Recent Tube

মহিলাদের মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় ঢেকে রাখার বিধান: দলিল ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনাঃ Tanzil Islam ইসলামি চিন্তাবিদ ও লেখক।

মহিলাদের মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় ঢেকে রাখার বিধান: দলিলভিত্তিক সংক্ষিপ্ত পর্যালো
মুসলিম উম্মাহ একমত যে, মহিলাদের মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় ব্যতীত সারা শরীর ঢেকে রাখা ফরয। আর মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় ঢেকে রাখার বিধান ফরয (আবশ্যিক) না মুস্তাহাব (উত্তম) তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন,
وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا. 
"আর মুমিন নারীদেরকে বল, যেন তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে।" (সূরা নূর ২৪/৩১)
এ আয়াত সম্পর্কে ইবনে মাসউদ (রাঃ) ও ইবনে আব্বাস (রাঃ) তাফসীর দু’ধরনের। 
(১) ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا. বলতে উপরের কাপড়; যেমন বোরকা, লম্বা চাদর ইত্যাদিকে ব্যতিক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
(২) ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও তাঁর শিষ্যরা বলেনঃ এখানে প্রকাশ্য সৌন্দর্য বলতে চেহারা, চোখের সুরমা, হাতের কব্জি এবং আংটি। কেননা, কোন নারী প্রয়োজনবশতঃ বাহিরে যেতে বাধ্য হলে কিংবা চলা ফেরা ও লেনদেনের মুখমণ্ডল ও হাতের তালু বা কব্জি আবৃত রাখা খুবই দূরূহ হয়। সুতরাং ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর তাফসীর অনুযায়ী মুখমণ্ডল ও হাতের কব্জি অনাবৃত রাখা জায়েয। দু' ধরণের তাফসীরের কারণে পরবর্তী মুফাসসির ও ফিকহবিদদের মাঝে মতভেদ দেখা যায়। (দেখুনঃ তাফসীরে তাবারী, কুরতুবী, ইবনে কাসীর, ফাতহুল কাদীর, তাফহীমুল কুরআন, মাআরেফুল কুরআন ইত্যাদি)
.
অধিকাংশ ইমাম এবং ফকীহগণের মতে মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় ঢেকে রাখা ফরয নয়। ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম তাবারী ও অন্যান্য ফকীহ ও ইমাম এ মত গ্রহণ করেছেন। তাঁরা বলেন, মুসলিম মহিলাগণ হাত ও মুখমণ্ডল অনাবৃত রাখতে পারবে। তবে তা ঢেকে রাখা উত্তম। তাঁদের মতে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া সর্বাবস্থায় মুখমণ্ডল আবৃত করে রাখাই সুন্নাত ও উত্তম, তবে তা ফরয নয়। ইমাম আহমদ থেকেও অনুরূপ মত বর্ণিত হয়েছে। (মুহাম্মদ ইবনুল হাসান, আল মাবসূত ৩/৫৬-৬৭; তাবারী, জামিউল বাইয়ান ১৮/১১৭-১২০; কাসানী, বাদাইউস সানাইয় ৫/১১৮-১২৫; সারখাসী, আল মাবসূত ১০/১৪৫-১৫৪; খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, পোশাক, পর্দা ও দেহ-সজ্জা, চতুর্থ অধ্যায়, পৃঃ ২৫৬)

পক্ষান্তরে কতিপয় ইমাম ও ফকীহ ফরয বলেছেন। আমি উভয় মতের পক্ষে দলিল দেখার চেষ্টা করেছি। যারা মুখমণ্ডল  ও হস্তদ্বয়কেও অাবৃত রাখাকে ফরয বলেন, তাদের মতের পক্ষে (ফরয হওয়ার) অকাট্য দলিল আমার নযরে পড়েনি। পক্ষান্তরে যাদের মতে মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় আবৃত রাখা ফরয নয় বরং মুস্তাহাব তাদের মত অধিকতর সঠিক বলে মনে হয়েছে। তাঁরা তাঁদের মতের পক্ষে যে সকল দলিল দেন, তার কতিপয় দলিল আমি পেশ করছি- 
.
