Recent Tube

ইসলামী পুনর্জাগরণ সমস্যা ও সম্ভাবনা ;২য় পর্ব ; ড. ইউসুফ আল কারজাভী

  
ইসলামী পুনর্জাগরণ স্যা ও সম্ভাবনা ;
          ২য় পর্ব;
 

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

অভিযোগবাস্তবতা

কোন বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা না থাকলে সে বিষয়ে মতামত প্রকাশ করা সমীচীন নয়। তাই যুক্তিবাদীরা মনে করেন অজ্ঞাত ও অস্পষ্ট বিষয় মত প্রকাশ করা উচিত নয়।

সুতরাং ধর্মীয় গোঁড়ামী ও চরমপন্থাকে আমাদের উক্ত প্রেক্ষিতেই বিচার করতে হবে। এর ভাল বা মন্দ বিচারের আগে এর প্রকৃত তাৎপর্য জানতে হবে। এজন্যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন এর বাস্তবতা ও বৈশিষ্ট্যগুলোর বিশ্লেষণ। আক্ষরিক অর্থে, উগ্রতাবাদ বা চরমপন্থার অর্থ হচ্ছে কেন্দ্র থেকে সম্ভাব্য সর্বশেষ প্রান্তে অবস্থান। বাহ্যত, এটা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ, চিন্তাধারা তথা আচার-আচরণের ক্ষেত্রে অনুরূপ দূরত্বে অবস্থানের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। চরমপন্থার একটি অন্যতম পরিণাম হচ্ছে এটি সমাজকে বিপজ্জনক ও নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। অথচ ঈমান, ইবাদত, আচার-আচরণ, আইন-বিধি তথা জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলাম মধ্যম সুষমপন্থা অবলম্বনের সুপারিশ করেছে। এটাকেই আল্লাহ তায়ালা ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ বা সহজ সরল পথ বলে উল্লেখ করেছেন। এ পথের একটি সুনির্দিষ্ট ও সুষ্পষ্ট বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর বিপরীত যতো মত পথ রয়েছে তার অনুসারীরা আল্লাহর গযবে পতিত হয়েছে। মোটকথা, আল্লাহ নির্দেশিত সিরাতুল মুস্তাকীমই হচ্ছে সুপথ আর এর উল্টো পথই হচ্ছে কুপথ বা বিপথ। তাই মধ্যম বা ভারসাম্যময় পন্থা ইসলামের কেবল সাধারণ বৈশিষ্ট্য নয় বরং এর মধ্যেই ইসলামের মৌলিক পরিচয় নিহিত। এ প্রসঙ্গে কুরআনের ঘোষণা:

“এমনিভাবে আমরা তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী উম্মাহ হিসেবে সৃজন করেছি যাতে তোমরা মানব জাতীর জন্যে সাক্ষী হবে আর রাসূল (সা) তোমাদের জন্যে সাক্ষী হবেন।” (২: ১৪৩)

এই দৃষ্টিতে,মুসলিম উম্মাহ একটি সুবিচারপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ পন্থার পথিক। একইভাবে এই জাতি ইহলৌকিক ও পরলৌকিক জীবনে সরল পথ থেকে মানুষের প্রতিটি বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সাক্ষী। ইসলামে এমন কিছু পরিভাষা রয়েছে যাতে মধ্যপন্থা অবলম্বনের এবং সব ধরনের চরমপন্থা ও হঠকারিতা প্রত্যাখ্যান ও পরিহারের আহবান জানানো হয়েছে। যেমন গুলু (বাড়াবাড়ি), তানাতু (উদ্রতা) ও তাশদীদ (কঠোরতা) -এই পরিভাষাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইসলাম বাড়াবাড়িতে শুধু নিরুৎসাহিত করেনি বরং এর বিরুদ্ধে কঠোর হুঁসিয়ারী উচ্চারণ করেছে। নিম্নোক্ত হাদীসগুলোতে এর সত্যতা পাওয়া যায়।

১. “ধর্মে বাড়াবাড়ি সম্পর্কে সাবধান! তোমাদের পূর্ববর্তী (জাতিগোষ্ঠি) এরূপ বাড়াবাড়ির পরিণামে নিশ্চিহ্ন হয়েছে।” (আহমাদ, নাসাই ও ইবনে মাজাহ) এখানে জাতি বলতে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জাতিগোষ্ঠিকে বোঝানো হয়েছে।” এর মধ্যে আহলে কিতাব বিশেষত খ্রীষ্টানরা উল্লেখযোগ্য। এদেরকে সম্বোধন করে আল-কুরআন বলছে: “বলুন, হে আহলে কিতাব! তোমরা তোমাদের দ্বীন সম্বন্ধে অন্যায় বাড়াবাড়ি করো না; এবং যে-সম্প্রদায় অতীতে বিপথগামী হয়েছে এবং অনেককে বিপথগামী করেছে এবং সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের স্বেচ্ছাচারিতার অনুসরণ করো না”। (৫:৭৭)

