Recent Tube

জুমার খুতবা আরবিতে হতে হবে নাকি মাতৃভাষায়? আসলাম হোসাইন।


জুমার খুতবা আরবিতে হতে হবে নাকি মাতৃভাষায়?
(একটি গবেষণাধর্মী দলিলভিত্তিক পর্যালোচনা)
------------------------------------------------
জুমার খুতবা নিয়ে আমার গত দিনের পোস্টে যারা বিভিন্ন প্রশ্ন করেছেন এবং যাদের মনে বিভিন্ন প্রশ্ন জেগেছে তারা এখান থেকে নতুনভাবে চিন্তার খোরাক পাবেন আশা করি। 

#আরবি ভাষায় খুতবা দেওয়ার পক্ষের লোকদের দলিল হচ্ছে, #প্রথমত: রাসুল সা., সাহাবায়ে কেরাম ও প্রাচীন মুসলিমগণ সব সময়ই আরবিতে খুতবা প্রদান করেছেন এবং অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার করেননি। তারা বলেন, রাসুলুল্লাহ সা.-এর বৈঠকে কখনো কখনো অনারবি ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকতো কিন্তু কোনো আয়াত থেকে জানা যায় না যে, তিনি তাদেরকে বুঝানোর জন্য আরবি ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় ভাষণ দিয়েছেন।

#খণ্ডন: যারা এই যুক্তি দিয়ে থাকেন তাদের এখানে একাধিক গলদ রয়েছে। যেমন: #প্রথমত তারা শরিয়ত সম্মত কর্মকাণ্ড এবং প্রথাসিদ্ধ ও স্বভাবসুলভ কর্মকাণ্ডের মধ্যে এবং সুন্নত ও তার উপকরণের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেন না। মূলত খুতবা হচ্ছে ইবাদত, ভাষা তার উপকরণ। যেমন হজ হচ্ছে ইবাদত আর হজে যাওয়ার বাহন তার উপকরণ। যদি বাহনকে ইবাদত ধরা হয় তাহলে রাসুলুল্লাহ উটে চড়ে হজে গিয়েছিলেন, এখন আমাদেরকেও উঠে চড়ে হজে যাওয়া লাগবে। আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কারো পক্ষেই এ ফরজ আদায় করা সম্ভব নয়। অনুরূপ ভাষাকে ইবাদত মনে না করে উপকরণ হিসেবে ধরলে আর কোনো সমস্যা থাকে না। 

#দ্বিতীয়ত: রাসুলের সা. ভাষা ছিল আরবি । যাদের সাথে তার কথা বলার সম্পর্ক ছিল তারা সকলে হয় আরব ছিল অথবা এমন অনারব ছিল যারা আরবি এলাকায় বসবাস করত এবং আরবি ভাষা সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ছিল । যেমন হজরত সালমান ফারসী রা.। তাদের সামনে তিনি আরবি ছাড়া আর কোন ভাষায় খুতবা দিবেন? অনুরূপ সাহাবায়ে কেরামও বিভিন্ন দেশে গিয়ে যে সব লোকদের সামনে বক্তৃতা দিয়েছেন তাদের অধিকাংশ লোকই আরবি জানতো, বুঝ‌তো, তাই আরবি ভাষাভাষী নবী বা তাঁর অনুসারীরা আরব-অনারব জনগণের সামনে আরবিতে বক্তৃতা দিবেন, এটা তো একটা স্বভাবসুলভ কাজ। এটাকে শরিয়তের ব্যাপারে দলীল হিসেবে গ্রহণ করা কিভাবে যুক্তিসঙ্গত হতে পারে? তিনি যদি বলতেন যে, খুতবা আরবি ভাষায় দিতে হবে এবং অন্য কোনো ভাষায় দেওয়া যাবে না, তাহলে সেটা অবশ্যই শরিয়তের ব্যাপারে দলিল হত।
,
#দ্বিতীয় যুক্তি হিসেবে তারা খুতবাকে সালাতের স্থলাভিষিক্ত করেছেন। তারা বলেন যে, জুমার সালাত জোহরের মতো চার রাকাত ছিল । খুতবার জন্য দুই রাকাত কমিয়ে তার পরিবর্তে দুইটি খুতবা চালু করা হয়েছে। কেননা কোনো কোনো বর্ণনা থেকে জানা যায়, হজরত উমরসহ কিছু সাহাবি ও তাবেঈ বলেছেন যে, খুতবার কারণে জুমার সালাত সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে ।

