Recent Tube

দ্যা চয়েস ইজ ইউরস-১৩ঃ জিয়াউল হক।

                         দ্যা চয়েস ইজ ইউরস
                                         পর্ব-১৩,
                                   
     আব্দুল মুত্তালিব কর্তৃক পুত্র আব্দুল্লাহকে কুরবানি করতে নিয়ে যাবার ঘটনার প্রেক্ষাপটে পুরো মক্কাজুড়ে যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল, লটারির মাধ্যমে একশত উট যবেহ করে দেবার পরে সেই চাঞ্চল্যের অবসান হয়েছে। আব্দুল্লাহর জীবনাশংকা কেটে গেছে। 

     একদিন তিনি কাবা চত্তর থেকে হেঁটে আসছিলেন পথিমধ্যে ওয়ারাকা বিন নওফালের বোন উম্মে কিতাল রুকাইয়্যা বিনতে নাওফেল বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি তার ভাই ওয়ারাকা বিন নাওফালের কাছেই শুনেছিলেন, আব্দুল্লাহর ঔরসে এ উম্মতের নবী জন্মগ্রহণ করবেন। রুকাইয়্যার প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরে আব্দুল্লাহ জবাব দিয়েছিলেন, এ ব্যাপারে আমার পিতাই চুড়ান্ত ফায়সালা করবেন। আমি তাঁর মতামতের বিপরীত যেতে পারব না। 

    সমকালীন সময়ে টুকরো টুকরো এরকম বহু ঘটনা রয়েছে যা এ কথা তর্কাতিতভাবে প্রতিষ্ঠিত করে যে, সেকালে মক্কা ও তার আশেপাশের আরব গণমানস আসন্ন একজন নবীর আগমন যে অতি নিকটে কিংবা তিনি যে ইতোমধ্যেই জন্মগ্রহণ করে থাকবেন, সে কথাটা খুব দৃড়তার সাথেই বিশ্বাস করতো।

   জন্মভূমি ইয়াসরিব থেকে চারশত কিলোমিটারেরও বেশি দুরত্বে একই বাড়ির মধ্যে, জন্ম থেকেই পরিচিত ও একই সাথে বেড়ে উঠা সমবয়স্কা নিজেরই এক চাচাতো বোনের উপস্থিতি মা আমিনার সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা ও মানসিক সুস্থতার জন্য এক সহায়ক উপাদান হিসেবে কাজ করেছে, বিশেষ করে, এই কঠিন সময়ে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

    আমিনা নিজেও ছিলেন অত্যন্ত প্রখর ধীশক্তিসম্পন্না একজন নারী। সেটা তার শিশুকালে বান্ধবীর বাড়িতে খেলতে যাবার পথে সেই এক বৃদ্ধের হারিয়ে যাওয়া সোনার দিনার কুড়িয়ে পাওয়া এবং খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যাওয়া ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত বৃদ্ধকে তা ফিরিয়ে দিয়ে নিজ বাড়িতে ডেকে নিয়ে মাকে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে পেট পুরে খাইয়ে বিদায় দেবার ঘটনায় আমরা দেখেছি। 

    বাবা ওয়াহাব যুহরীও ছিলেন অত্যন্ত নরম মনের একজন মানুষ। সেটাও দেখেছি জন্মের দিন সর্বপ্রথমবারের মতো শিশু আমিনাকে কোলে নেবার পরে আবেগে উঠোনভর্তি মানুষের সামনে কান্নার ঘটনাতেই। সেই বাবারই সন্তান আমিনাও বাবার গুণ ধারণ করার পাশাপাশি মা বাররা বিনতে আব্দুল উযযা’র মতোই ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীলা আর বিচক্ষণ এক নারী।

     এরকম একজন নারী তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন ও একাকীত্বের এই কষ্টের সময়টাতে কাছে পেলেন একজন কিশোরীকে! এমন একজন কিশোরী, যে নিজ জন্মুভূমি, পরিবার পরিজন, বাবা-মা, ভাই-বোন ও আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে ছিনতাই কিংবা লুট বা বিক্রির মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন হয়ে এসেছেন অনেক দূরের এক জনপদে, অজানা, অচেনা এক পরিবেশে, একেবারেই একা। 

    হতাশায় ভেঙ্গে পড়ার, বিষণ্নতায় মুষড়ে পড়ার মতো সকল কারণ এই কিশোরীর জীবনে শতকরা একশত ভাগই বিদ্যমান ছিল। কারণ, হতাশাগ্রস্থ বিষণ্ন ও উৎকন্ঠিত হবার মাধ্যমে মানসিক রোগে আক্রান্ত হবার সকল কার্যকাকরণগুলো; বিচ্ছেদ, বঞ্চণা, একাকিত্ব ও বিরহের যন্ত্রণা (A sense of Deprivation, Detachment and Disassociation) তার (উম্মে আইমান) মধ্যে আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল অতি স্বাভাবিকভাবেই। 