উপরোক্ত কারণে মুসলমানদেরকে বিপথগামীদের পথ অনুসরণ থেকে বিরত থাকার কঠোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। যারা অন্যের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে প্রকৃতপক্ষে তারাই অধিকতর সুখী। তদুপরি বাড়াবাড়ি বা সীমালংঘন (আল-গুলু) এমন অর্থহীন কর্মকান্ডে প্ররোচিত করে যার তান্ডব আমাদের অগোচরে বিস্তৃত হয়ে শেষ পর্যন্ত গোটা সমাজদেহকে একটা হুমকির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। হযরত মুহাম্মদ (সা:) বিদায় হজ্জের সময় মুজদালিফায় পৌঁছে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) কে কিছু প্রস্তরখন্ড সংগ্রহ করতে বললেন। ইবনে আব্বাস (রা) কিছু প্রস্তর খন্ড সংগ্রহ করে আনলেন। রাসুলুল্লাহ (সা) পাথরগুলোর আকার দেখে সন্তোষ প্রকাশ করে বললেন: “হ্যাঁ, এই পাথরগুলোর মতোই ধর্মীয় ব্যাপারে বাড়াবাড়ি বা জবরদস্তি থেকে সাবধান।” (ইমামা আহমাদ, আন-নাসাই, ইবনে কাছীর ও হাশীম) এ থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, মুসলমানরা যেন অতি উৎসাহী হয়ে বড় পাথর ব্যবহারের মতো বাড়াবাড়িতে প্রবৃত্ত না হয়। ইমাম ইবনে তাইমিয়াও ঈমানের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল ক্ষেত্রে তথা ইবাদত ও লেনদেনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি খ্রীষ্টানদেরকে বিশ্বাস ও আচরণের ব্যাপারে সবচেয়ে সীমালংঘনকারী জাতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ পাকও কুরআনুল কারীমে তাদেরকে ভৎসনা করে বলেছেন, “ধর্মীয় বিষয়ে তোমরা সীমালংঘন করো না” (৪:১৭১)

২. “তারা অভিশপ্ত, যারা চুল ফাঁড়তে (অর্থাৎ ক্ষুদ্র বিষয়ে) লিপ্ত এবং রাসুলূল্লাহ (সা) তিনবার এই কথা উচ্চারণ করলেন।”(মুসলিম, আহমাদ ও আবু দাউদ) ইমাম আননববী বলেন, “এখানে ‘চুল ফাঁড়তে’ লিপ্ত ব্যক্তিদের বলতে তাদের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যারা কথায় ও কাজে সীমা অতিক্রম করে।” উল্লিখিত দু’টি হাদীসে স্পষ্টত এ কথাই ব্যক্ত করা হয়েছে যে, বাড়াবাড়ি ও হঠকারিতার পরিণামে মানুষ সম্পূর্ণরূপে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

৩. রাসুলুল্লাহ (সা) বলতেন, “নিজের ওপর এমন অতিরিক্ত বোঝা চাপিও না যাতে তোমার ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তোমাদের পূর্ববর্তী জনগোষ্ঠী নিজেদের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে ধ্বংস হয়েছে। তাদের ধ্বংসাবশেষ পুরাতন মঠ-মন্দিরে খুঁজে পাওয়া যায়।” আবু ইয়ালা তার মসনদে আনাস ইবনে মালিকের বরাতে এবং ইবনে কাছীর সূরা হাদীদের ২৭ আয়াতের তাফসীরে এই হাদীস উল্লেখ করেছেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) সর্বদা ধর্মীয় বাড়াবাড়ির প্রবণতাকে প্রতিহত করতে চেয়েছেন। তিনি তাঁর সাহাবীদের মধ্যে যাদেরকে ইবাদত-বন্দেগীতে বাড়াবাড়ি করতে দেখেছেন, সংসার ধর্ম পালনে বিমুখ দেখেছেন তাদেরকে প্রকাশ্যে ভৎসনা করেছেন। কারণ এসবই হচ্ছে ইসলামের মধ্যপন্থার পরিপন্থী। ইসলাম দেহ ও আত্মার সুষম বিকাশ চায় অর্থাৎ মানুষের পূর্ণরূপে বেঁচে থাকার অধিকার এবং স্রষ্টাকে উপাসনা করার অধিকারের মধ্যে সমন্বয় চায়। মানুষের অস্তিত্বের যৌক্তিকতা এখানেই।

এই আলোকে মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধি এবং ব্যক্তিগতভাবে ও সমষ্টিগতভাবে তার নৈতিক ও বৈষয়িক উৎকর্ষের লক্ষ্যে ইসলাম ইবাদতের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। এভাবে ইসলাম এমন এক সমাজ গড়তে চায় যেখানে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি বিরাজ করবে এবং এটা করতে গিয়ে ইসলাম সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে না। তাই দেখা যায় নামাজ, রোজা ও হজ্জের মতো ফরজ ইবাদতগুলোর একই সাথে ব্যক্তিগত ও সামাজিক ভূমিকা রয়েছে। স্বভাবত এই দায়িত্বগুলো পালন করতে গিয়ে একজন মুসলমান জীবনের মূলস্রোত থেকেও বিচ্ছিন্ন হয় না আবার সমাজ থেকেও তাকে নির্বাসিত হতে হয় না। বরং ভাবগত ও বাস্তব ও উভয় দিক দিয়ে সমাজের সাথে তার সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ট হয়। এ কারণে ইসলাম বৈরাগ্যবাদকে অনুমোদন করে না। আর বৈরাগ্যবাদ মানে সমাজ থেকে নির্বাসন। সেখানে স্বাভাবিক সামাজিক জীবনের স্পন্দন থাকে না। ইসলাম চায়, এই স্বভাবসম্মত সামাজিক জীবন যাপনের মাধ্যমে মানুষ পবিত্রতা অর্জন করুক। সমাজের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে প্রতিটি মানুষ তার অবদান রাখুক। অর্থাৎ ইসলামের দৃষ্টিতে গোটা পৃথিবী মানুষের ধর্মীয় কর্মকান্ডের ক্ষেত্র। তাই সিরাতুল মুস্তাকীমের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ মানুষের প্রতিটি কাজই ইবাদত ও জিহাদ বলে গণ্য করা হয়। ইসলাম অন্যান্য ধর্ম ও দর্শনের মতো মানুষের জৈবিক চাহিদাকে অস্বীকার করে তথাকথিত আধ্যাত্মিক সাধনায় তাকে মোটেও উৎসাহিত করে না। দেহের দাবীকে অস্বীকার বা উপেক্ষা করে আত্মার পরিশুদ্ধির স্থান ইসলামে নেই। এ ব্যাপারে কুরআনের ঘোষনা দ্ব্যর্থহীন: “হে আল্লাহ, আমাদের ইহকালকে সুন্দর করুন এবং সুন্দর করুন আমাদের পরকালকে।” (২:২০১)

