মাওলানা মওদূদীর (রহ:) সাথে দেওবন্দের বিরোধ রাজনৈতিক ছিলো শরয়ীগত গত নয় ।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে-
১৯২০ সালের শেষভাগে মাওলানা মওদূদী দিল্লী যান। ১৯২১ সালের প্রথম দিকে মাওলানা মুফতী কেফায়েতুল্লাহ ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি মাওলানা আহমদ সাঈদের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁরা জমিয়তের পক্ষ থেকে 'মুসলিম' নাম দিয়ে একটা পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং মাওলানা মওদূদীর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে তার সম্পাদক নিযুক্ত করেন। ১৯২৩ সাল পর্যন্ত পত্রিকাটি সুচারুরূপে চলতে থাকে এবং মাওলানা শেষ পর্যন্ত তার সম্পাদনা করেন।
এসময়ে তিনি উলামায়ে কেরামের নিকট আরবী সাহিত্য, হাদীস, তাফসীর ফেকাহ, মানতেক (তর্কশাস্ত্র), দর্শন প্রভৃতি অধ্যয়ন করে গভীর পাণ্ডিত্য লাভ করেন। মাওলানা আব্দুস সাত্তার নিয়াযী ছিলেন তৎকালীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেমে দ্বীন। তাঁর কাছে আরবী ব্যাকরণ (নাহু ও সারফ), মা'কুলাত, মায়ানী ও বালাগাত শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর ১২ই জানুয়ারী (১৯২৬) বাইশ বছর বয়সে সাইয়েদ মওদূদী দিল্লীর দারুল উলুম ফতেহপুরীর শিক্ষক মাওলানা মুহাম্মদ শরীফুল্লাহ খানের নিকট থেকে 'উলুমে আকলিয়া ও আদাবিয়া ও বালাগত' এবং 'উলুমে আসলিয়া ও ফরুইয়া' বিদ্যার সনদ হাসিল করেন।
পরবর্তী বছর (১৯২৭) উক্ত দারুল উলুমের শিক্ষক মাওলানা আশফাকুর রহমান কান্ধলভীর কাছে থেকে সাইয়েদ আবুল আ'লা হাদীস, ফেকাহ ও আরবী আদবে সনদ হাসিল করেন। উপরন্তু ১৯২৮ সালে সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী মাওলানা আশফাকুর রহমান কান্ধলভীর কাছে থেকে জামে তিরমিষী ও মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেকের সমাপ্তির সনদ হাসিল করেন। উল্লেখ্য, মাওলানা শরীফুল্লাহ খানের কাছে মাওলানা মওদূদী তাফসীরে বায়যাবী, হেদায়া, ইলমে মায়ানী ও বালাগতও শিক্ষা করেন।
ঊনিশ শ' তেইশ সালে 'মুসলিম' ব্ন্ধ হওয়ার পর মাওলানা মওদূদী হায়দারাবাদ রওয়ানা হন। কিন্তু পথিমধ্যে ভূপালে যাত্রা ভঙ্গ করে সেখানে দেড় বছরকাল নিবিষ্টচিত্তে অধ্যয়নে রত হন। ১৯২৪ সালে তিনি পুনরায় দিল্লী গমন করেন। ওই সময়ে পাকভারতের সিংহপুরুষ মরহুম মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহরের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। মাওলানা মুহাম্মদ আলী তখন 'হামদর্দ' পত্রিকা পরিচালনা করছিলেন। তিনি তরুণ উদীয়মান সাংবাদিক মাওলানা মওদূদীকে উক্ত পত্রিকার কার্যভার গ্রহণ করতে অনুরোধ জানান।
ঠিক এই সময়ে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের পক্ষ থেকে 'আল জমিয়ত' পত্রিকা প্রকাশ করার অভিপ্রায়ে মাওলানা আহমদ সাঈদ মাওলানা মওদূদীকে আহবান জানান। মাওলানা মুহাম্মদ আলীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও মওদূদীর স্বাধীন মন অন্যের অদীনতা স্বীকার বাধা দান করলো। অতএব তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে 'আল জমিয়ত' পত্রিকার সম্পাদনা ভার গ্রহণ করাই সমীচীন মনে করলেন। ১৯২৪ সাল থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত সম্পূর্ণ সুষ্ঠূভাবে তিনি অর্ধ সাপ্তাহিক 'আল জমিয়ত' পরিচালনা করেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি বিভিন্ন বিষয়ের মূল্যবান গ্রন্থও রচনা করেন। মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর এর অনুপ্রেরণায় তাঁর প্রথম প্রকাশনা 'আল জিহাদু ফিল ইসলাম' এবং 'দওলতে আসফিয়া ও হুকুমতে বরতানিয়া' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এ সময়ে 'আল জমিয়ত' পত্রিকার কর্তৃপক্ষ জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সাথে মাওলানার মৌলিক মতবিরোধ শুরু হয়। জমিয়তে উলামা ভারতীয় কংগ্রেসের অন্ধ সমর্থক হয়ে পড়েছিল। যে সময়ে মাওলানা মুহাম্মদ আলী প্রমুখ দেশবরেণ্য নেতৃবৃন্দ কংগ্রেসের একগুঁয়েমি , দ্বিমুখী নীতি ও ইসলাম বিরোধী মনোভাবের জন্য একে পরিত্যাগ করেছিলেন, সে সময়ে সেই কংগ্রেসের তল্পিবাহক হয়ে থাকা জমিয়তে উলামার মর্যাদার পক্ষে অত্যন্ত অশোভনীয় এবং তারই জন্যে ১৯২৮ সালে তিনি উক্ত পত্রিকার সম্পাদনা-ভার চিরদিনের জন্যে পরিত্যাগ করেন।
মাওলানা হোসাইন আহমাদ মাদানীর একজাতীয়তাবাদ
কংগ্রেস কিন্তু বরাবরই তার আপন লক্ষ্যে অবিচল ছিল। অর্থাৎ সমগ্র ভারতে একজাতীয়তা সৃষ্টি এবং তারই ভিত্তিতে দেশের স্বাধীনতা লাভ। ভৌগলিক ও আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ প্রমাণ করে ভারতীয় মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে হিন্দু-কংগ্রেস একজন শ্রেষ্ঠ আলেমকে কাজে লাগালো। ভারতের শ্রেষ্ঠতম ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র দেওবন্দের হাদীস শাস্ত্রের অধ্যক্ষ মরহুম হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী একদা লাহোর জামে মসজিদে কোরআন হাদীস উদ্ধৃত করে ভারতের হিন্দু-মুদলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-জৈন নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে এক ভৌগলিক জাতি প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন। তাঁর বক্তৃতা পুস্তিকাকারেও প্রকাশিত হলো।
এ সময়ে মুসলিম লীগ আন্দোলন বেশ দানা বেঁধে উঠছিল এবং মুসলমানদেরকে একটা স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে পেশ করেই এ আন্দোলন এতদুর অগ্রসর হয়েছিল। কিন্তু বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্রের হাদীস শাস্ত্রের অধ্যক্ষের মুখে মুসলিম-অমুসলিমের সমন্বয়ে একজাতীয়তার যুক্তি-প্রমাণ শুনে মুসলিম লীগমহল এবং সাধারণভাবে মুসলিম ভারত স্তম্ভিত, বিস্ময়বিমূঢ় ও নিরাশা বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়লো। এ সময়ে পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা দার্শনিক কবি ইকবাল রোগ শয্যায় শায়িত ছিলেন। তিনি রোগশয্যায় মাদানী সাহেবের উক্তির বিষয় জানতে পেরে অত্যন্ত ব্যথিত ও চঞ্চল হয়ে পড়েন। তিনি ধীরে ধীরে কম্পিত কলেবরে শয্যার উপর উঠে বসেন এবং স্বভাব-কবি রোগ যন্ত্রণার মধ্যেই কবিতার সুরে মাওলানা মাদানী সাহেবের উক্তির তীব্র সমালোচনা করেন-
আজম হনুয ন দানিস্ত্ রমুযে দীঅরনা,
যে দেওবন্দ্ হুসাইন আহমদ ইঁচে বুল্ আজবীস্ত্।
সরুদে বরসরে মেম্বর কে মিল্লাত আয ওতনস্ত্।
চে বেখবরয আয্ মকামে মুহাম্মদে আরবীস্ত।
বমুস্তফা বরেসাঁ খেশরা কে দী হমা উস্ত্
আগর বাউ না রসীদী তামামে বু লহবীস্ত।
অর্থাৎ-
বোঝেনি ঐ আজমবাসী
দ্বীনের মর্ম বিহ্বলতা,
দেওবন্দে তাইতো হুসেন
আহমদ কন আজব কথা।
"ওয়াতন থেকে মিল্লাত হয়"
এই কথা ফের গান যে তিনি,
বোঝেননি হায় নবীর মকাম
আল আরবীর মান যে তিনি।
নবীর কাছে পৌঁছিয়ে দাও
নিজেকে- এই দ্বীনের দাবি।
