দ্যা চয়েস ইজ ইউরস
পর্ব -২৮;
এটা ছিল এক চমৎকার এক জোস্নারাত । পূর্ণিমার রাত নয়, চাঁদের একাদশতম রাত, তথা, একাদশীর রাত। রাতের প্রায় পুরোটাজুড়েই জোৎস্নার আলো বিদ্যমান থাকার কথা। ভোরের দিকে মা আমিনা সন্তান প্রসব করলেন। এ ব্যাপারে মা আমিনার একটা বক্তব্য ইবনে সা’দের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রফেসর জাকারিয়া বশির তাঁর সিরাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এভাবে; ছেলেটা যখন আমার গর্ভ থেকে আলাদা হয়ে গেল (অর্থাৎ ভূমিষ্ঠ হলো) তখন আমি তাঁর শরির থেকে বিচ্ছুরিত আলোতে চতুর্দিক আলোকিত হয়ে যতে দেখলাম। (সুত্র: The Life of the Prophet in Makkah, Zakaria Bashier, পৃ: ৫০)।
ঠিক একইরকম একটা হাদিস ইবনে সা’দের বরাত দিয়ে ড: জাকারিয়া তাঁর ঐ একই গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, যেখানে নবী সা. বলছেন; জন্মমহুর্তে আমার শরির থেকে বিচ্ছুরিত আলোতে আমার মা বুসরা’র (সিরিয়া একটি শহর) রাজপ্রাসাদকে আলোকিত হতে দেখতে পেয়েছিলেন। (সুত্র: ঐ )
আমার ক্ষণিকের জন্য এ পর্যায়ে আবারও মা আমিনার এই মহুর্তের মানসিক অবস্থাটা আরও একটু পর্যালোচনা করে দেখতে চাই। সন্তান পেটে থাকাবাস্থায়ই তাঁর প্রিয়তম স্বামী দূর প্রবাসে গিয়ে আর ফিরে আসেননি, মৃত্যুবরণ করেছেন। অনাগত এই সন্তান চীরদিনের জন্যই তার বাবা হারালো এবং সে সন্তানকে মানুষ করে তোলার এক দুরুহ কাজ তাঁকে একাই পালন করতে হবে তার জন্মমহুর্ত থেকে। ঐ সমাজে তাঁর মত একজন নারীর পক্ষে সেটা এক দুরুহ কাজ।
এই অনিশ্চিত পরিস্থিতি তাঁকে বিচলিত করার কথা। বস্তুত স্বামীর দু:খজনক মৃত্যুর পরে তাঁর যে মানসিক ও শারিরিক অবস্থা তৈরি হয়েছিল, সেটা তাঁর মনের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সেই ঝড়কেই ইংগিত করে। আর তাঁর মতো একই পরিস্থিতিতে পড়লে যে কোন নারীর পক্ষেই এরকম দূর্বিষহ পরিস্থিতি তৈরি হওয়াটা অতি স্বাভাবিক ঘটনা।
এরকম অবস্থায় নিপতিত একজন নারীকে শান্তনা দেয়াটা পৃথিবীর কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভবপর নয়। এ সময় মা আমিনার মানসিক দৃড়তা বজায় থাকতে সহায়ক হয়েছিল তিনি যে বেশকিছু স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর অনাগত সন্তানকে নিয়ে সে সব বিষয়গুলো।
প্রথমত তিনি বুঝতেই পারেননি যে, তিনি সন্তানসম্ভবা, তথা, গর্ভবতী হয়েছেন। নিজের ঋতুবন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে সংশয়ের মধ্যে নিপতিত ছিলেন এবং মনে করেছিলেন কোন কারণে এটা অনিয়মিত হয়ে পড়ছে, হয়তো খুব শীঘ্রই তা আবার পূনরায় শুরু হবে (এ সংক্রান্ত উদ্ধৃতি ও তথ্যসুত্র আমরা ইতোপূর্বেই উল্লেখ করেছি)।
স্বপ্ন মারফত তিনি কেবল তার গর্ভবতী হবার খবরই পাননি, তাঁর গর্ভস্থ সেই অনাগত সন্তান যে একজন পুত্র সন্তান এবং তিনি যে মানব প্রজাতির জন্য বিশেষ উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন একজন হবেন, সেরকম পরিচয়ও জানানো হয়েছে। তাঁকে বিশেষ দোওয়াও শিখিয়ে দেয়া হয়েছে অনাগত সেই সন্তানের মঙ্গল কামনায় নিয়মিত সেই দোওয়াটা পড়ার জন্য।