হাদীসেও আমরা একই বাণীর প্রতিধ্বনি শুনতে পাই: “হে আল্লাহ, আমার সকল কাজকর্মের হিফাযতকারী ধর্মকে সঠিকরূপে উপস্থাপিত করুণ; আমার জাগতিক কর্মকান্ডকে পরিশুদ্ধ করুণ যেখানে আমি জীবন নির্বাহ করি এবং আমার পরকালীন জীবনকেও পবিত্র করুণ এবং সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে আমার জীবনকে প্রাচুর্যের উৎস বানিয়ে দিন এবং সকল অপকর্ম থেকে আমাকে রক্ষা করে আমার মৃত্যুকে শান্তির উৎসে পরিণত করুন।” (মুসলিম)

হাদীসে আরো বলা হয়েছে :"তোমার ওপর তোমার দেহের অধিকার রয়েছে।” (সকল প্রামাণ্য সূত্রে সমর্থিত) তদুপরি কুরআনুল কারীমে পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করার প্রবণতা অনমোদন করা হয়নি বরং এটাকে বান্দার প্রতি আল্লাহর দান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মক্কায় অবতীর্ণ একটি আয়াতে আল্লাহ পাক বলছেন:“হে আদমের সন্তানেরা! সুন্দর পরিচ্ছদে ভূষিত হও সব সময় এবং নামাযের স্থানেও । খাও ও পান করো কিন্তু অপচয় করো না। আল্লাহ অপচয়কারীকে ভালবাসেন না।”

“বলুন, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জীবিকা সৃষ্টির জন্যে যেসব শোভন বস্তু এবং বিশুদ্ধ ও পবিত্র জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তাকে কে নিষিদ্ধ করেছে?” (৭:৩২)

মদিনায় অবতীর্ণ একটি সূরায় আল্লাহ তায়ালা বিশ্বাসীদের সম্বোধন করে বলেছেন : “হে ঈমানদাররা! আল্লাহ তায়ালা যেসব উৎকৃষ্ট বস্তু তোমাদের জন্যে হালাল করেছেন তাকে তোমরা হারাম করো না এবং সীমালংঘন করো না। আল্লাহ সীমালংঘনকারীকে পছন্দ করেন না। আল্লাহ তোমাদেরকে যে হালাল ও উৎকৃষ্ট জীবিকা দিয়েছেন তা থেকে আহার করো আর আল্লাহকে ভয় করে চলো যাঁর প্রতি তোমরা ঈমান এনেছ।” (৫:৮৭-৮৮)

এসব আয়াতে ঈমানদারদের কাছে পবিত্রতা অর্জনের প্রকৃত ইসলামী পথ বাতলে দেয়া হয়েছে এবং অন্যান্য ধর্মে যেসব বাড়াবাড়ি রয়েছে সেরূপ প্রবণতা থেকে মুসলমানদেরকে নিবৃত করা হয়েছে। এই আয়াত দু’টির শানে নুযূলও এখানে লক্ষণীয়। একদল সাহাবী নিজেদেরকে খোজা করে দরবেশ হয়ে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে ব্যক্ত করলে এই আয়াত নাযিল হয়।

ইবনে আব্বাস (রা) বলেন: “একটি লোক রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে এসে বললেন: “হে আল্লাহর রাসূল, আমি যখনি এই গোশত গুলো খাই তখুনি আমার কামপ্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তাই আমি গোশত না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” এবং এরপর পরই আয়াত নাযিল হয়। আনাস ইবনে মালিক (রা) বর্ণনা করেন, “একদল লোক নবী সহধর্মিণীদের কাছে এসে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর এবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। এ ব্যাপারে অবহিত হওয়ার পর তারা তাদের ইবাদত-বন্দেগীকে অপর্যাপ্ত বিবেচনা করে একজন বললেন, আমি সর্বদা সারারাত নাময পড়ব; আরেকজন বললেন, আমি সারা বছর রোজা রাখব এবং কখনো ভাঙ্গবো না। এ সময় আল্লাহর নবী তাদের কাছে এলেন এবং বললেন: “আল্লাহর শপথ আল্লাহর প্রতি আনুগত্য আমারই সবচেয়ে বেশী এবং তাঁকে বেশী ভয় করি তোমাদের চেয়ে; তথাপি আমি রোযা রাখি এবং ভাঙ্গিও, আমি ঘুমোই এবং নারীকে বিয়ে করি। সুতরাং যে আমার সুন্নাহকে অনুসরণ করে না সে আমার অনুসারীদের অন্তর্ভূক্ত নয়।”

প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ (সা) -এর সুন্নাহর মধ্যেই ইসলামের ধ্যান ধারণা এবং তার বাস্তব রূপায়নের সমগ্র চিত্র ফুটে উঠেছে। এতে আল্লাহর প্রতি, পরিবারের প্রতি, নিজের প্রতি, তথা প্রতিটি ক্ষেত্রে দায়িত্ব ও কর্তব্যের এক সুষম ও সমন্বিত রুপ মূর্ত হয়েছে।