পৌঁছাতে না পারো যদি
সবই হবে 'বু-লাহাবী'।
বলা বাহুল্য, ডাঃ ইকবালের কয়েক ছত্র কবিতা যদিও মরহুম মাদানী সাহেবের মতবাদকে কশাঘাত করলো, তথাপি তা একজাতীয়তা মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। ফলে ভারতীয় মুসলমান এবং মুসলিম লীগ তাদের আন্দোলনকে কুয়াশাচ্ছন্ন দেখে দিশাহারা হয়ে পড়লো। ঠিক এই সংকট মুহুর্তে মাওলনা মওদূদী তাঁর বলিষ্ঠ মসি চালনা শুরু করেন এবং "মাসয়ালায়ে কওমিয়ত" নামে একখানা বিপ্লবাত্মক অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেন।
এখানে মরহুম মাওলানা মাদানী সাহেবের উক্তির কিঞ্চিৎ উল্লেখ প্রয়োজন বোধ করছি। তিনি তাঁর বক্তৃতায় এটাই প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন যে, বর্তমানকালে জাতি ভৌগলিক আঞ্চলিকতার ভিত্তিতেই গঠিত হয়। তিনি তাঁর উক্তি প্রমাণ করার জন্য প্রথমেই বলেন-
"একজাতিতত্বের বিরোধিতা এবং উহাকে ন্যায়নীতির বিপরীত প্রমাণ করার প্রসঙ্গে যাহা কিছু প্রকাশিত হইয়াছে এবং হইতেছে তাহার ভুলত্রুটি দেখাইয়া দেওয়া এখন জরুরী মনে করিতেছি। কংগ্রেস ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দ হইতে ভারতবাসীর নিকট স্বদেশিকতার ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্যের দাবি করিয়া যথেষ্ট পরিমাণে চেষ্টা ও সাধনা করিতেছে।
উহার বিরোধী শক্তিসমূহ ইহার অস্বীকার যোগ্য হওয়া বরং নাজায়েয ও হারাম হওয়ার কথা প্রমাণ করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতেছে। বস্তুতঃ ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদের পক্ষে ইহা অপেক্ষা মারাত্মক আর কিছুই নাই। ইহা আজ নয়, ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে কিংবা তাহার পূর্ব হইতে এইসব কথা প্রকাশ করা হইয়াছে।"
তিনি আরও বলেন-
"একজাতীয়তা যদি এমনই অভিশপ্ত ও নিকৃষ্ট বস্তু হইয়াও থাকে, তবুও ইউরোপীয়গণ যেহেতু এই অস্ত্র প্রয়োগ করিয়াই ইসলামী বাদশাহী ও ওসমানী খেলাফতের মূলোচ্ছেদ করিয়াছিল, তাই এই হাতিয়ারকেই ব্রিটিশের মূলোৎপাটনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা আজ মুসলমানদের কর্তব্য।" (ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ- পৃষ্ঠা ৪৩)।
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী মরহুম সাহেবের উক্তির প্রত্যুত্তরে যে বিপ্লবী গ্রন্থ ("ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ" মাওলানা মওদূদী প্রণীত উর্দূ গ্রন্থ "মাসয়ালায়ে কওমিয়তের" বাংলা অনুবাদ।) রচনা করেন তার প্রারম্ভে তিনি বলেন-
"দারুল উলুম দেওবন্দের প্রিন্সিপাল জনাব মাওলানা হুসাইন আহমেদ মাদানী 'একজাতিতত্ত্ব ও ইসলাম' নামে একখানি পুস্তিকা লিখিয়াছেন। একজন সুপ্রসিদ্ধ আলেম এবং পাক-ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের লিখিত এই পুস্তিকায় 'জটিল জাতিতত্ত্বের' সরল বিশ্লেষণ এবং প্রকৃত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির পূর্ণ অভিব্যক্তি হইবে বলিয়া স্বভাবতই আশা করা গিয়াছিল। কিন্তু ইহা পাঠ করিয়া আমাদিগকে নির্মমভাবে নিরাশ হইতে হইয়াছে এবং এই বইখানিকে গ্রন্থকারের পদমর্যাদার পক্ষ্যে হানিকর বলিয়া মনে হইয়াছে। বর্তমান যুগে অসংখ্য ইসলাম বিরোধী মতবাদ ইসলামের মূলতত্ত্বের উপর প্রবল আক্রমণ চালাইতে উদ্যত, ইসলাম আজ ইহার নিজের ঘরেই অসহায়। স্বয়ং মুসলমানগণ দুনিয়ার ঘটনাবলী ও সমস্যাবলী খালেছ ইসলামের দৃষ্টিতে যাচাই করে না। বলা বাহুল্য, নিছক অজ্ঞানতার দরুনই তাহারা উহা করিতে পারিতেছে না।
