খোলা চিঠি:
পর্ব-১১;
হে যুবক, সাবধান!
মুসলিম যুবকদের মনে রাখতে হবে, এই একবিংশ শতাব্দির পৃথিবীতে তাদের উপরে সবচেয়ে বড়ো যে অপবাদ সারা বিশ্ববাসী থেকে আরোপিত হচ্ছে তা হলো, উগ্রবাদ বা চরমপন্থা। মুসলমানরা উগ্রবাদী, সন্ত্রাসী বা চরমপন্থী, এই তকমা লাগিয়েই বিশ্বের নানা মুসলিম ব্যক্তি ও গোষ্ঠী, দেশ ও সমাজকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে বিগত প্রায় চারটি দশকে। এখনও দেশে দেশে একই অভিযোগে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে দমন পীড়ণ চলছে।
মানবিতিহাসের সবযুগে, প্রতিটি সমাজেই ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটা গোষ্ঠী কর্মতৎপর থেকেছে। সেটা নতুন নয়। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে অনেক গোষ্ঠী স্থানীয় রাজনৈতিক বা বৈষয়িক’সহ নানা কারণে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মনে জমে থাকা বিদ্বেষ ও ক্ষোভকে উগরে দেবার সুযোগ নিয়েছে এই অপবাদকে পুঁজি করে।
আমাদের প্রতিবেশি মায়ানমারে নিরীহ রোহিঙ্গা, ভারতের আসাম’সহ অন্যান্য প্রদেশে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা স্থানীয় নিরীহ মুসলমানদের হত্যা নির্যাতন ও উচ্ছেদ’সহ নানা অপকর্মের বৈধতা দিতে অভিযোগ তুলেছে উগ্রবাদিতার। এসবই কুটিল ষড়যন্ত্র সেটা সকলেই জানে।
নিরপেক্ষ বিচারে অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, মুসলমানরাই সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় এবং নীরিহ জাতি। কারণ, তারা বোধে ও বিশ্বাসে, চিন্তা ও কর্মে, আচারে ও আচরণে যে কোন উগ্রতা পরিহার করতে আদিষ্ঠ। তাদেরকে সৃষ্টিই করা হয়েছে তেমনভাবে। আল্লাহ তা’আলা নিজেই এ মুসলমানদেরকে একটা মধ্যপন্থী উম্মত হিসেবেই বানিয়েছেন। কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে (সুরা বাকারা : ১৪৩)।
খুব সুস্পষ্ট ও অকাট্য নির্দেশনা। কোনও ক্ষেত্রেই উগ্রতা, তথা, প্রান্তিকতা অবলম্বন করার কোন সুযোগই নেই। মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি যেমন করা উচিৎ নয়, তেমনি আচার আচরণ, কথা বার্তা, জীবনাচার, তথা, কর্মপদ্ধতিতে শৈথিল্য প্রদর্শন করাটাও উচিৎ নয়। উভয় অবস্থাই একজন ব্যক্তি মুসলমানের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি তা জাতি হিসেবে পুরো মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্যও বিপর্যয়কর।
মধ্যপন্থা পরিত্যাগ করে উগ্রতা কিংবা অতিমাত্রায় শৈথিল্য, নিস্পৃহ ভূমিকা অবলম্বন করাটা মুসলমানদেরকে পথচ্যুত করতে বাধ্য। চিন্তা, বিশ্বাস, কর্ম ও আচরণের ক্ষেত্রে ইতোপূর্বে এ ধরনের আচরণের কারণেই উম্মাহর অংশ বিশেষ (ইহুদি ও খৃষ্টান প্রভৃতি সম্প্রদায়) বিভ্রান্ত ও পথ্যুচত হয়েছে। আল কুরআন সে কথাটা সুচনাতেই জানিয়ে দিয়েছে (সুরা ফাতিহা দ্রষ্টব্য)।
মুসলমান সম্প্রদায় যেন তার সামষ্টিক জাতিয় চরিত্র; ‘মধ্যপন্থী উম্মত’; এইবুনিয়াদি বৈশিষ্ঠটা হারিয়ে না ফেলে সে কারণে প্রিয় মুহাম্মদ সা. আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন। জীবন চলার পথে সকল ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা ধারণ ও বাড়াবাড়ি, উগ্রতা কিংবা প্রান্তিকতাকে পরিহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন;
‘তোমরা আমলে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর, বাড়াবাড়ি করো না। সকাল-সন্ধ্যায় (ইবাদতের জন্য) বের হয়ে পড়ে এবং রাতের কিছু অংশেও। তোমরা অবশ্যই পরিমিতি রক্ষা করো। তাহলে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে।’ (সহিহ বুখারি),