ধর্মীয় চরমপন্থার ত্রুটি বস্তুত সকল উগ্রতা ও বাড়াবাড়ির মধ্যে মারাত্মক ত্রুটি অন্তর্নিহিত থাকে। এ কারণে এর বিরুদ্ধে সতর্কতা বাঞ্ছনীয়। প্রথম ত্রুটি হচ্ছে সাধারণ মানবীয় প্রকৃতি বাড়াবাড়ির (excessivenes) সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়; এই প্রকৃতি কোনো বাড়াবাড়িকে বরদাশত করতে পারে না। যদি মুষ্টিমেয় লোক স্বল্প সময়ের জন্যেও বাড়াবাড়ি সহ্য করতে পারে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তা করতে সক্ষম হবে না। আল্লাহর বিধান সমগ্র মানুষের জন্যে, মুষ্টিমেয় হঠকারীর জন্যে নয় যাদের তথাকথিত সহন ক্ষমতা বেশি বলে আপাতত প্রতীয়মান হয়। একবার রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর একজন বিশিষ্ট সাহাবী মুয়াযের ওপর ক্রদ্ধ হয়েছিলেন। কারণ তিনি নামাযের ইমামতিতে দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ করেছিলেন বলে একজন মুসল্লী অভিযোগ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে বললেন: “হে মুয়ায ! তুমি কি মুসল্লীদের পরীক্ষা করছ? তিনি তিনবার এ কথার পুনরুক্তি করলেন।” (বুখারী) আরেকবার মহানবী (সা) অস্বাভাবিক ক্রুদ্ধ হয়ে একজন ইমামকে লক্ষ্য করে বললেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ ভাল কাজের (নামায) প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা সৃষ্টি কর। তাই তোমরা যখনি নামায পড়াবে তখন তা সংক্ষিপ্ত করা উচিত, কারণ মুসল্লীদের মধ্যে দুর্বল ও বৃদ্ধ এবং কর্মব্যস্ত লোক থাকে। ” (বুখারী) রাসুলুল্লাহ (সা) মুয়ায ও আবু মূসাকে ইয়ামানে প্রেরণের প্রাক্কালে এই উপদেশ দিয়েছিলেন:“(জনগণের কাছে ধর্মীয় বিষয়গুলো) সহজ করে তুলে ধরো, কঠিনরূপে নয়। একে অপরকে মান্য করো, বিভেদে লিপ্ত হয়ো না।” (সকল প্রামাণ্য সূত্রে সমর্থিত)

উমর ইবনে খাত্তাব (রা) এর ওপর জোর দিয়ে বলেছেন: “নামাযের ইমামতিতে দীর্ঘসূত্রিতা করে বান্দার কাছে তার কাজকে (আমল) এবং আল্লাহকে ঘৃণার পাত্রে পরিণত করো না”।

বাড়াবাড়ি দ্বিতীয় ত্রুটি হচ্ছে, এটি ক্ষণস্থায়ী। যেহেতু মানুষের সহ্য ক্ষমতা ও অধ্যবসায় স্বভাবত সীমিত তাই সহজে সে একঘেঁয়েমি অনুভব করে। দীর্ঘ সময় ধরে বাড়াবাড়িমূলক ক্রিয়াকর্মে লিপ্ত থাকা তার স্বভাব বিরুদ্ধ। এমন একটা সময় আসবে যখন সে ক্লান্ত হয়ে পড়বেই, দৈহিক ও মানসিক উভয় দিক দিয়ে। এমনকি স্বভাবসম্মত নূন্যতম কাজটিও সে পরিত্যাগ করবে। অথবা অতিরিক্ত আমলের উল্টো এমন এক পথ বেছে নেবে যা হবে শেষ পর্যন্ত চরম অবহেলা ও শৈথিল্যের শামিল। এমন কিছু লোকের সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটেছে যাদেরকে দৃশ্যত গোঁড়া ও কঠোর মনে হয়েছে। পরে আমি তাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি যে, তারা হয় পথভ্রষ্ট হয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত পথে চলতে শুরু করেছে কিংবা ন্যূনপক্ষে হাদীসে বর্ণিত হঠকারী চরিত্রের লোকদের মতো সবেগে পিছু হটে এসেছে। এ সম্পর্কিত হাদীসটি হচ্ছে: “যে (হঠকারী জল্লাদবাজ লোক) (নির্দিষ্ট) দূরত্বও অতিক্রম করতে পারে না এমনকি পারে না তার বাহনের পিঠটাকেও ঠিক রাখতে।” (জাবিরের সনদে আল-বাজ্জাজ)

রাসূলুল্লাহর (সা) আরেকটি হাদীসেও এরূপ ইঙ্গিত রয়েছে: “সেই সব সৎকর্মে প্রবৃত্ত হও যা সহজে সম্পন্ন করা যায়; কেননা আল্লাহ তায়ালা (পুরষ্কার দানে) ক্লান্ত হন না যতোক্ষণ না তুমি (নেক আমলে) ক্লান্ত ও অবসন্ন হও... এবং আল্লাহর কাছে সেই আমলই সবচেয়ে প্রিয় যা নিয়মিত সম্পাদন করা হয় তা যতই ছোট হোক না কেন।” (হযরত আয়েশার (রা) বরাতে বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ ও আন-নাসাঈ) ইবনে আব্বাস (রা) বলেন: “মহানবী (সা) -এর একজন সেবক দিনে রোযা রাখতেন আর সারা রাত নামায পড়তেন। রাসূলুল্লাহ (সা) কে এ বিষয়ে জানান হলে তিনি বললেন, “প্রতিটি কাজের একটি শীর্ষ বিন্দু থাকে এবং তাকে অনিবার্যভাবে অনুসরণ করে শৈথিল্য। যে তার স্বাভাবিক সরল জীবনে আমার সুন্নাহকে অনুসরণ করে সে সঠিক পথে আছে আর যে শৈথিল্যের কারণে অন্যের পথ নির্দেশ অনুসরণ করে সে (ভুল করল) এবং (আল্লাহ পাক প্রদত্ত সরল পথ থেকে) বিচ্যুত হলো।” (আল বাজ্জাজ)