(১) মহান আল্লাহর বানী:
وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا. 
"আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে।" (সূরা নূর ২৪/৩১) প্রখ্যাত সাহাবী আলী (রা), তাফসীর সম্রাট ইবনু আব্বাস (রা), তাবেয়ী সাঈদ ইবনু জুবাইর, আতা ইবনে রাবাহ, হাসন বসরী, কাতাদা, মুজাহিদ, আমির ইবনু যাইদ, আওযায়ী, ইউনুস, ইমাম আবু হানিফা ও মালিক (রাহঃ) সহ প্রমুখ ইমামদের মতে এখানে إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا. দ্বারা উদ্দেশ্য হলো الوجه والكفان তথা মুখ ও হাতের কব্জি। (তাফসীরে তাবারী ১৮/১১৭-১২০) হানাফী মাযহাবের অন্যতম প্রসিদ্ধ ফকীহ, ইমাম আবূ বাকর জাসসাস বলেন, আমাদের আলিমগণ বলেছেন, এখানে মুখ ও হস্তদ্বয় বুঝানো হয়েছে। ... এতে প্রমাণিত হয় যে মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় আউরাত বা আবৃতব্য গুপ্তাঙ্গ নয়। (আহকামুল কুরআন ৩/৩১৫-৩১৬ )
অত্র আয়াতের তাফসীরে কাযী ছানাউল্লাহ পানিপথী বলেন,
"ইমাম আবূ হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদের মতে মুখমণ্ডল ও উভয় হাতের পাঞ্জা 'যা সাধারণত প্রকাশ থাকে' এর অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ মুখমণ্ডল ও কব্জি পর্যন্ত দুই হাত সতর নয়। সাঈদ ইবনে যোবায়ের সূত্রে তিরমিযী বর্ণনা করেছেন, ইবনে আব্বাস বলেছেন, 'যা সাধারণত প্রকাশ থাকে' (মা জাহারা) অর্থ মুখাবয়ব ও উভয় হাতে তালু ও পিঠ। জননী আয়েশা থেকে আত্বাও এ রকম বর্ণনা করেছেন।" (তাফসীরে মাযহারী ৮/৩৮৯)
.
(২) আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, 
وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ.
"তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে।" (সূরা নূর ২৪/৩১)
প্রাক ইসলামী যুগে মহিলারা চুল খোলা রাখতো। তাদের সামনের দিকে বুকের একটি অংশ খোলা থাকতো। সেখানে গলা ও বুকের উপরের দিকের অংশটি পরিষ্কার দেখা যেতো। বুকে জামা ছাড়া আর কিছুই থাকতো না। পেছনের দিকে দুটো তিনটে খোঁপা দেখা যেতো। তাই মুসলিম নারীদেরকে আদেশ করা হয়েছে তারা যেন এরূপ না করে; বরং 'তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে।' যাতে করে তাদের উড়নার দু’পাশের বর্ধিত অংশ দিয়ে মাথাসহ, কান, গলা ও বুক আড়াল করে নেয়। (ইবনে কাসীর) 
আল্লাহ তা’য়ালা এই আয়াত দ্বারা মস্তকাবরণ দিয়ে গ্রীবা ও বক্ষদেশ আবৃত করতে নারীদের নির্দেশ দিয়েছেন কিন্তু মুখ আবৃত করতে নির্দেশ দেননি। মাথার আবরণ দ্বারা বুক ও গলা আবৃত করতে হলে ওড়নাকে দুই কানের উপর দিয়ে ঝুলিয়ে মুখের নিচ দিয়ে গলা, ঘাড় ও বুকের উপর দিয়ে জড়াতে হবে, এতে মুখ অনাবৃত থাকবে। (ইবনে হাযম, আল-মুহাল্লা ৩/২১৬, আলবানী, জিলবাব পৃঃ ৭২-৭৩)
.
