Recent Tube

নবাব সলিমুল্লাহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমিদান বিতর্ক : কামারুজ্জামান।


নবাব সলিমুল্লাহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমিদান বিতর্ক : 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাব সলিমুল্লাহর জায়গা আছে কিনা, এই মর্মে সর্দার ফজলুল করিম তার বইতে অধ্যাপক রাজ্জাক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য কোট করেন। রাজ্জাকের মতে, "রমনার যে জায়গায় ঢাকা ইউনিভার্সিটি-এর পুরাই খাসমহল, সরকারের জমি। সেটলমেন্ট রিপোর্টে-এ তাই আছে।"[৬০] এছাড়াও, প্রচলিত বিভিন্ন বইপুস্তকে নবাব সলিমুল্লাহর জায়গায় ঢাকা ইউনিভার্সিটি বলে একটা জনশ্রুতি আছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৬০০ একর জায়গা দিয়েছেন বলেও এসব বইপুস্তক থেকে জানা যায়। 

এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঢুকার পূর্বে আমাদেরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলের জায়গা-জমির ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে একটু নড়াচড়া করা জরুরি। ঢাকার শাহবাগ ছিল বাংলার বারো ভূঁইয়াদের হাতে গড়া বাগানবাড়ী। যাকে বলা হতো বাগে শাহী। এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে উনারা রাজধানী গড়েছিলেন। বারো ভুঁইয়াদের নেতা মূসা খাঁর কবর ও মসজিদ এখনো শহীদুল্লাহ্ হলের রাস্তার পূর্ব পাশে রয়ে গেছে।পরবর্তীতে, এই জায়গায় এসে আবাস স্থাপন করেন মোগল সুবাদার ইসলাম খাঁ। তার সাথে চুক্তির বদৌলতে মূসা খাঁ এখানে বসবাসের অনুমতি পেয়ে ছিলেন। ইসলাম খাঁর রাজধানী জাহাঙ্গীরনগরও ছিল আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা ও তার আশপাশের অঞ্চলকে নিয়ে। 

পরবর্তীতে, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, গ্রীক ও ব্রিটিশরা এখানকার অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলের জায়গাগুলোর মালিক হয়। তাদের থেকে অনেক জায়গা জমি কিনে নিয়ে ছিলেন ঢাকার নবাব আব্দুল গণী। যেমন, রমনার একটি বিশাল জায়গার মালিক ছিলেন আর্মেনিয়ান খাজা আরাতুন। ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস যখন রমনার সংস্কার করেন। সে সময় আরাতুন ডসের কাছ থেকে রমনা এলাকার বিরাট অংশ লাভ করেন। এস্থানে তিনি বাগানবাড়ি নির্মাণ করেন। জজ জন ফ্রান্সিস গ্রিফিত-এর বাড়িও ছিল এখানে। এবং ১৮৪৪/৪৫ এর দিকে অবসর গ্রহণের পর তিনি তার নিজের সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছিলেন ঢাকার নওয়াব আব্দুল গনির কাছে। তারাও রমনায় স্থাপন করেছিলেন নিজেদের বাগানবাড়ি৷[৬১]বাগানবাড়ির এক স্থানে যে সুরম্য প্রাসাদ গড়ে তোলেন এর নাম 'এশারাত মঞ্জিল' বাগানে আরো ছিল চার দেওয়ালে সুরক্ষিত গাছ-গাছরায় ঘেরা মার্বেল পাথরে তৈরি বৈঠকখানা, গোলাকার প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট অনেক ভবন। আর 'নিশাত মঞ্জিল' নামক জাঁকালো দ্বিতল প্রাসাদ। এশারাত মঞ্জিলের দরবার কক্ষটি ছিল খানিকটা দূরে। দরবার কক্ষে নানা অধিবেশন হবার কারণে ক্রমেই এটি বিখ্যাত হয়ে ওঠে। শাহবাগ কৃষি মেলার নিয়ন্ত্রণ, বামফিল্ড ফুলারের পদত্যাগ সভা, নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে প্রাদেশিক শিক্ষা বৈঠক,নিখিল ভারত মুসলিম লীগের জন্ম, বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদনসহ সমকালীন সকল গুরুত্বপূর্ণ কাজে এই দরবার গৃহের ভূমিকা ছিল অনন্য। পরবর্তীতে, এই দরবার গৃহে ক্যান্টিন স্থাপন করা মধু দা ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর হাতে মারা গেলে এর নামকরণ করা হয় মধু দার ক্যান্টিন। 
আর্মেনীয়ান খাজে আরাতুনের ছিল দুই মেয়ে। তার মৃত্যুর পর জমিদারি মেয়েদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায় এবং তারা আর ঢাকায় থাকেন নি৷ ঢাকার নওয়াবদের কাছে জমিদারি বিক্রি করে চলে যান তারা কলকাতায়। পরবর্তীতে, রমনা এলাকায় আর্মেনীয়ান খাজে আরাতুনের এক সময়ের বাগানবাড়ির পরিত্যক্ত অংশটিতে পাকিস্তান আমলে আনবিক শক্তি কমিশনের অফিস স্থাপিত হয়। যা বর্তমানেও তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।[৬২] 