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বলেন: “ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকতে থাকতে ক্লান্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা) কে অবহিত করা হলে তিনি বললেন: ‘এটা হচ্ছে ইসলামের কঠোর অনুশীলন এবং আমলের সর্বোচ্চ পর্যায়। প্রতিটি গোঁড়া ক্রিয়াকলাপের একটি শীর্ষ পর্যায় থাকে এবং সেই সাথে থাকে অনিবার্য শৈথিল্য.. যার সহজ-সরল আমল কিতাব (কুরআনুল কারীম) ও সুন্নাহর আলোকে নিষ্পন্ন হয় সে-ই সঠিক পথের ওপর কায়েম থাকে আর যার অবসন্নতা অবাধ্যতায় পর্যবসিত হবে তার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।” (আহমাদ এবং আবু শাকির সমর্থিত)

ইবাদতের ক্ষেত্রে চরমপন্থা বর্জনের এবং মধ্যপন্থা অবলম্বনের কী চমৎকার তাগিদ এই হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা) মুসলমানদেরকে দিয়েছেন! তিনি আরো বলেছেন: “ধর্ম খুব সহজ আর সে নিজের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে নেয় সে তা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে না। সঠিক পথে চলো (বাড়াবাড়ি বা অবহেলা কোনটাই না করে), (পূর্ণতার) নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করো এবং (তোমার সৎকর্মের পুরষ্কার লাভের জন্যে) সুসময়ের অপেক্ষা করো।” (বুখারী ও নাসাঈ, আবু হুরায়রা বর্ণিত)

তৃতীয়ত, হঠধর্মী বাড়াবাড়ি অন্যের অধিকার ও কর্তব্যকে বিপন্ন করে। এ প্রসঙ্গে একজন বুযুর্গ বলেন: “প্রত্যেক বাড়াবাড়ির মধ্যে কারো কারো অধিকার হারানোর বেদনা জড়িত আছে।” আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) ইবাদত-বন্দেগীতে এমন মশগুল থাকতেন যে, তার স্ত্রীর প্রতি কর্তব্যও উপেক্ষিত হচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) একথা জানতে পেরে বললেন, “হে আবদুল্লাহ, আমি কি শুনিনি যে, তুমি সারাদিন রোযা রাখো আর সারারাত বন্দেগী করো?” আবদুল্লাহ বলেন, “জী হ্যাঁ, আল্লাহর রাসূল! মহানবী (সা) বললেন, “এরূপ করো না, কয়েকদিন রোযা রাখো আবার কয়েক দিনের জন্যে ছিড়ে দাও, রাতে বন্দেগীও করো আবার ঘুমোতেও যাও। তোমার ওপরে তোমার শরীরের অধিকার আছে, তেমনি তোমার ওপরে তোমার স্ত্রীর দাবী আছে এবং তোমার ওপর তোমার অতিথিরও দাবী আছে......।” (বুখারী)

এ ব্যাপারে প্রখ্যাত সাহাবী সালমান ফারসী এবং তাঁর অন্তরঙ্গ আবু দারদার মধ্যেকার ঘটনাটিও প্রণিধানযোগ্য। রাসূলুল্লাহ (সা) সালমান ও আবু দারদার মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন কায়েম করে দিয়েছিলেন। একদা সালমান আবু দারদার বাড়িতে বেড়াতে গেলেন। দেখলেন আবু দারদার স্ত্রী উমআল দারদা জীর্ণবসন পরিহিতা। তিনি এর কারণ জিজ্ঞেস করলে উমআল দারদা বললেন আপনার ভাই দুনিয়াবী (সাজগোজে) আগ্রহী নন। ইতিমধ্যে আবু দারদা এলেন এবং সালমানের জন্যে খাবারের আয়োজন করলেন। সালমান তার সাথে আবু দারদাকে খেতে বললে তিনি বললেন, ‘আমি রোযা আছি’। তখন সালমান বললেন, ‘তুমি না খেলে আমিও খাব না।’ সুতরাং আবু দারদাও সালমানের সাথে খেলেন। রাতে আবু দারদা নামাযের জন্যে উঠলে সালমান তাকে ঘুমোতে যেতে বললেন। দারদা তাই করলেন। আবু দারদা পুনরায় শয্যাত্যাগ করলে সালমান আবার তাকে ঘুমোতে যেতে বললেন। শেষরাতে সালমান আবু দারদাকে উঠতে বললেন এবং উভয়ে নামায আদায় করলেন। পরে আবু দারদাকে সালমান বললেন, “তোমার ওপরে তোমার প্রভুর অধিকার আছে, তোমার ওপর তোমার আত্মার অধিকার আছে, তোমার ওপর তোমার পরিবারের অধিকার আছে, সুতরাং প্রত্যেককে তার ন্যায্য অধিকার দাও।” আবু দারদা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে এ ঘটনা বিবৃত করলেন। তিনি বললেন: “সালমান সত্য কথাই বলেছে।” (বুখারী ও তিরমিযী)

