Recent Tube

দ্যা চয়েস ইজ ইউরস-১১ জিয়াউল হক।

          দ্যা চয়েস ইজ ইউরস-১১

উম্মে আইমান আর মা আমিনা আব্দুল মুত্তালিবের বাড়িতে একই ঘরে থাকতেন। উম্মে আইমান তার পায়ের দিকে আলাদা শয্যা পেতে সেখানে শুতেন। সারাটাক্ষণ একরকম নীরব ও একাকি থাকতেই পছন্দ করতেন। খুব কম কথা বলতেন। যেটুকু বলতেন, তা ঐ এক উম্মে আইমানের সাথে। তার সাথেই নিজের কষ্টগুলো ভাগভাগি করতেন। 

অন্তস্বত্তাবস্থায় তিনি তেমন কোন কষ্টই অনুভব করেন নি। এমনকি, তিনি যে সন্তানসম্ভ্যবা, সেটাই তার মনে হতো না। তবে খুব চমৎকার কয়েকটি স্বপ্ন দেখেছিলেন যার প্রতিটি উম্মে আইমানকে বলেছেন।

দেখতে দেখতে সাড়ে চার মাস চলে গেছে। সাধারণত চার থেকে পাঁচ মাস সময় লাগতো মক্কা থেকে কাফেলা সিরিয়া গিয়ে বাণিজ্য শেষে আবার ফিরে আসতে। প্রায় প্রতিদিনই তিনি উদগ্রিব হয়ে চেয়ে থাকতেন কোন খবর পান কি না সেটা জানার জন্য। একদিন খবর পেলেন কাফেলার কিছু লোক ফিরে আসছে। দ্রুত উম্মে আইমানকে পাঠালেন। উদগ্রিব হয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। কিছুক্ষণ উম্মে আইমান ফিরে এসে জানালেন; সবাই নয়, কিছু কিছু লোক ফিরেছে বটে, তবে তাদের মধ্যে তার মনীব আব্দুল্লাহ নেই।

কয়েকদিন পরে আবারও খবর পেলেন কাফেলার লোকগুলো ফিরে এসেছে। একইভাবে এবারেও তিনি  উম্মে আইমানকে আবারও পাঠালেন। উম্মে আইমান গিয়ে জানতে পারলেন আব্দুল্লাহ ফেরার পথেই অসুস্থ হয়ে পড়েন ইয়াসরিবে। সেখানে তার নানীর বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। 

উম্মে আইমানের সামনে যেন পুরো দুনিয়াটা আঁধার হয়ে এলো। মা আমিনার অপেক্ষার প্রহর আরও দীর্ঘ হতে যাচ্ছে দেখে তিনি খুবই মর্মাহত হলেন, দু’চোখ ভরে ব্যাথা আর কষ্টে অশ্রুর ঢেউ নেমে আসলো। তিনি তো জানেন মা আমিনা কি অধির আগ্রহ নিয়ে স্বামীর অপেক্ষা করছেন!

কাফেলা ফিরে আসার খবরটা বাতাসের গতিতে চাউর হলো সারা মক্কাজুড়ে। যারা ফিরে এলেন, তাদের বাড়িতে বাড়িতে আপনজন ফেরার আনন্দ কোলাহল, পথ ঘাট মুখরিত।

আব্দুল মুত্তালিবের বাড়িতে একটা ঘরের চৌকাঠ ধরে তখনও মা আমিনা তাঁর প্রিয় স্বামী ফেরার খবরটা জানার জন্য কান পেতে আছেন। অসুস্থতার খবরটা তার কানে পৌছুলে সন্তানসম্ভবা আমিনার কি প্রতিক্রিয়া হয় কে জানে! ভেবে খবরটা তার কানে অন্য কারো মারফত পৌছুনোর আগেই উম্মে আইমান ছুটলেন বাড়ি পানে। 

অধির আগ্রহে মা আমিনা উম্মে আইমান আর স্বামীর পথ চেয়েছিলেন। উম্মে আইমানকে আসতে দেখে তিনি এগিয়ে এলেন ত্রস্ত পায়ে। কিন্তু না তাঁর স্বামী ফেরেননি। উম্মে আইমানের কাছে সব শুনলেন তিনি। তাঁর স্বামী সিরিয়া থেকে ফেরার পথে অসুস্থ হয়ে পড়লে ইয়াসরিবে তাঁর মামার বাড়িতে উঠেন।

আমিনার সারাটা মন প্রাণ এক অজানা আতংকে কেঁপে উঠে। না জানি তাঁর স্বামী কেমন আছেন। তার নিজের বাবা মা’ও ঐ ইয়াসরিবেই আছেন, নিশ্চয় স্বামীর সেবা যতেœ কোন ত্রুটি হবে না, তবুও যে মন মানছে না। চোখে অশ্রুর ধারা যে শুকোচ্ছে না! এই কঠিন মুহুর্তেও পরম মমতায় উম্মে আইমান দাঁড়ালেন তাঁর পাশে। শান্তনা দেওয়া থেকে শুরু করে একজন প্রসূতি মায়ের সকল সেবা যত্ন  করে যেতে থাকলেন। 

