Recent Tube

জি-হাদের অপপ্রয়োগ, অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার;প্রতিরোধে চাই সতর্কতা, সচেতনতা ও সাবধানতা- শামছুদ্দোহা আশরাফী হাফি.




জি-হাদের অপপ্রয়োগ, অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার;
প্রতিরোধে চাই সতর্কতা, সচেতনতা ও সাবধানতা-

 জি-হা-দ ফি সাবিলিল্লাহ। নামাজ, রোজা, হজ যাকাত ইত্যাদি ইবাদতের মত একটি স্বতন্ত্র ও স্বকীয় ইবাদত। যা পরিবেশ-পরিস্থিতি তথা স্থান, কাল, পাত্র ভেদে কখনো ফরজে আইন আবার কখনো ফরজে কিফায়াহ। অন্যান্য ইবাদতের মত এ ইবাদতকেও ইচ্ছাকৃতভাবে  অস্বীকারকারী, সন্দেহ পোষণকারী, তুচ্ছতাচ্ছিল্যকারী,অপরাধ আখ্যাদাতা কাফের-মুরতাদ গণ্য হবে।

বিধানগত দিক থেকে জিহা-দকে অন্যান্য ইবাদাতের মত মনে হলেও প্রয়োগ ও বাস্তবায়নগত দিক থেকে বেশ ভিন্নতা রয়েছে। ফলে স্পর্শকাতর ও শর্তযুক্ত এ ইবাদত অনেক সময় অবহেলা, অপব্যাখ্যা ও অপপ্রয়োগের  শিকার হয়েছে।  সংক্ষেপে তার কিছু নমুনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। 

নমুনা (১)-
জিহা-দ শব্দের অপপ্রয়োগ ও  অপব্যবহারের অন্যতম নমুনা হল, পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের দোসর মডারেট মুসলিমরা। তারা ইসলাম ও মুসলমানদের উপর যাবতীয় অন্যায় অবিচারবে বৈধতা দেয়ার জন্য উগ্র (fanatic), মৌলবাদী (fundamentalist) এর পাশাপাশি আরেকটা শব্দকেও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে সেটা হল, জিহা-দিস্ট (jihadist)। জিহা-দিস্ট বা জিহা-দপন্থী। আরবি ‘মুজাহি-দুন’ শব্দটির ইংরেজির বিকৃত ভাষান্তর হলো,  (terrorist) সন্ত্রাসী। মতলবটা পরিস্কার। পৃথিবীর সকল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জি-হাদ শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে ইসলামফোবিয়া ছড়ানো। 

উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লেখক, সংবাদপত্র ও বিশ্লেষক বিশেষ করে যারা ইসলামবিদ্বেষী, তারা এই ‘জিহা-দিস্ট’ শব্দকে বেশ জোরেশোরেই ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। এটা তারা ‘সন্ত্রাসী’র সমার্থক হিসেবেই ব্যবহার করছেন। প্রকৃতপক্ষে কোনোভাবেই সন্ত্রাস জিহাদের কোনো অনুবাদ নয়। jihadist হচ্ছে জিহাদ শব্দের প্রকৃত ব্যবহারের বিপরীতে একটি কটূক্তিপূর্ণ ব্যবহার।

মুলত জি-হাদকে যদি সহজে বুঝাতে চাই তাহলে সেটাকে একটি রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার সাথে তুলনা করা যায়। বিশ্বের  প্রতিটি রাষ্ট্র যেমন তার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, শত্রু পক্ষকে প্রতিহত করা এবং নিজেদের প্রভাব বিস্তার ও সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন বাহিনী গঠন করে থাকে । ঠিক তেমনিভাবে ইসলামী রাষ্ট্রও তার সার্বভৌমত্ত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষার্থে এধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের বৈধতা রাখে।  এই প্রক্রিয়াকে জিহাদ ও  এ ধরনের বাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্টদেরকে ইসলামী পরিভাষায় মুজাহিদ বলা হয়েছে। ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আশা করি বিষয়টা ক্লিয়ার হয়ে যাবে।

