Recent Tube

শিক্ষা' কি? What is Education? জিয়াউল হক।

                

                              'শিক্ষা' কি?    
                     What is Education?

     জর্জ পার্কার, আমেরেকিান আইটি ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সালটেন্ট, জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে কাজ করেছেন। হঠাৎ করেই বিশ্বব্যাংকের এক্সপার্ট কনসালটেন্ট হিসেবে তৃতিয় বিশ্বের দেশ বাংলাদেশে আসতে হলো। ঢাকা শহরে হলে না হয় হতো, তার পোষ্টিংটা হলো একেবারে মফস্বল শহরে, ধরুন, আমাদের কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে।

     জর্জ আসতে চাননি, কিন্তু বাংলাদশে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের একটা যৌথ প্রজেক্টে তাকে আসতেই হলো। বেতনসহ সম্মানী যেমন অনেক বেশি, এর সাথে সাথে একটা একটা চ্যালেঞ্জিং প্রজেক্ট, যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে তাঁর ক্যারিয়ারের জন্য এটা একটা বিরাট সফলতা হিসেবে দেখা হবে। এসব ভেবে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্তেও কেবলমাত্র ভবিষ্যৎ বিবেচনায় তাকে আসতেই হলো।

      কুষ্টিয়ার দৌলতপুর। মফস্বল শহর, এখানেই তাকে থাকতে হবে বেশির ভাগ সময়। আধুনিক জীবনের সুযোগ সুবিধা তেমন একটা নেই। তারপরেও কোনো মতে তিনি মাত্র কয়েকটা মাস কাটিয়ে দেবেন ভেবে নিয়েছেন। বাংলাদেশী কলিগদের বলে তিনি স্থানীয় একজন ছেলে জোগাড় করে নিয়েছেন, নিজের বাজার ঘাট করা থেকে শুরু করে ঘর, অফিস গুছিয়ে রাখাসহ স্থানীয় গাইড হিসেবে কাজ করার জন্য।

      ছেলেটা সুঠাম ও চৌকষ হলেও আধুনিক জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ঠ অনেক মেশিনপত্র, যেমন, ব্লেন্ডিং, ইলেকট্রিক কুকার, টোস্ট মেকার, মাইক্রোওয়েভ ওভেনস, ডিসার্ট মেকার, স্টিম পট, কফি মেকার, ঘর পরিষ্কার করা হুভার, ওয়াশিং মেশিন, ড্রাই ক্লিনার, পেপার শ্রেডার ব্যবহার করতে জানে না। এসবের অনেকগুলোই সে জীবনে চোখেও দেখেনি, এমনকি, নামও শোনেনি।

     এ কারণে সে প্রথম প্রথম একটু হতাশ হলেও তা কাটিয়ে উঠেছে সহসাই। কারণ, জর্জ বাংলাদেশে আসার জন্য দুই সপ্তাহ রিলোকেশন লিভ ও সেই সাথে প্রায় দশ হাজার মার্কিন ডলার পেয়েছে। সে এই দুই সপ্তাহ সময় কাজে লাগিয়ে ছেলেটাকে এইসব মেশিনপত্রের ব্যবহার শিখিয়ে নিজের কাজের জন্য উপযোগী করে নেবে বলে স্বিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সে লক্ষ্যে কাজও শুরু করে দিয়েছে।

      বাংলাদেশি ছেলেটা, ধরুন তার নামে রাসেল, অভাব অনটনের সংসারে কোনো মত গ্রাজুয়েশন শেষ করে এখন বেকার। চাকুরির সন্ধান করে করে হন্যে হয়ে ঘুরেছে, এরকম সময়ে মাত্র কয়েকমাসের জন্য এই প্রজেক্টে অস্থায়ী ভিত্তিতে একটা কাজ পেয়ে আপাতত মন্দের ভালো হিসেবে সেটাই লুফে নিল।

     কয়েকমাসের জন্য আকর্ষণীয় অংকের আর্থিক বেতন ছাড়াও একজন ইংরেজের সাথে কাজ করার ফলে তার নিজের ইংরেজি দক্ষতার কিছুটা উন্নতি হবে, সেটাও একটা দিক। যে সব কাজ তাকে করতে হবে, তার অনেক কিছুই সে জানে না, তবে আশার কথা হলো, জর্জ তাকে তার কাজ শিখিয়ে নেবে, হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে নেবে। অতএব সে সানন্দে রাজী হয়ে যায়।

