Recent Tube

মুক্তমনা মহামতি আকবর!! জিয়াউল হক।

     
          

 মুক্তমনা মহামতি আকবর!!

 সম্রাট আকবরতে গ্রেট আকবর ডাকা হয়। তিনি নাকি মুক্তমনা ছিলেন। তিনি যে কতেটা মুক্তমনা ছিলেন এবং তার পরিণতি কি হয়েছে, সে ব্যাপারে ঐ ঐতিহাসিক বলেন;
একজন মুক্তমনা হিসেবে তিনি এক ধরনের ধর্মীয় বহুত্ববাদীতার ধারনা পেশ করেন, যা একইসাথে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়কেই ক্ষিপ্ত করে। মুসলমানদের কাছে আকবর প্রবর্তিত ধর্ম 'দ্বীন ই ইলাহি' ইসলামি দর্শনের সাথে তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়, অপরদিকে গোঁড়া হিন্দুরা ধর্ম নিয়ে তার এ ধরনের পরীক্ষা নীরিক্ষাকে অপরিণামদর্শী ও বিদঘুটে হিসেবেই দেখেছে। আর এভাবেই আকবরের এই ধরনের অপরপিক্ক পদক্ষেপ হিন্দু মুসলমান দুই গোষ্ঠীর সম্পর্ককে জোরদার করার পরিবর্তে আর বিভেদের দিকে ঠেলে দিল।(১)
আকবর ভারতের আঠারো কোটি জনগণের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা ও ক্ষমতাকে সংহত করতে নিজেকে বহুজাতিক জনগোষ্ঠীর একচ্ছত্র রাজা হিসেবে জাহির করেছেন।(২ )
আকবরের আগে ভারতবর্ষে পর পর নয়টি মুসলিম রাজবংশ রাজ্য শাসন করলেও কেউই চল্লিশ বৎসরের বেশি রাজত্ব করতে পারেনি।(৩) তার টার্গেট ছিল নিজের শাসনকালকে দীর্ঘস্থায়ী করার। এ জন্য তিনি ধর্মকে নিখুঁতভাবে কাজে লাগিয়েছেন। স্বার্থ আদায়ে ধর্মকে বিকৃত করেছেন, নিজের ও সংখ্যালঘুর ধর্মবিশ্বাসকে অত্যন্ত ন্যাক্কারজনকভাবে অবমাননা করতে সংখ্যাগুরুর ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েও তাদের সে ধর্ম গ্রহণ করেন নি।
নিজে মুসলমান ও মুসলিম বাবা মার সন্তান হয়েও ধর্ম পরিবর্তন ছাড়াই হিন্দু নারী বিয়ে করেছেন, সেই নারীদের ধর্মপালনে রাজপরিবারেই মন্দির গড়ে দিয়েছেন, তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দিত্যে।(৪) উনিশ বৎসরের যুবক আকবরের চারটি স্ত্রী ! ইসলাম ধর্মমতে আরও বিয়ের পথ না থাকলেও তিনি বিয়ে করেছিলেন। এভাবে পর পর তিনশত বিয়ে করলেন। কি নির্মম রসিকতা, যে সম্রাট নিজের জন্য তিনশত স্ত্রী এবং আরও পাঁচ হাজার উপপত্নী বেছে নিলেন, সেই সম্রাটই কিছুদিন পর রাজকীয় ফরমান জারী করছেন; একজন পুরুষের একজন মাত্র স্ত্রী থাকাই বাঞ্চনীয়!(৫)

হাস্যকর বিষয় হলো; আকবর যে সময়টাতে এই ঘোষণা দিচ্ছেন, সেই তখনও তার ঘরে তিনশত স্ত্রী এবং হাজারেরও উপরে রক্ষিতা! তার এইসব বিয়ের পথ বের করে দিয়েছে বিকৃত ইসলামি চেতনায় উজ্জীবিত শিয়া সভাষদ আবুল ফজল ও তার বাবা শেখ মুবারাকের মত দরবারি আলেমরা। ইসলামের লেবাস পরিয়ে 'মুতা'আ' বিয়ে হিসেবে।(৬)  যে ইসলামের বিরোধিতায় তিনি মাঠে নেমেছেন সেই ইসলামেরই বিকৃতি!
হিন্দু স্ত্রী, তাদের বাবা দাদাদের খুশি করতে নিজে হিন্দু সন্যাসীদের মত গেরুয়া পোশাক পরেছেন। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরেছেন।(৭) কপালে চন্দনের তিলক লাগিয়েছেন। দৈনন্দিন পানি পানের ক্ষেত্রে সারাজীবন গঙ্গাজলকেই বেছে নিয়েছেন পবিত্রজ্ঞানে।(৮)

