Recent Tube

ওরা বুঝেছিল, আপনি কেন বুঝবেন না? জিয়াউল হক।

     
                 ওরা বুঝেছিল, আপনি কেন বুঝবেন না?


     সিরিয়া তথা ফিলিস্তিন জনপদে প্রেরিত হয়েছিলেন তিনজন নবী। প্রথমে দু’জন নবী ইসলামের দাওয়াত তুলে ধরলেও অধিবাসীরা তা অস্বীকার করে এবং নানা অপপ্রচার চালিয়ে স্থানীয় জনগণকে তাঁদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে।

     এমতাবস্থায় আল্লাহপাক উক্ত দু’জন সম্মানিত নবীর সাথে আরও একজন নবীকে ঐ জনপদে ইসলামের দাওয়াতে পাঠান। তাঁরা তিন জন একত্রে ঐ জনপদে সত্যের দাওয়াত তুলে ধরা সত্তেও লোকজন তাদের হঠকারীতায় অটল থাকে। গুটিকতক বিবেকবান ছাড়া পুরো জনপদ এ দাওয়াতকে কেবল অস্বীকারই নয় বরং তাদের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রোপাগান্ডা এবং শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন চালাতে থাকে।

    পাশাপাশি এসব সম্মানিত নবীরাই তাদের সমাজে সকল বিভক্তি, অশান্তি, অনগ্রসরতা আর পশ্চাৎপরতার জন্য দায়ী, তাদের জাতিয় উন্নতি আর প্রগতির পথে একমাত্র বাধা বলে ঘোষণা করে।

    এপর্যায়ে স্থানীয় একজন, পেশায় ছুতার, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি বিবেচনায় নগণ্য ব্যক্তি, হাবিব নাজ্জার, এগিয়ে এলেন, সমাজবাসীদের হঠকারীতার জবাবে যুক্তি উপস্থাপন করে বলেন যে, এঁরা কোন পারিশ্রমিক চাইছেন না বরং একান্তই নি:স্বার্থভাবে আমাদেরকে সত্য-সুন্দরের দিকে ডাকছেন। আপনারা এঁদের কথা শুনুন।

     আলকুরআনে সে চিত্র বর্ণিত হয়েছে সুরা ইয়াসিনের কুড়ি নম্বর আয়াতে এভাবে ‘অত:পর শহরের প্রান্তভাগ থেকে এক ব্যক্তি দৌড়ে এলো। সে বলল, হে আমার স¤প্রদায়, তোমরা রাসুলগণের অনূসরণ কর। অনুসরণ করো তাঁদের, যাঁরা তোমাদের কাছে কোন বিনিময় কামনা করেন না, অথচ তাঁরা সুপথপ্রাপ্ত’

     নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের প্রতি তার আবেদন ছিল, ‘আমরা কেন ভেবে দেখবনা? কেন সেই আহ্বানের প্রতি কর্ণপাতটুকু না করে উল্টো সেইসব নি:স্বার্থ লোকদেরকেই দোষারোপ করব? আর আমি-ই বা কেন সেই আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করবো না, যাঁর কাছেই আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে?

     নেতাদের মুখের উপরে সামান্য এক ছুতারের এসব যুক্তি, ভালো লাগলনা। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল একত্রে নিজ গোত্রের লোকটির উপরে যার যা ছিল, লগী, বৈঠা, বাঁশ, খেজুর ডাল নিয়ে! যাদের তাও ছিলনা, তারা চালালো কিল, ঘুঁষি, লাথি! এভাবে তাকে মেরেই ফেলল! এ যেন সেযুগের আঠাশে অক্টোবর!!

     এরপরে ঘটল আসল ঘটনাটা। হাবিব নাজ্জার মরার সাথে সাথে তাঁর সামনে খুলে গেল জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতার স্বর্ণদূয়ার। যে লোকটা ইসলামের জন্য কিছুই করতে পারেননি ঈমান আনার পরে, পারেননি কোন মসজিদ বা খানক্বাহ বা ইসলামিক ফাউন্ডেশন বানাতে বা হজ্জ করতে, যাকাত দিতে বা জ্বেহাদ করতে, গরীব দু:খীদের পূনর্বাসন করতে বা ত্যাগের নজরাণা দেখাতে, কেবলমাত্র ইসলামের আহ্বান মেনে, এর দাওয়াত দানকারীদের প্রতি মৌখিক সমর্থনটুকু দেখানো ছাড়া। সেই তিনিই সফলতা পেলেন! তাকে বলা হলো ‘জান্নাতে প্রবেশ করো।’ মৃত্যুর সাথে সাথে!

