Recent Tube

কতভাবেই না ইতিহাস পড়া যায়! জিয়াউল হক।

               কতভাবেই না ইতিহাস 
     পড়া যায়!
  
    এ বছরের শুরুর দিকে দেশে থাকতে হঠাৎ করে আমন্ত্রণ পেলাম বাংলাদেশের উদীয়মান একজন লেখিকা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা Mardia Mumtaz এর বাসায়। দীর্ঘ আটটি মাস ছুটিতে দেশে থাকাবস্থায় বেশকিছু দাওয়াত আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম, কিন্তু এড়িয়ে গেছি বেশিরভাগই। আমি বরাবরই ঘরকুণো মানুষ। নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই, তাই সামাজিক অনেক অনুষ্ঠান আর আমন্ত্রণকে নানা কৌশলে এড়িয়ে যাই।

     তবে মিসেস মারদিয়ার আমন্ত্রণ এড়ানো গেল না। আমি তাঁর লেখার ভক্ত পাঠক। তিনি যে কেবল ভালো লেখেন, তাই'ই নয়, তিনি অল্প কথার সাথে অনেক বেশি ভাব আর আবেগের অসাধারণ সম্মিলন ঘটাতেও পটু। এটা এক দূর্লভ গুণ, সবার মধ্যে থাকে না। তাঁর লেখায় আছে। আমাদের আগামি দিনের 'মুহাদ্দিসাত'! মিসেস মারদিয়ার স্বামী প্রবরের সাথে ষষ্ঠ তলার ফ্লাটে উঠতে উঠতে যে কথাটা মনে হয়েছিল, সেটাই আজ লিখছি।
  
    ঐ ঘটনার ঠিক দুই যুগ আগে ১৯৯৫  সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দশক। তারিখটা মনে নেই সঠিকভাবে। মক্কায় ছিলাম তখন। রমাদ্বানের শেষ দশকে কুয়েত থেকে আমরা কয়েকজন মিলে সড়কপথে মক্কায় গেলাম। দীর্ঘদিনের শখটা মনে পুষে রেখেছিলাম। সময়কালটা ছিল দারুণ, রাতের বেলায় বেশ ঠান্ডা আর দিনের বেলাতে গরম হলেও মরুভূমির জূন-জুলাই কিংবা আগস্টের তীব্র গরম নয়।  
 
    একদিন সকালের দিকে গেলাম হেরা পাহাড়ে চড়তে। গাড়ি পার্কিং থেকে পাহাড়টার দিকে নজর দিয়েই আবেগে আপ্লুত হলাম নিজের অজান্তেই।এই সেই পাহাড়, যার গুহায় এসে আমার প্রিয় রাসুল সা: বসে থাকতেন একাকী, নীরবে নিভৃতে। এই সেই পাহাড়, যেখানে প্রথমবারে মতো কুরআনের বাণী নিয়ে হাজির হয়েছিলেন জিবরাইল আ:। যেখান থেকে সূচিত হয়েছিল দীর্ঘ তেইশ বছরব্যাপী কুরআন নাজিলের প্রক্রিয়াটি, আনুষ্ঠানিকভাবে।  
সাথে ছিলেন দিনাজপুরের মকবুল ভাই। দু'জনে একই বয়সের। পাহাড়ের গোড়ায় দাঁড়িয়ে একবার দেখে নিলাম ভালো করে। ভীড় এড়াতেই সকালে আসা, কিন্তু যে ভীড় দেখলাম, তাতে অবাক না হয়ে পারিনি।  

   ছোটকালে করাচিতে ক্লিপটন বিচে যাবার পথে ডিফেন্স সোসাইটি ঘেঁষে কৌরোঙ্গি রোডের ধারে সেই বিখ্যাত আগা খাঁনের কুঠি বাড়ি দেখতে পাহাড়ে উঠতাম,বিশাল সাইজের ইরানি গোলাপ চুরি করতে গিয়ে মালির তাড়া খেয়ে নেমেও আসতাম।  অভিজ্ঞতা বলতে ঐটুকুই মাত্র। সেই অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে হেরা পাহাড়ে উঠতে এসেছি। সাহসের কথা নয়, আবেগটাই ছিল সবচেয়ে বড়ো। আর সেটা ছিল বুকের পুরোটা জুড়েই।  

