয়েছেন, তাই হয়েছে।’ তিনি বিষয়টিকে পুরোপুরি আরেক প্রান্তে পাঠিয়ে দিয়েছেন; যদিও ‘আল্লাহ যা চেয়েছেন, এরপর আপনি যা চেয়েছেন, তাই হয়েছে’– বলা বৈধ রয়েছে। যেমন ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إِذَا حَلَفَ أَحَدُكُمْ فَلاَ يَقُلْ مَا شَاءَ اللَّهُ وَشِئْتَ.‏ وَلَكِنْ لِيَقُلْ مَا شَاءَ اللَّهُ ثُمَّ شِئْتَ ‏ "তোমাদের কেউ যেন শপথ করতে গিয়ে এভাবে না বলে, ‘আল্লাহ ও আপনি যা চেয়েছেন তাই হয়েছে।’ বরং সে যেন বলে, ‘আল্লাহ যা চেয়েছেন, এরপর আপনি যা চেয়েছেন, তাই হয়েছে’।" [ইবনু মাজাহ, হা: ২১১৭; সনদ: হাসান সহিহ]

  জুহাইনা গোত্রের এক মহিলা বলেছেন, জনৈক ইহুদি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, ‘তোমরা তো আল্লাহর সাথে শিরক করো।’ কারণ তোমরা বল, আল্লাহ ও আপনি যা চেয়েছেন তাই হয়েছে। তোমরা আরও বলে থাক, কাবার কসম।’ এরপর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিলেন, মুসলিমদের মধ্যে যারা শপথ করতে চায়, তারা যেন বলে, ‘কাবার রবের শপথ,’ আর যেন বলে, ‘আল্লাহ যা চেয়েছেন, এরপর আপনি যা চেয়েছেন, তাই হয়েছে।’ [নাসায়ি, হা: ৩৭৭৩; মুসনাদ আহমাদ, খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৩৭১-৩৭২; সনদ: সহিহ]

  আমি বলছি, ‘আল্লাহ যা চেয়েছেন, এরপর আপনি যা চেয়েছেন, তাই হয়েছে’– বলা বৈধ হওয়া সত্ত্বেও নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘না; বরং আল্লাহ একাই যা চেয়েছেন, তাই হয়েছে।’ বাস্তবিক অর্থেই নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরোপুরি শির্কের সকল মাধ্যম ও রাস্তা রুদ্ধ করে দিয়েছেন।

  প্রকৃতপক্ষে সকলেই এ আলোচনা বোঝে। এমনকি সবচেয়ে দুর্বল সমঝের মানুষও—যাকে লোকেরা ‘নির্বোধ’ আখ্যায়িত করে থাকে, যার বুঝশক্তি থাকে দুর্বল—তা বোঝে। যতক্ষণ সে আরবি বোঝে, কুরআন পড়ে, তার কাছে সুন্নাহর জ্ঞান পৌঁছে, ততক্ষণ সে এই মূলনীতি এবং এর বিপরীত বিষয়কে হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে।

  এরপর শাইখ বলেছেন, ‘এরপর অধিকাংশ উম্মতের ওপর যা আপতিত হওয়ার তা যখন আপতিত হয়ে গেল, তখন বুজুর্গ ব্যক্তিদের সম্মানহানি এবং তাঁদের অধিকার বাস্তবায়নে অবহেলার মোড়কে শয়তান তাদের কাছে একনিষ্ঠ তাওহিদের প্রকাশ ঘটাল। আর বুজুর্গ লোকদের প্রতি ভালোবাসা এবং তাঁদের অনুসরণের সুরতে উম্মতের কাছে শির্ককে প্রকটিত করল।’

