চিকিৎসক, সরকার ও
দেশবাসী সমীপে;
ফুসফুসে ক্যান্সারে আক্রান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমন চাকমা সোমবার (৬ এপ্রিল) সকালে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে গেলেও করোনা ভাইরাসের ভয়ে চিকিৎসা দেয়নি কোনো হাসপাতাল। ফলে বিনা চিকিৎসাতেই মৃত্যু হয় তার(বিডিটুডে, ৬ই এপ্রিল, ২০২০)।
বিগত কয়েকদিন ধরে এরকম বেশ কিছু সংবাদ নজরে আসছে। বোধ করি পর্যাপ্ত সরকারি, প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য ও নিরাপত্তা এবং অপরিহার্য নিরাপত্তা উপাদান পিপিই না পেয়ে অনেক ডাক্তারই তাদের প্রাইভেট প্র্যাক্টিস বন্ধ রেখেছেন। ফলে ঐ সব ডাক্তারদের নিয়মিত রুগীরাও আর তাদের চলমান চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না। এর সাথে রয়েছেন নতুন রুগী, যাদের নানাবিধ কারণে চিকিৎসার প্রয়োজন হচ্ছে, তারাও।
এ দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এখনও সেই মান্ধাত্বা আমলেই পড়ে রয়েছে, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও গণসচেতনতার এবং রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ববোধের সমন্বয় ঘটেনি, দু’একটা ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানবিক চেতনাবোধের উন্মেষ ঘটেনি, তা আমরা সবাই জানি।
যে সব হাসপাতাল বিশ্বের অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্বলিত চিকিৎসাবিষয়ক যন্ত্রপাতি ও মেশিনারিজ এনেছে, তা সর্বসাধরণের জন্য উন্মক্ত নয় এবং আর্থিক খরচ বিবেচনায় নাগালের বাইরে। আবার যাদের আর্থিক সঙ্গতি রয়েছে, সেই তারাও এইসব হাসপাতালগুলোকে আস্থায় নিতে না পেরে নিজেদের চিকিৎসার প্রয়োজন হলে চলে যান সিঙ্গাপুর, বাংকক, ভারত, আমেরিকা কিংবা ইংল্যন্ডে। দেশের শতকরা নিরানব্বই ভাগ জনগণকেই তাদের দু:সময়ে এই ভঙ্গুর স্বাস্থ্যসেবার উপরেই নির্ভর করতে হয়।
করোনা মহামারী ভঙ্গুর সেই স্বাস্থ্যপরিসেবার উপরেই বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে, অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। বাংলাদেশ তো দূরের কথা, বিশ্বের শক্তিধর, প্রযুক্তি, বিত্ত, সক্ষমতা ও বিজ্ঞানে সবচেয়ে অগ্রসর দেশ হিসেবে খ্যাত ও পরিচিত আমেরিকা এবং ইংল্যন্ডের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও এ ধাক্কা সামাল দিতে একরকম বিপর্যস্থ পড়ছে।
চিকিৎসা পাওয়া মানুষের নৈতিক ও মৌলিক অধিকার। কোন অবস্থাতেই এ অধিকারকে রাষ্ট্র বা সমাজ বা চিকিৎসক বা অন্য কেউ অস্বীকার করতে পারে না। আঠারো কোটি মানুষের দেশে শতকরা কুড়ি জনই দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছে। প্রতি দশ হাজার লোকের জন্য মাত্র ৩.৫ জন ডাক্তার ও ১.৭ জন প্রশিক্ষিত নার্স রয়েছেন।
স্বাস্থ্যখাতে সরকারি বাজেট শোচনীয় পর্যায়ে। ডাক্তারদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ও কাজের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়নি। স্বাস্থ্যসেবা পরিচালনায় ডাক্তারদের মতামতের চেয়ে আমলাদের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া, এসবই এক তিক্ত বাস্তবতা। এসবকে উপেক্ষা করে এখনও দেশে হাজার হাজার ডাক্তার, নার্স নিজেদের জীবন বিপন্ন করে চিকিৎসা সেবা দিয়ে চলেছেন, তাদের স্বশ্রদ্ধ সালাম।
তবে এটাও তো সত্য যে, অনেক ডাক্তারই তাদের চেম্বার বন্ধ রেখেছেন। হাসপাতালেও নানা অসুখ নিয়ে আগত রুগী ভর্তি করতে অনীহ হয়ে আগে ভাগেই তাদের অন্যান্য হাসপাতালে রেফার করে দিচ্ছেন। ফলে যথাযসময়ে যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে অনেক রুগী মৃত্যুবরণ করেছেন।
এই আলোকেই সকল ডাক্তারদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান বজায় রেখেই তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, কেবলমাত্র পেশাগত দিক থেকেই নয়, বরং মুসলমান হিসেবেও প্রতিটি চিকিৎসকই (চিকিৎসাকর্মীসহ) প্রয়োজনের মহুর্তে চিকিৎসা সেবা দিতে বাধ্য। কোন অবস্থাতেই তারা এ দায়িত্বে অবহেলা করতে পারেন না, এ থেকে বিরত থাকতে পারেন না।
অসুস্থতায় প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা. আমাদেরকে চিকিৎসা ও নিরাময় খুঁজতে নির্দেশ করেছেন; ‘হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ করো, কেননা আল্লাহ তাআলা এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি, যার প্রতিষেধক তিনি সৃষ্টি করেননি; শুধু বার্ধক্যরোগ ছাড়া।’ (সুনানে আবু দাউদ)
