হে যুবক, তুমি নামাজী হও !
-------------------------
গত সপ্তাহে মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর একজন ভাই বললেন, দেশ থেকে এসেছি আপনার জন্য একটা গিফট, গাড়ির পিছন থেকে একখানা বই "সিরাতে ইবনে হিশাম" বের করে দিলেন। ছাত্র জীবন শেষে বই খানা আর পড়া হয় নি। মাঝখানে ৩৮ বছরের ব্যবধান। কানাডার টরেন্টো শহরে বছরের সবচেয়ে ভয়াবহ শীত। -৩০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড । বাইরের বরফ শক্ত হয়ে পাথরের মত হয়ে গেছে। আসরের নামাজের পর মাগরিব পর্যন্ত মসজিদে কাটালাম, ইতিমধ্যে বই খানার প্রায় ৮০ পৃষ্ঠা পড়া হয়ে গেছে, রাসূল (সা:) এর মক্কী জীবনের ভয়াবহ কঠিন দিনগুলোর যে বর্ণনা বইটিতে দেয়া হয়েছে তা পড়তে পড়তে চোখে বারবার পানি আসলো। আল্লাহর রাসূল (সা:) কাবা ঘরের নামাজ না পড়তে পেরে সাহাবীদেরকে নিয়ে গিরি গুহায় গোপনে নামাজ পড়তে যেতেন, ঘটনা যখন পড়ছিলাম তখন আমাদের দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামাজের একটি দৃশ্য আমার মানষ পটে ভেসে উঠলো-
১৯৮০ সালে আমাদের এলাকার ফয়জুর রহমান রানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিল। আমি ছিলাম রংপুর মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। সিলেট থেকে রংপুর যেতে দুইদিন লাগতো, রংপুর যাওয়ার পথে একরাত্রি শহিদুল্লাহ হলে রানার রুমে থেকে পরদিন সকালে ঢাকা-আরিচা, পাবনা, বগুড়া হয়ে রংপুরে পৌঁছতাম সন্ধ্যা নাগাদ। আরিচা ফেরি পার হতে তিন থেকে চার ঘন্টা সময় লাগতো। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নামাজ ঘরে এশা এবং ফজরের নামাজ পড়া হত। নামাজ পড়তে কেউ বারন করত না বা সন্দেহের চোখে দেখত না। কিন্তু ৯০ এর দশক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বিঘ্নে, স্বাচ্ছন্দ্যে, নির্ভয়ে নামাজ পড়াও দুরহঃ হয়ে গিয়েছিল। নামাজি সন্দেহে কত ছেলের রক্ত ঝরেছে তার হিসাব কে রাখে। নামাজি সন্দেহে শেষ পর্যন্ত বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ-কে এই পৃথিবী থেকে বিদায় হতে হয়েছে।
২০১১ সালের ঘটনা। সিলেট শহরের উপকণ্ঠে বাসা, আমার এক ভাতিজা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তার সাথে আমার হাসপাতালে দেখা। জিজ্ঞেস করলাম ভাতিজা শুনলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে নামাজ পড়লে অনেকেই নিগ্রহের শিকার হয়, তুমি কিভাবে নামাজ পড়ো ? তার কথা মনে হলে আজও আমার শরীর কেপে ওঠে, উত্তরে বলল চাচা নামাজের সময় যখন হয়, হলে নামাজ পড়ার কোন উপায় নেই, নিজের রুমে পড়লেও অনেকে সন্দেহ করে। তাই নামাজের সময় হলে গোসলখানায় টাওয়েল নিয়ে যাই। গোসল করার ভান করে, টাওয়েলটা বাথরুমে বিছিয়ে নামাজ আদায় করে আবার রুমে ফেরি। অথচ কাছেই মসজিদ। সেখানে তাবলীগ ছাড়া কেউ নামাজ পড়ে না। কি দুর্ভাগ্য, আর কি দুঃসময় ? আমাদের প্রাণ প্রিয় মাতৃভূমিতে।
অথচ কয়েক সপ্তাহ আগে কানাডার একটি ইউনিভার্সিটিতে আমার ছোট ছেলের কম্পিউটার ফ্যাকাল্টিতে আসরের নামাজ আদায় করলাম। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য খুবই সুন্দর পরিচ্ছন্ন আলাদা মসজিদ ঘর, আলাদা অযুর জায়গা, মাইক এবং প্রেজেন্টেশন স্লাইড শো-সহ কনফারেন্স হল। যে কেউ খুশি অনুমতি নিয়ে কনফারেন্স রুম ব্যবহার করতে পারে। “মুসলিম স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন” ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়। সবাইকে সংঘটিত করে, আধুনিক এই সমস্ত হলরুমে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তারা প্রেজেন্টেশন দেয়। নির্বিঘ্নে, নিশ্চিন্তে ইসলামের দাওয়াতী কাজ করে, কেউ কাউকে মৌলবাদী বলে না, ছাত্ররাই পালাক্রমে জুমার নামাজে খুতবা দেয়, এজন্য জুমার খুতবার ট্রেনিং দেওয়া হয়। গতকাল ছিল আমার ছোট ছেলে সালেহীনের খুতবার পালা। আলহামদুলিল্লাহ সে খুতবা দিয়ে জুমার নামাজে ইমামতি করেছে। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, এমনকি স্কুলেও স্বাধীনভাবে সবাই নামাজ আদায় করতে পারে। ধর্মচর্চা করতে কোন বাধা নেই। স্কুল কর্তৃপক্ষ নামাজের কথা বললেই ছাত্রদেরকে নামাজের ব্যবস্থা করে দেন। এমনকি কোন কোন স্কুল ছাত্ররা ক্যাম্পাসে জামাতে নামাজ পড়ে। ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদের আসরের নামাজের ব্যস্ততা আমি তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছিলাম। আর মহান আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করছিলাম। পাশ্চাত্যে এই সমস্ত দেশে পথ হারাবার সকল রাস্তা খোলা থাকার পরও যুবক-যুবতীরা এভাবে নামাজ পড়ছে। হিজাব এবং নিকাব পরে ক্লাস করছে। এতে আমরা মহান মাবুদের কাছে কৃতজ্ঞ। মুদ্রার অন্য পিট অন্ধকার, সে বিষয়ে অন্য একদিন লিখব ইনশাআল্লাহ। আমাদের দেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এভাবে নির্বিঘ্নে মন খুলে নামাজ পড়ুক। হে যুবক তুমি তোমার মহান রবের ডাকে সাড়া দাও। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ে শয়তানকে পরাজিত করো। এই হোক আজকের প্রার্থনা।
-------------------------
লেখকঃ ডাঃ সায়েফ আহমদ।
প্রবন্ধ লেখক, চিকিৎসক, অনলাইন একটিভিস্ট, ইসলামি চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদ।
১৫:০১:২০২৪ইং
0 Comments