ইতিহাসের এক ঝলক
ও আমাদের লজ্জা-
**
মুুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব ওহাবি মতবাদের প্রবক্তা, কুরআন ও সুন্নাহর বাইরে কোনকিছুই সহ্য করতে প্রস্তুত ছিলেন না, আরব ভূমিকে নিখাঁদ ইসলামি আদর্শে সাঁজাতে চেয়েছেন। কিন্তু তার অধিকাংশ কর্মপন্থা ও কর্মসূচীই ছিল উগ্র ও অসহিষœু ধরনের।
মাজার ভাঙ্গা থেকে শুরু করে আরবের বুকে অনেক অনৈসলামিক রসম রেওয়াজ দূর করার যৌক্তিক কাজের ক্ষেত্রে জনমত গঠনের পরিবর্তে বলপ্রয়োগে লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করার ফলে জনমনে ঘৃণা ও বৈরিতার জন্ম হয়। নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস সৃষ্টি, হত্যা, লুন্ঠন এসব অভিযোগে ওসমানীয় খেলাফত যেমন ওয়াহাবি মতবাদকে ইসলাম বহির্ভূত মতবাদ হিসেবে ঘোষণা করে। মক্কার কাজীও বেশ কয়েকবার ওয়হাবিদের কাফের হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
মুহাম্মদ আব্দুল ওয়াহাব ছিলেন একজন ধর্মীয় নেতা। তার কোন রাজনৈতিক ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ছিল না। অপরদিকে মুহাম্দ ইবনে সউদ ছিলেন আরবের Ad-Diriyyah’র শাসক। তার ছিল সৈন্যবাহিনী ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। ইবনে সউদ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের বাবার ছাত্র হবার সুবাদে দু’জনের পরিচয়, উভয়েই আরবভুমিতে ইসলামের পূণর্জাগরণ চান, ফলে তারা গাঁটছড়া বাঁধলেন।
আরবে বিশুদ্ধ ইসলাম প্রতিষ্ঠায় দু’জনের মধ্যে একটা চুক্তি হলো ১৭৪৭ খৃষ্টাব্দে; ক্ষমতা পেলে মুহাম্মদ ইবনে ওয়াহাব ও তার সন্তানরা হেজাজের ধর্মীয় দিক দেখাশোনা করবেন। আর মুহাম্মদ ইবনে সউদ বা তার সন্তানরা শাসনক্ষমতা, তথা, প্রাশাসনিক দিক দেখবেন। ওয়াহাবি ম্যুভমেন্ট গতিময়তা পায়।
চুক্তির আঠারো বসর পরে ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে মুহাম্মদ ইবনে সউদ ও পঁয়তাল্লিশ বছর পরে ১৭৯২ সালে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব ইন্তেকাল করলেও তাদের সন্তানেরা চুক্তি মেনে চলেছে। শাসনক্ষমতা হাতে পেতে বার বার মক্কা আক্রমণ করেছে। ইরাক থেকে মক্কা পর্যন্ত পুরো হেজাজ ও পুরো আরব উপদ্বীপজুড়ে মুসলমানদের নির্বিচারে কাফের আখ্যা দিয়ে হত্যা করেছে, এমনকি, কাবা চত্তরেও হাজীদের হত্যা করেছে, রক্তের বন্যা বইয়েছে।
এরকম সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও রক্তপাতের কারণে সাধারণ আরব এবং তুর্কিরা ওয়াহাবিদের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে দেখতো। একই দৃষ্টিভংগী ছিল তাদের সহযোগী ইবনে সউদ ও তার আন্দোলনের প্রতিও। ইবনে সউদ নিজেও জানতেন যে, মক্কার লোকজন তাদেরকে ইসলামবিচ্যুত একটা দল হিসেবে মনে করে।