এদিকে মন মানছে না বৃদ্ধ আব্দুল মুত্তালিবেরও। সবচেয়ে আদরের সন্তানের জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে পড়লেন। সময়কালটা ছিল শীতকাল, জানুয়ারি মাসের তীব্র ঠান্ডা। চুয়াত্তর বছর বয়সে তার নিজের পক্ষে এখন আর এই দীর্ঘ চারশত কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়া সম্ভবপর নয়। তাই বিড় ছেলে হারিসকে দ্রুত রওয়ানা দিতে বললেন ইয়াসরিবের উদ্দেশ্যে। হারিস কাল বিলম্ব না করে রওয়ানা দিলেন ছোট ভাইয়ের খবর নিতে ও তাকে সাথে করে মক্কায় ফিরিয়ে আনতে।

সেকালে মক্কা থেকে ইয়াসরিব পর্যন্ত এই দীর্ঘ পথ যেতে কমপক্ষে আট থেকে নয়দিন, আবহাওয়া ভালো মন্দের উপরে নির্ভর করে কখনও কখনও প্রায় দশদিন সময় লেগে যেতো। যারা ফিরে এসেছে, তারা তো কমপক্ষে নয়দিন আগেকার খবর নিয়ে এসেছে, না জানি বিগত নয়দিনে তাঁর আদরের সন্তানের কি অবস্থা হয়েছে! 

নিজের পিতা হাশিমও এরকমই একটা সফরে গিয়ে গাজায় ইন্তেকাল করেন, সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। তিনি তখনও মা সালমার গর্ভে। পিতার মুখটাও দেখার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর। মৃত বাবার শেষ অসিয়াত হিসেবে মানুষ হয়েছেন চাচা আল মুত্তালিবের কাছে। নিজের নাম, শায়বা চাপা পড়ে গেছে চাচার নামের সাথে সম্পৃক্ত করে তার নতুন পরিচিতি; আব্দুল মুত্তালিব হিসেবে।

বৃদ্ধের ঘুম হারাম হয়ে গেলো। এই আব্দুল্লাহ, তাঁর সবচেয়ে ছোট সন্তান, সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। এই ছেলেকেই তিনি কুরবানি করতে গিয়েছিলেন (ইতোপূর্বের অধ্যায়ে সে বর্ণনা দিয়েছি) মানত পুরো করতে। 

স্ত্রী ফাতেমা; আব্দুল্লাহর গর্ভধারীনি মা কাঁদতে কাঁদতে সামনে এসে আকুতি জানিয়েছিলেন, আমাদের সকল সম্পদ, সকল অর্থ-বিত্ত সব আল্লহর রাস্তায় বিলিয়ে দিন এ সন্তানের বিনিময়ে, তারপরেও তাঁকে কুরবানি করা যাবে না। তার ষোলো সন্তান, পাঁচ স্ত্রীসহ সকল আত্মীয় স্বজন জিদ ধরেছিল সেদিন।

শুধু কি তারা! পুরো মক্কাবাসীরই যেন ঐ একই দাবী! ভাগনে (আব্দুল্লাহর মামাতো ভাই) মুগীরা বিন আব্দুল্লাহ বিন আমর মাখযুমি তো পথ আগলে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, গলা উচিয়ে আকুতি জানিয়েছিল; ‘আল্লাহর কসম যতোক্ষণ না তাকে বাঁচানোর সকল প্রচেষ্টা সফল হচ্ছে, ততোক্ষণ আপনি তাকে কুরবানি করতে পারেন না। ওর জীবন বাঁচাতে যদি আমাদের সকল সম্পদ ব্যায় করতে হয়, তাতেও পিছপা হবো না’। শেষে লটারির মাধ্যমে একশত উটের বিনিময়ে আব্দুল্লাহর জীবন সে যাত্রা বেঁচে যায়।

সম্ভবত বৃদ্ধ আব্দুল মুত্তালিবের সামনে সবচেয়ে বড়ো পীড়াদায়ক হয়ে দেখা দিয়েছিল বাড়িতে অন্তস্বত্তা পুত্রবধুর করুণ নি:সঙ্গতা। তিনি যে কতোটা অন্তর্দ্বন্দে, কি নিমর্ম মর্মপীড়া আর অপরাধবোধে ভুগছিলেন এ নারীর সামনে তা বোধহয় কল্পনাও করা সম্ভবপর নয় আমাদের পক্ষে! এ বাস্তবতার প্রমাণ আমরা পাবো আরও কিছুদিন পরের একটা ঘটনায়।
(সংক্ষেপকৃত),
চলবে,,,,,

Post a Comment

0 Comments