Recent Tube

এমন সময় মসজিদ থেকে ভেসে এলো—আস সালাতু খাইরুম মিনান নাউম... মাহমুদুল হাসান।



 
 এশা পড়ে বের হলাম। মসজিদ থেকে অনতি দূরেই এক অনাহুত মানুষের সাথে সাক্ষাৎ।

 আমি মানুষটির চোখে চোখে তাকিয়ে থাকলাম। দৃষ্টি ফেরাতে চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি কোনোভাবেই পারছি না। যেন অদ্ভুত এক মায়ায় জড়িয়ে পড়েছি। খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে, কিন্তু একটুর জন্য পারছি না স্বরণে আনতে। 
ধ্যাত, এতটা অসার হলে হয়! 
মনে মনে ক্ষিপ্র হলাম নিজের ওপর। এরপর একবার ক্ষণিকের জন্য চোখ বন্ধ করে মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিলাম।

~ 'কী বৎস, চিনতে পারছ না আমায়? আমি কি এতটা অপরিচিত হয়ে গিয়েছি তোমাদের কাছে?'

 'ইয়াহু চিনেছি!' 
হঠাৎই যেন আমার স্বরণদৃষ্টি খুলে গেল। প্রায় চিৎকার করে বললাম—
~ 'আমিরুল মুমিনিন আপনি? 

আবেগের অতিশয্যে আমি এগিয়ে গিয়ে তাঁর হাতে চুমু দিতে চাইলাম। কিন্তু তিনি হাত সরিয়ে নিলেন। বললেন—
~ 'কী করছ বেটা? আমি এক নগণ্য মানুষ। এত মর্যাদা দেওয়ার কী প্রয়োজন?' 

~ 'আপনি, আপনি কী.....' 
আমার মুখে কথা আটকে গেল।

~ 'এত উত্তেজিত হয়ো না বেটা। আমি এসেছি তোমাদের এই শহর একটু ঘুরে ঘুরে দেখবো বলে।'

~ 'ইয়া আমিরুল মুমিনিন, এ আমাদের সৌভাগ্য। যদি কিছু মনে না করেন একটি আবদার করবো!'

~ 'মনে করার কিছু নেই, বলো।'

~ 'আমি আপনার সফরসঙ্গী হতে চাই। পূর্ণ করতে চাই আমার জীবনের সার্থকতা। দয়া করে আপনি অমত করবেন না।'

তিনি একটু মুচকি হাসলেন। বললেন— 
~ 'আচ্ছা ঠিক আছে। তবে আমার আশঙ্কা হচ্ছে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়বে।'

~ 'আজ আমার আত্মা আমার শরীরকে বাধ্য করবে।'

~ 'ঠিক আছে চলো, শুরু করি তাহলে।'

এরপর তিনি বিসমিল্লাহ বলে কদম ফেললেন। আমিও পিছু পিছু চললাম।

রাত তখন নটা। 
ঝলমল করছে পুরো শহর। ব্যস্ত সবখানে। হইচই আর চেঁচামেচিতে ভরপুর চারদিক। আমি তাঁর দিকে আড়ষ্টতা নিয়ে তাকালাম। দেখলাম, কপাল কিছুটা কুঞ্চিত। ভাবনার দুয়ার বন্ধ করার আগে তিনি কথা বলে উঠলেন।

~ 'আচ্ছা, এশা শেষ হয়েছে বেশ আগেই। রাত্রী প্রথম প্রহর চলছে। কিন্তু তারপরও এত লোকজন কেন? এরা কি ঘুমাবে না?'

আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। বললাম— 
~ 'আমিরুল মুমিনিন, সবে তো বাজার জমেছে। মধ্যরাত পর্যন্ত এভাবেই চলবে।'

~ 'বলো কী? এরা কি পকেট ভারী করতে দেহের ওপর জুলুম করছে? এশার পর আবার কীসের বাজার?' 

আর কিছু না বলে তিনি হাঁটতে থাকলেন। 

বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে আমরা একটা উপশহরের উপকণ্ঠে এলাম। তখন গভীর রাত্রী। এদিকটা কিছুটা নিরিবিলি। আমরা মূল রাস্তা ছেড়ে ছোটো রাস্তায় উঠলাম। এ এলাকায় বেশ কিছু বন্ধু এবং বড়ো ভাই থাকেন আমার। মাঝেমধ্যে তাদের সাথে আড্ডাবাজি চলে আমার।

হঠাৎ তিনি একটি ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে থামলেন। বাসাটাতে বেশ কয়েকজন বন্ধু থাকে আমার। তাদের কেউ কেউ ফোন চাপছে মনোযোগ দিয়ে। 

~ 'ছেলেরা কী করছে?'

