আল্লামা মওদুদী (রাহঃ) এর নামে 'হাদীস অস্বীকার' এর মিথ্যা অপবাদ ও আমাদের জবাবঃ পর্ব ২
-----------------------------------------------------------------
(মুজতাহিদ ইমাম কর্তৃক সহীহ হাদীস বর্জন ও যঈফ হাদীস গ্রহণের উদাহরণ)
উস্তাদ ও ইমাম সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী (রাহঃ) বলেছেন, "মুজতাহিদ ইমামগণের দৃষ্টিতে হাদীসের সত্যতার মাপকাঠি একমাত্র সনদ ছিল না বরং সনদ ছাড়াও তাঁরা تفقه বা অনুধাবন শক্তি দ্বারা হাদীসকে যাচাই-বাছাই করতেন এবং যে হাদীস প্রকৃত সত্যের নিকটবর্তী বলে তাঁদের মনে প্রতীতি জন্মাত মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিকোণ থেকে তা যতই মারজু হোক না কেন- তাকেই গ্রহণ করতেন।" (নির্বাচিত রচনাবলী পৃঃ ২/১৯৩)
প্রথম পর্বে বিভিন্ন মুজতাহিদ ইমামগণের কাওল পেশ করে আল্লামা মওদুদী (রাহঃ) এর বক্তব্য প্রমাণ করা হয়েছিল যে, 'সনদ সহীহ হলেই মতন সহীহ হওয়া শর্ত নয়'। মতন নিয়ে প্রশ্ন তুললে কেউ হাদীস অস্বীকারকারী হয়ে যায় না। কারণ মুজতাহিদ ইমামগণ জেনে বুঝেই বিশেষ কোনো ফিকহি কারণে মতনের উপর আপত্তি তুলে সহীহ হাদীসের উপর আমল না করে ফিকহি ব্যাখ্যা প্রদান করে হাদীসটি ত্যাগ করেন। আবার তাঁরা ফিকহি অনুধাবন শক্তি দ্বারা হাদীসকে যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত সত্যের নিকটবর্তী বলে প্রমাণিত হলে মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিকোণ থেকে তা যতই দুর্বল হোক না কেন- তাকেই গ্রহণ করতেন। (দেখুনঃ ইমাম সাখাবী, ফাতহুল মুগীছ শরহে আলফিয়াতিল হাদীস: ২৪৯-২৫০; আল্লামা ইবনে হাজার, ফাতহুল বারী, ২/২৩৩; আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলী, ইমাম নববী, শারহুল মুহাজ্জাব, ১/১০৪; রিসালাতুন ফিল খুরুজি আনিল মাযাহিবিল আরবায়া, পৃঃ ২২; আল্লামা ইবনে হামদান, সিফাতুল ফতোয়া, পৃঃ ৩৮; আল্লামা ইবনে কাইয়ুম, আল-ফুরূসিয়্যাহ ১/১৮৬; আল্লামা ইবনুল হুমাম, ফাতহুল ক্বাদীর ৩/১৪৩)
একটা সহীহ হাদীসের সমালোচনা করতে গিয়ে ইমাম ইবনে আব্দুল বার (রাহঃ) বলেন,
ﺣﺪﻳﺚ ﺍﺑﻦ ﻋﻤﺮ ﻭﻫﻢ ﻭﻏﻠﻂ ﻭﺃﻧﻪ ﻻ ﻳﺼﺢ ﻣﻌﻨﺎﻩ ﻭﺇﻥ ﻛﺎﻥ ﺍﺳﻨﺎﺩﻩ ﺻﺤﻴﺤﺎ-
"ইবনে ওমরের বর্ণিত হাদীস উদ্ভট কল্পনা প্রসূত ও ভ্রান্ত। এর বক্তব্য সঠিক নয় যদিও তার সনদ সহীহ।" (আল ইস্তিয়াব: ৩/১১১৬) .
