Recent Tube

কুরআনের মর্মকথা ---১ম পর্ব ; শামিম আজাদ।



কুরনের মর্মকথা
           ------ ১ম পর্ব,

কুরআনের স্বচ্ছন্দ অনুবাদ ও ভাব প্রকাশ

কুরআনের অনুবাদের ক্ষেত্রে আমি এখানে শাব্দিক অনুবাদের পদ্ধতি পরিহার করে স্বাধীন-স্বচ্ছন্দ অনুবাদ ও ভাব প্রকাশের পদ্ধতি অবলম্বন করেছি। এর পেছনে আমার শাব্দিক অনুবাদ পদ্ধতিকে ভুল মনে করার মতাে কোনাে ধারণা কার্যকর নেই। বরং মিল্লাতে ইসলামিয়ার বড় বড় মনীষী এবং শ্রেষ্ঠ ইসলামী জ্ঞান সম্পন্ন আলেমগণ বিভিন্ন ভাষায় এ দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন। তাই এ পথে নতুন করে অগ্রসর হবার তেমন কোনাে প্রয়ােজন আমি দেখিনি। তবে এমন কিছু প্রয়ােজন আছে যা শাব্দিক অনুবাদে পূর্ণ হয় না এবং হতে পারে না। স্বাধীন-স্বচ্ছন্দ অনুবাদ ও ভাব প্রকাশের মাধ্যমে আমি সেগুলােকে পূর্ণ করার চেষ্টা করেছি।
শাব্দিক অনুবাদের আসল লাভ হচ্ছে এই যে, পাঠক কুরআনের প্রতিটি শব্দের মানে জানতে পারে। প্রতিটি আয়াতের নীচে তার অনুবাদ পড়ে তার মধ্যে কি কথা বলা হয়েছে তা জানতে পারে। কিন্তু এই পদ্ধতিটির এই লাভজনক দিকের সাথে এর মধ্যে এমন কিছু অভাব রয়ে গেছে যার ফলে একজন আরবী অনভিজ্ঞ পাঠক কুরআন মজীদ থেকে ভালােভাবে উপকৃত হতে পারে না।

১. শাব্দিক অনুবাদ পড়তে গিয়ে সর্ব প্রথম রচনার গতিশীলতা, বর্ণনার শক্তি, ভাষার অলংকারিত্ব ও বক্তব্যের প্রভাব বিস্তারকারী ক্ষমতার অভাব অনুভূত হয়। কুরআনের প্রতিটি ছত্রের নীচে শাব্দিক অনুবাদের আকারে পাঠক এমন একটি নিষ্প্রাণ রচনার সাথে পরিচিত হয়, যা পড়ার পর তার প্রাণ নেচে ওঠে না, গায়ের পশম খাড়া হয়ে যায় না, চোখ দিয়ে অশ্রুধারা প্রবাহিত হয় না এবং তার আবেগের সমুদ্রে তরংগও সৃষ্টি হয় না। কতকগুলাে নিষ্প্রাণ বাক্য পড়ার পর সে মােটেও অনুভব করে না যে, কোনাে বস্তু তার বুদ্ধি ও চিন্তা শক্তিকে জয় করে হৃদয় ও মনের গভীরে নেমে যাচ্ছে। এই ধরনের কোনাে প্রতিক্রিয়া হওয়া তাে দূরের কথা বরং অনুবাদ পড়ার সময় অনেক সময় মানুষ ভাবতে থাকে, এটি কি সেই গ্রন্থ যার একটি বাক্যের অনুরূপ একটি বাক্য রচনা করার জন্য সারা দুনিয়াবাসীকে চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছিল? এর কারণ, শাব্দিক অনুবাদ সব সময় নীরস হয়। এর মাধ্যমে মূল বিষয়ের রসাস্বাদন কোনাে ক্রমেই সম্ভব হয় না। কুরআনের মূল রচনার প্রতিটি বাক্য যে গভীর সাহিত্য রসে সমৃদ্ধ অনুবাদে তার সামান্যতম অংশও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। অথচ কুরআনের প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে তার পবিত্র ও নিষ্কলুষ শিক্ষা এবং তার
উন্নত বিষয়বস্তুর অবদান যতটুকু তার সাহিত্যের অবদানও সে তুলনায় মােটেই কম নয়। কুরআনের এই বস্তুটিই তাে পাষাণ হৃদয় মানুষের দিলও মােমের মতাে নরােম করে দেয়। এটিই বজ্রপাতের মতাে আরবের সমগ্র ভূখন্ডকে কাঁপিয়ে তােলে। এর চরম শত্রুরাও এর প্রভাব বিস্তারের যাদুকরী ক্ষমতার স্বীকৃতি দিতাে। তারা এর ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত থাকতাে। কারণ তারা মনে করতাে, যে ব্যক্তি একবার এই যাদুকরী বাণী শুনবে সে এই বাণীর কাছে তার হৃদয়-মন বিক্রি করে বসবে। কুরআনের মধ্যে যদি এই সাহিত্যের অলংকার না থাকতাে এবং অনুবাদের ভাষার মতাে নীরস ও অলংকারহীন ভাষায় তা নাযিল হতাে, তাহলে কুরআনের পরশে অরববাসীদের হৃদয় কোনাে দিন উত্তপ্ত হতাে না, কোনাে দিন তাদের দিল নরােম হতাে না।