তবে আজকের চারুকলার গোলপুকুর সংলগ্ন জায়গাটি ছিল শাহ নুরুদ্দিন হোসাইন নামক এক ব্যক্তির। তিনি ঢাকার নায়েব নাজিম নুসরত জংয়ের সময়কার লোক এবং নিমতলী মসজিদের খতিব ছিলেন। চারুকলার ভিতরেই রয়েছে তার মাজার। পরবর্তীতে, তার পুত্র থেকে পুরো জায়গাটি কিনে নিয়েছিলেন ঢাকার নবাব আব্দুল গণী। তার পরিবারের কবরগুলোকে মিশিয়ে দেওয়া হবে না শর্তে তিনি জায়গাটি বিক্রি করেন। নবাবরা পুরো এলাকাজুড়ে বাগানবাড়ি গড়ে তোলেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের ভবনগুলো নির্মাণ হলেও কবরগুলোর হেফাজত করা হয়। 

ঢাকা শহরে নবাবদের ছিল তিনটি বাগানবাড়ি। এগুলো দিলখুশা, শাহবাগ ও বেগুনবাড়িতে অবস্থিত ছিল। শাহবাগের বাগানে ছিল নবাব আহসানুল্লাহর সখের চিড়িয়াখানা। হাকিম হাবিবুর রহমানের মতে, "এ বাগানে স্বতন্ত্র বেষ্টনীর ছিল একটি চিড়িয়াখানা। এতে পোষা হতো নানাধরণের পশু-পাখি। এদের জন্য ছিল লোহার শলাকা ও জালযুক্ত কুঠুরি সমূহ। ১৮৮৮ সালে আমি এখানে বাঘ, ভাল্লুক, উটপাখি ও বিভিন্ন ধরনের বানর দেখেছিলাম।"[৬৩] 

ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর শাসনামলে ১৮২৫ সালে ব্রিটিশ কালেক্টর মি.ডস রমনা জায়গাটিকে পরিষ্কার করে রমনা মঠ, মসজিদ ও মীর জুমলা গেট ছাড়া বাকি সকল স্থাপনাকে ভেঙে ফেলে এটিকে ঘোড়া দৌড়ের মাঠ তৈরি করেন। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় রেসকোর্স। ইংরেজদের কাছ থেকে এই এলাকাটি পত্তন নিয়েছিলেন ঢাকার নওয়াব আব্দুল গনি। পরবর্তীতে, নবাব গনি এখানে রেস প্রবর্তন করেন। 

১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে ঢাকা আবার রাজধানীর মর্যাদা পেলে ব্রিটিশদের এখানে বিভিন্ন প্রশাসনিক দালান-কোঠা নির্মাণ করতে নবাব সলিমুল্লাহ তার পরি বিবির নামে পরিচিত পরিবাগ এলাকার জায়গা, শাহবাগ বাগানবাড়ি, টিএসসির জায়গাগুলো ও তার অধিনে থাকা মিন্টো রোডের জায়গাগুলো ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেন। বিশেষ করে, ঢাকায় নতুন সিভিল স্টেশন স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে অনেক জায়গার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। নবাব সলিমুল্লাহই শুধু নয় আরো যাদের জায়গাজমি রমনা এলাকা কেন্দ্রিক ছিল।সবাইকে তা তুলে দিতে হয় নতুন রাজধানী গড়ার কাজে। 