(৩) উম্মুল মু'মিনীন আয়েশা (রাঃ) বৰ্ণনা করেন, 
 أَنَّ أَسْمَاءَ بِنْتَ أَبِي بَكْرٍ دَخَلَتْ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَعَلَيْهَا ثِيَابٌ رِقَاقٌ فَأَعْرَضَ عَنْهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَالَ يَا أَسْمَاءُ إِنَّ الْمَرْأَةَ إِذَا بَلَغَتْ الْمَحِيضَ لَمْ تَصْلُحْ أَنْ يُرَى مِنْهَا إِلَّا هَذَا وَهَذَا وَأَشَارَ إِلَى وَجْهِهِ وَكَفَّيْهِ. 
তার বোন আসমা বিনতে আবু বকর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সামনে আসেন। তখন তিনি পাতলা কাপড় পরে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সংগে সংগেই মুখ ফিরিয়ে নেন এবং বলেনঃ ‘‘হে আসমা! কোন মেয়ে যখন বালেগ হয়ে যায় তখন তার এটা ও ওটা ছাড়া শরীরের কোন অংশ দেখা যাওয়া জায়েয নয়।” বর্ণনাকারী বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার হাতের কব্জি ও চেহারার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। (সুনান আবু দাউদ হাঃ ৪১০৪, মিশকাত হাঃ ৪৩৭২) 
শাইখ আলবানী এই হাদীসকে হাসান হাদীসের অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন তাঁর জিলবাবুল মারআতিল মুসলিমা, ইরওয়া আল গালীল, সহীহুল জামে, এবং তাখরিজ আল হালাল ওয়াল হারাম নামক কিতাব গুলোতে)
.
(৪) ইবনে জারীর হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে উদ্ধৃত করেছেনঃ তাঁর কাছে তাঁর বৈপিত্রেয় ভাই আবদুল্লাহ ইবনুত তোফায়েলের মেয়ে আসেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) গৃহে প্রবেশ করে তাকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এ হচ্ছে আমার ভাইয়ের মেয়ে। তিনি বলেনঃ
إذا عركت المراة لن يجل لها أن تظهر إلا وجهها والا ما دون هذا وقبض علي ذراع نفسه وترك بين قبضته وبين الكف مثل قبضة أخري-
“মেয়ে যখন বালেগ হয়ে যায় তখন তার জন্য নিজের মুখ ও হাত ছাড়া আর কিছু বের করে রাখা হালাল নয়, আর নিজের কব্জির ওপর হাত রেখে হাতের সীমানা তিনি এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁর মুঠি ও হাতের তালুর মধ্যে মাত্র একমুঠি পরিমাণ জায়গা খালি থাকে।" (তাফসীরে তাবারী, তাফহীমুল কুরআন, সূরা নূর ২৪/৩১, টীকা নং ৩২) 
মুখমণ্ডল ও হাতের কব্জি অনাবৃত রাখার বিষয়ে আরো বিভিন্ন সনদে বিভিন্ন হাদীস ইমাম আবূ দাউদ, তাবারানী, বায়হাকী প্রমুখ মুহাদ্দিস বর্ণনা করেছেন (আল-মারাসীল পৃঃ ৩১০, মুজামুল কাবীর ২৪/১৪২, মুজামুল আওসাত ৮/১৯৯, সুনানুল কুবরা ৭/৮৬)। সনদগুলোর সমন্বয়ে একাধিক মুহাদ্দিস 'মুখমণ্ডল ও হাত খোলা রাখা'র হাদীসকে হাসান বা নির্ভরযোগ্য বলে মত দিয়েছেন (আলবানী, জিলবাব পৃঃ ৫৮-৫৯)। যেমন ইমাম হাইসামী - তাবারানী ও বায়হাকীর সনদে বর্ণিত হাদীস উল্লেখ করে 'হাসান' বলেছেন। (মাজযাউয যাওয়াইদ ৫/১৩৭)
.