একজন রুগী তার শারিরীক ও মানসিক অসুস্থতার সময়ে সবচেয়ে বেশি হতাশাগ্রস্থ, আতংকিত, উদ্বিগ্ন ও শংকিত হয়ে সবার আগে যার শরণাপন্ন হন, তিনি একজন চিকিৎসক। তার রোগ নিরাময় সন্মন্ধ্যে পরামর্শ চান। তাকে এই পরামর্শ দেয়াটা একজন চিকিৎসকের জন্য যে কেবল নৈতিক ও পেশাগত দায়িত্ব, তাই নয়, বরং এটা একটা উত্তম ঈবাদাতও বটে। প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা. এর এক বাণীতে দেখতে পাই তিনি বলেছেন; ‘যার কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়, সে আমানতদার।’ (তিরমিজি)
ইসলাম আমানত রক্ষার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন; ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতসমূহ প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দাও। আর যখন মানুষের বিচার-মীমাংসা করবে তখন ইনসাফভিত্তিক মীমাংসা কর। আল্লাহ তোমাদের সদুপদেশ দান করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী, দর্শনকারী।’ (সুরা নিসা : ৫৮)
আমানতের খেয়ানত করাটা স্পষ্ট মুনাফেকি। প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা. আমানত খেয়ানতকারীকে বেঈমান, ঈমানহীন বলেছেন। হজরত আনাস (রা.) বলেন; ‘এমন খুব কম হয়েছে যে, নবীজি (সা.) ভাষণ দিয়েছেন অথচ তাতে এ কথা বলেননি ‘যার মধ্যে আমানতদারী নেই তার ঈমান নেই।’
অন্য এক হাদিসে আমানত খেয়ানত করাটা মুনাফেকির লক্ষণ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে; হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন; ‘মুনাফিকের লক্ষণ তিনটি। তা হলো; মিথ্যা কথা বলা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা এবং আমানতের খেয়ানত করা।’ (বুখারি)।
কাজেই চিকিৎসাপ্রার্থী কোন রুগীকে চিকিৎসা দেয়া থেকে বিরত থাকা কোন মুসলমান ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মীর পক্ষেই সম্ভবপর নয়।
একজন চিকিৎসকের শান্তনাবাণীতেও রোগের অনেক উপশম হয়। রুগীর মনে আস্থা ও সাহস ফিরে আসে। বলা হয়ে থাকে একজন চিকিৎসকের উত্তম আচরণ, শান্তনাবাণী আর সদাচারে রুগীর অর্ধেক রোগ ভালো হয়ে যায়! দরদমাখা কথাটাও সাদাকা হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন; ‘ভালো ভালো কথা বলাও সদকার অন্তর্ভূক্ত।’ (মুসনাদে আহমদ)
সবশেষে আমি সম্মানিত চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের উদ্দেশ্যে মুসলমান চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের সাত দফা শপথ (Oath of a Doctor) তালিকাটা বিনিতভাবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই;
I swear by God the Great
To regard God in carrying out my profession
To protect human life in all stages and under all circumstances, doing my utmost to rescue it from death, malady, pain and anxiety..
To keep peoples’ dignity, cover their privacies and lock up their secrets…
To be, all the way, an instrument of God’s mercy, extending my medical care to near and far, virtuous and sinner and friend and enemy…
To strive in the pursuit of knowledge and harnessing it for the benefit but not the harm of mankind,,
To recover my teacher, teach my junior, and be brother to members of the Medical Profession joined in piety and charity…
To live my Faith in private and in public, avoiding whatever blemishes me in the eyes of God, His apostle and my fellow Faithful.
And may god be witness to this Oath (সুত্র: Bulletin on Islamic Medicine, 1st Vol. p.751, Kuwait, 1981)
একইসাথে দেশবাসী, প্রশাসন ও সরকারকে চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয় সকল সহযোগীতা ও নিরাপত্তা প্রদানে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারমূলক বিশেষ কর্মসূচী গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি।
--------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।
0 Comments