Recent Tube

তাসবীহ পাঠে দানা বা মালার ব্যবহার!; আব্দুল হামীদ আল-ফাইযী আল-মাদানী।

 
 তাসবীহ পাঠে দানা বা মালার ব্যবহার!;

 মহান আল্লাহর করুণা লাভের অন্যতম উপায় হল সময়ে ও অবসর সময়ে তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করা। মহান প্রতিপালকের স্মরণ থেকে বিস্মৃত না হওয়া। তাঁর যিকরের ব্যাপারে উদাসীন না থাকা। আর তাহলেই তাঁর রহমত ও করুণা আমাদের উপর বর্ষিত হবে।
বিশেষ ক'রে যাদের অবসর সময় বেশি, যারা শুয়ে-বসে অধিকাংশ সময় নষ্ট করে, যারা বেকার বসে থাকে, তাদের সেই অবসর ও সময়কে কাজে লাগানো তথা মহান আল্লাহর যিকরে কাটানো উচিত।
মহানবী ﷺ বলেছেন,
((يَا نِسَاءَ الْمُؤْمِنَاتِ عَلَيْكُنَّ بِالتَّهْلِيلِ وَالتَّسْبِيحِ وَالتَّقْدِيسِ وَلَا تَغْفُلْنَ فَتَنْسَيْنَ الرَّحْمَةَ وَاعْقِدْنَ بِالْأَنَامِلِ فَإِنَّهُنَّ مَسْئُولَاتٌ مُسْتَنْطَقَاتٌ))
“হে মু'মিন মহিলাগণ! তোমরা তাহলীল, তাসবীহ ও তাক্বদীস পড়তে অভ্যাসী হও। তোমরা উদাস হয়ো না, নচেৎ রহমত বিস্মৃত হবে। আর তোমরা আঙ্গুলের গিরা গণনা কর। যেহেতু তাকে (কিয়ামতে) জিজ্ঞাসা করা এবং কথা বলানো হবে।” (আহমাদ ২৭০৮৯, তিরমিযী ৩৫৮৩, ত্বাবারানীর আওসাত্ব ৫০১৬, ইবনে আবী শাইবাহ ৭৬৫৬, সঃ জামে' ৪০৮৭নং)

    কুরআন ও হাদীসে মহান আল্লাহ যিকর করার নির্দেশ ভূরিভূরি আছে। উক্ত হাদীসে কেবল মহিলাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে, কারণ সাধারণতঃ পুরুষদের তুলনায় তাদের উদাসীনতা বেশি, তাদের অবসর সময় বেশি এবং তারা সময়ের অপচয় ঘটায় অধিক।
“তোমরা তাহলীল পড়তে অভ্যাসী হও” অর্থাৎ, তোমরা 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' বেশি বেশি পড়।
“তোমরা তাসবীহ পড়তে অভ্যাসী হও” অর্থাৎ, তোমরা 'সুবহানাল্লাহ' বেশি বেশি পড়।
“তোমরা তাক্বদীস পড়তে অভ্যাসী হও” অর্থাৎ, তোমরা 'সব্বূহুন ক্বুদ্দূসুন রব্বুল মালাইকাতি অর-রূহ' বেশি বেশি পড়।

  (ডান হাতের) আঙ্গুল দিয়ে তসবীহ গণনা কর। কারণ তাকে কিয়ামতে জিজ্ঞাসা করা হবে। যেমন বান্দার ভালো-মন্দের ব্যাপারে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে জিজ্ঞাসা করা হবে।
যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন,
{إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْؤُولاً} (36) سورة الإسراء
“নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় ওদের প্রত্যেকের নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে।” (বানী ইস্রাঈলঃ ৩৬)

    বান্দাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, এই অঙ্গসমূহকে সে কোন কাজে ব্যবহার করেছে? অনুরূপ এই অঙ্গসমূহকেও জিজ্ঞাসা করা হবে, তারা যার অধীনে ছিল, সে তাদেরকে কোন কাজে ব্যবহার করেছে? সে তাদের দ্বারা কী আমল করেছে?

