Recent Tube

ভাষ্কর্য, মূর্তি— আখেরি আলাপ --সরওয়ার ফারুকী

ভাষ্কর্য, মূর্তি - আখেরি আলাপ;


মানুষ?

  ইসলামের ঘোষণা— মানুষ সৃষ্টির সেরা। তাঁর উপরে কেউ নেই। দৃশ্যমান পাহাড়-গিরি-সমুদ্র-নদী-গ্রহ-নক্ষত্র, অথবা বিশালাকার যা যা সব-ই মানুষের ব্যবহার্য। অদৃশ্য জগতের হুর-পরি, ফেরেশতাকুল— সকলের মানগত স্থানও মানুষের পায়ের তলায়, বরং মানুষের খেদমত করতে পারলেই তারা ধন্য। অনুভূত সৌন্দর্যের ফুল-পাখি-সুর-গান-সুবাস— সব-ই একজন কুৎসিত মানুষের চেয়ে অসুন্দর। মানুষকেই সর্বোত্তম আকৃতিতে পয়দা করা হয়েছে- আল কুরআন। 
মানুষের চেয়ে সুন্দর, শ্রেষ্ঠ কেউ নয়। জান্নাতের সমুদয় নায-নেয়ামতও মানুষের জন্যই বরাদ্ধ! অকল্পনীয় এই মানগত অবস্থান যার কাছে যত স্পষ্ট— ইসলাম এবং মানুষের মূল্য সম্পর্কে সে তত ওয়াকিবহাল। সে মানুষকে মহান এবং শ্রেষ্ঠ ভাবতে শিখে— তর্জনী উঁচিয়ে সে-ই উচ্চারণ করতে পারে:

বল   বীর -
               বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
                 বল  বীর -
বল   মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
       চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
       ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
       খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
       উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!

 গুহাযুগের মানুষ আর চন্দ্রজয়ী মানুষ— কে মহান?
এ সুন্দর ধরায় মানুষের আগমন কত কোটি বছরের পুরনো— তা স্পষ্ট না হলেও, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব যে তার সৃষ্টিলগ্নেই— তা কেতাবের পাতায় বর্ণিত রয়েছে। যখন সে কাপড় পরতে শিখেনি, রান্নাবান্না শিখেনি, ঘরদোর বানাতে জানে না— তখনও সে শ্রেষ্ঠ, তখনই তার পায়ে তামাম ফেরেশতার সিজদা। প্রাগৈতিহাসিক আমলের মানুষ, আর আকাশজয়ী মানুষ— মানুষ হিসেবে দুজনেই সমান। এ অনুভতির কাব্যিক প্রকাশ—
সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই।

মানুষ যা যা বানিয়েছে— তা সকলেই জানি।
কিন্তু মানুষ এমন কী সৃষ্টি করেছে— যা তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ? মানুষ কী এমন দুর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি করেছে— যা সে ভাঙতে পারে না?
হ্যা, মানুষই প্রতিনিয়ত তৈরি করছে এবং তারই হাতের কামাই সে প্রতিনিয়ত ভাঙছে। বিস্ময়কর যা যা আবিষ্কার করেছে মানুষ সব-ই তার অনুগত, কোনো সৃষ্টি তাকে ছাড়িয়ে যায়নি— সে সামর্থ নেই। নিপুণ সৃষ্টিসামগ্রী মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অনন্য দলীল।

মানুষের অনুভূত চরিত্র—
 গরু-ছাগল, কুকুর-মেকুর কখনও ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় না, প্রিয়ার স্মরণে গান গায় না, বিচ্ছেদে ‘বিষাদ সিন্দু’ রচনা করে না। কোন কালে কোনো শুয়োর পাহাড় চড়তে চড়তে গায় নি—
আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই।
ওই পাহাড়ের ঝর্না আমি, ঘরে নাহি রই গো
উধাও হ’য়ে বই।

 মানুষই ফুল দেখে আপ্লুত হয়, পাহাড়-নদী-জল সমুদ্র দেখে শিহরিত হয়— অজস্র অনুভূতি কালান্তরে পৌঁছে দিয়ে ঘোষণা করে— আমিই শ্রেষ্ঠ।