এমন অনেক হাদীস পাওয়া যায় যেগুলো মুহাদ্দিস ইমামগণের নিকট সনদের দিক থেকে সহীহ রূপে স্বীকৃত কিন্তু হাদীসের মতন তথা বিষয় বস্তু, ফিকহি জ্ঞানের বিরোধী হওয়ার কারণে মুজতাহিদ ইমামগণ সেগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে যঈফ হাদীসকে সহীহ হাদীসের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। এখানে কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা হল-
★★ আল্লাহ তা'য়ালা বলেন,
إِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ.
নিশ্চয় তোমাদের রব আসমানসমূহ ও জমিন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। (সূরা আ'রাফ : ৭/৫৪)
এ আয়াতের তাফসীরে সুপ্রসিদ্ধ মুফাসসির, মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক ইমাম ইবনে কাসীর (রাহঃ) বলেন, "এখানে আল্লাহ তা'য়ালা সংবাদ দিচ্ছেন যে, তিনি আসমান ও জমিনের সৃষ্টিকর্তা। আসমান ও জমিনকে তিনি ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। যার বর্ণনা কুরআনুল কারীমের কয়েক জায়গায় এসেছে।" একটু এগিয়ে তারপর বলেন, আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার হাত ধরে বললেন,
«خَلَقَ اللهُ التُّرْبَةَ يَومَ السَّبْتِ، وَخَلَقَ فِيهَا الجِبَالَ يَومَ الأَحَدِ، وَخَلَقَ الشَّجَرَ يَومَ الاِثْنَينِ، وَخَلَقَ المَكْرُوهَ يَومَ الثُّلاَثَاءِ، وَخَلَقَ النُّورَ يَوْمَ الأَربِعَاءِ، وَبَثَّ فِيهَا الدَّوابَّ يَومَ الخَمِيسِ، وَخَلَقَ آدَمَ عليه السلام، بَعْدَ العَصْرِ مِنْ يَومِ الجُمُعَةِ في آخِرِ الخَلْقِ فِي آخِرِ سَاعَةٍ مِنَ النَّهَارِ فِيمَا بَيْنَ العَصْرِ إِلَى اللَّيْلِ».
"আল্লাহ তা‘আলা শনিবার জমিন সৃষ্টি করেছেন, রবিবার তার মধ্যে পর্বতমালা সৃষ্টি করেছেন। সোমবার সৃষ্টি করেছেন গাছ-পালা। মঙ্গলবার মন্দ বস্তু সৃষ্টি করেছেন। বুধবার আলো সৃষ্টি করেছেন। তাতে (জমিনে) জীবজন্তু ছড়িয়েছেন বৃহস্পতিবার। আর সমস্ত জিনিস সৃষ্টি করার পর পরিশেষে জুমার দিন আসরের পর দিনের শেষভাগে আসর ও রাতের মাঝামাঝি সময়ে (আদি পিতা) আদম-কে সৃষ্টি করেছেন।" (সহীহ মুসলিম হাঃ ২৭৮৯; মুসনাদে আহমাদ হাঃ ৮১৪১; রিয়াযুস স্বালিহীন হাঃ ১৮৬৩)
হাদীসটি পেশ করে ইবনে কাসীর বলেন, "এ হাদীসে সপ্তম দিনেও (সৃষ্টির কাজে) ব্যস্ত থাকার কথা সাব্যস্ত হচ্ছে। অথচ আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন, ব্যস্ততার দিনের সংখ্যা ছিল ছয়। এ জন্য ইমাম বুখারী সহ প্রমুখ মনীষী এ হাদীসের সঠিকতার ব্যাপারে সমালোচনা করেছেন।" (তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা আ'রাফ : ৭/৫৪ তাফসীর দ্রষ্টব্য)
সনদগত ভাবে হাদীসটি সহীহ। ইমাম আহমদ, মুসলিম (রাহঃ) সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তারপরও ইমাম ইবনে কাসীর এ হাদীসের মতনের সমালোচনা করেছেন এবং তা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর বাণী নয় বলে ইমাম বুখারী (রাহঃ) সহ প্রমুখ মুহাদ্দিসের বরাতে মন্তব্য করেছেন।
★★ সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম সহ বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে দাড়িয়ে পেশাব করার সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যেমন হুযাইফা (রাঃ) বলেনঃ
أَتَى النَّبِيُّ ﷺ سُبَاطَةَ قَوْمٍ فَبَالَ قَائِمًا، ثُمَّ دَعَا بِمَاءٍ، فَجِئْتُهُ بِمَاءٍ فَتَوَضَّأَ.