উপরন্তু 'জাতীয়তার' ব্যাপারটি এতই জটিল যে, উহাকে সুস্পষ্টরূপে হৃদয়ঙ্গম করার উপরই এক একটি জাতির জীবন-মরণ নির্ভর করে। কোন জাতি যদি নিজ জাতীয়তার ভিত্তিসমূহের সহিত সম্পূর্ণ ভিন্ন মূলনীতির সংমিশ্রণ করে, তবে সে 'জাতি' হিসাবে দুনিয়ার বুকে বাঁচিতে পারে না। এই জটিল বিষয়ে লেখনী ধারণ করিতে গিয়া মাওলানা হুসাইন আহমেদ সাহেবের ন্যায় ব্যক্তির নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল। কারণ তাঁহার নিকট নবীর আমানত গচ্ছিত রহিয়াছে। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও মূল তত্ত্বের উপর যদি কখনওজঞ্জাল-আবর্জনা পুঞ্জীভুত হয়, তবে ইহাদের ন্যায় লোকদেরই তাহা দূরভূত করা কর্তব্য।
বর্তমান অন্ধকার যুগে তাঁহাদের দায়িত্ব যে সাধারণ মুসলমানদের অপেক্ষা অনেক বেশি এবং কঠোর, সে কথা তাহাদের পুরাপুরিই অনুধাবন করা উচিৎ ছিল। সাধারণ মুসলমান যদি ভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত থাকে, তবে সে জন্যও সর্বপ্রথম এই শ্রেণীর লোক দিগকেই দায়ী করা হইবে। সেই জন্য আমাকে আবার বলিতে হইতেছে যে, মাওলানা মাদানীর এই পুস্তিকায় তাঁহার দায়িত্বজ্ঞান ও দায়িত্বানুভূতির কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।" (ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ - পৃষ্ঠা ৪১)।
সমগ্র ভারতবাসীর "একজাতিতত্ত্বকে" সঙ্গত বলে প্রমাণ করার জন্যে মাওলানা মাদানী সাহেব আর একটি দলীল পেশ করেছেনঃ
"আমরা প্রতিদিন সম্মিলিত স্বার্থের জন্য জনসংঘ বা সমিতি গঠন করিয়া থাকি এবং তাহাতে শুধু অংশগ্রহণই করি না, উহার সদস্যপদ লাভ করিবার জন্যুদ প্রাণপণ চেষ্টাও করিয়া থাকি। .... শহর এলাকা, ঘোষিত এলাকা, মিউনিসিপ্যাল বোর্ড, জেলা বোর্ড, ব্যবস্থা পরিষদ, শিক্ষা সমিতি এবং এই ধরনের শত শত সমিতি রহিয়াছে যাহা বিশেষ উদ্দেশ্যের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মনীতি অনুসারে গঠিত হইয়াছে। এই সব সমিতিতে অংশগ্রহণ করা এবং সেজন্য সম্পূর্ণরূপে বা আংশিকভাবে চেষ্টা করাকে কেহই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে না।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ই ধরনের কোন সমিতি যদি দেশের স্বাধীনতা এবং বৃটিশ প্রভুত্বের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তাহাতে অংশগ্রহণ করা হারাম, ন্যায়পরায়ণতার বিপরীত, ইসলামের শিক্ষার পরিপন্থী এবং জ্ঞানবুদ্ধি ইত্যাদির বিপরীত হইয়া যায়।" (ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ - ৫২ পৃষ্ঠা)।
তদুত্তরে মাওলানা মওদূদী বলেন-
"বস্তুত ইহাকেই বলে ভুলের ভিত্তিতে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ। মাওলানা মাদানী একটি পাপের কাজকে ফরয গণ্য করতঃ উহারই অন্ধ প্রেমে পড়িয়া অনুরূপ আর একটি পাপকে সঙ্গত প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিতেছেন। অথচ উভয় ক্ষেত্রেই হারাম হওয়ার একই মূল কারণ বিদ্যমান। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলিতে চাই, উলামায়ে হিন্দের নিকট কিউন্সিল ও এসেম্বলীতে যোগ দেওয়াকে একদিন হারাম এবং অন্যদিন হালাল বলিয়া ঘোষণা করা একেবারে পুতুল খেলার শামিল হইয়াছে। কারণ প্রকৃত ব্যাপার লক্ষ্য করিয়া কোন জিনিসকে হারাম ঘোষণা করার নীতি তাহাদের নয়। গান্ধীজীর একটি শব্দেই তাহাদের ফতোয়াদান ক্ষমতা সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু আমি ইসলাম শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয় নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে বলিতেছি, আল্লাহ ও তাহার রাসূল (সাঃ) যে সব বিষয়ে সুস্পষ্ট ফয়সালা করিয়াছেন, সে সম্পর্কে নতুত ভাবে ফয়সালা করিবার নিরঙ্কুশ অধিকার মানুষকে দেয় যেসব সামগ্রিক প্রতিষ্ঠান- মুসলমানদের পক্ষে তাহা সমর্থন করা এক চিরন্তন অপরাধ সন্দেহ নাই।
কিন্তু এইরূপ নিরঙ্কুশ অধিকার ও কর্তৃত্বসম্পন্ন সামগ্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহে অমুসলিমদের সংখ্যা অধিক হইয়া পড়ে এবং তাহাতে সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতেই যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, তখন ইহা দ্বিগুণ অপরাধরূপে পরিগণিত হয়। অতএব এইসব সামগ্রিক প্রতিষ্ঠানের কর্মসীমা খোদার শরীয়তের নির্দিষ্ট সীমা হইতে স্বতন্ত্র করিয়া দেওয়াই মুসলমানদের প্রথম কর্তব্য এবং তাহাদের পক্ষে প্রকৃত আযাদী যুদ্ধ ইহাই। কর্তৃত্ব প্রয়োগের উল্লিখিত সীমা উভয়ের যদি সতন্ত্র হয়, তবে মুসলিম অমুসলিম উভয় জাতির কোন মিলিত স্বার্থের জন্য গঠিত দলের সহযোগিতা করা মুসলমানদের পক্ষে সঙ্গত হইবে। তাহা কোন শত্রুর আক্রমনের প্রতিরোধের জন্য হউক, কি কোন অর্থনৈতিক বা শৈল্পিক কাজকর্ম আঞ্জাম দেওয়ার জন্য হউক, তাহাতে কোনরূপ পার্থক্য নাই।
কিন্তু উভয় জাতির কর্ম ও ক্ষমতার সীমা যতদিন পরস্পর যুক্ত থাকিবে, মিলন ও সহযোগিতা তো দূরের কথা এইরূপ যুক্ত শাসনতন্ত্রের অধীন জীবনযাপন করাও মুসলমানদের পক্ষে সম্পূর্ণ অসঙ্গত।
এই ব্যাপারে নির্বিশেষে সকল মুসলমানই অপরাধী বলিয়া বিবেচিত হইবে, যতদিন না তাহারা সকলে মিলিয়া মিলিত শক্তির সাহায্যে উক্ত শাসনতন্ত্রকে চূর্ণ করিয়া দিবে। আর যাহারা সাগ্রহে এই শাসনতন্ত্র গ্রহণ করিবে এবং উহাকে চালু করার জন্য চেষ্টা করিবে তাহারা তদপেক্ষা বেশী অপরাধী হইবে। কিন্তু যে ব্যক্তি, সে যে-ই হউক না কেন, সেই শসনতন্ত্র চালু করার অনুকূলে কোরআন-হাদীস হইতে যুক্তি পেশ করিবে, তাহার অপরাধ হইবে সর্বাপেক্ষা বেশী।"
(ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ- পৃষ্ঠা ৫৩)
কংগ্রেসের একজাতীয়তার বিষময় ফল লক্ষ্য করে মওলানা মওদূদী বলেন-
"এই উদ্দেশ্যেই ওয়ার্ধা স্কীম রচনা করা হইয়াছে। বিদ্যামন্দির স্কীমেরও ইহাই উদ্দেশ্য ছিল। এই উদ্দেশ্য এই উভয় স্কীমেই স্পষ্ট ভাষায় লিখিয়া দেওয়া হইয়াছিল। কিন্তু মাওলানা মাদানী এই সব স্কীম এবং উহাদের পাঠ্য তালিকা মোটেই দেখেন নাই। পণ্ডিত নেহেরু কয়েক বছর পর্যন্ত এই জাতীয়তারই শিক্ষা ফুঁকিতেছেন। কিন্তু তাঁহার কোন বক্তৃতা বা রচনাও মাওলানা মাদানীর গোচরীভূত হয় নাই।
কংগ্রেসের দায়িত্বসম্পন্ন প্রত্যেকটি ব্যক্তি এই কথাই ঘোষণা করিতছেন, লিখিতেছেন এবং নতুন শাসনতন্ত্রলব্ধ রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে তাহা প্রবলভাবে প্রচারও করিয়া বেড়াইতেছেন। কিন্তু মাওলানা মাদানী ইহার কিছুই শুনিতে, দেখিতে ও অনুভব করিতে পারিতেছেন না। অথচ তিনি যে সব সামগ্রিক প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ করিয়াছেন, তাহাদের প্রত্যেকটির দ্বারাই এইসব কাজ সম্পন্ন করা হইতেছে।" (ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ- পৃষ্ঠা ৫৯-৬০)।
মাওলানা মওদূদী আরও বলেন-