২. শাব্দিক অনুবাদ প্রভাবহীন হবার আর একটি কারণ হচ্ছে এই যে, সাধারণত এই অনুবাদ মূলের প্রতিটি লাইনের নীচে বসানাে হয়। অথবা নতুন ষ্টাইল অনুযায়ী পাতাকে মাঝখান থেকে ডানে বামে দুভাগে ভাগ করে একদিকে আল্লাহর কালাম এবং অন্যদিকে তার অনুবাদ বসাননা হয়।
শাব্দিক অনুবাদ পড়ার ও শেখার জন্য এ ব্যবস্থা তাে ভালই। কিন্তু অন্যান্য বই একনাগাড়ে পড়ে মানুষ যেমন প্রভাবিত হয় এখানে তেমনটি হওয়া সম্ভবপর হয় না। কারণ এখানে ধারাবাহিকভাবে একটি বক্তব্য পড়ার সুযােগ নেই। বার বার মাঝখানে অন্য একটি অপরিচিত ভাষা এসে যাচ্ছে। কাজেই অনুবাদের বক্তব্য বার বার হোঁচট খেয়ে যাচ্ছে। ইংরেজী অনুবাদগুলােয় এর চাইতেও বেশি প্রভাবহীনতা সৃষ্টি হয়ে গেছে। কারণ সেখানে বাইবেলের অনুকরণে কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াতের অনুবাদ নম্বর ভিত্তিক করা হয়েছে। আপনি কোনাে একটি চমৎকার প্রবন্ধের প্রত্যেকটি বাক্য আলাদা করে লিখুন। তারপর ওপরে নীচে তার গায়ে
নম্বর লাগিয়ে পড়ুন। আপনি নিজেই অনুভব করবেন, সুবিন্যস্ত ও ধারাবাহিকভাবে লিখিত রচনাটি যেভাবে আপনাকে প্রভাবিত করতে, এই পৃথক পৃথক বাক্যগুলাের জন্য তার অর্ধেক প্রভাবও আপনার ওপর পড়েনি।

৩. শাব্দিক অনুবাদের প্রভাবহীন হবার তৃতীয় একটি বড় কারণ হচ্ছে এই যে, কুরআন একটি রচনার আকারে নয় বরং ভাষণের আকারে বর্ণিত হয়েছে। কাজেই ভাষান্তরিত করার সময় বক্তৃতার ভাষাকে যদি রচনার ভাষায় রূপান্তরিত না করা হয় এবং যেখানে যেমন আছে ঠিক তেমনটি
রেখে হুবহু অনুবাদ করা হয় তাহলে সমস্ত রচনাটিই অসংলগ্ন এবং বক্তব্যগুলাে পারস্পরিক সম্পর্কহীন হয়ে পড়বে।