   এখন নাকি পাহাড়ে উঠার জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষ পাথর কেটে সিঁড়ির মতো করে দিয়েছেন শুনেছি। তখন কিন্তু সেটা ছিল না। আমরা উঠেছিলাম সাপের মতো রুক্ষ পাথরকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে। ছোটো, মাঝারি, আর বিশাল বড়, বিভিন্ন সাইজের পাথর।

  আজ থেকে পচিশ ছাব্বিশ বছর আগেকা্র কথা, তখন শরিরে শক্তি ও বল ছিল।  সম্ভবত সোয়া এক ঘন্টার মধ্যেই চুড়ায় উঠেছিলাম। জাবাল ই নুরের চুড়ায় উঠলেই হেরা গুহা নয়, বরং চুড়া থেকে উল্টো দিকে আরও বেশ কিছুটা নেমে আসতে হয়। খুব ঝুঁকিপূর্ণ পথ। গড়িয়ে পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু, বাঁচার কোন সুযোগই নেই। 

  উঠার সময়ই দেখলাম, অনেক নারী পাহাড়ের গোড়াতেই অপেক্ষা করছেন, সম্ভবত তাদের স্বামী সন্তান বা ভাইদের কেউ কেউ হয়তো উপরে উঠেছেন বা উঠছেন। তাদেরই অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। দু'একজনকে দেখলাম উঠা শুরু করেছিলেন, কিন্তু সম্ভবত এক চতুর্থাংশ উঠেই ফেরার পথ ধরেছেন, পাথর পথর ধরে ধরে সাবধানে নেমে যাচ্ছেন। ঐ এক চতুর্থাংশ উঠেই নীচের দিকে তাকিয়েই তাদের আত্মা শুকিয়ে যাবার উপক্রম, গড়িয়ে পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু!

  পাহাড়টি কতোটা উঁচু, তা নিয়ে আমার কোন ধারণাই ছিল না। আজ জানি; ৬৪২ মিটার বা ২১০৬ ফুট উঁচু! মিসেস মারদিয়ার ফ্লাটটা কতোটা উঁচুতে ছিল? ষষ্ঠ তলা। তার মানে হলো; সর্বোচ্চ ৫৭ ফুট। মিটার হিসেবে মাত্র ১৭.৩৭ । সেই হিসেবে জাবালে নুর পাহাড়টি মোটামুটি ২২১ তলা উঁচু ভবনের সমান উঁচু!

  সেদিন ষষ্ঠ তলায় উঠতে উঠতে ঠিক এ কথাটাই হঠাৎ রে মাথায় জেগে উঠেছিল। এই সতোরো কিংবা আঠারো মিটার উঠতেই আমাদের ঘাম ছুটে যায়! আর আমাদের মা; হযরত খাদিজা রা: সপ্তাহে দুই বা তিনবার, কখনও কখনও চারবারও রাতের আঁধারে মক্কা থেকে তিন কিলোমিটপার পথ পায়ে হেঁটে ঐ পাহাড় বেয়ে কি করে উঠতেন! 

  ততোদিনে তিনি চার বা পাঁচটি সন্তানের মা'ও হয়েছেন, বয়সও প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই, কিংবা পঞ্চাশই।  সেই বয়সেও প্রিয় স্বামীর জন্য খাবার, পানি বেঁধে নিয়ে ঐ রাতের আঁধারে ২২১ তলা ভবনের সমান উচ্চতায় উঠতেন! সেখান থেকে আবার নেমেও আসতেন রাত থাকতেই! কারণ বাড়িতে শিশু সন্তানদের রেখে গেছেন। কি অসাধারণ ত্যাগ, কি অসাধারণ পরিশ্রম!! ভাবতে পারেন? 

 মা খাদিজার জীবনি যখনই পড়ি, ভাবি, অবাক হই। চোখে ভিজে আসে। ভাবি, আচ্ছা, আমরা যখন প্রিয় রাসুল সা: এর সিরাত পড়ি, কিংবা মা খাদিজার জীবনী, তখন কি তাঁর অনেক শ্রম আর ত্যাগের মধ্যে শারিরিক এই কষ্ট, এই অদম্য সাহসের কথা এভাবে ভেবে দেখি? উপলব্ধী করি কি? কিংবা উপলব্ধী করার চেষ্টাটুকুও কি করি?
-------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।          

Post a Comment

0 Comments