      সুধী পাঠক, আমাদের বর্তমান সমাজে আপনার, আমার সর্বোপরি আমাদের অবস্থা এই রাসেলের মত। বৈশ্বিক কর্পোরেট মার্কেটে চাহিদানুযায়ী সরকার বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানীগুলো তাদের চাহিদানুযায়ী প্রফেশনাল তৈরি করে।

      এই সব প্রফেশনালদের মধ্যে হেলথ, ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানীর চাহিদানুযায়ী কেউ হয় ডাক্তার বা নার্স কেউ হয় কেমিস্ট বা ফার্মাসিস্ট। ইন্ডাষ্ট্রিয়াল সেক্টরের জন্য কেউ হয় ইঞ্জিনিয়ার কেউবা টেকিনিশিয়ান। আর্ট ও ফ্যাশন জগতের জন্য কেউবা শিল্পী আর্টিস্ট, ডিজাইনার হন, কেউবা হয় প্রডিউসার। বাজার যাচাই, তৈরি, নিরুপণ, বিপনন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য এমবিএ পড়ে কেউবা হয় বিজনেস এক্সিকিউটিভ, চার্টার্ড একাউন্টেন্ট আবার কেউবা কেরানি।

      শ্রম বাজারে এই যে এত সব পেশার লোক তৈরি হয়, এই লোকগুলো তৈরি করে আমাদের কলেজ ইউনিভার্সিটিগুলো। ঐ যে এ নিবন্ধের শুরুতেই আমেরিকান আইটি কন্সালটেন্ট জর্জ পার্কারের কথা বলেছিলাম, জর্জ একজন ব্যক্তি হিসেবে নিজ উদ্যোগ ও গরজে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের রাসেল নামের এক যুবককে কিছু মেশিনপত্র চালানো শিখিয়ে নিয়েছিল, যেন তার নিজের কাজগুলো ঠিকঠাক মত এই রাসেল ছেলেটা করতে পারে।

     ঠিক সেই কাজটাই আরও বড় আঙ্গিকে সরকার বা বিভিন্ন কর্পোরেট মালিকদের করে দিচ্ছে আমাদের কলেজ ইউনিভার্সিটিগুলো। লক্ষ লক্ষ রাসেলদের প্রশিক্ষিত করে দিচ্ছে।

            আমাদের কলেজ ইউনিভার্সিটিগুলো 'জর্জ পার্কার' এর মত শত শত রাসেলকে বিভিন্ন মেশিন চালানোর টেকনিক শিখিয়ে দিচ্ছে। তাদের বাজার তৈরি, নিরুপন, নিয়ন্ত্রণ ও যাচাই করা শিখিয়ে দিচ্ছে, কাস্টোমারের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে, কিভাবে তাদের সন্তুষ্টিকে ধরে রাখতে হবে, তা শিখিয়ে দিচ্ছে যেন নিয়োগকর্তার কাজগুলো আঞ্জাম দিতে পারে।

       এই শিখিয়ে দেবার জন্য অবশ্য এই সব ইউনিভার্সিটিগুলো আবার সরকার বা ছাত্রদের কাছ থেকে, অথবা কর্পোরেট সমাজ থেকে অর্থও নিচ্ছে! এটাও তাদের একটা ব্যবসা বটে! আর আমরাও পেটের দু মুঠো ভাত, পরণের এক টুকরো কাপড় আর মাথার উপরে একটুখানি আচ্ছাদনের নিশ্চয়তা পেতে চাকুরির বাজারে চাহিদা বুঝে নিজেদের দক্ষতা বাড়িয়ে নিচ্ছি, কিছু ভাষা, কিছু টেকনিক, কিছু কৌশল শিখে নিচ্ছি!

      তা না হয় হলো। তা হলে 'শিক্ষা' নামক মহান ও মহার্ঘ বস্তুটা কোথায়? আমরা যে 'শিক্ষিত' হতে চেয়েছিলাম, শিক্ষাটা যে আমাদের উপরে ফরজ ছিল, সেই শিক্ষাটা কোথায়?

     এ প্রশ্নের উত্তরটা যদি আমরা সত্যিই জানতে চাই, তা হলে আমাদেরকে আবারও এটা জানতে হবে, আসলে 'শিক্ষা' জিনিসটা কি? আসুন, সেটাই আগে জানি।
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ, গ্রন্থপ্রনেত, গীতিকার, ও বিশ্লেষক।      

Post a Comment

0 Comments