নাবী (ﷺ) একদা গোত্রের ময়লা আবর্জনা ফেলার স্থানে আসলেন। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে পেশাব করলেন। অতঃপর পানি আনতে বললেন। আমি তাঁকে পানি এনে দিলে তিনি উযূ করলেন। (সহীহ বুখারী হাঃ ২২৪, ২২৫, ২৪৭১; সহীহ মুসলিম হাঃ ২৭৩; তিরমিযী হাঃ ১২; আহমদ হাঃ ২৩৩০১)
তবুও কোনো মুজতাহিদ ইমাম দাড়িয়ে পেশাব করাকে ওয়াজিব বা সুন্নাত বলে ফতোয়া দেননি বরং এ সহীহ হাদীসের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছেন।
হযরত উমর (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে দাঁড়িয়ে পেশাব করাতে দেখে বললেনঃ
"يَا عُمَرُ لاَ تَبُلْ قَائِمًا" . فَمَا بُلْتُ قَائِمًا بَعْدُ.
"হে উমর! দাঁড়িয়ে পেশাব করো না।" এরপর আমি আর কখনও দাঁড়িয়ে পেশাব করিনি। (তিরমিযী হাঃ ১২)
ইমাম তিরমিযী (রহঃ) এ হাদীসকে যঈফ সাব্যস্ত করেছেন। তারপরও তিনি এই হাদীসের পক্ষে রায় দিয়ে বলেন,
وَمَعْنَى النَّهْىِ عَنِ الْبَوْلِ قَائِمًا عَلَى التَّأْدِيبِ لاَ عَلَى التَّحْرِيمِ . وَقَدْ رُوِيَ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ إِنَّ مِنَ الْجَفَاءِ أَنْ تَبُولَ وَأَنْتَ قَائِمٌ .
দাঁড়িয়ে পেশাব করা একেবারে হারাম নয় তবে আদব ও শিষ্টাচারের দৃষ্টিকোন থেকে তা নিষেধ করা হয়েছে। ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, তিনি বলেছেনঃ 'দাড়িয়ে পেশাব করা শিষ্টাচার বিরোধী'। (তিরমিযী হাঃ ১২)
★★ ফুদাইল ইবনু মারযূক বলেছেন, ইবরাহীম ইবনু হাসান থেকে, ফাতিমা বিনতুল হুসাইন ইবনু আলী থেকে, আসমা বিনতু উমাইস (রা) তিনি বলেন:
"রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ওহী নাযিল হচ্ছিল। এসময়ে তাঁর মস্তক ছিল আলী (রা) এর কোলে। এজন্য আলী আসরের সালাত আদায় করতে পারেন নি। এমতাবস্থায় সূর্য ডুবে যায়। তিনি আলীকে বলেন: তুমি কি সালাত আদায় করেছ? তিনি বলেন না। তখন তিনি বলেন: হে আল্লাহ, আলী যদি আপনার ও আপনার রাসূলের আনুগত্যে থেকে থাকেন তবে তাঁর জন্য আপনি সূর্য ফিরিয়ে দিন। আসমা বলেন: আমি দেখলাম, সূর্য ডুবে গেল। এরপর ডুবে যাওয়ার পরে আবার তা উদিত হলো।" (ইবনু আররাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ১/৩৭৮)
