খোলা চিঠি: হে যুবক
পর্ব- ৮;
ইতিহাস অন্বেষা :
আল কুরআনের পাতায় পাতায় বার বার আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কর্তৃক ইতিহাসের অবতারণা করা দেখে কাফেররা বলে উঠেছে; এতো পুরোনো দিনের গাল গল্প! কেন ‘গালগল্প’ অবতারণা? সেটা বুঝতো না বলেই পথেরও দিশা পেতো না।
ইতিহাস হলো শিক্ষা ও জ্ঞানের তিনটি উৎসের অন্যতম একটি। ইতিহাস জ্ঞান দেয়। অজ্ঞানতাকে দূর করে। অথচ একদল মানুষ ইতিহাসকে গালগল্প হিসেবে দেখেছে, আর একদল তাকে সত্যিই সত্যিই গল্পই বানিয়ে ছেড়েছে!
আজও ইতিহাসকে পুরোনো দিনের ‘গালগল্প]’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ইতিহাস ‘হিস্টোরি’ (History) না হয়ে ‘হিজ স্টোাির’ (His Story) হয়েছে। অর্থাৎ ‘ঐতিহাসিকের গল্প’ হয়েছে, ইতিহাস হয়নি।
ইতিহাসকে অক্ষুন্ন রাখা বিশ্বমুসলমানদের দায়িত্ব। কারণ তা জ্ঞানের এক উৎস। পানির উৎস যেমন দূষিত হতে দেয়া যায় না বৃহত্তর মানবসমাজের জীবনের নিরাপত্তার জন্য, ঠিক তেমনই ইতিহাসকেও বিকৃত হতে দেয়া যায় না পৃথিবীর বুকে সত্য, ন্যায় আর ইনসাফের রুপ ও প্রকৃতিকে অক্ষত রাখার স্বার্থেই।
মুসলমানরা হলো জ্ঞানের ধারক, বাহক ও উপস্থাপক। তাদের উৎপত্তি ও উদ্ভবই হয়েছে বিশ্বে সত্যকে, জ্ঞানকে প্রতিষ্ঠা করে অজ্ঞানতাকে দূর করে বিশ্ববাসীকে সঠিক জ্ঞানের পথ দেখাতে। এই দায়িত্বটা পালনে আজ তারা ব্যর্থ। জ্ঞানের তিন উৎসের অন্যতম উৎস; ইতিহাস বিকৃত হলে কেবলমাত্র মুসলমানরাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে না, ক্ষতিগ্রস্থ হবে পুরো বিশ্বমানবতাই। কাজেই এটাকে অবিকৃত রাখতেই হবে।
সে ইতিহাস হতে পারে লজ্জার বা বেদনার। উত্থানের বা পতনের, আনন্দের বা দু:খের, সম্মানের বা অপমানের, জয়ের বা পরাজয়ের। সকল ইতিহাসকে নির্মোহভাবে জানতে হবে, জানাতেও হবে। এর চর্চাও করতে হবে প্রতিনিয়তই নিজেদের আত্মবিশ্লেষণের স্বার্থে।
দুধের ভেতরে পানি মেশানো রয়েছে তা মাপাে ল্যাক্টোমিটার রয়েছে। স্বর্ণকারের কাছে রয়েছে খাদ নিরুপণের জন্য কষ্টিপাথর। জারকের অম্লত্ব বা ক্ষারের পরিমান মাপতে রয়েছে লিটমাস পেপার। আর এর বিপরিতে ইতিহাসের ভেতরে যে জোচ্চুরি, যে বিকৃতিটা ঘটেছে, তা সনাক্ত করার কি কোন পথ, কান মানদন্ড নেই?