"সুতরাং মাওলানা মাদানী যদি তাঁহার মনোভাব ব্যক্ত করার জন্য 'পারস্পারিক বন্ধুতা' ইত্যাদি কোন শব্দ ব্যবহার করিতেন এবং ইহাকে কংগ্রেসের নীতি ও কর্ম হিসাবে পেশ না করিয়া নিজের তরফ হইতে একটি প্রস্তাবও সুপারিশ হিসাবে পেশ করিতেন, তবেই ভাল হইত। অন্তত এখনও যদি তিনি এই জাতির প্রতি এতটুকু অনুগ্রহ করেন, তবে তাহা বড়ই মেহেরবানী হইবে। অন্যথায় তাঁহার লেখনীতে মহা বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা রহিয়াছে। জালেম রাজা বাদশাহ ও ফাসেক রাষ্ট্রনেতা যাহা কিছু করিয়াছেন, আলেমগণ তাহাকেই কোরআন হাদীসের দলীল দিয়া সত্য প্রমাণ করত ধর্মকে অত্যাচার ও শোষণের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করিাছেন।
মাওলানা মাদানীর উল্লিখিত পুস্তিকা প্রকাশিত হওয়ার পর খালেছ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে 'জাতীয়তার' বিশ্লেষন করা এবং এই ব্যাপারে ইসলামী ও অনৈসলামিক মতবাদের পারস্পরিক মূলগত পার্থক্য উজ্জ্বল করিয়া ধরা অত্যান্ত জরুরী হইয়া পড়িয়াছে। তাহা করা হইলে এ সম্পর্কীয় যাবতীয় ভুল ধারণা লোকের মন হইতে দূর হইবে এবং উভয় পথের কোন একটি পথ বুঝিয়া-শুনিয়া গ্রহণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হইবে। ইহা আলেমদেরই কত্যর্ব ছিল, কিন্তু আলেম সমাজের প্রধান ব্যক্তিই যখন একজাতীয়তার পতাকা উত্তোলন করিয়াছেন এবং কোন আলেমই যখন প্রকৃত কর্তব্য পালনে প্রস্তুত হইতেছেন না, তখন আমাদের ন্যায় সাধারণ লোকেরাই তজ্জন্য তৎপর হইতে হইবে।" (ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ - পৃষ্ঠা ৬১)।
এ গ্রন্থে তিনি ইসলামী জাতীয়তার ভিত্তি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ
"যেসব গন্ডীবদ্ধ, জড় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও কুসংস্কারপূর্ণ ভিত্তির উপর দুনিয়ার বিভিন্ন জাতীয়তার প্রাসাদ গড়ে উঠেছ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) তা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেন। বর্ণ, গোত্র, জন্মভূমি, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অবৈজ্ঞানিক বিরোধ ও বৈষম্যের ভিত্তিতে মানুষ নিজেদের মূর্খতা ও চরম অজ্ঞতার দরুন মানবতাকে চূর্ণ করে দেয় এবং মানবতার দৃষ্টিতে সমস্ত মানুষকে সমশ্রেণীর সমমর্যাদা সম্পন্ন ও সমানাধিকার প্রদান করেছে।"
"ইসলামী জাতীয়তার মানুষে মানুষে পার্থক্য করা হয় বটে, কিন্তু জড়, বৈষয়িক ও বাহ্যিক কোন কারণে নয়। করা হয় আধ্যাতিক, নৈতিক ও মানবিকতার দিক দিয়ে। মানুষের সামনে এক স্বাভাবিক সত্য বিধান পেশ করা হয়, যার নাম ইসলাম। আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য, হৃদয়মনের পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা, কর্মের অনাবিলতা, সততা ও ধর্মানুসরণের দিকে গোটা মানব জাতিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে যে, যারা এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করবে, তারা এক জাতি হিসাবে গণ্য হবে। আর যারা তা অগ্রাহ্য করবে, তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতির অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ মানুষের একটি হচ্ছে ঈমান ও ইসলামের জাতি এবং তার সমস্ত ব্যক্তিসমষ্টি মিলে একটি উম্মাহ। অন্যটি হচ্ছে কুফর ও ভ্রষ্টতার জাতি। তার অনুসারীগণ নিজেদের পারস্পরিক মতবিরোধ ও বৈষম্য সত্ত্বেও একই দল ও একই দলের মধ্যে গণ্য।"