এ সনদে আসমা বিনতু উমাইস প্রসিদ্ধ মহিলা সাহাবী। ফাতিমা বিনতুল হুসাইন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য রাবী। ফুদাইল ইবনু মারযূক সদুক সত্যপরায়ণ রাবী। ইবরাহীম ইবনু হাসান কে ইবনু হিববান গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। এভাবে সনদ বিচারে হাদীসটি হাদীসটি সহীহ না হলেও ‘হাসান’ বলে গণ্য হতে পারে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বাহ্যিক সনদের দিকে তাকিয়ে এরূপ মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ইবনু তাইমিয়া, ইবনু কাসীর, যাহাবী ও অন্যান্য অনেক মুজতাহিদ মুহাদ্দিস تفقه তথা অনুধাবন শক্তি দ্বারা গবেষণা করে হাদীসটির ‘মতন’ বা ‘মূলবক্তব্য’ ‘জাল’ বলে গণ্য করেছেন। (ইবনু আররাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ১/৩৭৮-৩৮২; আলবানী, যঈফাহ ২/৩৯৫-৪০১)
★★ নাবী (ﷺ) এর কন্যা হযরত যয়নব (রা) এর স্বামী আবুল আস প্রথমে অমুসলিম ছিলেন। পরে মুসলিম হয়েছেন। সহীহ সনদে ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,
َرَدَّ النَّبِيُّ ﷺ ابْنَتَهُ زَيْنَبَ عَلَى أَبِي الْعَاصِي بْنِ الرَّبِيعِ بَعْدَ سِتِّ سِنِينَ بِالنِّكَاحِ الْأَوَّلِ وَلَمْ يُحْدِثْ نِكَاحًا قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ لَيْسَ بِإِسْنَادِهِ بَأْسٌ-
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার মেয়ে যয়নাব (রাঃ) কে প্রথম বিয়ে বহাল রেখেই আবূল আস ইবনুর রাবীকে ছয় বছর পর ফিরিয়ে দিয়েছেন, নতুন করে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেননি। তিরমিযী বলেন, এ হাদীসের সনদে কোনো সমস্যা নেই। (সনদ সহীহ; জামে তিরমিযী হাঃ ১১৪৩; আবু দাউদ হাঃ ২২৪০; ইবনু মাজাহ হাঃ২০০৯)
পক্ষান্তরে একটি যঈফ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নতুন করে মোহরানা নির্ধারণ করে তাঁদের বিবাহ নবায়ন করেছিলেন। (জামে তিরমিযী হাঃ ১১৪২, ১১৪৪; ইবনে মাজাহ হাঃ ২০১০; শায়েখ আলবানীও হাদীসটি কে যঈফ বলেছেন। দেখুন, ইরওয়া হাঃ ১৯১৮; যঈফ আবূ দাউদ হাঃ ৩৮৭)
তারপরও ইমাম তিরমিযী সহীহ হাদীস বাদ দিয়ে যঈফ হাদীসকেই অগ্রধিকার দিয়েছেন। তিনি বলেন,
هَذَا حَدِيثٌ فِي إِسْنَادِهِ مَقَالٌ وَفِي الْحَدِيثِ الْآخَرِ أَيْضًا مَقَالٌ وَالْعَمَلُ عَلَى هَذَا الْحَدِيثِ عِنْدَ أَهْلِ الْعِلْمِ أَنَّ الْمَرْأَةَ إِذَا أَسْلَمَتْ قَبْلَ زَوْجِهَا ثُمَّ أَسْلَمَ زَوْجُهَا وَهِيَ فِي الْعِدَّةِ أَنَّ زَوْجَهَا أَحَقُّ بِهَا مَا كَانَتْ فِي الْعِدَّةِ وَهُوَ قَوْلُ مَالِكِ بْنِ أَنَسٍ وَالْأَوْزَاعِيِّ وَالشَّافِعِيِّ وَأَحْمَدَ وَإِسْحَقَ-
