Recent Tube

এমন মানুষ দেখবো না আর এই ভবেতে ফের। আব্দুস সালাম আজাদী।




 এমন মানুষ দেখবো না আর এই ভবেতে ফের
------------------------- 

  নাম ছিলো আবুল খিজির মুহাম্মাদ আব্দুস সালাম, আমরা এ কে এম আব্দুস সালাম নামেই চিনতাম। গ্রেইট বৃটেইনে যারা ইসলাম প্রচারের কাজকে বেগবান করতে শক্ত হাতে কাজ করেছেন, তিনি ছিলেন তাদের অগ্রদূত। তার মূল বাড়ি সিলেটের উসমানী নগরের মুকতারপুরে। লন্ডনে আসেন ষাটের দশকে। তিনি সেই যুবক বয়সেই তৈরি করে  ছিলেন বিশ্বের বড় বড় স্কলারগণের সাথে সখ্যতা। বিশেষ করে সাঊদির ইমাম আব্দুল্লাহ ইবন বায, ডঃ আব্দুল মুহসিন আত তুরকী, সাবেক পেট্রলিয়াম মন্ত্রী ডঃ আব্দুহু ইয়ামেনী সহ ডঃ আহমাদ তুতুঞ্জি, মুহাম্মাদ কুতুব, ডঃ কামাল হিলবাওয়ী এবং পাকভারতের মাওলানা মাওদূদী ও শায়খ আবুল হাসান নাদাওয়ী। 

   তিউনিসিয়ার রাশেদ গানুশি তাকে বড় ভাই বলে ডাকতেন, সুদানের হাসান তুরাবির সাথে তিনি রেখেছিলেন ভ্রাতৃত্বের বন্ধন, ফিলাস্তিনের প্রফেসর ডঃ আযযাম তামিমি বরাবরই তাকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখেছেন, পাকিস্তানের খুররম মূরাদের সাথে ছিলো তার আবাল্য বন্ধুতা, ছিলো নাঈম সিদ্দীকীর প্রাণের ভাইজান। আর ছিলেন মালয়েশিয়ার আনোয়ার ইবরাহীমের প্রিয়পাত্র। 

  আমি নিজ চোখে দেখেছি পাকিস্তানের মিয়া মুহাম্মাদ তুফায়েল, ক্বাজি হুসায়ন আহমাদ, সাইয়েদ মুনাওয়ার তাকে সম্মানের চেয়ারে বসাতে, দেখেছি বৃটেইনের সর্বস্তরে মুসলিম নেতৃবৃন্দের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেতে।
 
  তিনি ছিলেন মাওলানা মাওদূদির খুবই আস্থা ভাজন। মাওলানা যখন বৃটেইনে এসে ইসলামি আন্দোলনের বীজ বপন করতে চাইলেন, এবং ইউকে ইসলামি মিশনের গোড়া পত্তন করেন, সেই প্রথম দিন থেকে জনাব আব্দুস সালাম ছিলেন নেতৃস্থানীয়। এমনকি আমীর ও ছিলেন তার। আজ এই সংগঠন বৃটেনে শত শত মসজিদ মাদ্রাসা এবং এখানের একমাত্র ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় মার্কফিল্ড ইন্সটিটিউট ফর হাইয়ার এডুকেশান (MIHE) প্রতিষ্ঠিত করেছে। যেখানে আব্দুস সালাম সাহেবের রয়েছে অনেক বড় অবদান। 

  আমি অনেক অনেক বার তার সাথে এই ইনস্টিটিউটে বিভিন্ন সেমিনার ও প্রোগ্রামে গেছি। দেখেছি ঐখানে তিনি অনেক শ্রদ্ধার আসন পেতেন। আকারে তিনি ছিলেন কিছুটা খাট, কৃশকায় কিন্তু কথা বলতেন অনেক ঋজুতায়, অনেক কনফিডেন্টের সাথে, অনেক বড় গলায় এবং প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রেখে। 

  বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইউকে ইসলামিক মিশন থেকে বাংলাদেশিদের আলাদা করে দাওয়াতুল ইসলাম ইউকে এন্ড আয়ার নামে নতুন সংগঠনের জন্ম হয়। সেখানে তিনি অনেক বার আমীর হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেছেন। তার আমীর থাকা অবস্থায় আমাদেরকে তিনি বাংলাদেশ থেকে আনেন, কারণ ছিলো তাদের প্রতিষ্ঠিত জামিয়াতুল উম্মাহ নামক প্রতিষ্ঠানকে সুন্দর ভাবে চালানো। এই দাওয়াতুল ইসলামের হাতেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইউরোপের সেরা মসজিদ ও প্রতিষ্ঠান ইস্ট লন্ডন মসজিদ। তাদের হাতেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইউকের সর্ব প্রথম ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “ইসলামিক কলেজ”। তাদের হাতেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইউকের প্রথম সারির চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান "মুসলিম এইড"।

   আমি তার সাথে যত বারই একান্তে বসেছি, ইতিহাসের নানা উত্থান পতনের ঘটনার থলে তিনি আমার সামনে মেলে ধরেছেন। ঋদ্ধ হতাম, জানতে পারতাম অনেক গভীর তথ্য। কিভাবে ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ পার্ট লন্ডনে দুইভাগ হয়, কারা কারা এখানে বড় বড় ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করে, কিভাবে বৃটেইনের মুসলিম কম্যুনিটিতে ফাটল ধরে- তার একটা ব্যাখ্যা আমি অনেকবার তার কাছে জানতে চেয়েছি। তিনি কারো নাম না ধরে একটা কথাই বলতেন, দেখেন ভাই, দাওয়াতুল ইসলামের উত্থান শয়তানের পছন্দ হয়নি। কারণ সে সময় গোটা ইউকেতে বাংগালি কম্যুনিটির যারা কোন ইসলামি সেন্টার  করতে চাইতেন আমাদের দ্বারস্ত হতেন। এবং আমাদের হাতেই তা তুলে দিতেন। সংগঠন দুইভাগ না হলে বাংলাদেশিদের মাঝে ইসলামের কাজ অনেক অনেকগুণ বেড়ে যেতো। 

  তিনি খুব গম্ভীর, সিরিয়াস ও রাসভারী লোক ছিলেন। পড়াশুনা করতেন। উর্দুতে তিনি খুব ভালো ছিলেন ফলে উর্দু সাহিত্যের ভান্ডার তার আয়ত্বে ছিলো। ইংরেজিতে ছিলেন পারদর্শি, একাউন্টিং এ তিনি ছিলেন খুব ভালো বিশেষজ্ঞ। তবে জামায়াতে ইসলামিতে তিনি অসম্ভব রকমের কমিটেড ছিলেন। এমনকি তার পড়া শুনার গন্ডীও এই ধারার লিটারেচারের বাইরে নেন নি কোনদিন। 

  আমাকে দিয়ে তিনি অনেক আর্টিকেল ও বইএর অনুবাদ করাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমার অনাগ্রহে তা হয়নি। একবার তিনি একটা আর্টিকেল আমার হাতে দিয়ে বললেন, আপনিই অনুবাদ করেন। উস্তাযাহ হুমায়রা মাওদূদির লেখা। আমি সময় বের করতে পারিনি বলে তিনি খুব ক্ষেপে ছিলেন। পরে উনি বুঝেছিলেন আমার দিয়ে অনুবাদের কাজ আর হবে না। একবার ডঃ আব্দুল হালীম আবু শুক্কার ৪ খন্ডে লেখা “রাসূলের যুগের নারী স্বাধীনতা” (تحرير المرأة في عهد الرسالة) বইটা আমার হাতে তুলে দেন, এবং বলেন, "আপনি আমার এই দাবিটা রাখবেন। এই বই এর আলোকে “ইসলামে নারী” বিষয়ক একটা লেকচার সিরীজ শুরু করেন"। আমি ঐ বইটাকে সামনে রেখে কুরআন ও সাহিহ হাদীসের আলোকে “পীস টিভিতে” ৪২ এপিসোডের একটা সিরীজ আলোচনা রেখেছিলাম। আমি মনে করি ইসলামি নারী অধিকারের উপরে আলোচনাটা ভালো কাজ করেছে। এই ক্ষেত্রে তার অবদান ভোলার মত না। 