     এ সামান্য (!) কাজটুকুর বিনিময়ে জান্নাত পেয়ে হাবিব নাজ্জার খূশীতে গদগদ হয়ে স্বগোতোক্তি করে উঠলেন। আলকুরআনই বলে দেয় উক্তিটি; ‘সে বলল, হায়, আমার জাতি যদি কোনক্রমে জানতে পারত যে, আমার প্রভূ আমাকে ক্ষমা করেছেন, আর আমাকে সম্মানিতদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন (সুরা ইয়াসিন, ২৬-২৭)

      এই যে চেতনা, সত্য আর মিথ্যার সাথে চিরন্তন দ্বন্দে সত্যের পক্ষে আন্তরিক সমর্থনটুকু ঢেলে দেয়াটা সহজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন সত্যকে মেনে নেবার মত সাহস। প্রয়োজন নিজের দল, নেতা-নেত্রীর আনুগত্য ছেড়ে সত্যের আনুগত্য করার মত মানসিক চেতনা। এই চেতনাই হলো ঈমানের পূর্বশর্ত। ঈমানদার হবার অন্যতম অনুষঙ্গ।

    হক্বের সাথে বাতিলের, সত্যের সাথে মিথ্যার দ্বন্দে যাঁরা নিরপেক্ষত (!) থাকেন, তাদের ঈমান কোন পর্যায়ে, ইসলামের দৃষ্টিতে কোন স্তরে, সেটা আমার লেখনীতে নয় বরং স্বয়ং হজরত আলীর শাসনামলের এক ঘটনাতেই দেখা যাক।

     ক্রধোন্মত্ত এক ব্যক্তি উদ্যত তরবারী হাতে অপর এক ব্যক্তিকে হত্যা করতে তেড়ে যাচ্ছে দেখে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রাণ বাঁচাতে অনতিদুরেই আলাপরত দু’ব্যক্তির পিছে লুকোনোর চেষ্টা করল। কিন্তু তারপরেও ঘাতক অনায়াসেই তাকে হত্যা করলেও আলাপরত দু’ব্যক্তির একজন ঘাতককে ধরে ফেলেছে ততক্ষণে।

   বিচার গেল আদালতে। মদিনার কাজী সুক্ষ বিচার শেষে সাজা ঘোষণা করলেন; ঘাতককে দিলেন মৃত্যুদন্ড। আর নিরপেক্ষ (?) দাঁড়িয়ে থাকা দু’সাক্ষীকেও দিলেন কঠিন সাজা। যে ব্যক্তি ঘাতককে জাপটে ধরে পুলিশের হাতে দিয়েছে, তাকে দিলেন যাবজ্জীবন কারাদন্ড। কারণ, সে নাগরিক দায়িত্ব পালন করেছে বটে, তবে হত্যাকান্ডের পরেই মাত্র।

      নিহত ব্যক্তি এদের পেছনেই আশ্রয় নিয়েছিল, তারা হত্যাকান্ডের আগেই ঘাতককে নিবৃত করলে নিহত এবং ঘাতক, দু’জনের জীবনই বাঁচত। কিন্তু তারা তা করেনি। যে ব্যক্তি সমাজে বাস করেও মানুষের নিরাপত্তা বজায়ে নাগরিক কর্তব্যটুকু পালন করে না, সমাজে সে মুক্তাবস্থায় থেকে লাভ কি? কারাগারেই আটকে রাখা অধিক সমিচীন বিবেচনায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়েছে।

      অপরব্যক্তি, যে নিরপেক্ষ(!) থেকেছে, বিচারক তাকে কঠোর সাজা দিয়ে তার চোখদুটো উপড়ে ফেলার আদেশ দেন। সমাজে বাস করেও যে ব্যক্তি আশেপাশে সংঘটিত অন্যায়, অবিচার দেখেনা, তা রোধে ভুমিকা রাখেনা, তার সেই চোখ সমাজের কোন কাজে লাগবে? তার চোখ থাকা বা না থাকায় সমাজের কি লাভ? অতএব সে অন্ধ হলেইবা কি?