ধর্মীয় চরমপন্থার ধারণা ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রতিকার করতে হলে সর্বপ্রথমে এর সঠিক সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা ও গভীর পর্যালোচনা প্রয়োজন। বিশুদ্ধ ইসলামী চেতনা ও শরীয়ার ভিত্তিতেই বিষয়টির বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে। অন্য কোনো মানদন্ডে বিচার করলে তার কোনো মূল্য নেই, কেবল ব্যক্তিগত মতামতের কোন অবকাশ থাকতে পারে না। এ প্রসঙ্গে কুরআন বলছে: “যদি তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে মতভেদ সৃষ্টি হয় তবে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে পেশ করো যদি তোমরা আল্লাহ ও কিয়ামতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে থাকো।” (৪:৫৯)

মুসলিম উম্মাহর সমগ্র ইতিহাসে এ ব্যাপারে ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, মুসলমানদের মধ্যে বিভেদের বিষয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে পেশ করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর কিতাব, আল কুরআন এবং মহানবী (সা)-এর সুন্নাহর মধ্যে এর সমাধান অন্বেষণ। শরীয়ভিত্তিক এরুপ অনুমোদন ছাড়া মুসলিম যুব সমাজ-যাদের বিরুদ্ধে চরমপন্থার অভিযোগ আনা হয়েছে-মুসলিম আলিমদের ফতোয়াবাজির প্রতি কর্ণপাত করবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে যাবে। অধিকন্তু তারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই অজ্ঞতা ও মিথ্যাচারের অভিযোগ আনবে।

এখানে উল্লেখ্য, ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস আশ-শাফিঈর বিরুদ্ধে রাফেজী হওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি কোনো পরোয়া না করে এই সস্তা অভিযোগের বিরোধিতা করে একটি শ্লোক পাঠ করেন যার অর্থ হচ্ছে: “আহালে বায়েতের সকলের প্রতি ভালবাসাই যদি হয় প্রত্যাখ্যান তবে মানুষ ও জিনকে সাক্ষী করে বলছি যে, আমি একজন প্রত্যাখ্যানকারী।” বর্তমান যুগের একজন ইসলাম প্রচারক তার বিরুদ্ধে “প্রতিক্রিয়াশীলতার” অভিযোগ শুনে বলেন “কুরআন ও সুন্নাহর সুনির্দিষ্ট অনুসরনই যদি প্রতিক্রিয়াশীলতা তাহলে আমি প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবেই বাঁচতে, মরতে ও পুনরুত্থিত হতে চাই।”

আসলে “প্রতিক্রিয়াশীলতা”, “অনমনীয়তা” ,“গোড়ামী” ইত্যাদি শব্দের সঠিক সংজ্ঞা নিরূপণ করা অত্যাবশ্যক। তাহলেএক গ্রুপের বিরুদ্ধে আরেক গ্রুপের এসব শব্দের অপব্যবহার যেমন রোধ করা যাবে তেমনি ডান-বাম বলে পরিচিত বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী ও সামাজিক মহল এসব শব্দের সুবিধাবাদী মনগড়া ব্যাখ্যাও দিতে পারবে না। একইভাবে “ধর্মীয় চরমপন্থা” শব্দটির সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা নির্ণীত না হলে সবাই নিজ নিজ মর্জি মাফিক এর প্রয়োগ করবে। ফলত মুসলিম সমাজে বিভেদ ক্রমবিস্তৃত হতে থাকবে আল-কুরআন ঘোষণা করেছে:

“যদি সত্য তাদের ইচ্ছা মাফিক নির্ধারিত হতো তাহলে আকাশ ও পৃথিবী এবং উভয়ের মধ্যস্থিত সব কিছু বিভ্রান্তি ও দুর্নীতি পূর্ণ হয়ে উঠতো।” (২৩:৭১)

