Recent Tube

বিএনপির সাথে কী ইসলামী আন্দোলনের রাজনৈতিক ঐক্য হবে? - পলাশ রহমান

বিএনপির সাথে কী ইসলামী আন্দোলনের রাজনৈতিক ঐক্য হবে?
          --- পলাশ রহমান।
ক'দিন আগে বলেছিলাম, ই আন্দোলন তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ঠিক করে ফেলেছে। রাখঢাক না করে বিএনপির বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনায় নেমেছে দলটি। সুতরাং এখনই সময় বিএনপির রাজনৈতিক মুন্সিয়ানা দেখানোর।

সোমবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা ই আন্দোলনের অফিসে যান এবং সৈয়দ রেজাউল করীমের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে তারা মিডিয়ার সামনে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেন। তারা উল্লেখ করেন, বিএনপি এবং ই আন্দোলন ১০টি বিষয়ে ঐক্যমত হয়েছে।

লিখিত ঐক্যমতে উভয় দলের নেতাদ্বয় স্বাক্ষর করেন এবং তা মিডিয়ায় তুলে ধরেন। যা বিএনপির সময় উপযোগী 'রাজনৈতিক মুন্সিয়ানা' বলে আলোচিত হচ্ছে বিজ্ঞ মহলে।

এর আগে বিএনপির দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াত নেতা শফিকুর রহমান বরিশালের চরমোনায় গিয়ে সৈয়দ রেজাউল করীমের সাথে দেখা করেন এবং নির্বাচনী ঐক্যের বিষয়ে উভয় দলের নেতারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। মূলত জামায়াত এবং ই আন্দোলনের ঘনিষ্ঠতার খবর ঢাকার রাজনীতিতে নতুন হিসাবের খাতা খুলে দেয়। দেশের ইসলামপন্থী জনগণসহ উভয় দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সন্তোষ দেখা যায়। তারা মনে করেন, ইসলামপন্থী বড় দুই দলের মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতা হলে দেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন সম্ভব।

হঠাৎ কেনো ই আন্দোলনের দুয়ারে দেশের বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা?

তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশের রাজনীতিতে ই আন্দোলন সক্রিয়। দলটির নেতারা কখনো ফুলটাইম রাজনীতি করেননি। ধর্মীয় ইস্যুর বাইরে তারা স্টিম লেভেলে যাননি কখনো। সংসদে তাদের একজনও এমপি ছিলো না। কিন্তু নীতি আদর্শের বিষয়ে দলটি এখন পর্যন্ত কারো সাথে আপস করেনি। ফ্যাসিনার কোনো ভুয়া জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। ফ্যাসিনা আমলের পুরটা সময়- ই আন্দোলন রাজপথে থাকার চেষ্টা করেছে। ফ্যাসিনা সরকারের সমালোচনা করেছে। তবু জনমনে একটা চিকন সন্দেহ ছিলো- ই আন্দোলন এবং আওয়ামীলীগের মধ্যে গোপন বোঝাপড়া নিয়ে।

দেশের সাধারণ জনগণ এবং রাজনৈতিক মহল থেকে সকল সন্দেহ সরে যায় ২৪ এর জাতীয় নির্বাচনের পরে। অনেকেই ভেবেছিলো ই আন্দোলন ফ্যাসিনার ফ্যাসি-নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু সকল জল্পনায় কীর্তনখোলার পানি ঢেলে দেয় দলটি। বহু চাপ এবং লোভ উপেক্ষা করে তারা নির্বাচন বয়কট করে। ফ্যাসিনা খেদাও আন্দোলনে দলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফ্যাসিনা যখন ছাত্র জনতার আন্দোলনে দিশেহারা হয়ে গণহত্যা শুরু করে, তখন সবাইকে চমকে দিয়ে ই আন্দোলন দলীয় ব্যানার নিয়ে রাস্তায় নামে। যা ছাত্র-জনতার বিপ্লবী সাহসকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। সৈয়দ রেজাউল করীম হয়ে ওঠেন 'বঙ্গঅভিভাবক'। তিনি দেশবাসীকে রাজপথে মেনে আসার আহবান জানিয়ে বলেন, আপনার সন্তানরা গুলি খেয়ে মরছে- আপনি ঘরে বসে থাকতে পারেন না। রাজপথে মেনে আসুন, আমরা আপনাদের সাথে আছি। তিনি প্রশাসনের উদ্দেশ্যে হুংকার দিয়ে বলেছিলেন, 'এ নরপিশাচ, তুই আমার ছেলে মেয়েদের বুকে গুল করলি কেনো'! 

রক্তপিপাসু ফ্যাসি-পুলিশদের থামাতে সে সময় এমন একটা রাজনৈতিক হুংকার খুব দরকার ছিলো। তিনি প্রশাসনের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, কোনো বাবা কী সন্তানের বুকে গুলি চালাতে পারে? তার ওই কথায় রক্তপিপাসুদের মনোবল ভেঙ্গে গিয়েছিলো। তারা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলো। চাঙ্গা হয়ে উঠেছিলো ছাত্র জনতার আন্দোলন।

ই আন্দোলনের আরেক নেতা সৈয়দ ফয়জুল করীম হাজার হাজার নেতাকর্মী সাথে নিয়ে নিজে রাস্তায় নেমেছিলেন। প্রেসক্লাবে, শাহবাগে ছাত্র জনতার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ৫ তারিখে কুখ্যাত বঙ্গভবন (ফ্যাসিনার আস্তাবল) ঘেরাও করার ঘোষনা তিনি সবার আগে দিয়েছিলেন।

