Recent Tube

জাতীয় সংগীতের সুর নকল করে ইসলামী সংগীত রচনা ও পরিবেশন করায় মাদরাসা বন্দ ও জতীয় সংগীত রচনার তথ্যমূল নিয়ে যৌক্তিক পর্যালোচনা। ---- মনির আহমদ মনির।

জাতীয় সংগীতের সুর নকল করে ইসলামী সংগীত রচনা ও পরিবেশন করায় মাদরাসা বন্দ ও জতীয় সংগীত রচনার তথ্যমূল নিয়ে যৌক্তিক পর্যালোচনা। 
--------------------------------- 
  
জাতীয় সংগীতের সুর নকল করে ইসলামী সংগীত (হামদ) পরিবেশনের কারণে একটি মাদ্রাসার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। কোন কোন সূত্র মতে অন্য  কারণ দেখিয়ে স্থগিত করা হলেও সুর নকলের কারণে পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অভিষেক দাস।[১]

আমাদের মতেও সুর নকলের বিষয়টি সমর্থনযোগ্য নয়, ইসলামী সংগীতের সুরেরও স্বকীয়তা রক্ষা জরুরি,  এ জাতীয় কাজ অবশ্যই বর্জনীয়। তবে এই ঠুনকো অজুহাতে মাদ্রাসার কার্যক্রম স্থগিত করা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

তবে মজার বিষয় হলো, যে গানের সুর নকল করা নিয়ে আলাপ হচ্ছে সে গান তথা রবী ঠাকুরের 'আমার সোনার বাংলা' গানের সুরও রবী ঠাকুরের নিজস্ব নয়! বরং এই গানের সুর নকল (চুরি পড়তে পারেন) করা হয়েছে বাউল শিল্পী গনন হরকরার 'আমি কোথায় পাবো তারে' গান থেকে। হরকরার মৃত্যুর তিন দশক পর রবীন্দ্রনাথ ' আমার সোনার বাংলা' গানটি রচনা করে নিজেই গীতিকার ও সুরকার বনে যান। এমনকি "মরি হায় ...হায় রে...'' কলিটুকুও হরকরার গানে রয়েছে, সেখান থেকে ঠাকুর কলিটি চুরি করে ' আমার সোনার বাংলা গানে নিজের নামে চালিয়ে দেন।[২]

বাংলাদেশের অনেক মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথের 'আমার সোনার বাংলা' গানকে জাতীয় সংগীত হিসেবে রাখার বিষয়ে প্রবল আপত্তি আছে, এর কারণ হিসেবে অনেকে গানটি রচনার পেছনে বাংলাদেশ স্বার্থ বিরোধী ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সামনে আনেন। অনেকে জাতীয় সংগীত হিসেবে বিকল্প গানের নাম প্রস্তাব করেন। 

এ পর্যায়ে আমরা 'জাতীয় সংগীত' বিষয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো, আজ থেকে ১০০ বছর আগে এ অঞ্চলের মানুষের জাতীয় সংগীত কি ছিলো? বা ১০০০ বছর আগে? অথবা তার আগে? সহজ উত্তর হলো কোন জাতীয় সংগীতই ছিলো না! মাত্র কয়েকশ বছর আগেও বিশ্বজুড়ে জাতীয় সংগীত ধারণার অস্তিত্ব ছিলো না। তাহলে বর্তমান পৃথিবীর ভূখণ্ড ভিত্তিক জাতীয়তা নির্ভর প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজেস্ব 'জাতীয় সংগীত' তৈরির হেতু কী? মানব সভ্যতার ইতিহাসে যার কোন প্রয়োজনীয়তা ও অস্তিত্বই ছিলো না তাকে ঊনিশ শতকে এসে কেন বিশ্ব জুড়ে অপরিহার্য মনে করা হচ্ছে? কেনো এর সাথে পবিত্রতা আরোপ ও ভক্তি প্রদানে বাধ্য করা হচ্ছে। কেন এই সংগীত গাওয়ার সময় দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করতে হয়? এ প্রশ্ন গুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি। 