কেন মানুষ ধর্মাশ্রয়ী;
 এই যে সে বড়, মহান, মহৎ— এতসব গুণাবলি তার— এসব দেখে সে তৃপ্ত হয় না। বরং আরও মহান, মহৎ, আরও বড় কিছু সে খুঁজতে থাকে। কিন্তু পায় না, তবুও খোঁজে, তবুও খোঁজে। এই মানুষের মধ্য থেকেই কেউ একজন বলে, আগুন আমার চেয়ে অধিক কিছু, কারণ আগুন জ্বালিয়ে দেয়, তখন সে আগুনের পুজা করে। কেউ একজন জানায় ‘না না, সূর্য-ই বড়, সে আমাদের আলো দেয়, বাঁচিয়ে রাখে”— সে তখন সূর্যের পুুজা শুরু করে। আবার কেউ একজন জানায়, ‘না না, তামাম সৃষ্টিতে আমিই বড়, আমার চেয়ে কেবল সে-ই বড়, যে আমারও স্রষ্টা, সে তখন তার বন্ধনা করতে চায়। এক অদৃশ্র আশ্রয়ে নিজেকে সঁপে দেয়। দৃশ্যমান পাথর, বৃক্ষ অথবা গ্রহ-নক্ষত্রের চেয়ে সে অদৃশ্য কল্পনার প্রতি অধিক বিশ্বস্ততা বোধ করে। এভাবে, মানুষ তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কাউকে খুঁজতে গিয়েই বৈচিত্র্যময় ভাগে ভাগ হয়ে যায়। বহুভাগে বিভক্ত প্রতিটি চিন্তার পেছনে ধীরে ধীরে অজস্র মানুষ ভীড় করে, প্রত্যেকেই তার মেধা আপন আপন ক্বওমের পেছনে খরচ করে, বিশ্বাসের ভীত শক্ত করে— এভাবেই সকল মত ও পথ মানবজাতির চিন্তাকে বিকশিত করে।

ভাষ্কর্য, মূর্তি— এক অদ্ভুত বিতর্ক?

  বঙ্গদেশে ভাষ্কর্য-বিতর্ক এজন্য নয় যে, একদল মানুষ তাদের ধর্মীয় মূর্তি, স্ট্যাচু বা ভাষ্কর্য নির্মাণ করতে চায়, আর অপর দল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে, বাহুবলে তা বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিতে চায়। বরং যারা বানাতে চায় তারা যদি বলত, এটা আমাদের নতুন ধর্ম, এ ধর্মের নাম ‘আওয়ামী ধর্ম’, এ ধর্মে ভাষ্কর্যের সংজ্ঞা এমন। এমন ঘোষণা দিয়ে নবধর্মের নামে সরকারি রেজিস্ট্রেশন নিয়ে সুনির্দিষ্ট স্থানে হাজারটা ভাষ্কর্য বসাত, তাহলে এমন বিতর্ক তৈরি হত না। বরং বিতর্ক এজন্য যে, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় বিধানের বিকৃতিভাষ্য দিয়ে সুসংবদ্ধ একটি ধর্মের বন্ধনী ভেঙে দিতে চাচ্ছে, রাষ্ট্রীয় সংঘাত তৈরী করতে চাচ্ছে। আর সংঘাত তো সংঘাতের পথই প্রসস্থ করে।
ভাষ্কর্যপন্থীরা আরও বলছেন, এ ভাষ্কর্য পূজনীয় নয়, বরং ইতিহাসের দলীল বা সৌন্দর্যের স্মারক। এ নতুন ব্যাখ্যাই তৈরী করেছে তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব।

বেশ আগের গল্প—
  মীরাবাজার মসজিদ। উদ্বোধন হয়েছে আগের সপ্তায়। মেহরাবের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য সেগুন কাটে খোদাই করে আনা হয়েছে কা’বা ঘরের প্রতিচ্ছবি। ইমাম সাহেবকে প্রশ্ন করলাম, এখানে এ চিত্রকর্ম কেন?
উত্তর দিলেন সৌন্দর্যের জন্য।
কিন্তু এ কা'বার ছবি যদি সৌন্দর্যের জন্য না হয়ে ভক্তি প্রকাশের জন্য হয়, তাহলে?
বললেন, না, জায়েজ নেই। কারণ, সৌন্দর্য দানকারী বস্তু বা প্রাণী আমাদের প্রয়োজন পুরা করে। আর, যে প্রয়োজন পুরনের নিমিত্তে নিবেদিত— সে তো অধীন এবং অধম। অধম কারও পায়ে অর্ঘ্য দান নিষিদ্ধ।