৪. সবাই জানেন, কুরআন মজীদ শুরুতে লিখিত পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়নি। বরং ইসলামী দাওয়াত প্রসংগে প্রয়ােজন ও পরিস্থিতি অনুযায়ী একটি ভাষণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাযিল করা হতাে এবং তিনি ভাষণ আকারে তা লােকদের শুনিয়ে দিতেন। প্রবন্ধের ভাষা ও বক্তৃতার ভাষার মধ্যে স্বাভাবিকভাবে অনেক পার্থক্য থাকে। যেমন প্রবন্ধ লেখার সময় পাঠক সামনে থাকে না। তাই সেখানে কোনাে সংশয়ের উল্লেখ করে তার জবাব দেয়া হয়। কিন্তু বক্তৃতার সময় শ্রোতা তথা সংশয়ী নিজেই সামনে হাযির থাকে। তাই সেখানে সাধারণত এভাবে বলার প্রয়ােজন হয় না যে, “লােকেরা একথা বলে থাকে।” বরং বক্তা তার বক্তৃতার মাঝখানে প্রসঙ্গক্রমে এমন একটি কথা বলে যায় যা সন্দেহ পােষণকারীর সন্দেহ দূর করতে সাহায্য করে। প্রবন্ধের বেলায় বক্তব্যের বাইরে কিন্তু তার সাথে নিকট সম্পর্ক রাখে এমন কোনাে কথা বলতে হলে তাকে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করে কোনাে না কোনােভাবে প্রবন্ধের মূল বক্তব্য থেকে আলাদা করে লিখতে হয় যাতে বক্তব্যের ধারাবাহিকতা ক্ষুন্ন না হয়। অন্যদিকে বক্তৃতার মধ্যে শুধুমাত্র বক্তৃতার ধরণ ও ভংগি পরিবর্তন করে একজন বক্তা বিরাট বিরাট প্রাসংগিক বক্তব্য বলে যেতে পারেন। শ্রোতারা এই বক্তব্যের মধ্যে কোথাও সম্পর্কহীনতা খুঁজে পাবে না। প্রবন্ধে পরিবেশের সাথে বক্তব্যের সম্পর্ক জোড়ার জন্য শব্দের সাহায্য গ্রহণ করা হয়। কিন্তু বক্তৃতায় পরিবেশ নিজেই বক্তব্যের সাথে নিজের সম্পর্ক জুড়ে নেয়। সেখানে পরিবেশের দিকে ইংগিত না করেই যেসব কথা বলা হয় তাদের মধ্যে কোনাে শূন্যতা অনুভূত হয় না। বক্তৃতায় বক্তা ও শ্রোতার বারবার পরিবর্তন হয়। বক্তা নিজের শক্তিশালী বক্তব্যের মাধ্যমে পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী কখনাে একটি দলের উল্লেখ করে তৃতীয় পুরুষ হিসেবে। কখনাে তাকে মধ্যম পুরুষ হিসেবে উপস্থাপিত করে সরাসরি সম্বােধন করে। কখনাে বক্তব্য পেশ করে এক বচনে আবার কখনাে বহু বচন ব্যবহার করতে থাকে। কখনাে বক্তা নিজেই সরাসরি বলতে থাকে, আবার কখনাে অন্যের পক্ষ থেকে বলতে থাকে। কখনাে সে উচ্চতর ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে, আবার কখনাে সেই উচ্চতর ক্ষমতা নিজেই তার মুখ দিয়ে বলতে থাকে। এ জিনিসটি বক্তৃতায় একটি সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। কিন্তু প্রবন্ধে এসে এটি সম্পূর্ণ একটি অসম্পর্কিত বস্তুতে পরিণত হয়। এ কারণে কোনাে বক্তৃতাকে প্রবন্ধ আকারে লিখলে পড়ার সময় তার মধ্যে বেশ সম্পর্কহীনতা অনুভূত হতে থাকে। মূল বক্তৃতার পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে পাঠকের দূরত্ব যতই বাড়তে থাকে এই সম্পর্কহীনতার অনুভূতিও ততই বাড়তে থাকে। অজ্ঞ লােকেরা কুরআন মজীদে যে অসংলগ্নতার অভিযােগ করে তার ভিত্তিও এখানেই। সেখানে ব্যাখ্যামূলক টীকার মাধ্যমে বক্তব্যের পারস্পরিক সম্পর্ক সুস্পষ্ট করা ছাড়া আর কোনাে উপায় নেই। কারণ কুরআনের আসল বাক্যের মধ্যে কোনাে প্রকার কমবেশী করা হারাম। কিন্তু অন্য কোনাে ভাষায় কুরআনের অর্থ প্রকাশ করার সময় বক্তৃতার ভাষাকে সতর্কতার সাথে প্রবন্ধের ভাষায় রূপান্তরিত করে অতি সহজে এই অসংলগ্নতা দূর করা যেতে পারে।