(৫) এ হাদীসও আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
 إِنْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَيُصَلِّي الصُّبْحَ، فَيَنْصَرِفُ النِّسَاءُ مُتَلَفِّعَاتٍ بِمُرُوطِهِنَّ، مَا يُعْرَفْنَ مِنَ الْغَلَسِ‏.‏
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) যখন ফজরের সালাত শেষ করতেন তখন নারীরা চাদর মুড়ি দিয়ে ঘরে ফিরতেন। অন্ধকারের দরুণ তখন তাঁদেরকে চেনা যেতো না। (সহীহ বুখারী হাঃ ৮৬৭, সহীহ মুসলিম হাঃ ৬৪৫, তিরমিযী হাঃ ১৫৩, নাসায়ী হাঃ ৫৪৫, আবু দাউদ হাঃ ৪২৩, আহমদ হাঃ ২৪৯২৬, মিশকাত হাঃ ৫৯৮)
এই সহীহ হাদীসে আয়েশা (রাঃ) স্পষ্ট জানাচ্ছেন যে, শুধুমাত্র রাতের আঁধার থাকার কারণে নামাজে আগত মহিলাদের চেনা যায়নি। ফর্সা হলে চেনা যেত। অতএব সালাতে আসা মহিলাদের মুখমণ্ডল যে খোলা ছিলো এই হাদীস থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
.
(৬) আল্লাহ তা'য়ালা বলেন,
لَا يَحِلُّ لَكَ النِّسَاءُ مِنْ بَعْدُ وَلَا أَنْ تَبَدَّلَ بِهِنَّ مِنْ أَزْوَاجٍ وَلَوْ أَعْجَبَكَ حُسْنُهُنَّ. 
"এরপর তোমার জন্য অন্য স্ত্রী গ্রহণ হালাল নয় এবং তোমার স্ত্রীদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করাও হালাল নয়, যদিও অন্য নারীদের সৌন্দর্য তোমাকে বিমোহিত করে।" (সূরা আহযাব ৩৩/৫২)
এই আয়াতে আল্লাহ তা'য়ালা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, অন্য
কোন নারীর সৌন্দর্য তাঁকে যতই আকৃষ্ট
করুক না কেন তাঁকে আর কোন বিয়ে
করতে অনুমতি দেয়া হবেনা। যদি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর আমলে সব নারীরা মুখ ঢেকে চলা ফেরা করতো তাহলে কেমন করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর পক্ষে মুখ ঢাকা নারীর রূপ সৌন্দর্য দেখা সম্ভব হতে পারে?
সুতরাং এই আয়াতটি আরেক দলিল যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর আমলে নারীদের মুখ ঢাকা থাকতো না।
.
(৭) “যদি তোমাদের কেউ কোন নারী দেখতে পাও, যার রূপ লাবণ্য তোমার অন্তরকে মুগ্ধ করে”- সহীহ মুসলিমের এই শিরোনামে জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসটি দেখি। যার প্রেক্ষাপট হলো- একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একজন মহিলাকে দেখতে পেয়েছিলেন। যার রূপ সৌন্দর্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিমুগ্ধ হয়েছিলেন। এবং ঐ বিমুগ্ধতা থেকে মুক্তি লাভের জন্য জয়নাব (রাঃ) এর
সান্নিধ্যে এসেছিলেন। পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর সাহাবাগণকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
إِذَا أَحَدُكُمْ أَعْجَبَتْهُ الْمَرْأَةُ فَوَقَعَتْ فِي قَلْبِهِ فَلْيَعْمِدْ إِلَى امْرَأَتِهِ فَلْيُوَاقِعْهَا فَإِنَّ ذَلِكَ يَرُدُّ مَا فِي نَفْسِهِ.
"যখন তোমাদের কাউকে কোন স্ত্রীলোক বিমুগ্ধ করে এবং তা তার মনকে প্রলূব্ধ করে তখন সে যেন তার স্ত্রীর নিকট আসে এবং তার সাথে সংগম করে। এতে তার মনে যা আছে তা দূর করে।" (সহীহ মুসলিম, কিতাবুন নিকাহ, হাঃ ১৪০৩, আবু দাউদ হাঃ ২১৫১, মুসনাদে আহমদ হাঃ ১৪৩৩৪)
এই হাদীস প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং সাহাবাগণ এর আমলে নারীগণ হিযাব করে চললেও সবাই মুখ ঢেকে চলতেন না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যে নারীকে দেখেছিলেন, তার মুখমণ্ডল ঢাকা ছিল না বলেই তিনি বিমুগ্ধ হয়েছিলেন। কারণ মুখ ঢাকা ফরয নয়। যদি ফরয হত তাহলে তিনি সাহাবাগণকে উপদেশ না দিয়ে মহিলাদেরকে মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতে নির্দেশ দিতেন। 
.
