Recent Tube

ইয়ারমুক যুদ্ধ এবং মুসলমানদের বিজয়। ডঃ মুহাম্মদ আবদুল মাবুদ।

  
  ইয়ারমুক যুদ্ধ এবং মুসলমানদের বিজয়। 

ইয়ারমুকের জিহাদ, যে জিহাদে খৃষ্টীয় রোম সাম্রাজ্য তছনছ হয়ে গিয়েছিল। ইয়ারমুকের যুদ্ধ ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের মধ্যে সংঘটিত হয়।

 ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০-১৫ আগস্টে,১৫ হি ৫-১০ রজব ইয়ারমুক নদীর তীরে ছয়দিনব্যপী এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বর্তমানে এই নদী সিরিয়া, জর্ডান ও ইসরায়েলের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে এবং তা গ্যালিলি সাগরের পূর্বে অবস্থিত। এই যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়ের ফলে সিরিয়ায় বাইজেন্টাইন শাসনের অবসান ঘটে। সামরিক ইতিহাসে এই যুদ্ধ অন্যতম ফলাফল নির্ধারণকারী যুদ্ধ হিসেবে গণ্য হয়.

 কাফিরেরা ৬ লক্ষ ছিল, আর মুসলমান ছিলেন মাত্র ৪০ হাজার। কোন কোন মতে কাফিরেরা ছিল ২ লক্ষ, মতান্তরে ২লক্ষ ৪০ হাজার আর মুসলমান ছিলেন ৩০ হাজার। একদিন নয় দুদিন নয়, ৬ দিন ধরে যুদ্ধ চলছে। রোমক সৈন্যদের পায়ে শৃঙ্খল লাগানো হয়েছিল যাতে তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে না পারে। অর্থাৎ জিততে না পারলে প্রান দেবে এই দুর্জয় পণ নিয়েই রোমকরা যুদ্ধে নেমেছে।পাদ্রীরা তাদের নির্জন বাস ছেড়ে ধর্মের নামে খৃষ্টানদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করছে।

ইয়ারমুকের যুদ্ধ ও সেনাপতি খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রাঃ)

হযরত আবু বকর (রাঃ) তখন খলিফা। তিনি খবর পেলেন, সেনাপতি মানানের নেতৃত্বে দুই লক্ষ চল্লিশ হাজার সদস্যের এক বিরাট রোমান সৈন্য বাহিনী ইয়ারমুকে সমবেত হয়েছে। পাদ্রীরা তাদের নির্জন বাস ছেড়ে ধর্মের নামে সাধারন জনগনকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করছে। এই খবর শুনে খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ) মন্তব্য করলেনঃ ‘আল্লাহর কসম, আমি খালিদের দ্বারা তাদের প্রবৃত্তি ও প্ররোচনার নিরাময় করবো’। মুসলিম বাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে তিনি খালিদ ইবনুল ওয়ালিদকে পাঠিয়ে দিলেন যুদ্ধের ময়দানে।

যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হয়ে খালিদ দেখেন, মুসলিম বাহিনীর বিভিন্ন কমান্ডার পৃথকভাবে নিজ নিজ সৈন্য পরিচালনা করছেন। তিনি মুসলিম যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। আল্লাহ ও রাসূলের হামদ-সানার পর তিনি বলেন ‘আজকের এই দিনটি আল্লাহর অন্যতম একটি দিন। এই দিনে গরবো ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ পাওয়া উচিত নয়। তোমরা তোমাদের জিহাদে নিষ্ঠাবান হও। তোমাদেরন কাজের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তষ্টি কামনা কর। এসো আমরা ইমারাহ বা নেতৃত্ব ভাগাভাগি করে নেই। আমাদের কেউ আজ, কেউ আগামীকাল, কেউ পরশু আমীর হোক। এভাবে তোমাদের সকলেই আমীর হবে। তোমরা আজকের দিনটি আমাকে ছেড়ে দাও।’ সকলেই তার প্রস্তাবে রাজী হলো। তিনি গোটা বাহিনীকে ৩৮/৩৬ ভাগে বিভক্ত করে প্রত্যেক ভাগে একজন অফিসার নিয়োগ করলেন। তিনি মুসলিম বাহিনীকে এমনভাবে বিন্যাস করলেন যা আরবরা ইতিপূর্বে আর কখনও দেখেনি।