৫. কুরআন মজীদের সূরাগুলি আসলে ছিল এক একটি ভাষণ। ইসলামী দাওয়াতের বিশেষ একটি পর্যায়ে একটি বিশেষ সময়ে প্রতিটি সূরা নাযিল হয়েছিল। প্রতিটি সূরা নাযিলের একটি প্রেক্ষাপট ছিল। কিছু বিশেষ অবস্থায় এই ধরনের বক্তব্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছিল। কিছু প্রয়ােজন পূরণ করার জন্য তখন এগুলাে নাযিল হয়েছিল। এই প্রেক্ষাপট ও নাযিলের উপলক্ষের সাথে কুরআনের সূরাগুলাে এত গভীর সম্পর্কযুক্ত যে, সেগুলাে থেকে আলাদা হয়ে নিছক শাব্দিক অনুবাদ কারাের সামনে রাখা হলে অনেক কথা সে একেবারেই বুঝতে পারবে না। আবার অনেক কথার উল্টো অর্থ বুঝবে। কুরআনের পূর্ণ বক্তব্য সম্ভবত কোথাও তার আয়ত্তাধীন হবে না। আরবী কুরআনের ক্ষেত্রে এই সমস্যা দূর করার জন্য তাফসীরের সাহায্য নিতে হয়। কারণ মূল কুরআনের কোন কিছু বৃদ্ধি করা যেতে পারে। কিন্তু অন্য ভাষায় কুরআনের ভাব প্রকাশ করার সময় আমরা আল্লাহর কালামকে তার প্রেক্ষাপট ও নাযিলের অবস্থার সাথে সম্পর্কিত করতে পারি। এভাবে পাঠক তার পরিপূর্ণ অর্থ গ্রহণ করতে পারবে।

৬. কুরআন সহজ সরল আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হলেও সেখানে একটি বিশেষ পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। বিভিন্ন প্রচলিত শব্দকে তার আভিধানিক অর্থে ব্যবহার না করে একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আবার বিভিন্ন শব্দকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছে। শাব্দিক অনুবাদ করার সময় তার মধ্যে এই পারিভাষিক ভাষার ভাবধারা ফুটিয়ে তােলা
বড়ই কঠিন ব্যাপার। এই ভাবধারা ফুটিয়ে না তােলা হলে অনেক সময় পাঠকরা বিভিন্ন সংকট ও ভুল ধারনার সম্মুখীন হয়। যেমন কুরআনে বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ হচ্ছে “কুফর”। কুরআনে এ শব্দটি যে পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে মূল আরবী অভিধানে এবং আমাদের ফকীহ ও ন্যায় শাস্ত্রবিদদের পরিভাষায় ব্যবহৃত অর্থের সাথে তার কোনাে মিল নেই। আবার কুরআনেও সর্বত্র এটি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। কোথাও এর অর্থ পরিপূর্ণ ঈমানবিহীন অবস্থা। কোথাও এর অর্থ নিছক অস্বীকার। কোথাও একে অকৃতজ্ঞতা ও উপকার ভুলে যাওয়ার অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আবার কোথাও ঈমানের বিভিন্ন দাবীর মধ্য থেকে কোন দাবী পূরণ না করাকে কুফরী বলা হয়েছে। কোথাও আকীদাগত স্বীকৃতি কিন্তু কর্মগত অস্বীকৃতি বা নাফরমানী অর্থে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কোথাও বাহ্যিকআনুগত্য কিন্তু প্রচ্ছন্ন অবিশ্বাসকে কুফরী বলা হয়েছে। এ ধরনের বিভিন্ন জায়গায় যদি আমরা কুফরী' শব্দের অর্থ কুফরী’ লিখে যেতে থাকি বা এর কোনাে একটি প্রতিশব্দ ব্যবহার করতে থাকি তাহলে নিঃসন্দেহে অনুবাদ সঠিক হবে। কিন্তু পাঠকগণ কোথাও এর সঠিক অর্থ থেকে বঞ্চিত থাকবেন, কোথাও তারা ভুল ধারণার শিকার হবেন, আবার কোথাও সন্দেহ-সংশয়ের সাগরে হাবুডুবু খাবেন।