~ 'আমিরুল মুমিনিন, তারা ফেসবুকে সময় দিচ্ছে।'

~ 'ফেসবুক কী?' 
ভাবান্তর ছাড়াই জানতে চাইলেন।

~ 'এটা একটা যন্ত্র। আল্লাহর দেওয়া মেধা কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবন করেছে আমাদের বিজ্ঞানীরা। এখানে অনেক মানুষ একসাথে কথা বলতে পারে, মত দিতে পারে। অর্থাৎ মন যায় চায় তা লিখে প্রকাশ করতে পারে। যারা এই লেখালেখি করে তাদের বলা হয়, এক্টিভিস্ট।'

~ 'এই যে এরা কোন ধরনের এক্টিভিস্ট?'

~ 'এরা ইসলামি এক্টিভিস্ট আমিরুল মুমিনিন।'

~ 'রাত্রী দ্বিপ্রহর চলছে। এখনও জেগে জেগে এই ইসলামি এক্টিভিস্টরা কী করছে? তাহাজ্জুদের জন্য অপেক্ষা করছে নাকি?'

আমি মাথা নিচু করলাম। বললাম—
~ 'না আমিরুল মুমিনিন। এরা ইসলামের পক্ষে বলছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে।'

~ 'এত রাত জেগে এসব খেদমত কে করতে বলেছে তাদের। এরা কি রাসূল স. এর সুন্নাহ জানে না? শরীরের হক সম্পর্কে ধারণা নেই? আচ্ছা, এরা ঘুমায় কখন?'

~ 'যখন তাহাজ্জুদের সময় হবে তখন।'

~ 'তাহাজ্জুদ না পড়ে ঘুমায়?'

আমি আবারও মাথা নিচু করলাম। 

তিনি আবার বললেন—
~ 'ফজর পড়ে কখন এরা?'

~ কেউ দেরিতে পড়ে আবার কেউ রুমেই পড়ে নেয়।'

~ 'কেন মসজিদ নেই তোমাদের।'

~ 'অবশ্যই আছে। আমাদের শহরকে বলা হয় মসজিদের শহর। বাসা থেকে যে কোনো দিকে কিছু কদম ফেললেই মসজিদ মেলে।'

~ 'তারপরও মসজিদে যাওয়া হয় না? এদের বাড়িগুলোতে তো আ-গুন দিয়ে জ্বা-লিয়ে দেওয়া জরুরি। তুমি বলছো রাত জেগে জেগে এরা ইসলামের খেদমত করে আর মসজিদে নামাজ পড়ার সময় হয় না? এত বড়ো ধৃষ্টতা, এত অধঃপতন! আবু বকর জীবিত থাকলে এদের ধড় নামানোর আদেশ দিতেন।'

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে আছি। তাঁর চোখের দিকে ক্ষণিকের জন্য তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করলাম। সাহস হলো না আবারও তাকানোর। জ্বলন্ত লাভার দিকে চেয়ে থাকার সাহস কার আছে, কোন পুরুষের?

আবার হাঁটা শুরু করলাম। 

ফজরের আজান দিলো। এর মধ্যে আর কোনো কথা বলার হিম্মত আমার হলো না। আমরা মসজিদে গেলাম। 

ধীরে ধীরে মসজিদে মুসল্লি আসা শুরু হলো। আমি ইমামের সাথে কথা বলার জন্য এক কদম বাড়ালাম। কিন্তু তিনি ইশারায় থামিয়ে দিলেন আমাকে। 

যথারীতি নামাজ শেষ হলো। বাহিরে বের হলাম।

~ 'আচ্ছা বেটা, তোমাদের শহরে মুসলমান কী পরিমান?'
~ 'প্রায় ৯০ ভাগ।'

~ ‘আচ্ছা এই যে পাঁচ তলা বিল্ডিং, এই বিল্ডিং-এ লোকজন থাকে না?'

~ ‘আমিরুল মুমিনিন, এটা তো মসজিদ! এখানে লোক থাকবে কেন? পুরোটাই নামাজের জন্য ব্যবহৃত হয়।'

~ 'কই আমি তো দেখলাম, নিচ তলার অর্ধেকও পূর্ণ হয়নি। 

~ 'না মানে, শুক্রবার পুরোটাই ভরে যায়। এরপর রাস্তায়ও নামাজ পড়তে হয়।'

~ তাই নাকি? ওরা ফজরে আসে না কেন?'

