Recent Tube

দ্যা চয়েস ইজ ইউরস-১৬ ; জিয়াউল হক।

                             দ্যা চয়েস ইজ ইউরস
                            পর্ব-১৬,
                                    
    ভিন্ন ধরনের এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো বৃদ্ধ আব্দুল মুত্তালিবের জীবনে। বিগত প্রায় চারটি দশক ধরে পুরো মক্কা তো বটেই সেই সাথে কুরাইশ বংশেরও আর্থিক অবস্থা ক্রমশই খারাপ হয়ে আসছিল। সকলেই এ অবস্থার শিকার হয়েছেন। মিলে মিশে তা মোকাবেলাও করছেন। 
তবে এ পর্যায়ে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে যে দূর্যোগটা নেমে এলো প্রিয় সন্তানের অকাল মৃত্যুতে, তার জন্য তিনি আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। জীবনের এ প্রান্তে এসে অন্তরটা তার ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। তিনি মুষড়ে পড়লেন। 

    আরও একটা বিষয়, সেটা হলো, একজন মানুষের অতি স্বাভাবিক মানবিক মনস্তত্ব। আব্দুল মুত্তালিব কি প্রিয় পুত্র আব্দুল্লাহর অকাল মৃত্যুর জন্য নিজের মনে কোন ধরনের অপরাধবোধে ভুগেছেন? মাত্র দু’সপ্তাহের নববিবাহিতা স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে প্রায় চার থেকে পাঁচ মাসের দীর্ঘ, কষ্টকর ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সফরে পাঠিয়েছেন তিনি তাঁর একক স্বিদ্ধান্তে। 

    ক্রমাবনতিশীল আর্থিক অবস্থার মুখোমুখি হয়ে আাগমি প্রায় একটা বছরের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার ও রসদের জন্য না পাঠিয়ে কোন উপায়ও ছিল না। কারণ এটাই ব্যবসার সিজন। মক্কা ও তার আশে পাশে, তথা, পুরো হেজাজের জীবনযাত্রাই নির্ভর করতো এই সিস্টেমের উপর। শাম ফিলিস্তিন থেকে গ্রীষ্মের এই সময়টাতে খাদ্যদ্রব্য ও ইয়াসরিব থেকে খেজুর’সহ নানা খাদ্যদ্রব্য প্রতিবছরই আনা হয়, এবারেও তার কোন ব্যতিক্রম ছিল না। শীত শুরু হলে বরফ ঢাঁকা শামে যাওয়া মক্কার লোকজনের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।

      আব্দুল মুত্তালিব কি মা আমিনার কাছে নিজেকে অপরাধী ভাবতেন? তেমন কোন তথ্য ও চিত্র আামদের সামনে নেই নিশ্চিত করে বলার মতো। কিন্তু মানবিক মনস্তত্বের দিকটি বিবেচনা করলে এমন একটা সম্ভাবনা অবান্তর নয়। আমরা বরং সেটা জানার জন্য উভয়ের পারস্পরিক আচরণের দিকে মনযোগ দিতে বাধ্য হই। মাস দু’য়েকের মধ্যেই মা আমিনার সাথে আব্দুল মুত্তালিবের একদিনের একটা আচরণের মধ্যে দিয়ে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যাবে আমাদের সামনে।

     আব্দুল্লাহ যখন ইন্তেকাল করেন, তখন আব্দুল মুত্তালিবের বয়স ছিল প্রায় চুয়াত্তর বছর। এ বয়সেও তাঁর স্বাস্থ্য অপেক্ষাকৃত অনেকটাই শক্ত সামর্থ ছিল। তিনি মক্কার সমকালীন অন্যান্য সমবয়স্কদের মতো মানসিক দূর্বলতায়ও ভুগতেন না। জন্ম থেকেই তিনি অত্যন্ত উন্নত বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। আর তার পাশাপাশি সম্ভবত এর সবচেয়ে বড়ো কারণ ছিল,  জীবনেও কোন ধরনের মদ বা মাদকজাতিয় পানীয় সেবন করেননি। এর ফল তিনি সারাজীবনই পেয়েছেন।

     তাঁর সন্তান আব্দুল্লাহও ছিলেন অত্যন্ত সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী। কোনরকম জানা রোগ তার ছিল না। তিনি (আব্দুল্লাহ) ছিলেন বাবা আব্দুল মুত্তালিবের মতোই অত্যন্ত সুঠাম ও কর্মঠ। দেখতেও অত্যন্ত সুশ্রী, সুদর্শন, লম্বা, কালো গোলাকার চোখ ও খাড়া নাক বিশিষ্ঠ। 