শাব্দিক অনুবাদের পদ্ধতিতে এই ত্রুটি ও অভাবগুলাে দূর করার জন্য আমি মুক্ত ও স্বচ্ছন্দ অনুবাদ ও ভাবার্থ প্রকাশের পথ বেছে নিয়েছি। কুরআনের শব্দাবলীকে ভাষান্তরিত করার পরিবর্তে কুরআনের একটি বাক্য পড়ার পর তার যে অর্থ আমার মনে বাসা বেঁধেছে এবং মনের ওপর তার যে প্রভাব পড়েছে, তাকে যথাসম্ভব নির্ভুলভাবে নিজের ভাষায় লেখার চেষ্টা করেছি। লেখ্য ভাষায় স্বাভাবিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন ভাষণের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক তুলে ধরেছি। আল্লাহর কালামের অর্থ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ দ্ব্যর্থহীনভাবে সুস্পষ্ট করার সাথে সাথে তার রাজকীয় মর্যাদা ও গাম্ভীর্য এবং ভাব প্রকাশের প্রচন্ড শক্তিকে যথাসম্ভব উপস্থাপন করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছি। এই ধরনের মুক্ত ও স্বচ্ছন্দ অনুবাদের জন্য শব্দের শৃংখলে বন্দী না থেকে মূল অর্থ ও তাৎপর্য প্রকাশের দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা চালানােই ছিল অপরিহার্য। কিন্তু যেহেতু আল্লাহর কালামের ব্যাপার, সেজন্য আমি অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে এপথে পা বাড়িয়েছি। আমার পক্ষ থেকে যতদূর সতর্কতা অবলম্বন করা সম্ভব তা করেছি। কুরআন তার বক্তব্যকে নিজের ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষেত্রে যতটুকু স্বাধীনতা দেয় তার সীমা অতিক্রম করার চেষ্টা করিনি।

আবার কুরআনকে পুরােপুরি বুঝার জন্য তার প্রতিটি বাণীর পটভূমি পাঠকের সামনে থাকা প্রয়ােজন। মুক্ত ও স্বচ্ছন্দ অনুবাদ এবং ভাবার্থ প্রকাশের মাধ্যমে তা পুরােপুরি সম্ভব নয়। তাই প্রতিটি সূরার শুরুতে আমি একটি ভূমিকা সংযুক্ত করেছি। সেখানে সম্ভাব্য সকল প্রকার অনুসন্ধান চালিয়ে আমি বিভিন্ন বিষয় নির্দিষ্ট ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। যেমন, সংশ্লিষ্ট সূরাটি কোন্ সময় নাযিল হয়েছিল! তখন কি অবস্থা ছিল? ইসলামী আন্দোলন তখন কোন পর্যায়ে ছিল? তার প্রয়ােজন ও চাহিদা কি ছিল? সে সময় কোন কোন সমস্যা দেখা দিয়েছিল? এ ছাড়াও কোথাও কোনাে বিশেষ আয়াতের অথবা আয়াত সমষ্টির নাযিলের কোনাে পৃথক উপলক্ষ থাকলে সেখানেই টীকার মধ্যে তা বলে দিয়েছি। টীকায় এমন কোনো কথা আমি আলােচনা করিনি যার ফলে পাঠকের দৃষ্টি কুরআন থেকে সরে গিয়ে অন্যদিকে চলে যেতে পারে। যেখানে আমি অনুভব করেছি সাধারণ পাঠক এখানে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ চান অথবা তার মনে কোনাে প্রশ্ন দেখা দেবে বা তিনি কোনাে সন্দেহ-সংশয়ের শিকার হবেন, সেখানে আমি টীকা লিখেছি এবং ব্যাখ্যা সংযােজন করেছি। আবার যেখানে আমার মনে আশংকা জেগেছে যে পাঠক এখানে কোনাে গুরুত্ব না দিয়ে সােজা এগিয়ে যাবে এবং কুরআনের বাণীর মর্মার্থ তার কাছে অস্পষ্ট থেকে যাবে সেখানে আমি টীকা ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিষয়টি সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছি।