(৮) আল্লাহ তা'য়ালা বলেন,
قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ۚ ذَٰلِكَ أَزْكَىٰ لَهُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ.
"(হে নবী সাঃ) মুমিন পুরুষদেরকে বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত।" (সূরা নূর ২৪/৩০)
কুরআনে কোথাও মুমিন নারীদের মুখমণ্ডল ঢাকার নির্দেশ দেওয়া হয়নি বরং মুমিন পুরুষদের দৃষ্টি সংযত রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতেই প্রমাণ হয় মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা ফরয নয় বরং খুলে রাখার অনুমতি আছে। তা না হলে দৃষ্টি সংযতের নির্দেশ দেওয়ার কোন মানেই হয় না।
.
(৯) আবূ দারদা কর্তৃক বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
 يَا عَلِيُّ لَا تُتْبِعْ النَّظْرَةَ النَّظْرَةَ فَإِنَّ لَكَ الْأُولَى وَلَيْسَتْ لَكَ الْآخِرَةُ.
হে আলী! তোমার প্রথম দৃষ্টিপাতকে (বেগানা স্ত্রীলোকের প্রতি) তোমার দ্বিতীয়  দৃষ্টি যেন অনুসরণ না করে। কেননা, প্রথমবার দৃষ্টিপাত তোমার জন্য জায়েয আর দ্বিতীয়বার (ইচ্ছাকৃতভাবে)  দৃষ্টিপাত  করা তেমার জন্য বৈধ নয়। (আবু দাউদ হাঃ ২১৪৯, জামে তিরমিযী হাঃ ২৭৭৭, আহমদ হাঃ ১৩৭৭, ২২৪৮২, দারেমী হাঃ ২৭০৯; ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। তাছাড়া একই রকম হাদীস সহীহ মুসলিমেও এসেছে দেখুনঃ হাদীস নং ২১৫৯)
আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজেও পুরুষদের দৃষ্ট সংযত রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন, মহিলাদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখার নির্দেশ দেননি। মহিলাদের মুখমণ্ডল ঢাকা ফরয হলে পুরুষদের দৃষ্টি সংযত রাখার কোন প্রয়োজন হত না।
.
(১০) আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার কুরবানীর দিনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ফাযল ইবনে আব্বাস কে আপন সওয়ারীর পিঠে নিজের পেছনে বসালেন। ফাযল একজন সুপুরুষ ছিলেন। নাবী (সাঃ) লোকেদের মাসআলা মাসায়িল বলে দেয়ার জন্য আসলেন। 
وَأَقْبَلَتْ امْرَأَةٌ مِنْ خَثْعَمَ وَضِيئَةٌ تَسْتَفْتِي رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَطَفِقَ الْفَضْلُ يَنْظُرُ إِلَيْهَا وَأَعْجَبَهُ حُسْنُهَا فَالْتَفَتَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَالْفَضْلُ يَنْظُرُ إِلَيْهَا فَأَخْلَفَ بِيَدِهِ فَأَخَذَ بِذَقَنِ الْفَضْلِ فَعَدَلَ وَجْهَهُ عَنْ النَّظَرِ إِلَيْهَا.