#খণ্ডন: প্রথমত তারা সাহাবি ও তাবেঈদের এই কথার স‌ঠিক মর্মার্থ বুঝতে পারেননি। এখানে সলফে সালেহীন খুতবার গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে বলেছেন যে, খুতবায় উপস্থিতি এত গুরুত্বপূর্ণ যে, এর জন্য সালাতকে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে । তারা খুতবাকে সালাতের স্থলাভিষিক্ত করেননি। আর কয়েকটা কারণেই তাদের এই যুক্তি সঠিক নয়। যেমন:
১. নামাজের জন্য অজু শর্ত কিন্তু খুতবার জন্য অজু শর্ত নয়।
২. নামাজের জন্য কেবলামুখী হওয়া শর্ত কিন্তু খুতবার জন্য তা জরুরি তো নয়ই বরং কিবলার দিকে পিঠ দিয়ে মুক্তাদির দিকে মুখ করে খুতবা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
৩. নামাজের মধ্যে কথা বললে নামাজ নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু খুতবার সময় প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলা জায়েজ। স্বয়ং রাসুলুল্লাহও সা. খুতবার মধ্যে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেছেন।
৪. দাঁড়িয়ে ইমামতি করা ফরজ কিন্তু দাঁড়িয়ে খুতবা দেওয়া ফরজ নয়। হেদায়া গ্রন্থকার বলেন, ولو خطب قاعدا أو على غير طاهرا جاز لحصول المقصود " ইমাম সাহেব যদি বসে খুতবা দেন কিংবা অপবিত্র অবস্থায় খুতবা দেন তাহলে তা জায়েজ, কেননা তাতেও উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় । (হেদায়া 1/82)

ইমাম ইবনে খুযাইমা বলেন،
ان الخطبة ليست بالصلاة
 "খুতবা সালাতের অংশ নয়"।
(সহীহ ইবনে খুযাইমা, ২/২৫২)
হানাফি মাজহাবের ইমাম ও ফকিহ আল্লাহ সারাখসী বলেন, 
والأصح أنها لا تقوم مقام الشطر الصلاة 
"সঠিক মত হল খুতবা সালাতের অংশ নয় বা দুই রাকাতের স্থলাভিষিক্ত‌ও নয়। কারণ খুতবায় কিবলামুখী হতে হয় না, কথাবার্তা বললে খুতবা নষ্ট হয় না, অজু ছাড়া খুতবা দিলেও তা আদায় হয়ে যায়। (আল মাবসূত, ২/৩১৩)।

#তৃতীয় যুক্তি হিসেবে তারা বলেন যে, কুরআনে বলা হয়েছে, فسعوا إلى ذكر الله । এখানে জিকির বলতে খুতবাকে বুঝানো হয়েছে । আর জিকির আরবি ভাষায় হতে হবে।

#খণ্ডন: প্রথম কথা হচ্ছে জিকির আরবি ভাষায় হতে হবে এটা হানাফি মাযহাব বিরোধী ফতওয়া। কেননা ইমাম আবু হানিফা বলেছেন, الذكر يحصل بكل لسان "যে কোনো ভাষাতেই জিকিরের উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে"। (আল মাবসূত 1/36)। এছাড়া এই জিকির দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কার‌ও মতে খুতবা উদ্দেশ্য, আবার কারো মতে খুতবা ও সালাত দুটি উদ্দেশ্য আবার কেউ কেউ বলেছেন যে, শুধু সালাত উদ্দেশ্য। এখানে জিকির দ্বারা উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, যারাই জিকির দ্বারা খুতবা উদ্দেশ্য নিয়েছেন তারা প্রত্যেকেই খুতবা বলতে ইমামের ওয়াজ, নসিহত ও উপদেশ বুঝিয়েছেন। আর এগুলো তো মাতৃভাষায় হওয়াই যুক্তিসঙ্গত।

সাঈদ ইবনু মুসাইয়্যিব বলেন, এই আয়াত দ্বারা বুঝানো হয়েছে, موعظة الامام "অর্থাৎ ইমামের নসিহত।" (আইনী, উমদাতুল কারী , 6/162)
ইমাম ইবনে হুমাম বলেন,
 فالظاهر ان المراد بالذكر  الصلاة ويجوز كون المراد به الخطبة " 
এই আয়াতে জিকির অর্থ বাহ্যত সালাত তবে খুতবা অর্থ‌ও হতে পারে। (ফাতহুল কাদীর, 2/49)
ইমাম যারকানী বলেন,  
موعظة الإمام بالخطبة أو الصلاة أو هما معا  
"এই আয়াত দ্বারা খুতবার মাধ্যমে ইমামের নসিহত অথবা সালাত অথবা একসাথে দুটোই বুঝায়" (শরহে যারকানী 1/389)
তাফসীরে তাবারীতেও বলা হয়েছে, মাওইযাতুল ইমাম। (23/384)
ইমাম সরাখসী বলেন, والخطبة كلها وعظ وأمر بمعروف "খুতবা তো পুরাপুরি ওয়াজ ও ন্যায়ের আদেশ" । (আল মাবসূত ২/৩২৫) । 

বিভিন্ন হাদিসেও জুমার খুতবাকে ওয়াজ বলা হয়েছে। (সহিহ আবু দাউদ, ১/৯৫; মুসনাদে আহমদ, (৫/৯৯; ৪/২৬৮; হাইসামী , মাজমাউয যাওয়াইদ , ২/১৮৮)। আর ওয়াজ তো মাতৃভাষাতেই হতে হবে। 
وما ارسلنا من رسول الا بلسان قومه ليبين لهم

#চতুর্থ যুক্তি হিসেবে তারা বলেন, বাংলা খুতবা দিলে বাংলায় নামাজ‌ও পড়তে হবে।

#খণ্ডন: তাদের এই যুক্তি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা দুইটার মৌলিকত্ব ও উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। নামাজের নির্দিষ্ট পদ্ধতি এবং নির্দিষ্ট শব্দাবলী রয়েছে , এর বাহিরে যাবার কোনো সুযোগ নেই । তাই যে ব্যক্তি আরবি জানেন তিনি সামান্য একটু সময় ব্যয় করলেই সহজে তার অনুবাদ মুখস্ত কিংবা মর্মার্থ বুঝে নিতে পারেন। কেননা এর শব্দ বিন্যাস একেবারেই সীমিত। কিন্তু খুতবার ব্যাপারটা ঠিক এর বিপরীত। এর কোনো শাব্দিক রূপ নেই। প্রত্যেক জুম্মার একটা নতুন খুতবা দিতে হয় । এবং আগ থেকে তা অনুবাদ করে বুঝে নেওয়া বা বাড়ি থেকে হৃদয়াঙ্গম করে আসা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

১. তাই সবার জন্য আরবিকে বাধ্যতামূলক করার নিশ্চিত ফল এই হবে যে, আরবি না জানা লোকদের জন্য এটা একটা নিরর্থক জিনিস এবং একটা নিষ্প্রাণ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হবে। এতে করে খুতবা প্রবর্তনের শরিয়তে যেসব উদ্দেশ্য নিহিত ছিল তা শেষ হয়ে যাবে। একজন সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ বুঝতে পারে যে, তুর্কি ভাষাভাষীর সামনে জার্মানি ভাষায় বক্তৃতা করা একটা অহেতুক অনুষ্ঠান ছাড়া আর কিছু নয়। যে মহাবিজ্ঞানী শরিয়তের বিধান প্রণয়ন করেছেন তার সম্পর্কে কিভাবে এরূপ ধারণা করা চলে যে, ইসলামের নির্দেশনা বলে বুঝানো এবং নৈতিক শিক্ষা প্রদানের জন্য তিনি আদৌ বুঝতে পারে না এমন বক্তৃতা দেওয়ার নির্দেশ দেবেন?