  তার জীবদ্দশায় তার স্ত্রী ইন্তেকাল করেন। তিনি তার নিজের বাড়ি ছেলে সন্তানদের দিয়ে সরকারি বাড়িতে থাকতেন। প্রতি ঈদে আমরা তার সাথে দেখা করার সুযোগ নিতাম। গত রমাদানের ঈদে আমি, শায়খ আব্দুর রহমান মাদানি, শায়খ ডঃ আবুল কালাম আজাদ, শায়খ আবু তাহের তার বাসায় যাই। তাকে আমরা একটা খামে কিছু ঈদ গিফট দেই। তিনি খামে চুমা দেন এবং বলেন, একেতো ঈদের দিনের হাদীয়া, তার উপর আমার বাবারা নিয়ে এসেছেন, এটা আমার জন্য অনেক বড় বারাকাহ। পরে যখন দেখলেন এখানে অঙ্কটা একটু বেশি, মাদানি সাহেবকে টেলিফোন করে বললেন, আমি ভেবেছি ১০/২০ পাউন্ড হবে। কিন্তু আপনারা এতো গুলো দিলেন কেন, আমার তো টাকার অভাব নেই। আপনারা এটা নিয়ে যান। দুনিয়ার প্রতি তার এই অনীহা আমাকে মুগ্ধ করে। 

  তিনি খুব বড় স্কলার ছিলেন না। কিন্তু স্কলার তৈরি করতে পারতেন। তিনি আমাদের টিভি আলোচনা খুব নিবিষ্ট মনে শুনতেন। আমার আলোচনা শেষ হলে ফোন করতেন। বলতেন এই কথা টা, ঐ তথ্যটা, উমুক হাদীসটা আরেকবার চেক করবেন। আমি আপনার আলোচনা শুনে নোট করি। এভাবেই তিনি আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন, সম্মান দিয়েছেন, ভালোবেসেছেন, ভালোবাসা আদায় করেছেন। আমি যখন লন্ডনে পা রাখি, দাওয়াতুল ইসলামের আমীর হিসেবে তিনি আমাকে প্রথমে সাক্ষাতকার নেন। আমাকে সূরা ফাতিহা পড়তে বলেন। পড়া শেষের পর বললেন, صِرَاطَ এর “রা” যাবরের পর হারফে “ইস্তি’লার” “ত্বা” অক্ষরটা আসায় “রা” কে একটু বেশি তাফখীম করলে আরো ভালো শোনাতো। আমি উনার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি দিলাম। এরপর বললেন, আর কেও পরুক আর না পরুক আপনি নিয়মিত পাগড়ি পরবেন। আমার একটা সবুজ পাগড়ি আছে ঐটা আপনাকে দেব ইন শা আল্লাহ। আমি আরেক বার তার মুখের দিকে তাকালাম। মাদানি সাহেব মুচকি হেসে চোখের ইশারায় আমাকে বিতর্কে যেতে নিষেধ করলেন। আমিও একটু হালকা করে দিয়ে বললাম, “আমীর সাহেবের মাথায় পাগড়ি থাকলে মা’মূর রা তো পরবেই”। দেখলাম কথাটা উনার পছন্দ হয়েছে, এবং একটা স্নিগ্ধ হাসি বিনিময় করে আমাকে ক্লাসে যেতে বললেন।   
 
  তার জামাতা হলেন ইউকের প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার মাওলানা আব্দুল মালেক। ছেলে মেয়েদের তিনি ইসলামের উপরেই লালন পালন করেছেন। 

  আজ ০২/০৯/২০২২ শুক্রবার বিকেলে তিনি ইন্তেকাল করেছেন ঘুমের ভেতরেই। ১০ দিন আগে শায়খ মাদানিকে তিনি ফোন দিয়েছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন, ২৬ আগস্ট পর্যন্ত তিনি লন্ডনে আছেন কিনা। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা। ঐদিনে আমার নাতি দেশ থেকে ফিরবে। এর মধ্যেই যদি আমি মরে যাই আপনি জানাযা পড়াবেন। আর এর পরে মারা গেলে আমার নাতি জানাযা পড়াবে। মাদানি সাহেব তাকে এই নিয়ে চিন্তা না করার জন্য অনুরোধ জানালে তিনি বলেন, আমার শেষ সময় এসে গেছে। দুয়া করবেন যেন ঈমানের সাথে শুক্রবারে আমার মরণ হয়। 

  তিনি নামায আদায় করে ঘুমিয়ে পড়েন। এবং ঐ ঘুমের মাঝেই খুব আরামের সাথে তার চাওয়া দিনেই আল্লাহর রহমতের চাদর গায়ে নিয়ে ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ আমার মুরুব্বিকে মাফ করে দিন। জান্নাতুল ফেরদাউসের মেহমান বানিয়ে নিন।

Post a Comment

0 Comments