"এ দুটি জাতির মধ্যে বংশ ও গোত্রের দিক দিয়ে কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য বিশ্বাস ও কর্মের। কাজেই একই পিতামাতার দু'টি সন্তানও ইসলাম ও কুফরের উল্লিখিত ব্যবধানের দরুন স্বতন্ত্র দুই জাতির মধ্যে গণ্য হতে পারে এবং দুই নিঃসম্পর্ক ও অপরিচিত ব্যক্তি ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার কারণে এক জাতির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।"
"জন্মভূমির পার্থক্যও এ উভয় জাতির মধ্যে ব্যবধানের কারণ হতে পারে না। এখানে পার্থক্য করা হয় হক ও বাতিলের ভিত্তিতে। আর হক ও বাতিলের 'স্বদেশ' বা 'জন্মভূমি' বলতে কিছু নেই। একই শহর, একই মহল্লা এ একই ঘরের দুই ব্যক্তির জাতীয়তা ইসলাম ও কুফরের পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন হতে পারে। একজন নিগ্রো ইসলামের সূত্রে একজন মরক্কোবাসীর ভাই হতে পারে।"
"বর্ণের পার্থক্যও এখানে জাতীয় পার্থক্যের কারণে নয়। বাহ্যিক চেহারার রং ইসলামে নগন্য। এখানে একমাত্র আল্লাহর রঙেরই গুরুত্ব রয়েছে। তা-ই হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম রং।"
"ভাষার বৈষম্যও ইসলাম ও কুফরের পার্থক্যের কারণ নয়। ইসলামে মুখের ভাষার কোনই মূল্য নেই। মূল্য হচ্ছে মনের, হৃদয়ের-ভাষাহীন কথার।
ইসলামী জাতীয়তার এ বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে কালেমা- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। বন্ধুতা আর শত্রুত এ কালেমার ভিত্তিতেই হয়ে থাকে। এ স্বীকৃতি মানুষকে একীভূত করে, অস্বীকৃতি মানুষের মধ্যে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটায়। এ কালেমা যাকে বিচ্ছিন্ন করে, তাকে রক্ত, মাটি, ভাষা, বর্ণ, অন্ন, শসন ব্যবস্থা প্রভৃতি কোন সূত্র এবং কোন আত্নীয়তাই যুক্ত করতে পারে না। অনুরূপভাবে এ কালেমা যাদেরকে যুক্ত করে তাদেরকে কোন কিছুই বিচ্ছিন্ন করতে পারে না।
মাওলানা আরও বলেনঃ
"উল্লেখ্য যে, অমুসলিম জাতিসমূহের সাথে মুসলিম জাতির সম্পর্কের দু'টি দিক রয়েছে। প্রথমটি এই যে, মানুষ হওয়ার দিক দিয়ে মুসলিম অমুসলিম সকলেই সমান। আর দ্বিতীয়টি এই যে, ইসলাম ও কুফরের পার্থক্য হেতু আমাদেরকে তাদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র করে দেওয়া হয়েছে। প্রথম সম্পর্কের দিক দিয়ে মুসলমানেরা তাদের সাথে সহানুভূতি, দয়া, ঔদার্য ও সৌজন্যের ব্যবহার করবে। কারণ মানবতার দিক দিয়ে এরূপ ব্যবহারই তারা পেতে পারে।
এমনকি তারা যদি ইসলামের দুশমন না হয়, তাহলে তাদের সাথে বন্ধুত্ব, সন্ধি এবং মিলিত উদ্দেশ্যের (Common Cause) সহযোগিতাও করা যেতে পারে। কিন্তু কোন প্রকার বস্তুগত ও বৈষয়িক সম্পর্ক তাদেরকে ও আমাদেরকে মিলিত করে 'এক জাতি' বানিয়ে দিতে পারে না।"
যা হোক, মাওলানা মওদূদীর উপরিউক্ত গ্রন্থখানি তৎকালীন সমাজে এক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং মাওলানা মাদানীর বক্তৃতা ও পুস্তিকা যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে তা সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়। পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা ও কর্মীগণ একে একটি শাণিত হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন। বস্তুত এই গ্রন্থখানি দ্বিজাতি তত্বের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি স্থাপন করে এবং ইহাই পাকিস্তান সৃষ্টির মূল কারণ হয়ে পড়ে। গ্রন্থখানি কংগ্রেসের রামরাজ্য স্থাপনের মারাত্মক পরিকল্পনা এবং মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী সমর্থিত আঞ্চলিক জাতীয়তার যুক্তি তর্ক নস্যাৎ করে তাকে অবৈজ্ঞানিক, অযৈক্তিক, অনৈসলামী এবং অন্তঃসারশূন্য প্রমাণ করে দেয়। শুধু তাই নয়, মাওলানা মওদূদী এই গ্রন্থখানি দ্বারা মুসলমানদের স্বতন্ত্র জাতীয়তার ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র স্থাপন দাবির যৌক্তিকতা উজ্জ্বল ও পরিস্ফুট করে তুলেছিলেন।
