Recent Tube

না, তুরস্ক মরে যায় নি। আপনাদের স্বপ্ন পূরণ হবার নয়। --- জিয়াউল হক।


না, তুরস্ক মরে যায় নি। আপনাদের স্বপ্ন পূরণ হবার নয়। 
----------------------------------------------------------

   ইংল্যন্ডের সাউথাম্পটন ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক  J M Roberts  গিয়েছিলেন কেনিয়াতে। বিশ্বসেরা ইতিহাস গবেষক হলিডেতে গেলেও সাথে নিয়ে গেছেন গবেষকের দুটো চোখ, একজন গবেষকের কান। 

. সমুদ্র উপকূলে পেপসির একটা খালি ক্যান উপকুলে নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে প্রচন্ড বেগে বাতাসের সাথে এদিক ওদিক ছুটে যাচ্ছে। আর পাথরের সাথে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে এক ধরনের আওয়াজও করছে।

     রবার্টস একদন্ড থেমে নুড়ি পাথরের সাথে খালি ক্যানটির নিরন্তর ঘর্ষণে সৃষ্ট আওয়াজটি শুনলেন। কেনিয়ার এক প্রত্যন্ত বাতাসের ঝাপ্টায় ছুটে বেড়ানো ঐ ক্যানটিকেই পশ্চিমা সভ্যতার বিজয় নিশান, নুড়ি পাথরের সাথে অনবরত ঘর্ষণে সৃষ্ট আওয়াজকে তুলনা করলেন পশ্চিমা সভ্যতার বিজয়ডংকা’র সাথে। দেশে ফিরেই লিখে ফেললেন, জীবনের সেরা গবেষণা গ্রন্থ Triumph of the West ।

    যাদের চোখ আছে তারা নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য দর্শন ও বোধ বিশ্বাসের বাস্তবতায় উল্লসিত হন, কেউবা আবার নিজেদের পরাজয়ে নীরবে ছাড়েন দ্বীর্ঘশ্বাস। পূর্ব হতে পশ্চিমে, উত্তর হতে দক্ষিণে, যে কোন স্থানে যান না কেন, দেখবেন, বিশ্বময় আজ এই পশ্চিমা সভ্যতা, তথা, খৃষ্টবাদী সভ্যতার বিজয় কেতন উড়ছে। পশ্চিমা সভ্যতা বিশ্বের আর সকল সভ্যতার উপরে এমনভাবে আধিপত্য বজায় রেখে চলতে পারেনি কখনই। মাত্র ক’টি শতাব্দী আগেতো এর নাম নিশানাও ছিল না। 

    ইসলামি খেলাফতের অধপতন ও বিলুপ্তি দীর্ঘ, জটিল ইতিহাস। আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটে ১৯২৪ সালের ৩রা মার্চ। তার আগে সেই ১৯১৪ সালের ২৮শে জুন অষ্ট্রীয় হাঙ্গেরী সিংহাসনের উত্তরাধিকার ফ্রাঙ্ক ফার্নান্ডেজ সার্বিয় উগ্র জাতিয়তাবাদী কর্তৃক সারাজেভো টাউন হলে নিহত হন। ঘটনাটি ছিল পুরোপুরি ইউরোপীয় ভূখন্ডে, ইউরোপীয় জাতিসমূহের আভ্যন্তরীণ সংঘাত। কিন্তু সেই সংঘাতকেই টেনে আনা হয় বিশ্বমঞ্চে। খুবই চটকদার একটি শ্লোগাণও খাড়া করা হয় The great war; to end all war। 

   বিশ্বে সকল যুদ্ধ সংঘাতকে চিরতরে বন্ধ করতেই এ যুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ। ২৮শে জুলাই ১৯১৪ হতে ১১ই নভেম্বর ১৯১৮। কিন্তু তারপরেও থামেনি, তুরস্কের সাথে মিত্রবাহিনী জড়িয়ে পড়ে যুদ্ধে, যার দৃশ্যমাণ পরিসমাপ্তি ঘটে কামাল পাশা কর্তৃক ১৯২৪ সালের ৩রা মার্চ ইসলামি খেলাফতকে বিলুপ্ত ঘোষণার মাধ্যমে। 

   ইঙ্গ-ফরাসি মিত্রপক্ষের সাথে তুরস্কের সংঘাত অবসান ও তাদের ভূখন্ড ছেড়ে যাবার পূর্বশর্ত হিসেবে দাবী ছিল ইসলামি খেলাফতকে বিলুপ্ত করতে হবে। কামালপাশার সাথে ব্রিটেনের একটা চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। আর ইসলামি খেলাফতের আওতাধীন ফিলিস্তিন, হেজাজ, ইরাক, সিরিয়া ভূখন্ডগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করাটতো ছিলই।

