Recent Tube

দ্যা চয়েস ইজ ইউরস; --- জিয়াউল হক।

            দ্যা চয়েস ইজ ইউরস
                                 পর্ব- ৩৫;
                                             
      ওকাজ মেলা ছিল বাৎসরিক ও প্রধান জমকালো আয়োজন। বায়তুল্লাহতে আসার পথে বিভিন্নস্থানে নানারকম মেলা আয়োজনের মাধ্যমে জনসমাগম নিশ্চিত করা হতো। বায়তুল্লাহ জেয়ারতে আগত সবাইকেই কোন না কোন মেলায় অংশ নিতেই হতো। মেলাগুলোর আয়োজন হতো কোন না কোন দেব-দেবীর উপাসনা ঘিরে। সমকালীন যুগের সাংস্কৃতিক ধারা অনুযায়ী কবিতা, কাসিদা এসবের আয়োজনও হতো। দূর দূরান্ত হতে আসতো কবি সাহিত্যকরাও।

      আমাদের দেশেও মাঝে মাঝে নানা নামে বেনামে বাণিজ্যমেলা বসে। কয়েক দশক আগে প্রতি বছর জেলায় জেলায় আয়োজন করা হতো বার্ষিক এক্সিবিশন বা বাণিজ্য মেলার। সেখানে নানারকম স্টল বরাদ্দ হতো। আমোদ প্রমোদেরও ব্যবস্থা থাকতো। জুয়ার আসরও বসতো। প্রকাশ্যে বা গোপনে পান ও পানীয়ের সরবরাহও থাকতো।

      ওকাজ মেলা হতো তায়েফের কাছে। সেখানেও জড়ো হতো সারা আরবের নানা প্রান্ত থেকে আসা কবি সাহিত্যিকরা। তাদের শত শত কবিতা উপস্থাপন করা হলে তার মধ্য থেকে নির্বাচিত কিছু কবিতা পড়ে শোনানো হতো। পঠিত কবিতাগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে নির্বাচিতগুলোকে প্রকাশ্যে টানিয়ে দেয়া হতো।

     যেসব কবিদের কবিতা টানানো হতো, তারা ঐ সমাজে অত্যন্ত সম্মানের হিসেবে বিবেচিত হতো। ইমরুল কায়েস, লাবিদ, যুহায়ের’সহ অনেক কবির নাম ও তাদের সৃষ্টি আজও বিখ্যাত হয়ে আছে একারণেই। ইতিহাসের পাতায় ‘সাবা’আ মুয়াল্লাকা’ হাজার বছর পেরিয়ে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।

      এইসব মেলায় নিজ নিজ গোত্রের পক্ষ থেকে নেতৃত্বে মিছিল’সহ ঘটা করে উট বা ঘোঁড়া সাঁজিয়ে নানারকম উপহার, উপঢৌকন নিয়ে হাজির হতো। গোত্রনেতাদের পক্ষ থেকে প্রদত্ত এইসব উপহার আর উপঢৌকনের রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। 

      গোত্রভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় সেটা ক্ষমতা সংহত করা বা না করায় নিয়ামক ভূমিকা পালন করতো। এ কারণে ক্ষমতা হস্তগত করতে বা নিজেদের ক্ষমতা সংহত রাখতে প্রতিটি গোত্রনেতারা সব সময়ই সচেতন থাকতেন কিংবা তেমনটা থাকতে বাধ্য হতেন। 
বিভিন্ন গোত্রের পক্ষ থেকে আগত প্রতিটি মিছিলে থাকতো পতাকা, রং বেরং এর সাজ সজ্জা। এইসব উপহার, উপঢৌকনের কাঁচামাল সরবরাহ ও প্রস্তুত, বিপণন ও বিক্রয় করার মাধ্যমে স্থানীয় অনেক কর্মী, শিল্পী ও ব্যবসায়ীদের আয় রোজগারের ব্যবস্থা হয়ে যেতো।

    মেলাকে কেন্দ্র করে বসতো গণকদের আসর। সারা আরবের নামকরা গণকের এই সময় এসে জড়ো হতো মেলাতে। নিজ নিজ স্টল বসাতো। অপরদিকে ভাগ্য গণনার জন্যও মেলায় আসতো অনেকে। সেটাও করতে হতো পয়সার বিনিময়ে। তীর নিক্ষেপের মাধ্যমেও ভাগ্য গণনা হতো। দক্ষ তীরন্দাযের চাহিদা ছিল সে কারণেই। আরবরা এমনিতেই তীরন্দায হিসেবে সূনামের অধিকারী ছিল বরাবরই।