এ সময় খাশ‘আম গোত্রের এক সুন্দরী নারী রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর নিকট একটা মাসআলা জিজ্ঞেস করার জন্য আসল। তখন ফাযল তার দিকে তাকাতে লাগলেন। মহিলাটির সৌন্দর্য তাঁকে আকৃষ্ট করল। নাবী (সাঃ) ফাযল -এর দিকে ফিরে দেখলেন যে, ফাযল তার দিকে তাকাচ্ছেন। তিনি নিজের হাত পেছনের দিকে নিয়ে ফাযল -এর চিবুক ধরে ঐ নারীর দিকে না তাকানোর জন্য তার মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন। (সহীহ বুখারী হাঃ ৬২২৮, সহীহ মুসলিম হাঃ ১৩৩৪, নাসায়ী হাঃ ২৬১৩, আহমদ হাঃ ৩০৫০)
এ হাদীস থেকে জানা যায় মহিলার মুখমণ্ডল উন্মুক্ত ছিল। আর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মহিলাকে মুখমণ্ডল আবৃত করার নির্দেশ না দিয়ে ফযলের মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। এতে প্রমাণিত হয় মুখমণ্ডল খোলা রাখা জায়েয তবে দৃষ্টি সংযত রাখতে হবে। পঞ্চম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও মালেকী ফকীহ ইবনে বাত্তাল এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, "যদি মুখমণ্ডল আবৃত রাখা ফরয হতো তবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অবশ্যই ঐ মহিলার মুখমণ্ডল আবৃত রাখার নির্দেশ দিতেন এবং সেক্ষেত্র ফযলের মুখ ঘুরিয়ে দিতেন না। এতে প্রমাণিত হয় যে নারীর মুখমণ্ডল অাবৃত করা ফরয নয়।'' (ফাতহুল বারী ১১/১০) 
.
(১১) জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ঈদের দিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি খুত্বার আগে প্রথমে সলাত আদায় করলেন-আযান ইক্বামাত ছাড়া। অতঃপর তিনি বিলালের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ালেন এবং “আল্লাহ ভীতি” অর্জন করার আদেশ করলেন ও তাঁর আনুগত্য করার জন্য অনুপ্রাণিত করলেন। তিনি সমবেত জনতাকে উপদেশ দিলেন। তারপর বললেন, 
َ تَصَدَّقْنَ فَإِنَّ أَكْثَرَكُنَّ حَطَبُ جَهَنَّمَ فَقَامَتْ امْرَأَةٌ مِنْ سِطَةِ النِّسَاءِ سَفْعَاءُ الْخَدَّيْنِ فَقَالَتْ لِمَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ لِأَنَّكُنَّ تُكْثِرْنَ الشَّكَاةَ وَتَكْفُرْنَ الْعَشِيرَ قَالَ فَجَعَلْنَ يَتَصَدَّقْنَ مِنْ حُلِيِّهِنَّ يُلْقِينَ فِي ثَوْبِ بِلَالٍ مِنْ أَقْرِطَتِهِنَّ وَخَوَاتِمِهِنَّ.
তোমরা সদাক্বাহ্ কর। কেননা তোমাদের বেশীর ভাগ মহিলাই জাহান্নামের জ্বালানী হবে। (এ কথা শুনে) মহিলাদের মধ্যে থেকে উভয় গালে কালো দাগ বিশিষ্ট একটি মেয়েলোক দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন আল্লাহর রাসূল (সাঃ)? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, কেননা তোমরা বেশী অজুহাত ও অভিযোগ পেশ করে থাক এবং স্বামীর অবাধ্যচরণ করে থাক। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর মহিলাগণ তাদের অলঙ্কারাদি দান করতে শুরু করল। তারা তাদের কানের ঝুমকা, রিং এবং আংটিসমূহ বিলালের কাপড়ে ফেলতে লাগল। (সহীহ মুসলিম হাঃ ৮৮৫, ই.ফা. হাঃ ১৯১৮, ই.সে. হাঃ ১৯২৫, নাসায়ী হাঃ ১৫৭৫, তিরমিযী হাঃ ২৬১৩, আহমদ হাঃ ১৪০১১)
এ হাদীসে জাবির (রাঃ) প্রশ্নকারী মহিলার মুখের রং বর্ণনা করেছেন। কারণ তার মুখমণ্ডল অনাবৃত ছিল। আর মুখমণ্ডল আবৃত রাখা যদি ফরয হতো তাহলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আপত্তি জানাতেন এবং মুখমণ্ডল আবৃত রাখতে নির্দেশ দিতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। সুতরাং মুখমণ্ডল আবৃত রাখা ফরয নয়।
.