 ইয়ারমুকে মুসলিম বাহিনী নিজ নিজ অবস্থান গ্রহনের পর হযরত খালিদ মহিলাদের আহবান জানান এবং প্রথমবারের মত তাদের হাতে তরবারি দিয়ে নির্দেশ দেন, তোমরা মুসলিম মুজাহিদদের পেছনে অবস্থান করবে। কাউকে পালিয়ে পেছনে সরে আসতে দেখলে তাকে এ তরবারি দিয়ে হত্যা করবে।

ইয়ারমুকে যুদ্ধ শুরুর পূর্ব মূহুর্তে রোমান সেনাপতি ‘মাহান’ দূত মারফত জানালো যে, সে সেনাপতি খালিদের সাথে কথা বলতে চায়। খালিদ রাজি হলেন। দুই বাহিনীর মধ্যবর্তী ময়দানে দুই সেনাপতি মুখোমুখি হলেন। রোমান  সেনাপতি মাহান খালিদকে বললোঃ ‘আমরা জেনেছি, কঠোর শ্রম ও ক্ষুধা তোমাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। তোমরা চাইলে তোমাদের প্রত্যেককে আমরা দশটি দিনার, এক প্রস্থ পোশাক ও কিছু খাদ্য দিতে পারি। বিনিময়ে তোমরা দেশে ফিরে যাবে। আগামী বছরও আমরা অনুরূপ জিনিস তোমাদের কাছে পাঠাবো।’ রোমান সেনাপতির এ কথায় যে অপমান প্রচ্ছন্ন ছিলো খালিদ তা অনুধাবন করলেন। তিনি রাগে দাত কিরমিড় করতে করতে বললেনঃ ‘ক্ষুধা আমাদেরকে দেশ থেকে তাড়িয়ে এখানে আনেনি। তবে আমরা একটি রক্তপায়ী জাতি। আমরা জেনেছি, রোমানদের রক্ত অপেক্ষা অধিক লোভনীয় ও পবিত্র রক্ত নাকি পৃথিবীতে আর নাই। তাই সেই রক্তের লোভে আমরা এসেছি।’ কথা গুলো বলে মহাবীর খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রাঃ) ঘোড়ার লাগাম ঘুরিয়ে সোজা নিজ বাহিনীর কাছে ফিরে এলেন এবং আল্লাহু আকবর, হুয়্যি রিয়াহাল জান্নাহ – ধ্বনি দিয়ে যুদ্ধ ঘোষনা করলেন।

এদিকে রোমান বাহিনীও ভয়ংকররূপে অগ্রসর হতে লাগলো। রোমানদের এমন ভয়ংকররূপ আরবরা আগে কখনও দেখেনি। সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলো। খালিদ তার গোটা বাহিনীকে আক্রমনের নির্দেশ দিলেন। খালিদ রোমান অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর মধ্যভাগে ঢুকে পড়লেন। তিনি যেদিকে গেলেন, রোমান বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়লো। একাধারে একদিন ও একরাত তুমুল লড়াই চললো। পরদিন সকালে খালিদকে দেখা গেল রোমান সেনাপতির মঞ্চের উপরে। এই যুদ্ধে রনক্ষেত্রে নিহত হওয়া ছাড়াও পশ্চাৎ দিকে পলায়নরত সৈনিকদের মধ্যে এক লাখ বিশ হাজার রোমান সৈন্য জর্দান নদীতে ডুবে মারা যায়। এ যুদ্ধে তিন হাজার মুসলিম সৈন্য শহীদ হন।