যারা এই কিতাবটি থেকে ফায়দা হাসিল করতে চান তাদেরকে আমি কয়েকটি পরামর্শ দেবাে। প্রথমে সূরার শুরুতে সংযােজিত ভূমিকা তথা প্রসংগ ও পূর্ব আলােচনাটি গভীর মনােযােগ সহকারে পড়ে নিন। যতক্ষণ ঐ সূরাটি অধ্যয়ন করতে থাকেন ততক্ষণ মাঝে মাঝে ঐ ভূমিকাটি দেখতে থাকেন। তারপর প্রতিদিন নিয়মিতভাবে কুরআন মজীদের যতটুকু পড়েন তার প্রতিটি আয়াতের শাব্দিক অনুবাদ প্রথমে পড়ে নিন। এ উদ্দেশ্যে
মাতৃভাষায় বা অন্য যে কোনাে ভাষায় আপনার পছন্দসই যে কোননা অনুবাদের সাহায্য নিন। এটুকু হয়ে যাবার পর তাফহীমুল কুরআনের স্বচ্ছন্দ অনুবাদটি ব্যাখ্যার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে যতদূর প্রয়ােজন একটি ধারাবাহিক রচনার মতাে পড়ে নিন। এভাবে কুরআনের ঐ অংশের বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য একই সময় আপনার মনে ভেসে উঠবে। এরপর প্রত্যেকটি আয়াতকে বিস্তারিতভাবে বুঝার জন্য টীকা ও ব্যাখ্যা পড়তে থাকুন। এভাবে পড়তে থাকলে আমি মনে করি একজন সাধারণ পাঠক কুরআন মজীদ সম্পর্কে একজন আলেমের সমপর্যায়ে জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম না হলেও একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে ইনশাআল্লাহ যথেষ্ট জ্ঞান
লাভ করতে পারবেন।

আমি ১৩৬১ হিজরীর মুহররম (ফেব্রুয়ারী, ১৯৪২ খৃঃ) মাসে এ গ্রন্থের কাজ শুরু করি। ৫ বছরের অধিককাল ক্রমাগত এ কাজ চালু থাকে এবং সূরা ইউসূফ-এর তরজমা ও ব্যাখ্যা পর্যন্ত হয়ে যায়। অতঃপর এমন কিছু পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে যে পরিস্থিতিতে আমার না কিছু লেখার সুযােগ হয়েছে আর না এমন অবকাশ হয়েছে যে, পূর্বের কাজটুকু দ্বিতীয়বার দেখে গ্রন্থাকারে প্রকাশের উপযুক্ত করে তুলতে পারি। একে সৌভাগ্যই বলুন অথবা দুর্ভাগ্য, ১৯৪৮ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে হঠাৎ এমন সুযােগ এসে গেল যে, আমাকে জন নিরাপত্তা আইনে (Public Safety Act) গ্রেফতার করে জেলে পাঠানাে হলাে, আর এখানেই আমি সে অবকাশ পেয়ে গেলাম, যা এ গ্রন্থকে প্রকাশের উপযােগী করে তােলার জন্য প্রয়ােজন ছিল। আমি আল্লাহর দরবারে দোয়া করি যেন আমার শ্রমের উদ্দেশ্য সফল হয় এবং আল্লাহর বান্দাদের কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে এ গ্রন্থ সহায়ক প্রমাণিত হয়।
------------------------- 
আবুল আ'লা
নিউ সেন্ট্রাল জেল, মুলতনি
১৭ যিলকদ ১৩৬৮ হিঃ
(১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯ খৃঃ)

চলবে......

Post a Comment

0 Comments