  ভাইয়েরা, এখানে উম্মত বলতে দুরকম অর্থ হতে পারে। ব্যাপক ও নির্দিষ্ট— উভয় অর্থই হতে পারে। ব্যাপক অর্থ অনুযায়ী উম্মত বলতে আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালামকে জমিনে নামিয়ে দেওয়ার পর তৈরি হওয়া মানবগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়। ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা তাদের যে অবস্থা বর্ণনা করেছেন, তা ঘটেছিল সেসময়। কুরআনে যেসব মূর্তির নাম নেওয়া হয়েছে, সেসবের ব্যাপারে ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন, إِنّهَا أَسْمَاءُ رِجَالٍ صَالِحِيْنَ مِنْ قَوْمِ نُوْحٍ فَلَمَّا هَلَكُوْا أَوْحَى الشَّيْطَانُ إِلَى قَوْمِهِمْ أَنْ انْصِبُوْا إِلَى مَجَالِسِهِمْ الَّتِيْ كَانُوْا يَجْلِسُوْنَ أَنْصَابًا وَسَمُّوْهَا بِأَسْمَائِهِمْ “এগুলো নুহ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের কতিপয় নেক লোকের নাম ছিল। তাঁরা মারা গেলে শয়তান তাঁদের সম্প্রদায়ের লোকদের কুমন্ত্রণা দেয়, তারা যেসব মজলিসে বসত, সেসবে তোমরা কতিপয় মূর্তি স্থাপন করো এবং ওই সকল ভালো লোকের নামেই এগুলোর নামকরণ করো।” অর্থাৎ তোমরা তাদের ছবি-মূর্তি তৈরি করো এবং মূর্তিগুলোকে ভালো লোকদের নামেই নামকরণ করো। এ কাজের যুক্তি কী? যাতে তোমরা তাদের ইবাদতের কথা স্মরণ করে আল্লাহর ইবাদত করতে পারো। এরপর ইবনু আব্বাস বলছেন, فَفَعَلُوْا فَلَمْ تُعْبَدْ حَتَّى إِذَا هَلَكَ أُوْلَئِكَ وَتَنَسَّخَ الْعِلْمُ عُبِدَتْ “তারা তাই করল, কিন্তু তখনও সেসব মূর্তির পূজা করা হতো না। তবে মূর্তি স্থাপনকারী লোকগুলো মারা গেলে এবং মূর্তিগুলোর ব্যাপারে সত্যিকারের জ্ঞান বিলুপ্ত হলে লোকজন তাদের পূজা আরম্ভ করে দেয়।” [সহিহ বুখারি, হা: ৪৯২০]

 বুঝতেই পারছেন, অজ্ঞতা সকল অনিষ্টের বৃক্ষমূল। এজন্য যতক্ষণ অবধি সঠিক ও ফলপ্রসূ ইলম বিদ্যমান থাকবে, ততক্ষণ সেই ইলম আল্লাহর ইচ্ছায় সমুদয় অকল্যাণ থেকে মানুষকে প্রতিহত করবে।

 আবার উম্মত বলতে এখানে সীমাবদ্ধ অর্থটিও উদ্দিষ্ট হতে পারে। সীমাবদ্ধ অর্থ অনুসারে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত কবুলকারী উম্মত উদ্দিষ্ট হবে। যুগ যখন নবিজির সময়কাল থেকে দূরবর্তী হয়ে গেল, আর ইলম গেল কমে, তখন উম্মতের অধিকাংশের কাছে প্রবাহিত হলো পূর্ববর্তীদের মতাদর্শ। যেমন বুজুর্গ ব্যক্তিদের সম্মান করতে গিয়ে সীমালঙ্ঘন কর। এমনকি লোকেরা তাদেরকে বান্দার পর্যায় থেকে এত উঁচুতে ওঠাল যে, তাদের জন্য আল্লাহর প্রাপ্য হক পর্যন্ত ধার্য করে ফেলল। তারা আল্লাহর জন্য সুনির্ধারিত ক্ষমতা কতিপয় বুজুর্গের জন্য ধার্য করল। এমনকি মৃতকে জীবিত করার ক্ষমতাও বুজুর্গের আছে বলে বিশ্বাস স্থির করল। বুনতে লাগল ওই বুজুর্গের ঘিরে চালু থাকা অদ্ভুত ও আশ্চর্য সব কিসসার ঝুলি। মানবীয় বিবেকবুদ্ধি পর্যন্ত সুদূরপরাহত মনে করে, এমন কিসসা-কাহিনীকেও সত্যায়ন করতে লাগল তারা।

 আপনারা জানেন, তারা একটি ঘটনা বলাবলি করে। এক মহিলার সন্তান মারা যায়। সে আপন পিরবাবার কাছে গিয়ে বলে, ‘মালাকুল মাওত (মৃত্যুর ফেরেশতা) আমার ছেলের প্রাণ হরণ করেছে।’ ইত্যবসরে রুহ নিয়ে ফেরেশতা আসমানে পৌঁছার পূর্বেই পিরসাহেব আসমানে আরোহণ করেন। মালাকুল মাওতের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তখন ফেরেশতার কাছে ছিল রুহসমূহ রাখার থলি। আসমানে ওঠে ফেরেশতা ও আকাশের মাঝে আড়াল তৈরিকারী এই পিরবাবা আপন মহিলা মুরিদের ছেলেকে চিনে ওঠতে পারেন না। তাই থলে নিয়ে তিনি রুহগুলো ছড়িয়ে দেন। ওই রাতেই সবগুলো রুহ মৃতদেহে ফিরে আসে!