     কিশোরী উম্মে আইমান কারো সহায়তা ও নির্দেশনা ছাড়াই সেই যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে বিগত কয়েকটা বছর কাটিয়েছেন, নিজের মতো করে তা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছেন। যদিও নিজ বাবা-মা, পরিবার পরিজন ও পরিবেশ তাঁর পক্ষে জীবনেও ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি মানবিক প্রবৃত্তির কারণেই। ফলে উম্মে আইমানের মধ্যে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার মতো মানসিক শক্তি ও বাস্তব অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছে। তাঁর চরিত্রের এই দিকটি আমরা পরবর্তিতে, বিশেষ করে, উহুদ যুদ্ধের সময় আরও পরিস্কার দেখতে পাবো।

   মা আমিনা তাঁর দাসী উম্মে আইমানের মতো ঠিক ততোটা না হলেও বিগত কয়েকটা মাস এক ধরনের মানসিক পীড়ন, একাকিত্ব, উৎকন্ঠার মধ্যে সময় কাটিয়েছেন। একাকিত্ব, বিরহ ও মানসিক স্নায়ুচাপ (Stress) এসে দানা বেঁধেছে তাঁর মনেও। 

     গর্ভকালিন সময়ে নারীরা সাধারণত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তাদের শরিরে হরমোনের তারতম্যের কারণে। শারিরিকভাবেও তারা সঙ্গতকারণেই দূর্বলতা অনুভব করে থাকেন। এ সময়টাই খুব ঝুঁকিপূর্ণ একজন নারীর জন্য। তা ছাড়া,  যিনি জীবনে প্রথমবারের মতো এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন, তাঁর জন্য এটা আরও কষ্টকর সময়। 

   সার্বিক বিবেচনায় এ সময়টাতে একজন গর্ভবতী নারীর বিশেষ ধরনের সেবা শুশ্রুষা, বিশ্রাম ও পুষ্ঠির প্রয়োজন পড়ে। মা আমিনার জীবনও এ বাস্তবতা থেকে কোনভাবেই ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। আর এর উপরে রয়েছে তাঁর জীবনের এই বিশেষ মহুর্তে স্বামীর অনুপস্থিতিজনিত মানসিক পীড়নের ঘটনাও।

   নি:সঙ্গতার এই দীর্ঘ সময়কালটা নি:সন্দেহে বড়োই কষ্টের ছিল তাঁর জন্য। এই কষ্টকে মনে ধারণ করেই তিনি দিন কাটিয়েছেন; প্রথমত স্বামী ফিরে আসবেন সহসাই, এই আশায়। আর সেই সাথে তাঁর মনে বিশেষ ধরনের এক অপার্থীব, অজানা, কিন্তু রোমাঞ্চকর আশা জাগানিয়ার ঘটনাও ঘটেছিল। 

    মানুষ যখন, যে কোন কারণেই হোক না কেন, নিংসঙ্গতা, আশাভঙ্গ হওয়া, স্নেহ-ভালোবাসা, আকর্ষণ, মনযোগ, প্রিয়জনের সঙ্গপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়, তখন তার ভেতরে এক ধরনের বিষণ্নতা দেখা দেয়। আধুনিক মনোবিজ্ঞানের ভাষায় আমরা ডিপ্রেশন বলে জানি এটাকে। এটা অতি স্বাভাবিক মানবিক প্রবৃত্তি। ব্যক্তির দোষ বা ত্রুটি, অপূর্ণতা কিংবা অপরাধ নয়। প্রতিটি মানুষ্ই জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে এরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। 

      এরকম অবস্থায়ও একজন ব্যক্তি মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারেন যদি তার সেই বিষণ্নতাকে তিনি নিজের মনস্তাত্তিক প্রক্রিয়ায় (মনোবিজ্ঞানের ভাষায়; ‘Coping Mechanism’ মানুষের এরকম প্রায় গোটা তিরিশেক মেকানিজম রয়েছে) মোকাবেলা করে নিজের জীবন স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে নিতে পারেন। 

    আর সেটা না হলে তখন সেই বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন তার স্বাভাবিক জীবন যাপন করাটাকে অসম্ভব করে তুলে। সে অসুস্থ হয়ে যায়। মানসিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় তখন সেটা ‘ক্লিনিকাল ডিপ্রেশন’ হিসেবে বিবেচিত হয়। অবাক কান্ড হলো; সকল উপাদানের উপস্থিতি থাকা সত্তেও মা আমিনার মধ্যে এই ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন দেখা দেয়নি! এর কারণ কি? (ক্রমশ, প্রকাশিতব্য গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপকৃত)
--------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।          

Post a Comment

0 Comments