আছে। ইতিহাসে খাদ রয়েছে কি নেই, তা মাপার সবচেয়ে বড়ো মানদন্ড; আল কুরআন আর প্রিয় রাসুল সা. এর হাদিস। কুুরআন ইতিহাসগ্রন্থ নয়। খাঁটি ইতিহাস মাপার গ্রন্থ।
পৃথিবীর বুকে যতো খাঁটি ইতিহাসই হোক, যতো বড়ো ঐতিহাসিকের লেখাই হোক না কেন, তা যদি আল কুরআন ও হাদিসের বর্ণনার সাথে না মেলে, তবে তা খাঁটি ইতিহাস নয়। খুব সহজ ও সোজা সাপ্টা কথাটাকে মনে গেঁথে নিতে হবে চীরদিনের মতো।
প্রশ্ন হলো ইতিহাস থাকে কোথায়? কোথায় তাকে খুঁজতে হবে? এ প্রশ্নের উত্তরটা আরও একটি প্রশ্নের মধ্যে; ফুলে গন্ধ থাকে জানি, কিন্তু সেই গন্ধটা থাকে কোথায়? ফুুলের কোন জায়গাটায়? একইভাবে পাকা আমে মিষ্টি রস থাকে। কিন্তু কোন একটা সুনির্দিষ্ঠ জায়গা দেখিয়ে বলা যাবে কি ঠিক কোন জায়গায় রসটুকু থাকে? আসলে রস ও গন্ধ মিশে থাকে অস্তিত্তে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাকে আলাদা করে দেখা যায় না, দেখানোও যায় না। অনুতে অনুতে মিশে থাকে। বুঝা যায়, তবে পৃথক করা যায় না।
ঠিক তেমনি ইতিহাসও জাতিসত্তার চেতনায়, চরিত্রে, অস্তিত্তে মিশে থাকে। জীবনের বোধে ও বিশ্বাসে, আচারে ও আচরণে, কাজে ও কর্মে, রসম ও রেওয়াজে এবং শিক্ষা ও সাংস্কৃতিতে মিশে থাকে। এমনকি, মাটিতে, শিল্পে ও সাহিত্যে, ভাষা ও কৃষ্টিতে মিশে থাকে।
এগুলোকে খুঁজে নিতে হয়। সন্ধান করতে হয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়গুলিতেও। বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্নভাবে এর সুত্রগুলো পড়ে থাকে সমাজের স্মৃতিতে-বিস্মৃতিতে। অনেকটা অযতেœ, অগোচরেই মিশে থাকে সাহিত্যে, লোকগাঁথায়, স্থাপত্যে, শিল্পকলায়, সংষ্কারে-কুসংষ্কারে।
এগুলোকে পাওয়া যায়। একটু চেষ্টা করলেই সনাক্ত করাও যায়। কোথাও কোথাও নির্ভূলভাবে শতভাগই উদ্ধার করা সম্ভব। প্রয়োজন হয় ধৈর্য ও শ্রম, নিষ্ঠা আর আন্তরিকতা। ইচ্ছা আর অনুসন্ধিৎস, কৌশলী, কৌতুহলী মন। এর জন্য দক্ষ গোয়েন্দার মতো ডিটেক্টিভ ওয়ার্ক করা লাগে। (Learning about the past from words requires a kind of detective work.)
মনে রাখতে হবে, মানুষ এ পৃথিবীতে তার জীবদ্দশায় যাই করুক না কেন, যেখানেই করুক না কেন, বা যেভাবেই করুক না কেন, সে সবের কোন না কোন রেশ জেনে বা না জেনে পেছনে ফেলে যায়। এটা অনেকটা নদী তীরে বালুচরে হেঁটে বেড়ানোর মতো, ভেজা বালুর উপরে রেখে যাওয়া পদচিহ্নের ন্যায় মানুষও চলার পথে সমাজজীবনের পরতে পরতে তার কর্মকান্ডের চিহ্ন রেখে যায়। এগুলোকেই খুঁজে বের করতে হয়।
উনবিংশ শতাব্দির প্রখ্যাত আইরিশ কবি ও নাট্যকার Oscar Wild খুব মূল্যবান একটা কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন; The one duty we woe to history is to rewrite it ( ইতিহাসের প্রতি আমাদের একটা দায় রয়েছে, আর সেটা হলো; ইতিহাসের পূনর্লিখন)
বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানকে আজ এ দায় মেটাতে হবে। বিশেষ করে, এ উম্মাহর প্রত্যেকে যুবককে জীবনপণ করে মাঠে নামতে হবে নিজ নিজ শক্তি ও সাধ্যের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে হলেও ইসলামের ইতিহাসের গায়ে মিথ্যার যে প্রলেপ লাগানো হয়েছে তা দূর করতে। সত্য ইতিহাসকে তুলে ধরতে হবে জনসম্মুখে, বিশ্ববাসীর চোখের সামনে তা সে যে পাতালেই লুকোনো থাক না কেন, তাতে যতোই মিথ্যার রং চড়ানো হোক না কেন!
মনে রাখতে হবে এ উম্মাহর কোন মুক্তি নেই যতোক্ষণ না আমাদের সঠিক ইতিহাসের গায়ে যে নষ্ট প্রলেপ মাখানো হয়েছে, তা অপসারিত হচ্ছে। অতএব,মুক্তি ও সম্মানজনক জীবন চাইলে ইতিহাসের অন্বেষণে একদল ইতিহাস সন্ধানী যুবককে মাঠে নামতেই হবে।
-----------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।
0 Comments