আজকের পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের দোসরদের জি-হাদ ও মুজা-হিদ ইত্যাদি শব্দসমূহের বিকৃত ও  উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহারের মূল টার্গেট হল ইসলামী রাষ্ট্রের সামরিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দূর্বল করে দেয়া। প্রকান্তরে ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই স্বীকার না করা।  আর নিজেদের দেয়া বিকৃত নামকে পুঁজি করে নিরপরাধ মুসলিম হত্যাকে বৈধতা দেয়া।
 
নমুনা (২)
জি-হাদের নামে সাধারণ মানুষকে হত্যা করা, বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার মত ন্যাক্কারজনক ঘটনাগুলো মুলত পশ্চিমাদের প্রচারণাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যেই তাদের এ অপতৎপরতা। 

যার উজ্জল দৃষ্টান্ত হল আজকের আইএস। বিশ্বব্যাপী তারা ইসলামের নামে যে নৈরাজ্য পরিচালনা করছে এটা কোনভাবেই শরয়ী দৃষ্টিতে সমর্থনযোগ্য নয়। জিহাদের নামে মসজিদের বোমা হামলা,সাধারণ মুসলমানদের উপর আক্রমণ, মতের বাহিরের লোকদেরকে হত্যা বৈধ মনে করা এসবই ইসলাম হহির্ভুত। 

 বাংলাদেশেও ২০০৫ সালে জেএমবি নামক একটি সন্ত্রাসী সংগঠন দেখেছিলাম। যারা সারাদেশব্যাপী বোমা হামলা করে,নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করে ,মসজিদে ঈদগাহে বোমা মেরে মানুষ হত্যা করার নাম দিয়েছিল আসলে এসব জিহাদ নয় বরং সরাসরি সন্ত্রাস। এদেশের উলামায়ে কেরাম তাওহীদি জনতা তাদরেকে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করেছিল। এদের ব্যাপারে আমাদের পরিস্কার ঘোষণা হল, তারা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কাজ করছে না। বরং মুসলমানদের হত্যার মিশনে বিধর্মীদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।

যদি তারা সত্যিকার ইসলামের জন্যই কাজ করতো, তাহলে তারা মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী রাষ্ট্রগুলোকে তছনছ না করে সরাসরি ইজরাইল ও মিয়ানমারের মত মানবতার দুশমন রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করতো।

তাই তাদের থেকেও সতর্ক থাকা জরুরী।

وَمَن يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا [٤:٩٣]

যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাক্রমে মুসলমানকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম, তাতেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্যে ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন। [সূরা নিসা-৯৩]

নমুনা ( ৩)-
দ্বীনী যে কোন কাজকেই জিহাদ আখ্যা দেয়া এবং সেটাকে শরয়ী জেহাদের পর্যায়ভুক্ত, সমকক্ষ, স্থলাভিষিক্ত মনে করা। এ শ্রেণির মানুষদের ভুলের বড় একটা কারণ হল শাব্দিক অর্থ, হাকীকী অর্থ ও শরয়ী অর্থের মাঝে পার্থক্য না করে বা না জেনে তালগোল পাকিয়ে ফেলা। 

জি হা দ শব্দটি শব্দগত দিক থেকে দ্বীনি যেকোন কাজকেই অন্তর্ভুক্ত করে এবং বিশেষ কিছু ইবাদতকে শর্ত ও পরিস্থিতি সাপেক্ষে জি হা দ নামে নামকরণ বা সমপর্যায়ের নেকির কথা বলা হলেও শরয়ী জিহাদ তথা কিতাল একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। কোন মুসলমানের জন্য উচিত হবে না যে কিতালের মত পবিত্র ও স্বতন্ত্র ইবাদতকে ভুলব্যাখ্যার মাধ্যমে অন্য ইবাদতের সাথে গুলিয়ে ফেলবে। বরং এর মাধ্যমে শরয়ী একটি বিধানকেই প্রকারান্তরে অস্বীকার করা হবে বৈকি। 

এ ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানী হাফি. তার বিখ্যাত গ্রন্থ তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিমে ৩/৫ পৃষ্ঠায় লিখেন-