     ইউসুফ আ:কে তোলা হয়েছে কেনানের বাজারে নিলামে। কেনার জন্য মন্ত্রী, উজির, নাযির, আর বণীকের মত ধনাঢ্য লোকজন জড়ো হয়েছেন। এদেরই পাশে এক বুড়ী, যিনি কেনানের জনপদে ভিক্ষা করে নিজের খাবার জোগাড় করতেন, তিনিও হাজির হয়েছেন!

       স্বর্ণমুদ্রা নয়, রৌপ্যমুদ্রাও নয়, হাতে তাঁর ভিক্ষা করে পাওয়া তৎকালীন মুদ্রামাণের সর্বনিম্ন অংকের একটা পয়সা মাত্র! তা নিয়েই বুড়ী মন্ত্রী-মিনিষ্টার, ধনীক-বণীকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তিনিও নিলাম ডাকবেন! উপস্থিত গণ্যমান্যদের পাশে ইউসুফ আ:কে কিনতে ভিখারিণী বুড়ীকে দেখে সকলেরই সীমাহীন কৌতুহল! কেউ কেউ বুড়ীকে লক্ষ্য করে দু’একটা কৌতুক করতেও পিছপা হয়নি।

           বুড়ী অনেকক্ষণ নীরবে সয়ে একবার কেবল বললেন; ‘বাবা, আমি একজন ভিখারিণী মাত্র। আমার কি সাধ্য তোমাদের সাথে পাল্লা দিয়ে ইউসুফকে কিনি? তারপরেও দাঁড়িয়েছি ইউসুফকে মুক্ত করতে। জানি, সে সামর্থ এবং অর্থ আমার নাই। কিন্তু কেয়ামতের মাঠে আল্লাহকে অন্তত বলতে পারব ‘ আল্লাহ, আমার সামর্থ ছিলনা তুমি জানো, তবে যেটুকু সামর্থই দিয়েছিলে, সেটুকু নিয়েই তোমার নবীকে মুক্ত করতে দাঁড়িয়েছিলাম। ইউসুফ’কে যাঁরা মুক্ত করতে তৎপর ছিল, আমিও তাঁদেরই একজন। হে আল্লাহ, আজ আমাকে সেই প্রচেষ্টার কারণেই ক্ষমা করে দাও প্রভূ’

           পর পর তিনটা ঘটনা তুলে দিলাম। কুরআন থেকে, ইতিহাস থেকে। সত্য ও সুন্দরের পক্ষে একজন ব্যক্তির ভূমিকা কি হওয়া দরকার, তা বোঝা যায় এসব ঘটনা থেকে। কিছু পাওয়া না পাওয়া কিংবা পক্ষ, বিপক্ষ, আর নিরপেক্ষতা নিয়ে যারা নিত্যই সমস্যায় ভোগেন, যাঁরা সবকিছুতেই ‘নিরপেক্ষতা’ নামক শয়তানের অব্যর্থ বর্মের আড়ালে লুকিয়ে নিজেদের নিষ্পৃহতার, নিস্কৃয়তার অনুকুলে যুক্তি খোঁজেন, তাদের জন্য শিক্ষা আছে ঘটনাগুলোয়।

       বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সে শিক্ষাটা কি? তা জানতে খুব একটা গবেষণা করতে হবেনা। কথায় বলে, ‘আক্কেলমন্দ কি লিয়ে ইশারাই ক্বাফী! সেটা বুঝেছিলেন প্রাচীন যুগের ছুতার হাবিব নাজ্জার, কপর্দকশুন্য ভিখারিণী আর মদীনার কাজী।
       তাহলে আমাদের সুশীল সমাজের রথী-মহারথীরা, আমাদের আলোকিত তরুণ যুবকরা কেন তা বুঝবেন না? সেই প্রাচীন যুগের ওরা বুঝেছিল, তা হলে এই আধুনিক আলোকিত যুগের আপনি কেন বুঝবেন না?
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।          

Post a Comment

0 Comments