আমাদের আহলে হাদীস ও দেওবন্দীর কতিপয় ব্যক্তি বলে থাকেন বা প্রচার করেন যে, 'মওদুদী রাহঃ শিয়া মতবাদে ধারক, বাহক ও প্রচারক'। তাদের কেউ বলেন, 'শিয়া মওদুদী ভাই ভাই।' এখন দেখার বিষয় হলো- তাদের এ অভিযোগ কি আসলেই সত্য? নাকি মিথ্যা অপবাদ, যা গীবতের চেয়েও ভয়ঙ্কর পাপ?
.
জাবির (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমরা নবী (সাঃ)-এর সঙ্গে (জুমুআর) সালাত আদায় করছিলাম। তখন সিরিয়া হতে একটি ব্যবসায়ী কাফেলা খাদ্য নিয়ে আগমন করল। লোকজন (সাহাবী মুসল্লিগণ) সকলেই সে দিকে চলে গেলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সঙ্গে মাত্র বারোজন থেকে গেলেন। এ প্রসঙ্গে নাযিল হলঃ
وَإِذَا رَأَوْا تِجَارَةً أَوْ لَهْوًا انْفَضُّوا إِلَيْهَا وَتَرَكُوكَ قَائِمًا ۚ قُلْ مَا عِنْدَ اللَّهِ خَيْرٌ مِنَ اللَّهْوِ وَمِنَ التِّجَارَةِ ۚ وَاللَّهُ خَيْرُ الرَّازِقِينَ.
"আর তারা যখন ব্যবসায় অথবা ক্রীড়া কৌতুক দেখল তখন তারা তার দিকে ছুটে গেল, আর তোমাকে দাঁড়ান অবস্থায় রেখে গেল। বল, আল্লাহর কাছে যা আছে তা ক্রীড়া- কৌতুক ও ব্যবসায় অপেক্ষা উত্তম। আর আল্লাহ সর্বোত্তম রিিযিকদাতা।" (সূরা জুমু‘আহ ৬২/১১)।
(সহীহ বুখারী হাঃ ৯৩৬,২০৫৮, ২০৬৪, ৪৮৯৯, সহীহ মুসলিম হাঃ ৮৬৩, মুসনাদে আহমাদ হাঃ ১৪৯৮২; এ বিষয়ে বিভিন্ন হাদীস থেকে আরো তথ্যবহুল আলোচনা জানতে দেখুনঃ তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন)
.
অত্র আয়াতের তাফসীরে (মাঝ পর্যায়ে) আল্লামা মওদুদী রাহঃ বলেনঃ
শিয়া মতবাদের লোকেরা এ ঘটনাটিকেও সাহাবীদের (রা.) প্রতি কটাক্ষ করার জন্য ব্যবহার করেছেন। তাঁরা বলেনঃ এত বিপুল সংখ্যক সাহাবীর খোতবা এবং নামায ছেড়ে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও খেল তামাশার দিকে ছুটে যাওয়া প্রমাণ করে, তারা দুনিয়াকে আখেরাতের চেয়ে অগ্রাধিকার দিতেন। কিন্তু এটি এমন একটি কঠোর অমূলক দোষারোপ যা শুরু বাস্তব থেকে চোখ বন্ধ করেই করা যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এ ঘটনাটি ঘটেছিল হিজরাতের অব্যবহিত পরে। সে সময় একদিকে সাহাবীদের সামষ্টিক প্রশিক্ষণ ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে অন্যদিকে মক্কার কাফেররা তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি দ্বারা মদীনার অধিবাসীদের কঠোরভাবে অবরোধ করে রেখেছিল যার কারণে মদীনায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দুষ্প্রাপ্য হয়ে গিয়েছিল। হযরত হাসান বসরী বলেন, সেই সময় মদীনায় মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছিল, কিন্তু জিনিসপত্রের দাম ছিল আকাশ ছোয়া (ইবনে জারীর)। ঠিক এই পরিস্থিতিতে মদীনায় একটি বাণিজ্য কাফেলা এসে হাজির হলে নামাযরত লোকজন এই ভেবেআশঙ্কাবোধ করলো, আমরা নামায শেষ করতে করতে সব জিনিসপত্র বিক্রি না হয়ে যায়। এই ভয়ে তারা সেদিকে ছুটে গিয়েছিল। এটা ছিল এমন একটি ত্রুটি ও দুর্বলতা যা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব ও কঠোর পরিস্থিতির কারণে হঠাৎ করে সেই সময় দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তার পরবর্তী সময়ে এসব সাহাবী ইসলামের জন্য যেসব কুরবানী ও ত্যাগ-তিতিক্ষা দেখিয়েছেন, তা যদি কেউ দেখে এবং ইবাদাত-বন্দেগী ও সামষ্টিক কাজ-কর্মে তাদের জীবন যে অতুলনীয় আল্লাহভীতির সাক্ষ্য দেয় তাও দেখে তাহলে সে একথা বলে তাদের ওপর দোষারোপ করার দুঃসাহস দেখাতে পারবে না যে, তাদের মধ্যে আখেরাতের চেয়ে দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দেয়া ব্যাধি ছিল। তবে তার নিজের হৃদয় মনে যদি সাহাবীদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষের ব্যাধি থেকে থাকে তাহলে ভিন্ন কথা।
.