এখন আমি দু'টো গুরুত্বপূর্ন বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। প্রথম, একটি মানুষের সাধুতার (piety) মাত্রা এবং যে পরিবেশের মধ্যে তিনি বাস করেন তা বহুলাংশে অন্য মানুষের প্রতি তার মনোভাব গঠনের প্রভাবিত করে থাকে। কঠোর ধর্মীয় পটভুমি থেকে গড়ে ওঠা একজন মানুষ কারো মধ্যে সমান্যতম বিচ্যুতি বা অবহেলা দেখলে সহ্য করতে পারেন না। তার দৃষ্টিতে বিচার করে তিনি যদি দেখেন যে এমন মুসলমানও আছে যারা তাহাজ্জুদ পড়ে না বা নফল নামায পড়ে না তবে তার বিষ্ময়ের ঘোর কাটতে বেশ সময় লাগবে বৈ কি। এটা ঐতিহাসিকভাবেই খাঁটি কথা। মানুষের আমল ও আখলাকের পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, তাবেঈন এবং রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সাহাবীদের নিকটবর্তী যুগের লোকদের আমলের তুলনায় পরবর্তী লোকদের (মুসলমানদের) আমল-আখলাক ততোটা উজ্জ্বল নয়। একটি প্রাবাদে আছে: “পরবর্তী লোকদের নেক কাজ পূর্ববর্তী লোকদের ত্রুটির সমতুল্য।” এখানে আনাস ইবনে মালিক (রা) তার সমসাময়িক তাবেঈনদের উদ্দেশ্যে যা বলতেন তা স্মর্তব্য “আপনারা তুচ্ছ জ্ঞান করে অনেক কাজ করছেন অথচ একই কাজ রাসূলুল্লাহ (সা) -এর আমলে ভয়ানক পাপ বলে গণ্য করা হতো।” একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন হযরত আয়েশা (রা)। তিনি বিখ্যাত কবি লাবিদ ইবনে রাবিয়ার একটি শ্লোক আবৃত্তি করতেন। তিনি তার এই শ্লোকে এই বলে বিলাপ করেছেন যে, সমাজে অনুকরণীয় সজ্জন ব্যক্তিদের অন্তর্ধানে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা স্থান দখল করেছে ছন্নছাড়ারা যাদের সঙ্গ মামড়ি-পড়া পশুদের মতোই বিষাক্ত। হযরত আয়েশা (রা) এই ভাবে বিস্মিত হতেন যে লাবিদ আজ বেঁচে থাকলে বর্তমান সমাজের চেহারা দেখে কী মনে করতেন! হযরত আয়েশা (রা) -এর ভাগ্নে উরওয়াহ ইবনে আল জুবায়েরও এই শ্লোকটি আবৃত্তি করে ভাবতেন আজ হযরত আয়েশা (রা) ও বেঁচে থাকলে এ যুগের অধঃপতনকে কী চোখে দেখতেন! এবার আমরা এর উল্টোটা দেখি। যে ব্যক্তির ইসলাম সম্পর্কে তেমন জ্ঞান বা আনুগত্যবোধ নেই কিংবা সে এমন এক পরিবেশে গড়ে উঠেছে যেখানে শরীয়ত উপেক্ষিত বরং আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তাই করা হয় নিদ্বির্ধায়, সেই ব্যক্তি ইসলামের প্রতি কারো সামান্য অনুরাগ দেখলেই তাকে গোঁড়া বা চরমপন্থী বলে মনে করবে। এমন ব্যক্তি সাধুতার ভান করতে অভ্যস্ত এবং সে ধর্মের কোনো কোনো বিষয়ের সমালোচনা করেই ক্ষান্ত হবে না, এরা যৌক্তিকতাকেও অস্বীকার করে বসবে। ইসলামের প্রতি যারা অনুরক্ত তাদেরকে সে অভিযুক্ত করবে এবং কোনটা হারাম আর কোনটা হলাল সে বিষয়ে তর্ক করতে তার জুড়ি মেলা ভার। অবশ্য ইসলাম থেকে দুরত্বে অবস্থানের দরুনই এসব মানুষের এরুপ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। ভিন্ন আদর্শ ও জীবন ধারার প্রভাবের কারণে কোনো কোনো মুসলমানের কাছে পানাহার, সৌন্দর্যবোধ, শরীয়তের পাবন্দীর তাগিদ এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্টার মতো সুষ্পষ্ট ইসলামী মূল্যবোধগুলো ধর্মীয় গোঁড়ামী বা চরমপন্থা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। এমন ব্যক্তির চোখে শ্বশ্রুমন্ডিত মুসলমান তরুণ কিংবা হিজাব পরা মুসলিম তরুণী মাত্রই চরমপন্থী। এমনকি ভাল কাজের আদেশ ও খারাপ কাজের নিষেধকে গোঁড়ামী এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ বলে মনে করা হয়। আমরা জানি আমাদের ধর্ম বিশ্বাসের মূল ভিত্তি হচ্ছে একমাত্র ইসলামকেই সত্য বলে মেনে নেয়া এবং যারা এটা বিশ্বাস করে না তারা বিভ্রান্ত বলে স্বীকার করা। কিন্তু এ সমাজে এমন মুসলমানও দেখা যায় যারা এটা মানতে নারাজ। যারা ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মগ্রহণ করেছে তাদের কাফির গণ্য করতে তাদের ঘোরতর আপত্তি! এটাকেও তারা উগ্রতা ও গোঁড়ামী বলে মনে করে। আর এটা এমন একটা ইস্যু, যে ব্যাপারে আমরা কখনোই আপোস করতে পারি না।

দ্বিতীয়ত, কেউ জোরালো মতামত অবলম্বন করলেই তাকে “ধর্মীয় চরমপন্থী” বলে অভিযুক্ত করা অন্যায়। কেউ যদি তার মতামত সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত হয় যে, এ ব্যাপারে শরীয়তেরও অনুমোদন রয়েছে তবে সে তার মত অনুযায়ী স্বাচ্ছন্দে চলতে পারে। তার পেছনে ফুকাহাদের সমর্থন দুর্বল বলে অন্যেরা মনে করলেও তাতে কিছু আসে যায় না। সে তো কেবল তার চিন্তা ও বিশ্বাসের জন্যে দায়ী। সে যদি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতাকে সীমিত গন্ডিতে অনুশীলন না করে নিজের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে নেয়, কারো বলার কিছু নেই। কেননা সে হয়তো মনে করে অতিরিক্ত আমলের মাধ্যমে আল্লাহর রেজামন্দী হাসিল করা সহজ হবে। বস্তুত এসব বিষয়ে মত পার্থক্যের অবকাশ আছে। কেউ একটা বিষয়কে সহজভাবে নেয় আবার অনেকে এর বিপরীত আচরণে অভ্যস্ত। রাসূলে কারীম (সা) -এর সাহাবীদের বেলায়ও একথা সত্য। উদাহরণস্বরুপ, ইবনে আব্বাস (রা) ধর্মীয় বিষয়গুলোর প্রতি সহজতর দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন, কিন্তু ইবনে উমর (রা) ছিলেন কঠোর মনোভাবাপন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, একজন মুসলমানের পক্ষে যথেষ্ট হবে যদি সে কোনো একটি মাযহাবের অনুসরণ করে অথবা কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক নির্ভরযোগ্য ইজতিহাদের পন্থা অনুসরণ করে। অতএব যদি কেউ চার ইমাম যথা শাফিঈ, আবু হানিফা, মালিক ও আহমদ ইবনে হাম্বলের (রা) মাযহাবের মধ্যে কোনো একটি অনুসরণ করে এবং তা যদি অন্য কিছু পন্ডিতের বিবেচনায় সমকালীন মতের বিরোধী হয় তাহলেই কি ঐ ব্যক্তিকে চরমপন্থী বা গোঁড়া বলে অভিহিত করা সঙ্গত হবে? আমাদের কি কোনো অধিকার আছে অন্য কোনো ব্যক্তির ইজতিহাদী পন্থা বেছে নেয়ার অধিকারকে খর্ব করার?