কোন এক মণীষি তার সন্তানকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিলেন; বাছা! পুণ্য হচ্ছে দুই পাপের মাঝখানে অর্থাৎ শৈথিল্য ও বাড়াবাড়ির মাঝখানে। সবকিছুর মধ্যাবস্থাই সেরা। সেই গতি অতি মন্দ, যার তীব্রতা বাহনকে ধ্বংস করে’
ইসলামের অনুসারী মুসলমানদের মধ্যেও অনেকে এ কর্মধারা পরিহার করার কারণে বিভ্রান্ত হয়েছে, সে ইতিহাসও আমাদের সামনেই রয়েছে। কেবল প্রয়োজন একটু সচেতনভাবে তা অধ্যায়ন করা, একটু সময় নিয়ে সেগুলোকে ঘেঁটে দেখা।
খোলাফায়ে রাশেদার শেষ সময়কালে কোন কোন গোষ্ঠী এই মধ্যপন্থা বর্জন করা বা তা ধরে রাখতে না পারায় পথভ্রষ্ট হয়েছে। ফলে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে নানা দল-উপদলের সৃষ্টি হয়েছে, তাদের কেন্দ্রিয় ঐক্যে ভাঙ্গন এসেছে, সংঘটিত হয়েছে আন্তকোন্দল, যুদ্ধ সংঘাতও। তারই পথ ধরে সৃষ্টি হয়েছে নানা-ফিরকা, মতবাদ আর ধর্মীয় গোষ্ঠীরও। মু’তাযিলা, মুরজিয়া, জাহমিয়া, কাদরিয়া, খারিজি, রাফিজি, বাতেনি, কারামাতি প্রভৃতি সম্প্রদায়সমূহ এভাবেই অস্তিত্ব লাভ করেছে।
সালফে সালাফদের নাম ভাঙ্গিয়ে, তাদের একনিষ্ঠ অনুসারী হবার দাবী করে কোন কোন গোষ্ঠী আজও বিশ্বের নানা দেশে মুসলিম সমাজকে খন্ড খন্ড দলে উপদলে বিভক্ত করে ফেলেছে। আক্বিদা সংশোধনের নামে যাকে তাকে, যখন তখন 'কাফের' 'বাতিল' হিসেবে মুসলমান পরিচিতি থেকেই খারিজ করে দিচ্ছে।
প্রতিটি সমাজেই সবযুগেই কিছু লোক থাকে, যাদের ধর্মীয় আবেগ যতোটা থাকে, সে তুলনায় জ্ঞানের পরিপূর্ণতা ও পরিপক্কতা ততোটা থাকে না। সে রকম বাস্তবতা আজও রয়েছে। ফলে কিছু শেখ, মুফতি আলেম ওলামা নামধারী এরকম উগ্রতাকে পুঁজি করে উম্মাহর মধ্যে বিশৃংখলতার সৃষ্টি করছেন না জেনে, না বুঝেই। ভাবছেন তারা ইসলামের ও মুসলমানের এক বিরাট খেদমত করছে, আসলে বাস্তবে করছে তার উল্টোটা।
এটা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলাম বিদ্বেষীদের জন্য সুবর্ণ সুযোগের সৃষ্টি করায় তারা তা লুফে নিয়ে নানা কৌশলে মুসলিম সমাজকে আরও বেশি দ্বন্দ ও হানাহানিতে লিপ্ত করে ফেলেছে। আরবিতে একটা কথা বহুল প্রচলিত, বলা হয়ে থাকে; ‘খাইরুল উমুর ওয়াসাতিহা’ অর্থাৎ; ‘সকল বিষয়ে মধ্যবর্তীটাই সেরা।’
বিশ্বাস পোষণ ও ইবাদাতের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা ত্যাগ করাটা অত্যন্ত মারাত্মক ফল বয়ে আনে। অপ্রয়োজনীয় শৈথিল্য কিংবা উগ্র প্রান্তিকতার যে কোন একটা অবলম্বন করতে গেলে অনিবার্যভাবেই মধ্যপন্থা বর্জন করতে হয়। ফলে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর এ ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি, বিপর্যয় ও পথভ্রষ্টতা অনিবার্য হয়ে উঠে।
এরকম পরিস্থিতি থেকে অতি সাবধানতার সাথে, সচেতনতার সাথে বেঁচে থাকতে প্রিয় রাসুল সা. নির্দেশ দিয়ে গেছেন আমাদের। তিনি বলেছেন; ‘সাবধান তোমরা দীনের ভেতর বাড়াাবাড়ি করো না। কেননা তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তারা দ্বীনের ভেতর বাড়াবাড়ি করার কারণেই ধ্বংস হয়েছে। ( সুনানে ইবনে মাজাহ)
আরও আতংকের বিষয় হলো, যারা এই নির্দেশনার বাইরে গিয়ে কথা ও কাজে, আচারে আচরণে, চিন্তা চেতনায় প্রান্তিকতা কিংবা উগ্রতাকে লালন ও চর্চা করে, তাদের ব্যাপারে তিনি সা: পরিস্কার ধ্বংস কামনা করেছেন, বলেছেন; বলেছেন; ‘কথা ও কাজে সীমালঙ্ঘনকারীগণ ধ্বংস হোক’ (সহিহ মুসলিম)।
অতএব, হে যুবক, কথা কাজে, বোধে ও বিশ্বাসে, আচারে ও আচরণে উগ্রতা লালন ও ধারণ থেকে সাবধান!
------------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।
0 Comments