আবার,
হুজুর, চিত্রাঙ্কন জায়েজ?
হ্যা, জায়েজ, গাছপালা, পাহাড়-পর্বতের ছবি আঁকুন। তবে মানুষ বা জীব-জন্তুর ছবি আঁকা জায়েজ নেই।
আচ্ছা, হিন্দুধর্মে অত্যন্ত পবিত্র তুলসি-গাছের ছবি আঁকা জায়েজ?— প্রশ্নে কিছুটা খটকা লাগে!
আর লতাপাতা নেই যে আপনি তুলসি গাছের ছবি আঁকবেন! শুনেন, ভক্তি বা প্রণামের উদ্দেশ্য কা’বা হোক আর তুলসিই হোক— আঁকা যাবে না। কারণ, কোনো চিত্রকর্ম সুনির্দিষ্ট কোনো অনুভূতির নিয়ন্ত্রক হলে ‘মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব’ ধ্বংস হয়। জড়-অজড় কোন সৃষ্টিই মানুষের অনুভূতির নিয়ন্ত্রক হতে পারে না। বরং, মানুষই সকল জড়-অজড়ের ইচ্ছা-অনিচ্ছার নিয়ন্ত্রক। মানুষ তার চেয়ে অধম কোনো সৃষ্টির কাছে আত্মার জলাঞ্জলি দিতে পারে না, এতে তার শ্রেষ্ঠত্ব হোচট খায়।
সুন্দর একটা পাথর— যা দেখে কেউ একজন আনন্দ পেল, বিমোহিত হল, খুশিতে পাথরের টুকরোখানা সাজিয়ে রাখল সেলফে— এই যে সুখ, তা কী প্রমাণ করে? পাথর মানুষকে আনন্দ দিতে পারে, সৌন্দর্যের উপকরণ হতে পারে। কিন্তু, এই পাথরের টুকরোটি নিয়ে যদি অন্যরকম ভাবে? যদি ভাবে, আহ! পাথরখন্ডটি আমার চেয়ে সুন্দর,  আমার চেয়ে মহান— এমন ভাবনায় পাথরের নীচে যদি নিজেকে সঁপে দেয়— তাহলে? এমন হলেই সে আর মানুষ হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে পারল না, বরং নীচ হয়ে গেল। একটি জড় পদার্থের নীচে নিজের সত্ত্বা বন্দী করে নিল! এই নিম্নগামীতাই মানুষের জন্য সর্বোচ্চ মাত্রার অপমানের, লজ্জার। ইসলাম এ জায়গাতেই আঘাত করেছে। বলেছে— মানুষের জন্যই তামাম জাহান পয়দা, সমগ্র সৃষ্টি তারই খেদমতে ব্যাকুল। এ শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নে ইসলামের কোনো আপোষ নেই, এ প্রশ্নে সে কাউকে ছাড় দিবে না। এজন্য ইসলামের ধারক-বাহকেরা এ প্রশ্নে অনমনীয়।

ভাষ্কর্য তৈরি করা যাবে? যাবে না?

  মূর্ত বা বিমূর্ত— যা-ই মানুষকে অপমানিত করে, মানবীয় সত্ত্বাকে নমিত করে, যা মানুষের জন্যে অপমানকর— তা করা যাবে না। মূর্ত বা বিমূর্ত চিত্র— যা মানুষকে আনন্দে দেয়, সৌন্দর্য বর্ধনের উপকরণ হয়, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে— তা তো মানুষ করবেই। এজন্য, উপভোগের জন্য সকল শিল্প নির্মান জায়েজ, কিন্তু নিবেদনের জন্য একটি বালুদানাও আঁকা যাবে না।

ঐতিহাসিক ব্যক্তি, মূর্তি, ভাষ্কর্য—

  ইতিহাসের মহানায়কেরা অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে মানবজাতির দুরন্তপনা বাড়িয়ে তুলেন। নজরুল তাদের স্মরণে গেয়েছিলেন:
ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান,
আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান?

  এ মহানায়কেরা একেক সমাজে একেক রূপে আসেন। মুসলিম সমাজে মুসলমানের আমল বা কর্মে ফুটে ওঠেন। তারা যেভাবে, যে উদ্দেশ্যে, যখন যা যা করেছিলেন; ঠিক সেভাবে করতে পারার মাধ্যমেই তাদের আদর্শ জিন্দা রাখেন মুসলমনেরা। মুসলিমরা নবীদের আদর্শ, তাদের সাথীদের আদর্শ, ইতিহাসের অপরাপর মহানায়কদের আদর্শ স্মরণ করেন, বাস্তবায়ন করেন আমল বা কর্মের মাধ্যমে। তাদের আদর্শ পাথর বা জড়মূলে বেঁধে রাখেন না। কারণ, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার চেয়ে অধম কোনো সত্ত্বা সত্যায়িত করতে পারে না। যেহেতু জড়-অজড় কেউই মানুষকে সত্যায়িত করার যোগ্যতা রাখে না, সেহেতু তাদের প্রতিচিত্র, প্রতিমূর্তি সৃষ্টি করে তার পায়ে কোনো নিবেদনও পেশ করতে পারে না। জড়-অজড় নিজে মহিমান্বিত নয়, তাই তাকে মহিমান্বিতকর কল্পনা করা, তার জন্য নিবেদন করার নাম জাহেলিয়াত বা অন্ধত্ব। এ জাহেলিয়াত ভাঙার জন্যেই ইসলামের আগমন, এ জাহেলিয়াত ভাঙার আন্দোলনে সক্রিয় থাকার নামই ইসলাম। এ পথে লড়ে যাওয়ার নাম জেহাদ, আর মরে যাওয়ার নাম শাহাদাত।

Post a Comment

0 Comments