    আগত অভ্যাগত দেশি বিদেশি সকলের জন্য বিনোদনের জন্য নাচ গানের আসর জমতো অতি অবশ্যই। গায়িকা ও নর্তকী সরবরাহ হতো নানা অঞ্চল থেকে। গায়ক গায়িকা ও নর্তকী ছাড়াও তারে সরবারের হন্য সে কাজেও অনেকে জড়িয়ে থাকতো অর্থ আয়ের জন্য।

    জুয়ার আসরটায় জুয়াড়িরা জড়ো হতো। জমজমাট আসর। আর তার সাথে অতি অবশ্যই থাকবে সিরিয়ার বিখ্যতা মদ। আঙ্গর থেকে উৎপাদিত সিরিয়ান মদের চহিদা আরবের কাছে খবুই বেশি ছিল। এর পাশাপাশি নিজেদের খেজুর থেকে প্রস্তুতকৃত মদতো ছিলই। এই সময়টাতেই নিজে মদ পান আর বন্ধু বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনদের মদ উপহার দেয়াটা ছিল বহুল প্রচলিত সামাজিক আচার।

    দূর দূরান্ত হতে ব্যবসায়ীরা আসতেন এই সময়কে টার্গেট করে এই সব মেলায় আরবের বিভিন্ন পাহাড় থেকে যে সব রং বেরং এর দামী পাথর বিক্রির জন্য উঠতো, সেগুলো কেনার জন্য। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে এরকম দূর্মূল্য সব পাথর সংগ্রহ করা আর সেগুলোকে কেটে কেটে বাজারে তোলার জন্য উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য একদল লোক সারা বছর ব্যস্ত থাকতো। সেভাবেই তাদের আয় রোজগারের ব্যবস্থা হতো। এটা একটা পেশা হিসেবেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

    বছরের এই সময়টাতে আরবরা চেষ্টা করতো নানা প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীদের টানতে। এতে তারা খুবই দক্ষ ছিল। দূর দূরান্তের ব্যবসায়ীরা যেন আসে এবং তাদের পণ্য আরবের বাজারে তুলে, সে জন্য তারা সব সময়ই সচেষ্ট থাকতো।

    সেই প্রচেষ্টারই অংশ হিসেবে এইসব মেলায় অতি অবশ্যই থাকতো যৌনতার ছড়াছড়ি। আরব গোত্রনেতারা নিজেদের দাসীদের দিয়ে যৌন ব্যবসা করাতো বাড়তি আয়ের জন্য। এটা ছিল অনেকেরই বাড়তি আয়ের অন্যতম মাধ্যম। বাইরে থেকে আগত ব্যাবসায়ী বা পর্যটকদের মনোরঞ্জন ও বিনোদনের অন্যতম উপাদান ছিল এই যৌনতা।

        বিদেশী বণিকরা নিজেরা বা তাদের পক্ষ থেকে তাদের বাণিজ্য প্রতিনিধিরা বিদেশী পণ্য সামগ্রী হাজির করতেন এইসব মেলায়। এর সাথে ছিল দাসব্যবসা। বিভিন্ন আরব অঞ্চলতো বটেই, এমনকি, লোহিত সাগর পারের দেশ থেকে, তথা, আফ্রিকার সুদান, ইথিউপিয়া ও তৎসংলগ্ন এলাকা এবং বাইজান্টাইন শাসিত এলাকা থেকেও আসতো দাস দাসী। এদের মধ্যে সন্দুরী নারীদের বেশ কদর ছিল এই সময়টাতে। খুব উচ্চমূলে বাজারে বিক্রি হতো তারা। মক্কার বহু আরব গোত্র ও গোত্রনেতারা এইসব দাসদাসী বেচা কেনার সাথে জড়িত ছিল।

    এসব ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তো আসতোই। সিল্করুট ধরে আসা চীনা ও পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল থেকে আগত সিল্ক ও সুগন্ধী, ভারতীয় মশলা, তুর্কিস্থান, তুর্কমেনিয়া ও আধুনিক তুরস্কের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত উন্নত মানের চামড়া, বসরা ও ইরাক থেকে আগত উন্নতমানের তরবারি, ঢাল ও ছোরা ছিল খুবই চাহিদাসম্পন্ন পণ্য। আরবের লোকজন এসব পণ্যের জন্য মুখিয়ে থাকতো সারাটা বছর। সঙ্গতকারণেই ব্যাবসায়ীরাও তাদের সরবরাহকে নিশ্চিত করতে তৎপর থাকতেন। (ক্রমশ, সংক্ষেপকৃত)।
------------------------------------------------------------- 
লেখকঃ  ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক 

Post a Comment

0 Comments