এই সেকুলার জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভবের পূর্ব পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে জাতি নির্ধারিত হতো ধর্ম পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে। দেশ/শহরের পরিচয় ব্যবহৃত হতো কেবলমাত্র পরিচয়ের সুবিধার্থে; জাতীয়তা হিসেবে নয়। তখন মানুষের জাতীয়তা ছিলো মুসলিম, হিন্দু, ইহুদী ইত্যাদি। কিন্তু বর্তমান সেক্যুলার রাষ্ট্র সমূহের মানুষের জাতীয়তা নির্ভর করে ভূখণ্ডের উপর ভিত্তি করে। যেমন: বাংলাদেশি, ভারতীয়, পাকিস্তানি ইত্যাদি। সেক্যুলার রাষ্ট্র যেহেতু সাংবিধানিক ভাবে সকল ধর্মের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে তাই রাষ্ট্রের মানুষদের ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার পরিবর্তে ভূখন্ড ভিত্তিক জাতীয়তার সৃষ্টি করে, এতে কার্যত বিলুপ্ত হয়ে যায় ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা। সেক্যুলার জাতি রাষ্ট্র ভূখণ্ড ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রসারে জন্য জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা, জাতির পিতা, জাতীয় দিবস,সৌধ ইত্যাদি ধারণা আরোপ করে। যাতে রাষ্টের নানাধর্মের, ভাষার, লিঙ্গের মানুষেরা একটি কমন আইডেন্টিটি ও নিজেদের মধ্যে মিল খুঁজে পায়। শত্রু-মিত্র নির্ণীত হয়  ভূখণ্ড ভিত্তিক রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে। প্রতিটি ধারণার সাথে যুক্ত হয় সাংবিধানিক মর্যাদা ও বিধিনিষেধ। এভাবে ধর্মরাষ্ট্রকে রিপ্লেস করে সেক্যুলার রাষ্ট্র নিজেই নয়া ধর্ম রাষ্ট্রের মতো আবির্ভূত হয়।

অপরদিকে ইসলামী রাষ্ট্রে অথবা অন্যান্য ধর্ম রাষ্ট্রে জাতীয় সংগীতের প্রয়োজন পড়ে না। জাতীয়তা যেহেতু ধর্মের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে তাই মুসলিম জাতির অংশ হতে হলে যেকোন ভাষা, বর্ণ বা ভূখণ্ডের মানুষ হোক না কেন পবিত্র কালেমার স্বীকারোক্তির মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারা যায়। আর ধর্মের ভিত্তিতেই ঐক্যের বন্ধন গড়ে উঠে। তবে ইসলামী রাষ্ট্রেও পতাকা ও জাতির পিতার ধারণার অস্তিত্ব আছে যাতে পরিচয় ও  জাতীয় মেলবন্ধন দৃঢ় হয়। ইসলামী রাষ্ট্রের পতাকা ছিলো কালেমা খচিত পতাকা। এবং মুসলিম জাতি তাদের জাতির পিতা হিসেবে পয়গম্বর ইব্রাহিম আঃ-কে স্বরণ করেন।

ইসলাম বর্ণবাদের মতো ভূখণ্ড বা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ধারণাকেও ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব যেমন দেহের বর্ণের উপর নির্ধারণ করা অন্যায়। ঠিক তেমনি ভূখণ্ডের জন্মগত বা ভাষাভিত্তিক পরিচয়ের উপর নিজেকে অপরের চেয়ে উত্তম মনে করা বা নিজের অঞ্চল অপর অঞ্চলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ দাবি করাও ভ্রান্ত চিন্তা ও অন্যায়। ইসলামে মানুষের ভালো-মন্দ নির্ধারণের মাপকাঠি হচ্ছে তার কর্ম। এখানে আরবের উপর অনারবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই, আবার অনারবের উপর আরবেরও শ্রেষ্ঠত্ব নেই।

ধর্মহীন রাষ্ট্রের জন্য নিজস্ব জাতীয় পতাকা, নিজস্ব জাতির জনকের মতো নিজস্ব জাতীয় সংগীতের প্রয়োজন হয়, কেননা এখানে রাষ্ট্রের টিকে থাকার জাতীয়তাবাদের চর্চার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে যতই মুসলিম লেখক বা বাংলাদেশি লেখকের দেশপ্রেম নির্ভর জাতীয় সংগীত নির্ধারণ করা হোক না কেন তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাতিয়তাবাদের প্রসার ও সেকুলার জাতি রাষ্ট্রকেই সুসংহত করবে। এবং সত্যনির্ভর বিশ্বরাষ্ট্র গঠনের পথে প্রতিবন্ধকতাই তৈরি করবে। তাই বাইরে থেকে আরোপিত ভ্রান্ত দর্শনের মধ্যে ঘুরপাক না খেয়ে এর থেকে পরিত্রাণ পেতে বিদ্যমানতাকেই প্রশ্ন করতে শেখা জরুরি।
[তথ্যসূত্র কমেন্টে দেখুন]
--------------------------------------------------------------- 
লেখকঃ  ইসলামিক  আর্টিকেল  লেখক  ও  অনলাইন  এক্টিভিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments