Recent Tube

মিশন: আত্মপরিচয় সন্ধান- জিয়াউল হক।

 
  মিশন: আত্মপরিচয় সন্ধান-;
 --------------------------------- 
   ইসলাম বৈশ্বিক ধর্ম। সে তার জন্ম থেকেই বৈশ্বিক ধর্ম। কোন বিশেষ অঞ্চল, কোন বিশেষ ব্যক্তি, গোত্র, গোষ্ঠী, কোন বর্ণ বিশেষের ধর্ম নয়। বিশ্বের তাবৎ মানুষের জন্য, সকল স্থানের জন্য। আমরা আজ তা দাবী করছি। বড়ো আত্মবিশ্বাসের সাথে, গর্বের সাথে বলতে পারছি। এই যে বলতে পারছি, এই পারাটার সাথে ইসলামের জন্মলগ্ন থেকেই বাস্তবতার সম্পর্ক রয়েছে। 

  আমরা যদি প্রিয় রাসুল সা: এর তেইশ বসরের নবুওয়তি জীবনের সঙ্গী সাথীদের দিকে দেখি, তাদের নামের  তালিকা দেখি, তবেই আমরা আমাদের এ দাবীর সত্যতা দেখতে পাই। তাঁর জীবদ্দশাতেই, ঐ তেইশ বসরের জীবনে, সপ্তম শতাব্দির শুরুতেই (৬১০-৬৩২ খৃষ্টাব্দ সময়কালে) প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এর সাথে যুক্ত হয়েছিলেন, এশিয়া, আফ্রিকা আর ইউরোপ, এই তিনটি মহাদেশ থেকে মোট আঠাশ জন সম্মানিত ও সৌভাগ্যবান মানুষ। এঁদের মধ্যে সাতাশজনই তাঁর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। সরাসরি স্বাক্ষাৎ থেকে বঞ্চিত ছিলেন যিনি, তিনি হলেন আবিসিনিয়ার রাজা নাজ্জাশি।

     এই আঠাশজনের মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে পনোরো জন। দেশগুলোর আধুনিক নাম হলো, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, মিশর, কমোরোস দ্বীপপুঞ্জ। সম্মানিত এই পনোরোজনের মধ্যে খৃষ্টধর্মের যেমন ছিলেন তেমনি ছিলেন প্রকৃতি পুজারি স্থানীয় বিভিন্ন মতাদর্শী। 

   একজন ছিলেন আফগানিস্থান থেকে (হযরত মুহাব্বিহ ইবনে কামিল রা:)। একজন পাকিস্থান থেকে (হযরত কায়েস আব্দুর রাশিদ রা:, তাঁকে ইমরুল কায়েস খাঁন নামেও ডাকা হতো, তিনি বেলুচিস্থানের অধিবাসী ছিলেন)। দু’জন ভারত থেকে (হযরত চেরামান পেরুমল তাজউদ্দীন রা: এবং হযরত বাবা রতন হিন্দি রা:)। এই চারজনই ছিলেন ভারতীয় সংস্কৃতিতে জন্ম নিয়ে বেড়ে ওঠা মানুষ।

   তার মানে হলো; দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে মোট চারজন (একজন আফগানী, একজন বেলুচি, একজন মালয়ী এবং একজন হিন্দি (সম্ভবত গুজরাটি, আল্লাহ ভালো জানেন)) সাহাবি হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন।

   পারস্যের তথা, ইরানের ছিলেন তিনজন। তৎকালিন রোমান সা¤্রাজ্যের প্রাণ; বাইজান্টাইন সা¤্রাজ্য থেকে দুই জন। জীবনযাত্রা ও চিন্তা চেতনায় চলনে বলনে তারা পুরোপুরি সেকালের রোমান সংস্কৃতির মধ্যে দিয়েই বেড়ে উঠেছেন।

    ওদিকে কুর্দিস্থান ( সম্ভবত মসুল থেকে) এসেছিলেন তিনজন। (বর্তমানে এই কুর্দিস্থান ভেঙ্গে ইরান, ইরাক, তুরস্ক ও সিরিয়ার মধ্যে পড়েছে)। মিশর থেকে এসেছিলেন দুই জন। দুই নারী, দুই সহোদরা বোন।