 সুবহানাল্লাহ! এরা আল্লাহর জন্য সুনির্ধারিত ক্ষমতা বুজুর্গদের জন্য ধার্য করে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তাদের ইবাদত করে। তাদেরকে সেজদা করে, তাদের উদ্দেশে রুকু করে, তাদের সামনে হাত-পা দিয়ে হামাগুড়ি দেয়, তাদের কাছে প্রার্থনা করে, বিপদে উদ্ধার চায়! নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দ্বীন পালনের দাবি করে, এমন উম্মতেরই অনেকগুলো দল বুজুর্গদের ইবাদতে লিপ্ত হয়েছে, আল্লাহর সাথে শির্ক করার মতো অপরাধে নিপাতিত হয়েছে। আর জানা কথা, শয়তান মানুষকে স্টেপ বাই স্টেপ শির্কের দিকে চালিত করে। মানুষের কাছে শির্ক আসে বুজুর্গদের প্রতি ভক্তির মোড়কে।

 বুজুর্গদের ভালোবাসা, তাঁদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া ইবাদত এবং শরিয়তসম্মত কাজ। কিন্তু তাঁদের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করা তো জায়েজ নয়। শয়তান মানুষদের চালিত করে—ওই বুজুর্গদের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘনের পানে। আল্লাহ ও তাঁর রসুলের নির্দেশিত তাওহিদ থেকে মানুষদের এই যুক্তিতে বিতাড়িত করে যে, এতে বুজুর্গদের মানহানি হয়। এজন্য আপনি যখন কিছু মানুষের কাছে তাওহিদের দাওয়াত দেবেন, তারা আপনার কাছ থেকে সরে আসবে। কারণ কী? কারণ শয়তান ও তার দোসর মানব শয়তানগুলো মানুষের কাছে বদ্ধমূল ধারণার জন্ম দিয়েছে, যে ব্যক্তি তাওহিদ নিয়ে কথা বলে, সেই মূলত নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘৃণা করে, বুজুর্গদের অপছন্দ করে, আল্লাহর অলিদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে।

 ফলে মানুষ তাওহিদ থেকে সরে আসে এবং মানুষদেরও তাওহিদ থেকে বিতাড়িত করে। শয়তান তাদের কাছে তাওহিদকে করে তোলে সংশয়াবিষ্ট, তারাও শির্কের মধ্যে হতে থাকে নিপাতিত, আর শির্ককেই ভেবে বসে তাওহিদে পরিপুষ্ট। মনে করে, এ কাজ সম্পন্ন করে তারা নিজেদের ওপর বুজুর্গ ব্যক্তিবর্গের প্রাপ্য অধিকারই যেন বাস্তবায়ন করল। সত্যিকারার্থে এটা বর্তমান মুসলিমদের শোচনীয় পরিবর্তন। এর নেপথ্য কারণ জ্ঞানের স্বল্পতা, জ্ঞান-প্রসারের কমতি এবং অজ্ঞতার প্রসার। পানা চাই আল্লাহর কাছে এ পরিস্থিতি থেকে।

 আলোচ্য মূলনীতি সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে শাইখ রাহিমাহুল্লাহ অবলম্বিত এই অভিনব পদ্ধতির প্রতি লক্ষ করুন। তিনি মূলনীতি আলোচনা করেছেন এবং এর বিপরীত বিষয় কী, সেটাও ব্যাখ্যা করেছেন। পাশাপাশি তাঁর বক্তব্যের মাঝে এ কথাও সন্নিবেশ করে দিয়েছেন যে, স্রেফ কুরআন-সুন্নাহ আঁকড়ে ধরার মাধ্যমেই এই মূলনীতি বাস্তবায়ন করা এবং এর বিপরীত বিষয় থেকে সতর্ক থাকা সম্ভব। অনেক মুসলিমের যে কী ভয়াবহ পরিবর্তন হয়েছে, সে বিষয়টিও তিনি আলোকপাত করেছেন। জানিয়েছেন, বর্তমানে মুসলিমদের অনেকেই তাওহিদকে শির্ক মনে করে, আর শির্ককে মনে করে তাওহিদ! আল্লাহর পানা চাই এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে।

ক্রমশ চলবে, ইনশাআল্লাহ।

অনুবাদক: মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ মৃধা
www.facebook.com/SunniSalafiAthari

Post a Comment

0 Comments