  মহান আল্লাহ বলেছেন,
{يَوْمَ تَشْهَدُ عَلَيْهِمْ أَلْسِنَتُهُمْ وَأَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُم بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ } (24) سورة النــور
“যেদিন তাদের বিরুদ্ধে তাদের রসনা, তাদের হাত ও পা তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে সাক্ষি দেবে।” (নূর ঃ ২৪),

     প্রকাশ থাকে যে, এখানে আমভাবে যিকর করার কথা বলা হয়েছে। যেমন 
কুরআন-হাদীসের বহু উক্তিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমভাবে যিকর করার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং যা আম থাকে, তা আমভাবেই আমল করতে হবে। তাকে কোন নির্দিষ্ট সময়, সংখ্যা বা পদ্ধতি দ্বারা খাস করা যাবে না। যে যিকর যে সময়ে পড়ার কথা এসেছে, সেই যিকর সেই সময় পড়তে হবে। যে যিকর যে সংখ্যায় পড়ার কথা এসেছে, সেই যিকর সেই সংখ্যা গণনা ক'রে পড়তে হবে। যে যিকর যে নিয়মে পড়ার কথা এসেছে, সেই যিকর সেই নিয়মে পড়তে হবে। এর ব্যতিক্রম করলেই বিদআত হবে।

     তাহলে কি আঙ্গুলের বদলে তসবীহ-দানা বা গণনার যন্ত্র দিয়ে তসবীহ গোনা বিদআত হবে?
হ্যাঁ, অনেকে তাই বলেছেন। যেহেতু সুন্নত হল আঙ্গুল দিয়ে গোনা। তখন অন্য কিছু দিয়ে গোনা হবে বিদআত।
তবে অনেকে বলেছেন, না, বিদআত নয়। কারণ কাঁকর, দানা, মালা বা যন্ত্র ব্যবহার করা ইবাদত নয়; বরং তা ইবাদতের অসীলা। আর অসীলা বিদআত হয় না; যেমন নামাযে মাইক প্রভৃতি বিদআত নয়।
  
      তাঁরা আরো বলেন, কাঁকর দিয়ে তসবীহ গোনা হাদীসে এসেছে। কয়েকজন মহিলাকে গুনতে দেখে মহানবী ﷺ নিষেধ করেননি। সুতরাং মৌন-সম্মতি বৈধতার দলীল। আর কাঁকর দিয়ে তসবীহ গোনা বৈধ হলে মালা দিয়েও বৈধ হবে।

      কিন্তু সমস্যা হল এ ব্যাপারে যে সকল হাদীস এসেছে, তা সহীহ নয়। পরন্তু কাঁকর দিয়ে তসবীহ গোনা দেখে সাহাবী আবূ মূসা আশআরী (রায্বিয়াল্লাহু আনহু) ও আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রায্বিয়াল্লাহু আনহু) আপত্তি করেছেন।