ঠিক এরকম প্রেক্ষাপটে তুর্কি সুলতান মক্কার শরিফ হুসেইনকে মিশর ও আরবভূমি মুক্ত করতে ব্রিট্রেনের বিরুদ্ধে খেলাফতের জিহাদের স্বিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে প্রস্তুতি নেবার নির্দেশ দেন। হুসেইন সেই গোপন নির্দেশটা ব্রিটিশ প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন Shakespearকে জানিয়ে দিলে ব্রিটিশ সরকার তুর্কি সুলতানের জিহাদের প্রস্তুতি টের পেয়ে যায়। শরিফ হুসেইন জিহাদের ডাকে সাড়া নিয়ে বরং ব্রিটেনের নির্দেশে নিশ্চুপ বসে থাকলেন।
জিহাদের ডাক দেবার ঘটনায় ব্রিটিশ কুটনীতিক ও জেনারেলরা আতংকিত হয়ে উঠেন। ‘মুসলমানরা জিহাদে নামলে তা বিপর্যয়কর হবে’ মর্মে অতি জরুরি গোপন প্রতিবেদনে ক্যাপ্টেন Shakespear লন্ডনে ফরেন সার্ভিসকে জানান।
ওদিকে জিহাদের আহ্বান সম্বলিত গোপন চিঠি খলিফা নজদে অবস্থানরত ইবনে সউদকেও পাঠান। কট্টর ইসলামি অনুশাসনের অনুসারী ইবনে সউদের পদক্ষেপ এক্ষেত্রে খুবই বিষ্ময়কর! জিহাদ প্রতিটি মুসলমানের উপরে ফরজ, জেনেও তিনি জিহাদের ডাক পেয়ে ছুটে গেলেন যাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের জিহাদের জন্য প্রস্তুত হতে বলা হচ্ছে, সেই ব্রিটিশ সরকারের কাছেই! করণীয় জানতে চাইলেন। জবাবে ক্যাপ্টেন শেক্সপিয়ার ইবনে সউদকে নির্দেশ দিলেন;
‘আপনি আব্দুল আজিজ, আরবের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হিসেবে অবশ্যই মক্কার শরিফকে বলবেন যে, পবিত্র স্থানগুলো নিয়ে (মক্কা, মদিনা ও ফিলিস্তিন) আমার সরকারের কোন আগ্রহ নেই। অবশ্যই তুর্কিদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে। তুরস্কের ক্ষমতা শেষ, কালক্ষেপণ করতে হবে, যতদিন ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা জানানো না হয়, ততোদিন যতটা সম্ভব (তুর্কিদের) কম সহযোগীতা করতে হবে ।'
ইবনে সউদ নির্দেশমতো কাজ করেন। তিনিও হুসেইনের মতোই ব্রিটেনের বিরুদ্ধে জিহাদ থেকে তার বিরাট দলবলসহ মুখ ফিরিয়ে রাখেন।
শরিফ হুসেইন ছিলেন প্যান আরবিজম বা আরব জাতিয়তাবাদের ধারনায় উজ্জীবিত। তিনি না হয় আরব জাতিয়তাবাদের কারণে জিহাদ প্রত্যাখান করলেন। কিন্তু নিখাঁদ, পরিপূর্ণ ও কট্টর ইসলামি ভাবধারা ওহাবি মতবাদের ধারক হওয়া সত্তেও ইবনে সউদ কেন সেই জিহাদে সাড়া দিলেন না? এটা আমার কাছে আজও এক বিষ্ময়!
অথচ বাস্তবতা হলো, ইবনে সউদ তার মরহুম বাবা মুহাম্মদ ইবনে সউদ এবং মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির শর্তানুযায়ী খেলাফত রক্ষায় বাধ্য ছিলেন। কিন্তু আফসোস, তিনি শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য নির্দ্বিধায় তার দায়িত্বটুকু অস্বিকার করে জিহাদের ডাক থেকে কেবল যে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, তাই নয়, বরং হাজার হাজার অনুসারীকেও জিহাদ থেকে ফিরিয়ে রেখেছেন!
ইবনে সউদের দায়িত্বহীনতা ও বিশ্বাসঘাতকতার ফল উম্মাহর জন্য হয়েছে মারাত্মক। ব্রিটেন ও তার মিত্ররা সেই থেকে মুসলিম বিশ্ব নিয়ে ইচ্ছেমতো খেলে যাচ্ছে। আজও তা চলমান। জিহাদ থেকে ফিরে থাকা মুসলমানের ললাটে জিল্লতীর ধারা যেন শেষ হবার নয়। (প্রকাশিতব্য গ্রন্থ ‘সেক্যুলারিজম’ থেকে কিয়দংশ)।
--------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।
0 Comments