"সবগুলো সংজ্ঞার মূল বক্তব্যকে যদি আমরা এক কথায় নিয়ে আসতে চাই তাহলে বলা যায়, জিহা-দ মানে শুধুই সরাসরি (সশস্ত্র) যুদ্ধ নয়। বরং আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করা ও কুফফারদের অবদমিত করার প্রতিটি প্রচেষ্টাই জিহা-দের অন্তর্গত। এটা অস্ত্র, সম্পদ, কর্ম, কলম, জবান যে কোনটা দ্বারা হতে পারে। তবে জিহা-দ শব্দটা যখন প্রয়োগ করা হয় তখন অধিকাংশ অবস্থায় উদ্দেশ্য নেওয়া হয়, কুফফারদের সাথে যুদ্ধ করাকে। হ্যা, বাক্যের কোন স্পষ্ট আলামত যদি যুদ্ধ ব্যতিরেকে অন্য কোন অর্থের ইঙ্গিত করে তাহলে তখন সে অর্থই উদ্দেশ্য হবে। 
  
যেমন,  এর দ্বারা অনেক সময় নফসের বিরুদ্ধে  লড়াইকেও বুঝায়। তবে তা রূপক অর্থে। সুতরাং আলাদা কোন আলামত বিদ্যমান না থাকলে ভিন্ন অর্থের দিকে যাওয়া যাবে না।"

উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায় , জি হাদ শুধু কি-তালেই সীমাবদ্ধ নয় অন্যান্য দ্বীনি কাজও এর অন্তর্ভুক্ত। তবে শরয়ী জি হাদ বলতে কেবল কি-তালকেই বুঝানো হয়েছে। অন্যান্য দ্বীনি কাজ কখনো হাকিকি অর্থে শরয়ী জিহাদের পর্যায়ভুক্ত বা সমকক্ষ হতে পারেনা। 

ওই কাজগুলোর আসল পরিচয় যা তাই ঠিক থাকবে।  আল্লাহ চাহে তো  মুল্যায়নগত / সওয়াবের দিক থেকে জি-হাদের সওয়াব পাওয়ার আশা করতে পারে। 

যেমন কেউ ইসলামের পক্ষে লেখালেখি করলো, ইসলামের পক্ষে বক্তব্য  দিল এসব কাজ বিশেষ শর্তসাপেক্ষে ‍রুপকভাবে জি-হাদের অন্তর্ভুক্ত হলেও এগুলোকে সরাসরি জি হাদ নামকরণ করা বা শরয়ী জি- হাদের স্তরে মনে করার সুযোগ নেই। যেমন কেউ লেখালেখি করছে কিন্তু বলছে- জি হাদ করছি! অথবা মাহফিল ময়দানে বক্তব্য দিচ্ছে আর বলছে জি হাদ করছি !! এসব বলার সুযোগ নেই। মূলত এগুলো দ্বীন বিকৃতির অনুঘটক। 

তেমনিভাবে প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রচেষ্টা বা ভোটে অংশগ্রহণকে জি হাদ বা জি হাদের বিকল্প/সমকক্ষ মনে করা যাবে না। প্রশ্নবিদ্ধ এ পদ্ধতির বৈধতা-অবৈধতা,জায়েয না জায়েয হওয়াই যেখানে বিতর্কিত সেখানে এ পদ্ধতিকে জি হাদ আখ্যা দেয়ার সুযোগ কোথায়? 

বরং যেহেতু উলামায়ে কেরামের বিশাল জামায়াত প্রচলিত ইসলামি রাজনীতিকে বৈধতা দিয়েছেন এবং এর মাধ্যমে দ্বীন প্রতিষ্ঠার মেহনতকে অনুমোদন দিয়েছেন এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ। এটাকে জোর করে জি হাদ বানানো বা জি হাদের সমকক্ষ নির্ধারণের প্রয়োজন নেই। 

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সিরাতে মুস্তাকীমের উপর পরিচালিত করুন।
-------------------------------------------------- 
লেখক : ইসলামিক গবেষক, আলোচক, মুফতী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
--শায়েখ Mufti Shamsuddoha আশরাফী হাফি.

Post a Comment

0 Comments