কিন্তু, দূর্ভাগ্যবশত, ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে ব্রিটিশরা সেই জমিগুলো ফেরত না দিয়ে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দিয়ে দেন। তবে সব জমি নবাবদের ছিল না। অন্যান্য মালিকানা ভুক্তও ছিল। আর নবাব সলিমুল্লাহও রাজধানীর জন্য দেওয়া জমিগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে যান। যেমনটা সৈয়দ আবুল মকসুদের* লেখনীতে আমরা দেখতে পাই। না হলে তা ফেরত পাওয়ার জন্য তিনি ব্রিটিশদের কাছে অনুযোগ করতেন। যা আমরা পরবর্তী নবাব হাবিবুল্লাহর ক্ষেত্রেও দেখতে পাই না। অন্যান্য মালিকানাভুক্তদের ক্ষেত্রেও একই কথা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছিল নবাব সলিমুল্লাহর প্রধান স্বপ্ন। তাই তিনি সেগুলি আর ফেরত নেন নি। তাছাড়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি রাজস্ব এখনো পরিশোধ করা হয় 'সলিমাবাদ মৌজা' নামে। যা নবাব সলিমুল্লাহর নাম ও জমির বিবরণকে কে স্পষ্ট করে তোলে। নওয়াবদের এ জমি গুলোতে ছিল নওয়াবদের বাগানবাড়ি।[৬৪] 

এখানে, নবাবদের জায়গাজমির পাশাপাশি সরকারেরও জায়গা ছিল। কিন্তু, এর পুরো কর্তৃত্বই ভোগ দখল ছিল ঢাকার নবাবদের। এছাড়াও, নবাব সলিমুল্লাহর মৃত্যুর সময় সম্পত্তির যে তালিকা প্রণয়ন করা হয় তাতে রমনার রেসকোর্সকেও নবাব সলিমুল্লাহর সম্পত্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।[৬৫] যা মুনতাসীর মামুন তার ঢাকা সমগ্র-১ গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন,"শাহবাগ তো নবাবের ছিলই, অনুমান করে নিচ্ছি রমনা রেসকোর্সও ছিল নবাবের সম্পত্তির অন্তর্গত। ড. সিরাজুল ইসলাম একবার আমাকে বলেছিলেন, নবাব পরিবারের দলিলপত্র ঘেঁটে তিনি জেনেছেন,সলিমুল্লাহর মৃত্যুর পর তার সম্পত্তির হিসেব তৈরির সময় রেসকোর্সকেও দেখানো হয়েছিল তার সম্পত্তির অংশ হিসেবে।"[৬৬] 

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে যে বিষয়টা প্রতীয়মান হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার অধিকাংশ জায়গার মালিক ঢাকার নবাব পরিবার না হলেও পুরো এলাকাটি তাদের কর্তৃত্বেই ছিল। যার একটি শক্তিশালী দলিল হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মৌজার নাম সলিমাবাদ মৌজায় নামকরণ। নবাবরাই এর পূর্ণ ব্যবহার করতো। নবাবদের জমির মালিকানা হিসেব করলে, শাহবাগ জাদুঘর থেকে শুরু করে, চারুকলা, মধুর ক্যান্টিন হয়ে টিএসসি ও আনবিক শক্তি কমিশনের শেষ পর্যন্ত ছিল নবাবদের খাস জমি। রমনার রেসকোর্স ময়দানের অংশটিও নবাবদের জমি ছিল বলে ড. সিরাজুম ইসলাম ও মুনতাসীর মামুন মতামতের আলোকে ধারণা করা যেতে পারে। 

যার ফলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন ঢাকার নবাব পরিবারের জমিদান বিষয়ে অধ্যাপক রাজ্জাক কর্তৃক মন্তব্য পুরোপুরি সত্য বলে মনে হয় না। তার পাশাপাশি, যারা বলে থাকেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাব সলিমুল্লাহ ৬০০ একর জমি দান করেছিলেন বা নবাবের জমির উপর সম্পুর্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেটাও এক দিক থেকে সঠিক নয়। তবে,যে ৬০০ একরকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার পুরো ভোগ দখল কর্তৃত্ব ঢাকার নবাব পরিবারের হাতেই ছিল। ফলে, অনেকেই ধারণা করেছেন পুরো জমি নবাবদেরই ছিল। যা আমরা স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছি। মূলত, ছফা ও সরদারের বইয়ের আলোকে অধ্যাপক রাজ্জাককে বিবেচনা করলে, সর্বদাই ঢাকার নবাবদের আড়চোখে দেখতেই যেন তিনি অভ্যস্ত ছিলেন। যার ফলে, ঢাকা বিদ্যাজাগতিক সাহিত্য চর্চায় রাজ্জাক উত্তর সেই নবাবী উষ্মা থেকেই যায়। যা আজ পর্যন্ত বলবৎ আছে বলা চলে। কারণ, রাজ্জাকীয় চিন্তা ও মনন ধারার বুদ্ধিজীবী এখনো বাঙালি মুসলমানের মাথার উপর ছায়া বিস্তার করে রেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যেও খুব একটা ঢাকার নবাবদের প্রতি ভালোবাসা ও সৎ সাহস নিয়ে গবেষণা করার ইচ্ছে শক্তি কম বলে মনে হয়। তবে না হওয়ারও বা কি আছে? আমরা যে এখনো রাজ্জাকীয় যুগ পার করতে পারি নি। বাঙালি সেক্যুলাররা যে এখনো আমাদের চিন্তা ও মননে আঁচড় কেটেই যাচ্ছে। 

তবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা জমির হিসেবে সর্বদাই একটা অস্পষ্টতা লেগেই ছিল। এখনো বলবৎ আছে। ১৯১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ সম্বলিত নাথান কমিটির রিপোর্টে ঢাকার রমনা এলাকার ৪৫০ একর জমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে অধিগ্রহণের সুপারিশ করা হলেও কার্যত সেখানে জমি ছিল প্রায় ৭০০ একরেরও অধিক। বিভিন্ন পক্ষ থেকে এই জমি পাওয়ার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস লেখার সময় জমির পরিমাণ উল্লেখ করতে গিয়ে নানাজনের নানামত প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষ করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢাকা নওয়াব বাড়ির স্যার সলিমুল্লাহর স্মরণে যে সলিমাবাদ মৌজার সৃষ্টি হয় তার পরিমাণ কতটুকু, তা এখনো ইতিহাসের আড়ালেই রয়ে গেছে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর দ্বিতীয় ইতিহাস প্রণেতা, সৈয়দ রেজাউর রহমান লিখেছেন, "উচ্চশিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে ঢাকার রমনা সিভিল স্টেশন এলাকার প্রায় ৬০০ একর জমির উপর ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২১ সাল থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত রমনা সিভিল স্টেশনের মালিকানা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে টানাপোড়ন চলছিল। সে সময় সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে জমির জন্য ভাড়া দাবি করেছিল। পরে অবশ্য বাৎসরিক এক হাজার রুপি জমার চুক্তিতে রমনা এলাকার ৭২৮ বিঘা জমি ও এলাকার সব ভবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ইজারা দেওয়া হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে প্রাপ্ত পঞ্চাশ লক্ষ টাকা প্রাদেশিক সরকারকে বিনিময় হিসেবে দিয়ে দেয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পূর্ব বঙ্গ সরকার সিভিল স্টেশন অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জমি ও ভবনাদি রিকুইজিশন করে নিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যন্ত এসব জমি ফেরত পায় নি। পরবর্তীতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির পরিমাণ ক্রমশ কমে গেছে।"[৬৭] 

সৈয়দ রেজাউর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি ও প্রশাসনিক ভবনের বিনিময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের টাকা প্রাদেশিক সরকারকে বিনিময় হিসেবে দেওয়ার কথা বললেও এটা সঠিক ছিল মনে হয় না। কেননা, রমেশচন্দ্র মজুমদারের লেখায় জানা যায়, প্রাদেশিক সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডের ৫০ লক্ষ টাকা কেটে নেয় জমিও বিল্ডিংগুলো ব্যবহারের নামে। প্রাদেশিক সরকারের এহেন কর্মকান্ডের পিছনে মূল কলকাঠি নাড়িয়ে ছিলেন তৎকালীন প্রাদেশিক শিক্ষা মন্ত্রী প্রভাস চন্দ্র মিত্র। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্যই মূলত এমন কারসাজি ছিল একটি হিন্দুত্ববাদী প্রোপাগান্ডা। মূল্যমানের চেয়েও অতিরিক্ত টাকা কেটে নিলেও প্রভাস চন্দ্রের মত হিন্দুত্ববাদী মন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়কে তার জায়গাজমি ও প্রশাসনিক ভবন কোনটাই আর বুঝিয়ে দেয় নি। পরবর্তীতে, এসব জায়গা জমির সুস্পষ্ট হিসেবের জন্য অনেক দেন-দরবার, লেখালেখি করেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কখনো তা পরিপূর্ণভাবে আর বুঝে পায় নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা জমির হিসাব সুস্পষ্ট না থাকায় সরকারের বিভিন্ন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির উপর অবৈধ হস্তক্ষেপ, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন দখল করার পাশাপাশি, অন্যায়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গায় বিভিন্ন প্রশাসনিক মন্ত্রনালয় স্থাপন ও মন্ত্রীদের জন্য বাসভবন দখল করার ফলে, "২০০০ সালে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির পরিমাণ দাড়ায় প্রায় ২৫৩ একরে।"[৬৮] 

যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ব বাংলার মুসলিম নেতৃবৃন্দ তাদের সকল চাওয়া পাওয়াকে তুচ্ছ করে একনাগাড়ে কলকাতার হিন্দুত্ববাদী ও সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এর ভিত্তি দাড় করে ছিলেন। দূর্ভাগা আমরা, সেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরও আমরা হিন্দুত্ববাদীদের কবল থেকে মুক্ত হতে পারি নাই। তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চলনায় এখনো আমরা ঘুরপাক খেয়েই যাচ্ছি। তাদেরই যোগসাজশে এখানকার বাঙালি মুসলমানের ঘরে জন্ম নেওয়া কিছু জ্ঞানী মানুষের অন্যায় সমালোচনার মুখে পড়তে হলো সেই প্রতিষ্ঠাকালীন ত্যাগী মানুষদের। অবাক লাগে, আবুল হোসেন, কাজী আব্দুল ওদুদ ও অধ্যাপক রাজ্জাকদের মত মানুষরা এই বাঙালি মুসলমানের জন্য আলোর বাতিঘর হয়ে আবির্ভূত হতে পারেন নি। তারা নিজেদেরকে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন জালে আবদ্ধ করে ফেলেছিলেন। তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও এদেশের মুসলিম ব্যক্তিবর্গ বিশেষ করে, নবাব সলিমুল্লাহর মত মানুষও তাচ্ছিল্যের স্বীকার হয়েছিলেন। তারা তাকে নিয়েতো কথা বলেন ই নি। যেটুকু বলেছেন তাও তাদের আদর্শিক দ্বন্দ্বের জায়গা থেকে। এদেশীয় সেক্যুলাররা পূর্ব বাংলার মুসলিম নেতৃবৃন্দের জন্য রোপন করেছে শুধুই বিদ্বেষের চারা। অন্য কিছু নয়। 

মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ব বঙ্গের অবহেলিত কৃষক সন্তানদের বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে উন্নতি ঘটানোর লক্ষ্যেই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। যার দাবী প্রথম উচ্চকিত হয়েছিল নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে। কলকাতার হিন্দু জমিদার ও কতিপয় কংগ্রেসপন্থী মুসলমানদের বিরোধীতা সত্ত্বেও এতদঞ্চলের মুসলিম নেতৃবৃন্দের আপোষহীন মনোভাব ও নিরলস কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলার সূচনা ও শতবর্ষে এর পদার্পন। ইতিহাস বিস্মৃতির যে তকমা বিজ্ঞজনেরা বাংলাদেশীদের
দেন তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। নগর পুড়ালে দেবালয় বা কেন বাকি থাকবে? প্রতিষ্ঠাতাদের স্বপ্ন ও আদর্শের লালন দূরে থাক, তার আলোচনা করাটাও যেন পাপ পরিগণিত। ধর্মনিরপেক্ষতা ও মুক্ত বুদ্ধি চর্চার নামে ইতিহাসের অপলাপ এবং বিদ্বেষের চর্চা ও লালনই বরং বেড়ে চলছে। ফলে পূর্বসুরীদের সম্প্রীতির বন্ধনের আহ্বানের বিপরীতে উদগীরন ঘটছে সেক্যুলার সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার জায়গা আটকে পড়ছে রাজনীতির
পঙ্কিল ফাঁকে। এসবকে বৈধতা দেয়ার জনই রচিত হচ্ছে মিথ্যা ইতিহাস, অন্তরালে চলে যাচ্ছে জাতি গড়ার কারিগর নবাব সলিমুল্লাহর মতো পূর্বপুরুষগণ।

হদিস 
[৬০] সরদার ফজলুল করিম, পৃষ্ঠা-১৬।
[৬১] মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম,পৃষ্ঠা-৭০।
[৬২] মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলা, পৃষ্ঠা-৭১।
[৬৩] হাকীম হাবিবুর রহমান, ঢাকা পচাস্ বরাস্ পহলে, অনুবাদ: মোহাম্মদ রেজাউল করিম,বাংলা একাডেমি, ঢাকা-১৯৯৫, পৃ.১৫৬-১৫৭।
[৬৪]  মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম, পৃষ্ঠা-৪৪।
[৬৫] মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম,পৃষ্ঠা-৩৭।
[৬৬] মুনতাসীর মামুন, ঢাকা সমগ্র-০১, সাহিত্যলোক, ঢাকা, পৃ-২৮।
[৬৭]সৈয়দ রেজাউর রহমান,গৌরবোজ্জ্বল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রথম অধ্যায় : (১৯২১-১৯৪৭),পৃ.১৪৭।
[৬৮] সৈয়দ রেজাউর রহমান,গৌরবোজ্জ্বল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রথম অধ্যায় : (১৯২১-১৯৪৭),পৃ.১৪৭।
------------------------- 


Post a Comment

0 Comments