বহু ফকীহ এই রায় দিয়েছেন যে, মুখমন্ডল ও হাত বাদ দিয়ে মুসলিম মহিলারা সমগ্র দেহকে আবৃত করে- এমন পোষাক পরতে পারে। হাত ও মুখমন্ডলকে ছাড় দেয়ার পক্ষে তারা কুরানের এই আয়াতকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন: “..... তাদের সৌন্দর্য ও অলঙ্কার প্রদর্শন করা উচিত নয়, তা ব্যতীত যা (অবশ্যই সাধারণভাবে) দৃষ্টিগোচর হয়।” (২৪:৩১)

এর পক্ষে তারা হাদীসের প্রামাণ্য ঘটনা এবং ঐতিহ্যের সমর্থনও পেশ করেছেন। বহু সমকালীন আলেমও এই মতের সমর্থক, আমি নিজেও।পক্ষান্তরে, অনেক আলেম যুক্তি পেশ করে বলেছেন যে, হাত এবং মুখও ‘আওরা’ অর্থাৎ অবশ্যই ঢাকতে হবে। তারাও কুরআন, আল-হাদীস ও প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্য থেকে প্রমাণ পেশ করেন। সমসাময়িক বহু আলেম এই মতের সমর্থক। এদের মধ্যে পকিস্তান, ভারত, সউদী আরব ও উপসাগরীয় দেশের আলেমও রয়েছেন। তারা মুসলিম মহিলাদের মুখ ঢাকতে এবং হাত মোজা পরতে বলেন। এখন কোনো মহিলা যদি ঈমানের অঙ্গ হিসেবে এটা পালন করেন তবে তাকে কি গোঁড়া বলে চিহ্নিত করতে হবে? কিংবা কোনো ব্যক্তি যদি তার স্ত্রী কন্যাকে এটা মেনে চলার জন্য তাগিদ দেন তাহলে তাকেও কি চরমপন্থী বলে অভিহিত করতে হবে? আল্লাহর বিধান বলে কেউ যা মনে করে তা ছেড়ে দিতে কাউকে বাধ্য করার অধিকার কি আমাদের আছে? তা যদি করি তাহলে কি আমরা আমাদের খেয়ালখুশী চাপিয়ে দেয়া কিংবা চরমপন্থী বরে অভিযোগ এড়ানোর জন্যে আরেকজনকে আল্লাহর ক্রোধের দিকে ঠেলে দেয়ার অযাচিত নছিহত করব না? নাচ-গান, ছবি ও আলোকচিত্রের ব্যাপারে যারা কঠোর মনোভাব পোষণ করেন সে ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এসব কঠোর মত আমার ব্যক্তিগত ইজতিহাদ থেকে শুধু নয় বরং অন্যান্য প্রখ্যাত আলেমদের ইজতিহাদ থেকেও ভিন্নতর। কিন্তু স্বীকার করতেই হয় যে এসব মতামতের সাথে প্রাথমিক যুগ ও সমসাময়িক অনেক আলিমদের দৃষ্টিভঙ্গির সাজুয্য রয়েছে।

আমরা অনেকে শার্ট ও প্যান্টের পরিবর্তে ছওব (ঢিলা জামা-কাপড়) পরা অথবা মেয়েদের সাথে মোসাফাহা না করাকে গোঁড়ামি বলে সমালোচনা করি; কিন্তু খোদ উসূলে ফিকাহ এবং উম্মাহর ঐতিহ্যের মধ্যেই এসব বিষয়ে বিতর্কের বীজ নিহিত রয়েছে। মতপার্থক্য থাকার সুযোগের কারণেই সমসাময়িক আলিমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মত প্রকাশ করেন এবং জোর প্রচার চালান। ফলত, আল্লাহর রহমতের আশা এবং তাঁর শাস্তির ভয়ে কিছু নিষ্ঠাবান মুসলিম তরুণ এসব বিষয় মেনে নেন। সুতরাং ফকীহর রায়ের ভিত্তিতে আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কেউ যদি ধর্মচর্চায় কঠোরতা অবলম্বন করে তবে সে জন্যে তাকে নিন্দা করা বা গোঁড়ামির অপবাদ দেয়া সমীচীন নয়। তার বিশ্বাসের পরিপন্থী আচরণে তাকে বাধ্য করার অধিকার আমাদের নেই। আমাদের একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে প্রজ্ঞা, যুক্তি ও ধৈর্যের মাধ্যমে এমনভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা যাতে আমরা যেটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করি তা গ্রহণে সে উদ্বুদ্ধ হয়।

চলবে...... ইনশাআল্লাহ! 
শামীম আজাদ এর স্টাডি সার্কেল থেকে নেয়া

Post a Comment

0 Comments