২. যদি রাসুলের অনুসরণ করনার্থে আরবি ভাষায় খুতবা দেওয়া জরুরি হতো তাহলে খুতবার মধ্যে রাসুলুল্লাহ যেসব শব্দের প্রয়োগ করেছেন সাহাবায়ে কেরাম সেই রকম শব্দ প্রয়োগ করে তাঁর পূর্ণ অনুসরণ করতেন কিন্তু কোনো সাহাবি রাসুলুল্লাহর এই অনুসরণ করেননি বরং প্রত্যেকেই সৃজনশীল পদ্ধতিতে খুতবা দিয়েছেন। 

৩. বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায়, রাসুল সা. খুতবার মাধ্যমে বিভিন্ন উপদেশ দিতেন , নির্দেশ দিতেন, বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিতেন । আর এগুলো তো এমন ভাষায় হওয়া বাঞ্চনীয় , যে ভাষায় বললে শ্রোতা বুঝতে পারে। 

৪. রাসুল সা. ও তাঁর সাহাবারা খুতবা দিতেন, ওয়াজ করতেন কিন্তু আমরা তো খুতবা দেই না বরং খুতবা পড়ি। বই দেখে আবেগহীন সুরে কিছু আরবি তিলাওয়াত করি অথচ এই রকম ‌বেবুঝ পড়া সুন্নত নয়, সুন্নত হচ্ছে আবেগময় ওয়াজ করা।

৫. যদি আরবিতে খুতবা দিতেই হয় তাহলে একটি বই দেখে না বুঝে কিছু আরবি বাক্য পাঠ করার চাইতে তো কুরআন তিলাওয়াত করাই উত্তম। কেননা কুরআন তিলাওয়াত করলে অর্থ না বুঝলেও অন্তত প্রতি অক্ষরে ১০-১০ করে নেকি পাওয়া যাবে। 

#ইমাম_আবু_হানিফার_মত:

ইমাম আবু হানিফার মতে মাতৃভাষায় খুতবা দেওয়া জায়েজ। তিনি বলেন, "যে কোনো ভাষাতেই জিকিরের উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে"। (আল মাবসূত 1/36) ।" বলাবাহুল্য যে, খুতবা একটি জিকির। তাঁর মতে সালাতে তাকবিরে তাহরিমা ফারসি ভাষায় বললে তা জায়েজ হবে। আর হানাফি মাজহাবের সর্বসম্মত ফ‌ত‌ওয়া হচ্ছে যে, আরবি ভাষা জানেন এমন ব্যক্তিও প্রাণী জবাই করার সময় ফার্সিতে (মাতৃভাষায়) আল্লাহর নাম নিলেও তার প্রাণী হালাল হয়ে যাবে। (আল মাবসূত, ১/৩৬-৩৭)

মাতৃভাষায় তাকবিরে তাহরিমা বললে যদি তা জায়েজ হয়, পশু জবাই করার সময় যদি মাতৃভাষা জিকির করা জায়েজ হয় , যে কোনো ভাষাতেই জিকির করলে যদি উদ্দেশ্য হাসিল হয় তাহলে খুতবা দেওয়ার সময় মাতৃভাষায় বক্তব্য দিলে নাজায়েজ হ‌ওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই বরং মাকাসিদুস শারয়্যিয়াহ বা উদ্দেশ্যের দিকে লক্ষ রেখে মাতৃভাষাতেই খুতবা দেওয়া উত্তম। 

(এটা আমার সামান্য গবেষণা । যদি শুদ্ধ হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে আর যদি ভুল হয়ে থাকে তাহলে আমার ও শয়তানের পক্ষ থেকে।)
------------------------- 
লেখক : ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক, প্রবন্ধ লেখক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। 

#Aslam_Hussain

Post a Comment

0 Comments