এ যুদ্ধে খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রাঃ) এর ব্যক্তিত্ব কতটা প্রভাবিত করেছিলো তা একটি ঘটনা খেকে অনুধাবন করা যায়। ইয়ারমুকের যুদ্ধ তখন চলছে তুমুল গতিতে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে রোমান বাহিনীর এক কমান্ডার নাম ‘জারজাহ’ নিজ ছাউনি থেকে বের হয়ে এলেন। উদ্দেশ্য খালিদের সাথে কথা বলা। খালিদ বিষয়টি জানতে পেরে কথা বলতে রাজী হলেন। 

খালিদকে দেখে জারজাহ বললেনঃ ‘খালিদ আমাকে একটি সত্যি কথা বলুন। একটুও মিথ্যা বলবেন না। আল্লাহ কি আপনাদের নবীকে এমন কোন তরবারি দান করেছেন, যা তিনি আপনাকে দিয়েছেনে এবং সেই তরবারি যাদেরই বিরুদ্ধে উত্তোলিত হয়েছে তারাই পরাজিত হয়েছে?’          

খালিদ বললেনঃ না

জারজাহঃ তাহলে আপনাকে সাইফুল্লাহ – আল্লাহর তরবারি বলা হয় কেন?

খালিদঃ আল্লাহ আমাদের মধ্যে তার রাসূল পাঠালেন। আমাদের কেউ তাকে বিশ্বাস করলো কেউ করলো না। প্রথমে আমি ছিলাম শেষোক্ত দলে। তারপর আল্লাহ আমার অন্তর ঘুরিয়ে দিলেন। আমি তার রাসূলের ওপর ঈমান এনে তার হাতে বাইয়াত করি। রাসূল (সাঃ) আমার জন্য দোয়া করেন। আমাকে তিনি বলেন – ‘তুমি আল্লাহর একটি তরবারি।’ এভাবে আমি হলাম ‘সাইফুল্লাহ’।

জারজাহঃ কিসের দিকে আপনারা আহবান জানান?

খালিদঃ আল্লাহর একত্ব ও ইসলামের দিকে।

জারজাহঃ আজ যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহন করবে সেও কি আপনাদের মত সওয়াব ও প্রতিদান পাবে?

খালিদঃ বরং তার থেকে বেশী।

জারজাহঃ কিভাবে? আপনারা তো এগিয়ে আছেন।

খালিদঃ আমরা রাসূল (সাঃ) এর সাথে উঠেছি, বসেছি। আমরা দেখেছি তার মুজিযা ও অলৌকিক কর্মকান্ড। যা কিছু আমরা দেখেছি তা কেউ দেখলে, যা শুনেছি তা কেউ শুনলে, অবশ্যই তার উচিত সহজেই ইসলাম গ্রহন করা। আর আপনারা যারা তাকে দেখেননি, তার কথা শুনেননি, তারপর অদৃশ্যের উপর ঈমান

এনেছেন তার প্রতিদান অধিকতর শ্রেষ্ঠ। যদি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর উপর ঈমান আনেন।

জারজাহ ঘোড়া হাকিয়ে খালিদের পাশে এসে দাড়িয়ে বললেনঃ খালিদ আমাকে ইসলাম শিক্ষা দিন।

জারজাহ ইসলাম গ্রহন করে দু রাকাত নামাজ আদায় করলেন। এ দু রাকাতই তার জীবনের প্রখম ও শেষ নামাজ। তারপর এ নও মুসলিম রোমান শাহাদতের বাসনা নিয়ে মুসলিম বাহিনীর সাথে চললেন রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। আল্লাহ তার বাসনা পূর্ণ করলেন। তিনি শহীদ হলেন।

ইয়ারমুকের যুদ্ধে রোমান পরাশক্তি শোচনীয়ভাবে মুসলমানদের হাতে পরাজিত হলো। 
সূত্র: আসহাবে রাসূলের জীবনকথা – ২; 

Post a Comment

0 Comments