এর পাশাপাশি তাঁর জন্য সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় ছিল যেটা, তা হলো, একজন গর্ভবতী নারী গর্ভকালিন সময়ে যেসব নানারকম শারিরিক কষ্ট, ক্লেশ ও সীমাবদ্ধতার ভেতর দিয়ে যান, তার কোনটাই মা আমিনা নিজের ভেতরে দেখতে পাননি, উপলব্ধিও করেননি।। অত্যন্ত সহজ ও সাবলিল গর্ভ ছিল তাঁর।
এসব অনুকূল ও বিশেষ বৈশিষ্ঠমন্ডিত পরিস্থিতি যে তাঁর মনের ভেতরে অনাগত এতিম সন্তানের বিশেষত্ব, তার মর্যাদা এবং নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে সকল প্রকার অনিশ্চয়তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে তদস্থলে বরং উৎকন্ঠা ও দু:শ্চিন্তাহীন একধরনের প্রশান্তময় মানসিক অবস্থার সৃষ্টি করেছিল, তার প্রমাণ আমরা দেখতে পাই আবরাহা কর্তৃক কাবা আক্রমণের পূর্বমহুর্তে বাড়ি ঘর ছেড়ে পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিতে আব্দুল মুত্তালিবের নির্দেশের জবাবে খুব দৃড়তা আর নিরুদ্বিগ্নতার সাথে তাঁকে এই বলে জবাব দেয়া যে; ‘আমি কোথাও যাবো না, আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আবরাহা কাবা ধ্বংস করতে পারবে না’ (সুত্র: barakah.co.uk )।
এ বিষয়টি সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী (২০০১ খৃষ্টাব্দে) ফরাসি আমেরিকান নওমুসলিম Theresa Corbin কর্তৃক লিখিত ‘A Spotlight on Strong Female Companions of the Prophet’ শীর্ষক নিবন্ধেও তিনি তথ্যসুত্র’সহ উল্লেখ করেছেন ( দ্রষ্টব্য: aboutislam.net)।
আবরাহা কর্তৃক কাবা আক্রমণ করতে এসে শোচনীয় পরিণতি ভোগ করে ফিরে যাওয়ার পর ইতোমধ্যেই পঞ্চাশটি দিন অতিক্রম হয়ে গেছে। সে ঘটনার পঞ্চাশ দিন পরে আজ রাতের শেষ প্রহরে তিনি যে সন্তানকে ভুমিষ্ঠ করলেন, সেটা একজন পুত্র সন্তান। আর সন্তান জন্মের সাথে সাথে তিনি যে অস্বাভাবিক আলোর বিচ্ছুরণ দেখলেন সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের শরির থেকে, এগুলো সাধারণ কোন ঘটনা নয়।
এসবের প্রতিটিই ইতোপূর্বে তার দেখা স্বপ্নগুলোকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দিতে থাকে তাঁর মনে। এসব ঘটনা নি:সন্দেহে তাঁকে মানসিক প্রশান্তি যুগিয়েছে স্বামীহারা বিধবা হিসেবে এতিম সন্তান জন্মদানের সেই আবেগময় মহুর্তে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সন্তান ভূমিষ্ঠের পরে উম্মে আইমান মা আমিনার নির্দেশে দ্রুত গিয়ে আব্দুল মুত্তালিবকে খবরটা দিলেন। তিনি সেই মহুর্তে বাড়িতে ছিলেন না, কাবা চত্তরে অবস্থান করছিলেন (সুত্র: The Life of Muhammad. Muhammad Husayn Haykal পৃ: ৪৩)।
এ তথ্য আমাদেরকে নিশ্চিত করে যে, মা আমিনা যখন সন্তান প্রসব করেন, তখন রাত প্রায় শেষ হবার পথে। মক্কায় এপ্রিল মাসের ২০ বা ২১ তারিখে ফজরের নামাজের সময় হয় ভোর ৪টা ৩৮ মিনিটে এবং সূর্য উঠে ৫ টা ৫৭ মিনিটে।
সেই হিসেবে আমরা নিশ্চিত করেই বলতে পারি তিনি জন্মেছেন ১১ই রবিউল আওয়াল, ভোর রাতে, ভোরের আলো ফোটার অব্যবহতি পুর্বে, প্রায় সাড়ে চারটার দিকে। দিনটা ছিল সোমবার, ২০ শে এপ্রিল, ৫৭১ খৃষ্টাব্দ। (ক্রমশ) (নোট: দ্বিতীয় ছবিতে লালচিন্হিত বাড়িটিই আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের বাড়ি। এখানেই প্রিয় মুহাম্মদ সা. জন্মেছেন।)
-------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।
0 Comments