      যতোই সুস্বাস্থ্যের অধিকারি হোন না কেন বৃদ্ধ আব্দুল মুত্তালিব, পুত্রের মৃত্যু তাঁকে নিদারুণভাবে মুষড়ে দিয়েছে। মানসিকভাবে তিনি বড়ো কষ্টের মধ্যে নিপতিত হয়েছেন। আমাদের কাছে এমন কোন তথ্য নেই, যা প্রমাণ করে যে, আব্দুল মুত্তালিব তাঁর সন্তানের কবর দেখতে, নিজের মনকে শান্তনা দিতে ইয়াসরিবের সেই ‘দার আন নাবিঘা’ গিয়েছিলেন। 

      বস্তুত চুয়াত্তর বছরের একজন বৃদ্ধের পক্ষে মরুভূমির রুক্ষ ও বৈরি পরিবেশের মধ্যে দিয়ে চারশত কিলোমিটারেরও বেশি পথ পাড়ী দেয়া সম্ভবপর ছিল না। এমনকি, উটের পিঠে হাওদায় বসেও ঐ বয়সের একজন মানুষের পক্ষে নিরাপদ নয়, বিশেষ করে, বছরের ঐ সময়; ডিসেম্বর মাসে।। কাজেই ইচ্ছা ও আবেগ থাকলেও সঙ্গত কারণেই তাকে তা দমন করতে হয়েছিল।

      এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। পুরো আরব উপদ্বীপের যে জীবনচিত্র, যে সমাজব্যবস্থা ও জীবন ধারনের যে পদ্ধতি সেটাও আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে থাকা উচিৎ। এতে করে ইতিহাসের গতিপ্রকৃতির সাথে আমাদের আত্মিক সম্পৃক্ততা তৈরি করে নেওয়া সহজ হবে এবং ইতিহাসকে সঠিক অবয়বে উপলব্ধী করা যাবে। ইতিহাসের উৎসাহী পাঠক বা গবেষক, প্রত্যেকের জন্য এই আত্মিক সম্পৃক্ততা তৈরি করে নেয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সফল ইতিহাস পাঠের জন্য অপরিহার্য।

      আব্দুল্লাহ শাম থেকে ফেরার পথে অসুস্থ হয়ে ইয়াসরিবে প্রায় এক মাস চিকিৎসা নিয়েও ইন্তেকাল করেছেন। পুরো ঘটনাপ্রবাহকে বিশ্লেষণ করে দেখলে আমরা দেখতে পাই যে, আব্দুল্লাহ ডিসেম্বর মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে ইন্তেকাল করেন। তার আগে পুরো একমাস তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার মানে তিনি নভেম্বর মাসের প্রথমদিকে ইয়াসরিবে পৌছান। আর সে জন্য অক্টোবরের প্রথম দিকেই তাঁকে শাম থেকে রওয়ানা দিতে হয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ, ঐ সময়টাতে শামে ঠান্ডা পড়তে শুরু করে। ভোর রাতের দিকে মরুভুমিতে ঐ সময় তাপমাত্রা প্রায় শুন্য বা তার কাছাকাছি চলে আসে। ছেলের ইন্তেকালের খবর আব্দুল মুত্তালিব পেয়েছেন জানুয়ারি মাসের একেবারে শুরুর দিকে, সম্ভবত প্রথম সপ্তাহেই। 

      মরু আরবের আবহাওয়া, পরিবেশ ও প্রকৃতির বাস্তবতা আমাদের সামনে থাকা উচিৎ। সে সময়ে, মরুভূমিতে দীর্ঘ সফরে যাওয়া আসার সময় কাফেলার অধিকাংশ মৃত্যু ঘটতো যে ক’টি কারণে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, গ্রীষ্মকালে হিটস্ট্রোক, মরুঝড়ে পড়ে পথ হারিয়ে ফেললে পানির অভাবে, ডিহাইড্রেশন ও সাপের কামড়ে। আর শীতকালে নিউমোনিয়া এবং পেটের পীড়ায় এবং শীত বা গ্রীষ্ম উভয় সময়েই উটের পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়ে কিংবা পথিমধ্যে ডাকাতের হাতে।

      ইতিহাসের এই বাস্তবতা আমাদের সামনে এ কথাটা প্রতিষ্ঠিত করে দেয় যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব হিট স্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করেন নি। তিনি জ্বরে ভুগেছেন মৃত্যুর আগে। আর সেই জ্বর প্রায় মাসব্যাপী কাল চলেছে। তার মানে  তিনি হিটস্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করেননি। কারণ সেটা ছিল শীতকাল, ডিসেম্বর মাস, এ সময়টাতে হিটস্ট্রোক হবার কথা নয়। খুব সম্ভবত তিনি নিউমোনিয়া কিংবা চেস্ট ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। (ক্রমশ, প্রকাশিতব্য গ্রন্থ থেকে সংক্ষিপ্তকৃত)
--------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা, গীতিকার ও বিশ্লেষক            

Post a Comment

0 Comments