মাওলানা মওদূদীর প্রতি মাওলানা মাদানীর অন্ধ আক্রোশের এটাই মূল কারণ। এই আক্রোশকে ভিত্তি করেই মাওলানা মাদানী পরবর্তীকালে মাওলানা মওদূদীর উপরে আমরণ ফতোয়াবাজীর মেশিনগান থেকে অমূলক, ভিত্তিহীন ও বিদ্বেষমূলক অভিযোগ টেনে রোষানল প্রজ্জ্বলিত ফতোয়ার গোলাবর্ষণ করেছেন। ততোধিক পরিতাপের বিষয় এই যে, মরহুম মাদানী সাহেবের অনেক শিষ্য-সাগরিদ, যাঁরা 'উলামায়ে দ্বীন হিসাবে পরিচিত, ওস্তাদের অনুসরণ করে তাঁরাও মাওলানা মওদূদীর অন্ধ বিরোধিতায় মেতে ওঠেন। একথা অনস্বীকার্য যে, মাওলানা মাদানীসহ তাঁর শিষ্য-সাগরিদগণ পাকিস্তান সৃষ্টিতে চরম বাধা দান করেন। এমনকি পাকিস্তান ঘোষিত হওয়ার পরও 'সিলেট রেফারেন্ডামের' সময় এসব উলামায়ে কেরাম পাকিস্তানের বিপক্ষে ভোট সংগ্রহ করার জন্য সিলেটের মুসলমানদের দ্বারে দ্বারে ধরণা দেন। পাকিস্তান হওয়ার পর এ সব উলামায়ে কেরাম হঠাৎ পাকিস্তানের পরম ও চরম কল্যাণকামী সেজে মাওলানা মওদূদীকে পাকিস্তান আন্দোলন বিরোধী বলে অভিযুক্ত করেন। 'ইসলাম' ও 'উলামায়ে দ্বীনের' ইতিহাসে এর চেয়ে বড় কলঙ্ক, এর চেয়ে বড় সত্যের অপলাপ আর কি হতে পারে?
পাকিস্তান সৃষ্টির পশ্চাতে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদীর যে বিরাট অবদান ছিল, তা কোন বিবেকসম্পন্ন, জ্ঞানী, ন্যায়পরায়ন ও সুস্থ মস্তিষ্ক ব্যক্তির অস্বীকার করার উপায় নেই। এ কথা ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
আমদের দেশের স্বার্থান্ধ ও সুবিধাবাদী কিছু রাজনৈতিক দল এবং তাদেরই অন্ধ সমর্থক কিছু লোক, এমনকি কিছু সংখ্যক আলেম পর্যন্ত মাওলানা মওদূদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে থাকেন যে তিনি এক সময়ে কংগ্রেস ও জমিয়াতে উলামায়ে হিন্দুদের অনুসারী হিসাবে পাকিস্তানের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁদের এসব প্রচারণা যে ইসলাম বিদ্বেষ প্রসূত এবং ইসলামের পুর্ণজাগরণকে রোধ করার অশুভ চক্রান্ত, তা জ্ঞানী লোকের বুঝতে মোটেউ কষ্ট হবার কথা নয়। আমরা নিরপেক্ষ পাঠক-পাঠিকা ও দেশের সুধীজনকে অনুরোধ করি, তাঁরা যেন মাওলানা মওদূদীর সমগ্র অতীত কার্যাবলী জানবার ও বুঝবার চেষ্টা করেন।
মাওলানা মওদূদী একজন মানুষ ব্যতীত কিছুই নন। তাঁর মধ্যে মানবসূলভ দোষত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে যে ব্যক্তি তাঁর সমগ্র জীবনের সময়, অর্থ ও শ্রম আল্লাহর পথে উৎসর্গ করেছেন এবং দ্বীন ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে অক্লান্ত সাধনা করে চলেছেন, তাঁর প্রতি বিদ্বেষমূলক মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করা কোন ভাল মানুষের কাজ নয়। তাঁর প্রতি এর চেয়ে বড় জুলুম ও অবিচার আর কি হতে পারে? তবে এ ধরনের লোকের মনে রাখা উচিৎ যে, সত্য একদিন তার স্বর্গীয় আলোক আভায় উদ্ভাসিত হয়ে পড়বেই এবং সেদিন শূন্যে বিলীন হয়ে যাবে যত মিথ্যার ফানুস।
-------------------------
0 Comments