    মাদাগাস্কার দ্বীপের উত্তর পশ্চিম ও মোজাম্বিকের পূর্বে সাগরের মাঝে ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র কমোরোস থেকে এসেছিলেন দু’জন। তাদের সৌভাগ্য হয়েছিল প্রিয় রাসুল সা; এর স্বাক্ষাৎ ও সান্নিধ্য পেয়ে ঈমান এনে তাঁর সম্মানিত সাহাবি হবার।

     তিনজন ছিলেন অনারব ইহুদি। তার মধ্যে দু’জনতো আমাদের সম্মানীয়া উম্মাহাতুল মু’মিনিন; হযরত সাফিয়্যাহ রা: এবং হযরত রাইহানা রা:।
    আগত এই সব সম্মানীয়দের মধ্যে এগারোজন ছিলেন কালো বর্ণের; নিগ্রো বা কৃষœাঙ্গ। আর এই সাতাশজনের মধ্যে নয়জন ছিলেন নারী। আবার এই নয়জনের মধ্যে সাতজনই ছিলেন আফ্রিকা মহাদেশের।

     তা হলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এর আন্দোলনের একেবারে শুরুতেই সেখানে জুটেছিলেন বিভিন্ন বর্ণ, ধর্ম ও সংস্কৃতির নারী পুরুষ। তাঁর সাথে জুটিবদ্ধ হয়েছিলেন ইহুদি (তাঁর দু’জন স্ত্রী), খৃষ্টান (তন্মন্ধ্যে একজন তাঁর সম্মানিতা স্ত্রী  হযরত মারিয়া কিবত্বিয়া রা:), জুটেছিলেন হিন্দু ও মুর্তিপূজক। ছিলেন অগ্নিপূজক পারসিকও। ছিলেন গাছগাছালি ও প্রকৃতিপূজক প্যাগান কমোরোস দ্বীপবাসী।

    এতোসব সংস্কৃতির উপস্থিতিতে যে মিশ্র সংস্কৃতির সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা ছিল, তার কিছুই হয়নি। বরং এইসব সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে সকলেই একটামাত্র সংস্কৃতি; ইসলামি সংস্কৃতিকে ধারন ও লালন করেছেন আজীবন, আমৃত্যু। কেবল তাই নয়, তারা নিজ নিজ জনপদে নতুন এই একেশ্বরবাদী ইসলামি সাংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন, প্রচার ও প্রতিষ্ঠাও করেছেন। 

    প্রিয় রাসুল সা: যেমন নানা সংস্কৃতির মধ্যে বাস করেও, ভিন্নধর্মের মানুষদের সাথে সহাবস্থানের নামে কোন সংস্কৃতিকেই ধারণ ও লালন করেন নি, ঠিক তেমনই, তাঁর এই সব সম্মাানিত সাহাবিগণও নিজ নিজ সমাজ ও জনপদের সেই পুরোনো সাংস্কৃতির দিকে আর কখনোই ঝুঁকেন নি। অর্থাৎ তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ জীবন ও সমাজে নিজেদের নতুন সাংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। কোনরকম আপোষ করেন নি।

     সেই সাৃংস্কৃতির ধারক আজকের মুসলমানরা যখন সহাবস্থান , প্রগতিবাদিতা কিংবা আধুনিকতার নামে ইসলামি সাংস্কৃতিকে কলুষিত করতে উঠে পড়ে লাগে, নিজেদের সাংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে ভিন্ন সাংস্কৃতির অনূবর্তি হয় কিংবা দাসত্ব করে অবলীলায়, এবং এরই পাশাপাশি আবার প্রিয় রাসুল সা: এর উম্মত হবার দাবীও করে, তখন কেবল হাসিই পায় না, লজ্জাও পেতে হয় বটে!

   অবশ্য এই লজ্জাবোধটুকু কেবল তাদের মনেই জাগতে পারে, যাদের বোধে ও বিশ্বাসে, চিন্তা ও চেতনায় আত্মমর্যাদা বোধ, আত্মপরিচয়ের ছিটেফোটার কিছুটা হলেও টিকে আছে। 

     ইতিহাসের এই পাঠটুকু স্মরণে নিয়ে প্রত্যেকের উচিৎ নিজের মনের কোণে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখা, সেখানে কোন আত্মমর্যাদাবোধ কিংবা আত্মপরিচয়ের লেশমাত্র বাঁকি আছে কি না। খুব বেশি দেরি হবার আগেই আমাদের প্রত্যেকের জীবনের মিশন হওয়া উচিৎ আত্মপরিচয়ের সন্ধান।
-----------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক। 

Post a Comment

0 Comments