এ ঘটনা সাহাবীদের (রা.) প্রতি কটাক্ষকারীদের যেমন সমর্থন করে না তেমনি সেসব লোকের ধ্যান-ধারণার প্রতিও সমর্থন জানায় না যারা সাহাবীদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধার আতিশয্যে দাবী করেন যে, তাদের দ্বারা কখনো কোন ভুল হয়নি, কিংবা হয়ে থাকলেও কখনো তা উল্লেখ করা উচিত নয়। কারণ তাঁদের ভুল-ত্রুটির উল্লেখ করা এবং তাকে ভুল-ত্রুটি বলা তাদের অপমান করার শামিল। এতে হৃদয় মনে তাদের প্রতি মর্যাদা ও শ্রদ্ধাবোধ অবশিষ্ট থাকে না। তাছাড়া তাদের ভুল-ত্রুটির উল্লেখ সেসব আয়াত ও হাদীসেরও পরিপন্থী যার মধ্যে স্পষ্ট ভাষায় সাহাবীদের ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়া আল্লাহর নিকট প্রিয় হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব কথা স্পষ্ট বাড়াবাড়ি। এর সমর্থনে কুরআন ও হাদীসে কোন দলীল নেই। এখানে যে কেউ দেখতে পারেন, বিপুল সংখ্যক সাহাবীর (রা.) একটি দল কর্তৃক যে ত্রুটি হয়েছিল আল্লাহ তা’আলা নিজে এখানে তাদের সেই ত্রুটির উল্লেখ করেছেন। এমন গ্রন্থে তা উল্লেখ করেছেন যা কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত উম্মাতকে পড়তে হবে। সেই গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে গ্রন্থে তাদের ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়া এবং আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়ার কথাও স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া হাদীস ও তাফসীরের সমস্ত গ্রন্থে সাহাবা কিরাম (রা.) থেকে পরবর্তীকালের আহলে সুন্নাত ওয়া জামায়াতের বড় বড় মনীষীগণ পর্যন্ত তাদের এই ত্রুটি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। এর অর্থ কি এই যে, আল্লাহ তায়ালা মানুষের মন থেকে ঐ সব সাহাবীর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে ঐ ত্রুটির উল্লেখ করেছেন যা তিনি নিজেই মানুষের মনে কায়েম করতে চান? অথবা এর অর্থ কি এই যে, এসব অন্ধ ও গোঁড়া ভক্তগণ শরীয়াতের যে মাসয়ালাটি বলে থাকেন সাহাবায়ে কিরাম (রা.), তাবেয়ীগণ, মুহাদ্দিসগণ এবং মুফাসসিরগণের সে মাসায়ালাটি জানা থাকার কারণে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ তারা উল্লেখ করেছেন? আর যারা সূরা জুম’আ পড়েন এবং তার তাফসীর অধ্যয়ন করেন তাদের মন থেকে কি সত্যি সত্যিই সাহাবা কিরামের (রা.) প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা উধাও হয়ে গেছে? এ সব প্রশ্নের জবাব যদি নেতিবাচক হয়, আর নেতিবাচক তো অবশ্যই হবে তাহলে সাবাহায়ে কিরামের (রা.) মর্যাদার নামে কিছু লোক যেসব অনর্থক এবং বাড়াবাড়ি অতিরঞ্জিত ও অতিশয়োক্তিমূলক কথাবার্তা বলে থাকেন তা অবশ্যই ভ্রান্ত।
.
প্রকৃতপক্ষে সাহাবায়ে কিরাম কোন আসমানী মাখলুক ছিলেন না। বরং এই পৃথিবীতে জন্মলাভকারী মানুষ ছিলেন। তারা যা কিছু হয়েছিলেন তা হয়েছিলেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষার গুণে। তাদের এ শিক্ষা দেয়া হয়েছিল ক্রমান্বয়ে বছরের পর বছর ধরে। কুরআন ও হাদীসে আমরা এ শিক্ষার যে নিয়ম-পদ্ধতি দেখতে পাই, তা হচ্ছে যখনই তাদের মধ্যে কোন দুর্বলতা দেখা দিয়েছে আল্লাহ ও আল্লাহর রসূল (সাঃ) যথাসময়ে সেদিকে মনোনিবেশ করেছেন এবং দুর্বলতার সেই বিশেষ ক্ষেত্রে অনতিবিলম্বে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণদানের একটি কর্মসূচী শুরু করা হয়েছে। জুম’আর নামাযের এই ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাই যে, বাণিজ্য কাফেলা সংক্রান্ত ঘটনাটি ঘটলে আল্লাহ তা’আলা সূরা জুম’আর এ রুকূ’র আয়াতসমূহ নাযিল করে এ বিষয়ে সতর্ক করলেন এবং জুম’আর নামাযের নিয়ম-কানুন ও আদব-কায়দা অবহিত করলেন। (তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন ১৭/১৩৬-১৩৭)
.
আল্লামা মওদুদী রাহঃ এর দীর্ঘ আলোচনা থেকে জানা গেল যে, তিনি শিয়া মতবাদ ধারণ করা তো দূরের কথা বরং শিয়া মতবাদ ধোলাই (খন্ডন) করেছেন। তার পাশাপাশি সেসব লোকদেরও ধোলাই করেছেন, যারা সাহাবীদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধার আতিশয্যে মাতাল হয়ে কুরআন হাদীসকে অস্বীকার করে দাবী করে যে, সাহাবাগণ কখনো কোন ভুলত্রুটি করেননি, কিংবা ভুল হয়ে থাকলেও কখনো তা উল্লেখ করা জায়েজ নেই, হারাম! আল্লামা মওদুদী রাহঃ কুরআন হাদীস অস্বীকারকারীদের পক্ষাবলম্বন করেননি, এটাই কি তাঁর শিয়া প্রীতি, অপরাধ?
---------------------------------
Tanzil Islam
ইসলামি চিন্তাবিদ, গ্রন্থপ্রনেতা ও মাওলানা।
---------------------------------
Tanzil Islam
ইসলামি চিন্তাবিদ, গ্রন্থপ্রনেতা ও মাওলানা।
0 Comments