(১২) আত্বা ইবনে আবূ রাবাহ্  হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইবনে আব্বাস (রা) আমাকে বললেনঃ 
أَلاَ أُرِيكَ امْرَأَةً مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ قُلْتُ بَلٰى قَالَ هٰذِهِ الْمَرْأَةُ السَّوْدَاءُ أَتَتْ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَتْ إِنِّي أُصْرَعُ وَإِنِّي أَتَكَشَّفُ فَادْعُ اللهَ لِي قَالَ إِنْ شِئْتِ صَبَرْتِ وَلَكِ الْجَنَّةُ وَإِنْ شِئْتِ دَعَوْتُ اللهَ أَنْ يُعَافِيَكِ فَقَالَتْ أَصْبِرُ فَقَالَتْ إِنِّي أَتَكَشَّفُ فَادْعُ اللهَ لِي أَنْ لاَ أَتَكَشَّفَ فَدَعَا لَهَا.
আমি কি তোমাকে একজন জান্নাতী মহিলা দেখাব না? আমি বললামঃ অবশ্যই। তখন তিনি বললেনঃ এই কালো রঙের মহিলাটি, সে নাবী (সাঃ) এর নিকট এসেছিল। তারপর সে বললঃ আমি মৃগী রোগে আক্রান্ত হই এবং এ অবস্থায় আমার লজ্জাস্থান খুলে যায়। সুতরাং আপনি আমার জন্য আল্লাহর কাছে দু‘আ করুন। নাবী (সাঃ) বললেনঃ তুমি যদি চাও, ধৈর্য ধারণ করতে পার। তোমার জন্য আছে জান্নাত। আর তুমি যদি চাও, তাহলে আমি আল্লাহর কাছে দু‘আ করি, যেন তোমাকে অরোগ্য করেন। স্ত্রীলোকটি বললঃ আমি ধৈর্য ধারণ করব। সে বললঃ ঐ অবস্থায় আমার লজ্জাস্থান খুলে যায়, কাজেই আল্লাহর নিকট দু‘আ করুন যেন আমার লজ্জাস্থান খুলে না যায়। নাবী (সাঃ) তাঁর জন্য দু‘আ করলেন। (সহীহ বুখারী হাঃ ৫৬৫২, সহীহ মুসলিম হাঃ ২৫৭৬, মুসনাদে আহমাদ হাঃ ৩২৪০)
এ হাদীসেও ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ মহিলার মুখের রং বর্ণনা করেছেন। কারণ তার মুখমণ্ডল অনাবৃত ছিল। সুতরাং মুখমণ্ডল আবৃত রাখা ফরয নয়। কেননা, মুখমণ্ডল আবৃত রাখা যদি ফরয হতো তাহলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আপত্তি জানাতেন এবং মুখমণ্ডল আবৃত রাখতে নির্দেশ দিতেন। 
.
(১৩) আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা)- وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا. এই আয়াতের তাফসীরে বলেন,
  الكفان ورقعة الوجه.
"প্রকাশ থাকে করতল ও মুখমণ্ডল" (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৩/৫৪৬; জিলবাব পৃঃ ৫৯-৬০; হাদীস সহীহ)
.
(১৪) আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, 
الزينة الظاهرة الوجه والكفان.
"প্রকাশ্য সৌন্দর্য মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয়।" (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৩/৫৪৬; জিলবাব পৃঃ ৬০; হাদীস সহীহ)
.
(১৫) উম্মুল মু'মিনীন আয়েশা (রা) বলেন, 
ما ظهر منها الوجه والكفان. 
"নারী যা প্রকাশ থাকে তা মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয়।" (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৩/৫৪৬, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী ২/২২৬; সহীহ)
.
উপসংহার: উপরোক্ত দলিলসহ বিভিন্ন দলিলের আলোকে অধিকাংশ ইমাম ও ফকীহ মত দিয়েছেন যে, মহিলাদের মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় আবৃত ফরয নয়, তবে তা ঢেকে রাখা মুস্তাহাব তথা উত্তম। আমিও ব্যক্তিগত ভাবে এ মতকে সমর্থন করি।
والله اعلم بالصواب.

Post a Comment

0 Comments