কী উত্তর দেবো? আমি ফ্যালফ্যাল করে তাঁর মুখপানে চেয়ে থাকলাম।

~ 'যারা ফজরে মসজিদে আসে না, তাদের আল্লাহর রাসূল সা. মুনাফিক বলে পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত করেছেন। আমাদের সময় মুনাফিকরা এশা এবং ফজরে মসজিদে আসতো না, কষ্ট হবে এজন্য। তোমাদের সমাজে দেখছি তো, মুনাফিকের সংখ্যাই ৯০ ভাগ। কে বলেছে ৯০ ভাগ মুসলমান?'

আমি নিশ্চুপ। কী জবাব দেবো তাঁকে?

~ 'আচ্ছা আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো বেটা।'

~ 'জি আমিরুল মুমিনিন। বলুন।'

~ 'আচ্ছা, তোমাদের সমাজের নারীরা কি বন্ধ্যা? তারা কি সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম?''

~ 'কই, না তো! এই প্রশ্ন কেন করলেন আমিরুল মুমিনিন?'

~ 'করলাম কারণ, তোমাদের মসজিদে তো কোনো শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবক দেখলাম না। যা গুটিকয়েক দেখেছি তাদের প্রায় সবাই মধ্যবয়স্ক কিংবা বৃদ্ধলোক।
আচ্ছা, তোমাদের তরুণ-যুবকরা কি হিজরত করে অন্য জায়গায় গেছে নাকি শ-হী-দ হয়েছে কোনো জি-হা-দে?'

~ 'গোস্তাখি মাফ করবেন আমিরুল মুমিনিন। পর্যাপ্ত সিং-হ-তেজি নওজোয়ান আছে আমাদের। কিন্তু ওরা ফজরে মসজিদে আসতে অনিচ্ছুক। মুয়াজ্জিনের আজান তাদের বিকার করাতে পারে না।'

~ 'ফজরে মসজিদে আসতে পারে না, তারা আবার কীসের সিং-হ-তেজি নওজোয়ান। ধিক! তারা তো সেই খচ্চ-রের মতো। যাদের শৌর্যবীর্যের কোনো চেতনা নেই। মাকাল ফলের মতো এদের অবয়ব। জিন্দা লাশের মতো আত্মা তাদের। এদের পিঠে কয়েক ঘা করে ফেললেই কিছুটা হুশে আসতে পারে।'
আচ্ছা তুমি ফজরে কোথায় নামাজ আদায় করো বেটা?'

এই প্রশ্ন করে তিনি আমার দিকে তাকালেন।

আমার দম বন্ধ হয়ে এলো। অবশ হয়ে এলো স্নায়ুতন্ত্র। দরদর করে ঘেমে যাচ্ছে শরীর। গলা শুকিয়ে কাঠ। এবার বোধহয় ঘা কয়েক আমার পিঠে পড়বে। তওবা করলাম মনে মনে। আল্লাহ এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচাও। কণ্ঠনালী দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। এখন একটু পানি দরকার। এখনই। আমি অস্পষ্ট স্বরে বলতে লাগলাম, পানি পানি...

ধড়মড় করে উঠে পড়লাম। নিশ্বাস নিলাম ঘনঘন। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম।

~ 'এই তোমার কী হয়েছে, এমন করছো কেন?'

চমকে উঠে শব্দপানে তাকালাম। অন্য কেউ নয়। ভদ্রমহিলা। তাকে দেখে আশ্বস্ত হলাম। কথা না বলে চুপ করে থাকলাম আমি। ধীরে ধীরে মনে পড়ে গেল সব। এসব কি তাহলে স্বপ্ন ছিল?

কিন্তু কেন?

ও আচ্ছা, মনে পড়ল। আমি তো 'উমর রা.-এর সাথে দেখা হয়েছিল' বই সম্পাদনা করছিলাম। সেখান থেকেই এই স্বপ্নের উপত্তি।

এমন সময় মসজিদ থেকে ভেসে এলো—আস সালাতু খাইরুম মিনান নাউম...

(এই একটি প্রকাশিত্য বইয়ের বিশেষ বিজ্ঞাপন।)

~ মাহমুদুল হাসান

Post a Comment

0 Comments