এ হাদীসের সনদ সম্পর্কে সমালোচনা রয়েছে। তবুও আহলে ইলম এই হাদীসের মর্মানুযায়ী আমল করেছেন। কোন মহিলা যদি প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করে এবং তার ইদ্দত পালনের সময়ই তার স্বামী ইসলাম গ্রহণ করে তবে তার পূর্ব স্বামীর অধিকার অগ্রগণ্য। ইমাম মালিক ইবনু আনাস, আল-আওযায়ী, শাফিঈ, আহমাদ ও ইসহাক প্রমুখ ইমামগণের ইহাই অভিমত। (তিরমিযী হাঃ ১১৪২ এর আলোচনা)
★★ হাদীসের মতন বিশ্লেষণের প্রতি তেমন গুরুত্ব না দিয়ে শুধু সনদের উপর ভিত্তি করে হাদীসকে সহীহ বলার কারণে শায়েখ শুআইব আরনাঊত শায়েখ আলবানীর সমালোচনা করে বলেন, "আমি শায়েখ আলবানীর এ বিষয়টিতে যার-পর-নাই আশ্চর্য হয়েছি যে, তিনি তো ‘ইলমু মুসতালাহিল হাদীসে’ অবশ্যই পড়েছেন, “‘সহীহ’ হাদীস হল, যে হাদীসের সনদ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন এবং বর্ণনাটি ‘ইল্লত’ অথবা‘শুযূয’ মুক্ত।” কিন্তু আফসোস! শায়েখ বর্ণনার শুদ্ধাশুদ্ধি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দানের ক্ষেত্রে ‘শুযূয’ ও ‘ইল্লত’কে বিবেচনায় আনেননি, হাদীসের মতনের পর্যালোচনায় এ দুটো বিষয়কে আমলে নেননি। তাই তার কাছে হাদীসের সনদ সহীহ হলেই হাদীসটি ‘সহীহ’। এ কারণে তিনি এমন বহু হাদীসকে ‘সহীহ’ বলেছেন, যার ‘মতন’সম্পর্কে আলিমগণের আপত্তি রয়েছে।"
(উদাহরণ হিসাবে তিনি নিচের দুটি হাদীস পেশ করেন)
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
الْوَائِدَةُ وَالْمَوْءُودَةُ فِي النَّارِ.
“যে নারী তার সন্তানকে জীবন্ত কবর দিয়েছে সে আর জীবন্ত প্রোথিত কন্যা উভয়েই জাহান্নামী।” (আবু দাউদ হাঃ ৪৭১৭; মুসনাদে আহমদ হাঃ ১৫৪৯৩; মিশকাতুল মাসাবীহ, তাহকীক শায়েখ আলবানী, কিতাবুল ঈমান, বাবুল ঈমান বিলকদর, হাঃ ১১২; সহীহুল জামিইস সাগীর, হাঃ ৭১৪২)
হাদীসটি পেশ শায়েখ শুআইব আরনাঊত বলেন, শায়েখ আলবানী এ বর্ণনাকে ‘সহীহ’ বলেছেন। অথচ তা কুরআনের আয়াত,
وَإِذَا الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ بِأَيِّ ذَنْبٍ قُتِلَتْ.
“এবং যখন জীবন্ত প্রোথিত কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছে? (সূরা তাকবীর ৮১/৮-৯) এর সুস্পষ্ট বিরোধী। যদিও তিনি বর্ণনাটির এমন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়াস পেয়েছেন, যা গ্রহণযোগ্য নয়।
★★ আবু মুসা (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
أُمَّتِي هَذِهِ أُمَّةٌ مَرْحُومَةٌ لَيْسَ عَلَيْهَا عَذَابٌ فِي الْآخِرَةِ عَذَابُهَا فِي الدُّنْيَا الْفِتَنُ وَالزَّلَازِلُ وَالْقَتْلُ.