দিল্লির জরোস্ত্রিয় পারসিক ধর্মগুরুকে তিনি তার রাজসভার গুরুত্বপূর্ণ পদে, সভাসদ হিসেবে ঠাঁই দিয়েছেন এবং সেই একইসাথে জরোস্ত্রিয় পারসিক ধর্মীয় চিহ্ন হিসেবে তাদের বিশেষ ধরনের কোর্তা ও কোমরবন্ধ পরিধান করেছেন।(৯)
পর্তূগিজ পাদ্রিরা স্বয়ং আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় মোগল হেরেমের মধ্যেই খৃষ্টধর্ম প্রচার করেছে। আকবরও তার পুত্র মুরাদের গৃহ শিক্ষক হিসেবে পর্তূগিজ পাদ্রি মনসুরেট’কে নিয়োগ দেন।(১০)
এই পাদ্রি যুবরাজ মুরাদকে তার প্রতিটি পাঠদানের শুরু করিয়েছেন; ‘পবিত্র ইশ্বর ও তার পুত্র পবিত্র আত্মা প্রভূ যিশু’র নামে শুরু করছি’ বলে(১১)
ফলস্বরুপ ১৬১০ খৃষ্টাব্দ নাগাদ আকবরের তিন নাতি প্রকাশ্যে খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত হলে ঘটা করে মোগল রাজপরিবারে তাদের সে ধর্মান্তকরণের খৃষ্টীয় অনুষ্ঠানও পালিত হলো।(১২)
১৫৭৯ সালে এসে আকবর ভারতীয় মুসলিম রাজাদের যুগপ্রাচিন ঐতিহ্য; ক্বাবা ঘর রক্ষণাবেক্ষণ ও হাজিদের খেদমতে মক্কা ও মদিনায় অর্থ প্রেরণের ধারাটা বন্ধ করেন(১৩)। মক্কায় এর পর থেকে আর কোনো অর্থ পাঠান নি। অথচ এই আকবরই অখ্যাত জনৈক খাজা হুসেন মারুই তার সামনে স্বরচিত একটি শের শুনালে খুশিতে তাৎক্ষণিকভাবে দুই লক্ষ রুপি এনাম দিলেন!(১৪)

তার এসব অনৈসলামিক কর্মকান্ডের বিরোধিতার কারণে বা সে সবের প্রতিবাদ করার চেষ্টা করায় দুই সুন্নী আলেম; মকদুম উল মুলক ও শেখ আব্দুন নবী, দুইজনকেই বরখাস্ত করলেন(১৫)। তার সেই কুখ্যাত দ্বীন-ই-ইলাহি তো তখনও প্রবর্তণই হয়নি!
মুক্তমনা মহামতি সামান্য বিরোধিতাও সহ্য করছেন না।  অথচ তিনিই মুক্তমনা!
তথ্যসুত্র:
১. The Muslim 100, Muhammad Mojlum Khan, পৃ: ৩০৮// ২. After Tamerlane. The Global History of Empire, John Darwin পৃ: ৮৫ // ৩. The Great Moghuls, Bamber Gascoigne পৃ: ৭১//  ৪. চেপে রাখা ইতিহাস, গোলাম আহমদ মুর্তাজা, পৃ: ৬৯ //  ৫. ঐ পৃ: ৭৪// ৬. ঐ, পৃ: ৭৪  // ৭. চেপে রাখা ইতিহাস, গোলাম আহমদ মুর্তাজা, পৃ: ২১২//  ৮. ঐ পৃ: ৯২ // ৯. Foundation of Islam, Alexander Walker. পৃ: ২৫৪//  ১০. The Great Mughals, Bamber Gascoigne পৃ: ১০৪//   ১১. ঐ// ১২. - ঐ, পৃ: ১০৫//  ১৩. ঐ, পৃ: ১০৭//  ১৪. পরাজিত সম্রাট ও  শরাহত সুহৃদ, শ্যামাপ্রসাদ বসু, পৃ: ২৮// ১৫. The Great Mughals, Bamber Gascoigne, পৃ: ৭৪।
--------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।             

Post a Comment

0 Comments