   এতকিছুর পরেও ব্রিটেনে অনেকে ব্রিটেন তুরস্ক ছেড়ে চলে আসুক, তুরস্ক স্বাধীন হোক তা চাইছিল না। জনৈক ইংরেজ এমপি তো ‘হাউজ অব কমন্স’ দাঁড়িয়ে, লর্ড কার্জনের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ ঝেড়ে!  উত্তরে লর্ড কার্জন বলেছিলেন; 
   The point at issue is that Turkey has been destroyed and shall never rise again, because we have destroyed her spiritual power: the Khilafah and Islam..
ভাবানূবাদ: এক্ষেত্রে মূল বিষয় হচ্ছে, তুরস্কে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে, সে আর কখনই উঠে দাঁড়াবে না। আমরা এর অন্তর্ণীহিত শক্তি ইসলাম ও খেলাফতকে ধ্বংস করে দিয়েছি।‘

    এটাই আসল কথা। তুরস্ক নয়। আসল বিষয়; ইসলাম ও মুসলমানদের প্রাণশক্তি; তাদের ঐক্য। এরই প্রতীকই ইসলামি খেলাফত। এটাকে ধ্বংস করে সেই ধ্বংসস্তুপের উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি নতুন বিশ্বসভ্যতা। কেউ বলি ‘খৃষ্টবাদী সভ্যতা’ কেউবা ‘পশ্চিমা সভ্যতা’। কেনিয়াতে ঐতিহাসিক রবার্টস সমুদ্রপাড়ে নুড়ীপাথরের সাথে পেপসির খালি ক্যানের ঘর্ষণে এই সভ্যতারই বিজয়ডংকা শুনেছিলেন।

    এই জন্য ইউরোপকে অনেক চড়া মুল্য দিতে হয়েছে। এমনিতেই তার বিজয় নিশ্চিত হয়নি। বিশ্বে কোন দর্শন, কোন মতবাদই বিনা আত্মত্যগে প্রতিষ্ঠা পায়না। এটাই নিয়ম। সকল যুদ্ধের সম্ভাবনা চীরতরে শেষ করতে আয়োজিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কি আসলেই বিশ্ব থেকে যুদ্ধ শেষ করতে পেরেছে? পারেনি। চটকদার শ্লোগাণটি ছিল নিছক একটা প্রতারণা। 

    এই প্রতারণার পথ ধরেই ইউরোপের সামনে তার সবচেয়ে বড় শত্র“ ইসলামি খেলাফতকে তারা ভেংগে সেখানে তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এবং ‘মানবতাবাদ’ এসবের আড়ালে নিজেদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। পেরেছে মুসলিম দেশসমুহকে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য প্রভাব বলয়ে বাঁধতে। 

     এর জন্য চড়া মূল্যও তারা পরিশোধ করেছে। জার্মানি হারিয়েছে কুড়ি লক্ষ প্রাণ। ফরাসীরা চৌদ্দ লক্ষ, ইতালীয়রা চার লক্ষ ষাট হাজার আর ব্রিটিশরা হারিয়েছে ছয় লক্ষ জীবন। এর বিপরিতে রাশিয়া যে কত লক্ষ প্রাণ হারিয়েছে, তার কোন হিসেব নেই। সম্ভবত এই চারটি দেশের সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও তাদের হারাতে হয়েছে কয়েকগুণ বেশী লোক, পাঁচকোটি প্রাণ । 

   পাঁচকোটি প্রাণই সব নয়। সম্পদের নজরাণাও গুণতে হয়েছে অগণন। সে যুদ্ধে যে সম্পদ ব্যয় হয়েছে তার সঠিক হিসেব এ বিশ্ব কোনদিনই পাবে না। এক ব্রিটেনই ব্যায় করেছে সাত বিলিয়ন পাউন্ড, আজকের হিসেবে তা প্রায় সাতশত বিলিয়নেরও বেশী। ফ্রান্স দুই বিলিয়ন, জার্মানি তিন বিলিয়ন, ইতালি পাঁচ বিলিয়ন, সেই সেদিনের হিসেবে। আজকের মূল্যমানে এগুলো কয়েকশত গুণ বেশী হতে বাধ্য।

    জীবন ও সম্পদের এই যে নজরাণা, এটা একটা দর্শন, মতবাদকে বিজয়ী করতে অন্যতম শর্ত। সে শর্ত তারা পূরণ করেছে বলেই কেনিয়ার সমুদ্র তীরেই কেবল নয়, এমনকি, আমাজনের জঙ্গলেও তাদের মতাদর্শের বিজয়ডংকা শোনা যায়।

      কিন্তু না, তুরস্ক মরে যায় নি।  সে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। মাথা উুঁচু করে দাঁড়াবার সাহসও জুগিয়ে চলেছে। বর্তমান বিশ্বরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সেদিকেই এগুচ্ছে। ইউরোপ বুঝেছে, তাদের স্বপ্ন পূরণ হবার নয়। 
 
     পৃথিবীর বুকে আবারও ইসলামের বিজয় দেখার প্রত্যাশী মুসলিম বিশ্ব কি সেরকম চড়া মূল্য পরিশোধে প্রস্তুত?
-----------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক। 

Post a Comment

0 Comments