“আমার এ উম্মতের উপর আল্লাহর বিশেষ রহমত রয়েছে। আখেরাতে তাদের কোনো আযাব হবে না। তাদের আযাব দুনিয়াতেই ফিৎনা, ভূমিকম্প ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে হবে।” (আবু দাউদ হাঃ ৪২৭৮; মুসনাদে আহমদ হাঃ ১৯১৭৯, ১৯২৫৩)
এ হাদীসের সনদকে শায়েখ আলবানী সহীহ বলেছেন।(সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহা’ হাঃ ৯৫৯) কিন্তু শায়েখ শুআইব আরনাঊত বলেন, আমরা ‘মুসনাদে আহমাদের টিকায় এ হাদীসকে ‘যঈফ’বলেছি। (মুসনাদে আহমাদ, তাহকীক শুআইব আরনাঊত, হাদীস ১৯৬৭৮) ইমাম বুখারীও এ হাদীসটি ‘যঈফ’ হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। কারণ তিনি হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনাসূত্র’ এবং তাতে ‘এযতেরাব’ থাকার কথা উল্লেখের পর বলেন,
والخبر عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الشفاعة وأن قوما يعذبون ثم يخرجون أكثر وأبين وأشهر.
“অর্থাৎ শাফাআত বিষয়ে এবং শাস্তি ভোগের পর জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের বিষয়ে যেসব হাদীস রয়েছে, তা সংখ্যায়, স্পষ্টতায় ও প্রসিদ্ধিতে অগ্রগণ্য।” (আততারীখুল কাবীর ১/৩৮-৩৯)
এ থেকে বুঝা যায়, ইমাম বুখারী সনদের‘এযতেরাব’ বর্ণনার সাথে মতনের উপরও এভাবে ‘নকদ’ করেছেন যে, এই রেওয়ায়েত ঐ সকল হাদীসের বিপরীত যেগুলো ‘তাওয়াতুরের’ নিকটবর্তী। যেগুলো থেকে জানা যায়, “উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার কিছু লোক প্রথমে জাহান্নামে যাবে, পরে নবী কারীম (ﷺ) এর শাফাআতের কারণে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে।”
উপরে বর্ণিত হাদীস দু'টির সনদ পর্যালোচনা করে শায়েখ আলবানী সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু শায়েখ শুআইব আরনাঊত মতন পর্যালোচনা করে যঈফ বলেছেন। কারণ তার মতন কুরআন ও মুতাওয়াতির পর্যায়ে সহীহ হাদীসের পরিপন্থী।
প্রিয় পাঠন! এবার বলুন, আল্লামা মওদুদী (রাহঃ) মুজতাহিদ ইমামগণ সম্পর্কে যা বলেছেন, তা কি ভিত্তিহীন? একই কথা ইমাম আহমদ, আওযায়ী, সাখাবী, বুখারী, তিরমিযী, নববী, যারকাশী, ইবনে হাজার, ইবনে রজব, ইবনে কাসীর, ইবনে আব্দুল বার, ইবনে কাইয়ুম, যাহাবী, শুআইব আরনাঊত (রাহঃ) সহ অনেক মুহাদ্দিস ও ফকিহ বলেছেন, এতে কি তাঁরা হাদীস অস্বীকারকারী হয়ে গেলেন? তা না হলে মওদুদী (রাহঃ) এর বিরুদ্ধে এ অপবাদ কেন? বস্তুতঃ আজকাল কেবল হিংসার বশবর্তী হয়ে কতিপয় শায়েখ সত্য গোপন রেখে কিংবা অজ্ঞতাবশত মওদুদী রাহঃ কে ঘায়েল করার চেষ্টা করতেছেন। আল্লামা মওদুদী (রাহঃ) এর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে এ পর্ব শেষ করছি। তিনি বলেন, "যারা আমার সম্পর্কে না জেনে (আমার মন্তব্য/বক্তব্য) বিশ্লেষণ না করে লোকদের মধ্যে এরূপ কু-ধারণা ছড়াচ্ছে, সেজন্য আমি সবর করছি এবং তাদের কর্মের বিচার আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিচ্ছি।" (রাসায়েল ও মাসায়েল ১/১৫৯)
চলবে.....
0 Comments