জনমনে ই আন্দোলনের প্রতি সন্দেহের প্রধান কারণ হলো- ফ্যাসিনার আমলে সকল রাজনৈতিক দল অশ্লীল দমন নিপীড়নের মধ্যে থাকলেও তুলনামূলক ই আন্দোলন নিরাপদ ছিলো। মানুষ মনে করতো আওয়ামীলীগের সাথে তাদের গোপন বোঝাপড়া আছে। কিন্তু তা কোনো ভাবেই প্রমাণিত নয়। শতভাগ অনুমান নির্ভর। 

তাছাড়া দেশের ইসলামপন্থী দলগুলো যখন বিএনপি আওয়ামীলীগের পেছনে হিড়িক দিয়েছে, তখন ই আন্দোলন একলা চলেছে। নীতি আদর্শ পকেটে রেখে কারো সাথে একাকার হয়নি। ই আন্দোলনের মতে- ঐক্যের ভিত্তি ক্ষমতা হতে পারে না। ক্ষমতা কেন্দ্রীক ঐক্য রাজনৈতিক সুবিধাভোগী তৈরী করে। তারা চেয়েছে ইসলামপন্থীদের স্বতন্ত্র প্লাটফর্ম। কারো ক্ষমতার সিঁড়ি হতে রাজি হয়নি দলটি।

দেশের 'আদর্শ পোড়া' রাজনীতিতে ই আন্দোলন এক ব্যতিক্রম ধারা চালু করে। বিশেষ করে দেশের ইসলামপন্থী রাজনীতিতে তারা আশার আলো দেখায়। স্বতন্ত্রধারা যে রাজনৈতিক আত্মমর্যাদা এবং গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয় তা দেরিতে হলেও ইসলামপন্থীরা বুঝতে পারে। তারা বিএনপি আওয়ামীলীগের লেজ ছেড়ে ইসলামপন্থীদের মধ্যে আদর্শ ভিত্তিক ঐক্যের প্রতি আগ্রহী হয়। যার ধারাবাহিকতায় ছোট ছোট ইসলামপন্থী দলগুলোর সাথে ই আন্দোলনের দূরত্ব কমতে শুরু করে জ্যামিতিক হারে। সাপে নেউলে সম্পর্কের জামায়াতের সাথেও ই আন্দোলনের সম্পর্ক শীতল হয়। 

দেশের সাধারণ মানুষের মতো বড় রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা বিশ্বাস বাড়ে ই আন্দোলনের প্রতি। রেজাউল করীমের দৃঢ় এবং অটল অবস্থান ঢাকার রাজনীতিতে ই আন্দোলনকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। ফলে আগামীর জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো ই আন্দোলনকে পাশে রাখতে চায়। 

ই আন্দোলন কী তাদের এই রাজনৈতিক গুরুত্ব ধরে রাখতে পারবে?

আমার মনে হয় পারবে 'না'। কারণ ই আন্দোলন ফুলটাইম রাজনীতি করে না। যারা ফুলটাইম রাজনীতি করে বা ক্ষমতার রাজনীতি করে তাদের সাথে ই আন্দোলন ব্যালান্স করতে পারবে না। এক সময় ফের গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না।

রাজনৈতিক গুরুত্ব ধরে রাখতে হলে ফুলটাইম রাজনীতি করতে হবে। জনগণের নিত্য সমস্যা সমাধানে দৃশ্যমান ভূমিকা রাখতে হবে। নিজেদের নীতি আদর্শে অটল থেকে সকল রাজনৈতিক মহলে মিশতে হবে। নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ভাবে উপস্থাপন করতে হবে। ছায়া ক্যাভিনেট গঠন করে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সমস্যা এবং সমাধান নিয়ে কথা বলতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, আইন শৃংক্ষলার উন্নতি, বেকারত্ব দূরীকরণ, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং নতজানু পররাষ্ট্রনীতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখাতে হবে।

বিএনপির সাথে কী ই আন্দোলনের রাজনৈতিক ঐক্য হবে?

আমি মনে করি হবে না। বিএনপি ইসলামী আদর্শের রাজনীতি করে না। দুই ভিন্নাদর্শের রাজনীতির ঐক্য হলে নৈতিক কোনো লাভ হয় না। গাধা ঘোড়ার মিলনে যেমন 'খচ্চর' হয়, তেমন কিছু 'রাজনৈতিক খচ্চর' পয়দা হতে পারে। অতীতে যেমন বিএনপি, আওয়ামীলীগের সাথে জামায়াতসহ ইসলামপন্থী দলগুলোর মিলনে 'রাজনৈতিক খচ্চর' তৈরী হয়েছে। এবং সেই খচ্চরগুলোই এখন ইসলামপন্থী দলগুলোকে 'ঝুটা পার্টি' বলে। গণমানুষের ধর্মীয় চেতানা বিরোধী কথা বলে।

১০ দফা ঐক্যমতের ভবিষ্যৎ কী?

বিশেষ কোনো ভবিষ্যৎ নেই, তবে গুরুত্ব আছে। ই আন্দোলন ইসালামের নীতি আদর্শ জলাঞ্জলি দেবে বলে মনে করি না। বিএনপিও তাদের রাজনৈতিক আদর্শ থেকে সরবে না। সুতরাং 'রাজনৈতিক খচ্চর' পয়দার চেষ্টা না করে, এই ঐক্যমত জাতীর প্রতি 'জাতীয় কমিটমেন্ট' হতে পারে। 

আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মানে জাতীয় ঐক্যমত এবং জনগণের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর 'জাতীয় অঙ্গীকার' থাকতে হবে। আর সেই অঙ্গিকারের সুচনা হতে পারে ২৭ জানুয়ারী ২০২৫ এর ১০ দফা।

Post a Comment

0 Comments