      আমর বিন সালামাহ বলেন, ফজরের নামাযের পূর্বে আমরা আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রায্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর বাড়ির দরজায় বসে থাকতাম। যখন তিনি নামাযের জন্য বের হতেন, তখন আমরা তাঁর সাথে মসজিদে যেতাম। (একদা ঐরূপ বসেছিলাম) ইতিমধ্যে আবু মূসা আশআরী আমাদের নিকট এসে বললেন, 'এখনো কি আবূ আব্দুর রহমান (ইবনে মাসঊদ) বের হননি?' আমরা বল্লাম, 'না।' অতঃপর তাঁর অপেক্ষায় তিনিও আমাদের সাথে  বসে গেলেন। তারপর তিনি যখন বাড়ি হতে বের হয়ে এলেন, তখন আমরা সকলে তাঁর প্রতি উঠে দন্ডায়মান হলাম। আবূ মূসা আশআরী তাঁর উদ্দেশ্যে বললেন, 'হে আবু আব্দুর রহমান! আমি মসজিদে এক্ষনি এমন কাজ দেখলাম, যা অদ্ভুত বা অভূতপূর্ব। তবে আলহামদুলিল্লাহ, আমি তা ভালই মনে করি।' তিনি বললেন, 'কী সেটা? ' (আবু মূসা) বললেন, 'যদি বাঁচেন তো দেখতে পাবেন; আমি মসজিদে এক সম্প্রদায়কে এক-এক গোল বৈঠকে বসে নামাযের প্রতীক্ষা করতে দেখলাম। তাদের হাতে রয়েছে কাঁকর। প্রত্যেক মজলিসে কোন এক ব্যক্তি অন্যান্য সকলের উদ্দেশ্যে বলছে, একশত বার 'আল্লাহু আকবার' পড়। তা শুনে সকলেই শতবার তকবীর পাঠ করছে। লোকটি আবার বলছে, একশত বার 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' পড়। তা শুনে সকলেই শতবার তাহলীল পাঠ করছে। আবার বলছে, একশত বার 'সুবহানাল্লাহ' পড়। তা শুনে সকলেই শতবার তসবীহ পাঠ করছে।' তিনি  (ইবনে মাসউদ) বললেন, 'আপনি ওদেরকে কী বললেন?' আবু মূসা বললেন, 'আপনার রায়ের অপেক্ষায় আমি ওদেরকে কিছু বলিনি।' তিনি বললেন, 'আপনি ওদেরকে নিজেদের পাপ গণনা করতে কেন আদেশ করলেন না এবং ওদের পুণ্য বিনষ্ট না হবার উপর যামানত কেন নিলেন না?'
আমর বলেন, অতঃপর আমরা তাঁর সাথে  চলতে লাগলাম। তিনি ঐ সমস্ত গোল বৈঠকের কোন এক বৈঠকের সম্মুখে পৌঁছে দন্ডায়মান হয়ে বললেন, 'আমি তোমাদেরকে একি করতে দেখছি?' ওরা বলল, 'হে আবু আব্দুর রহমান! কাঁকর, এর দ্বারা তকবীর, তহলীল ও তসবীহ গণনা করছি।' তিনি বললেন, 'তোমরা তোমাদের পাপরাশি গণনা কর, আমি তোমাদের জন্য যামিন হচ্ছি যে, তোমাদের কোন পুণ্য বিনষ্ট হবে না। ধিক তোমাদের প্রতি হে উম্মতে মুহাম্মাদ! কী সত্বর তোমাদের ধ্বংসের পথ এল! তোমাদের নবীর সাহাবাবৃন্দ এখনও যথেষ্ট রয়েছেন। এই তাঁর বস্ত্র এখনো বিনষ্ট হয়নি। তাঁর পাত্রসমূহ এখনো ভগ্ন হয়নি। তাঁর শপথ যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে! তোমরা এমন মিল্লাতে আছ যা মুহাম্মাদ ﷺ-এর মিল্লাত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর অথবা তোমরা ভ্রষ্টতার দ্বার উদঘাটনকারী?!' ওরা বলল, 'আল্লাহর কসম, হে আবু আব্দুর রহমান! আমরা ভালরই ইচ্ছা করেছি।' তিনি বললেন, 'কিন্তু কত ভালোর অভিলাষী ভালোর নাগালই পায় না! অবশ্যই আল্লাহর রসূল ﷺ আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, “এক সম্প্রদায় কুরআন পাঠ করবে, কিন্তু তাদের ঐ পাঠ (তিলাঅত) তাদের কণ্ঠ অতিক্রম করবে না।” আর আল্লাহর কসম! জানি না, সম্ভবতঃ তাদের অধিকাংশই তোমাদের মধ্য হতে।'
অতঃপর তিনি সেখান হতে প্রস্থান করলেন। আমর বিন সালামাহ বলেন, 'নহরওয়ানের দিন ঐ বৈঠকসমূহের অধিকাংশ লোককেই খাওয়ারেজদের সাথে  দেখেছিলাম। যারা আমাদের (আলী ও অন্যান্য সাহাবাদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়ছিল।' (সিলসিলাহ সহীহাহ ২০০৫নং)
ইবনে অযযাহ ক্বুরত্বুবী ইবনে মাসঊদ (রায্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, একদা তিনি এক মহিলার নিকট দিয়ে পার হচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন, সে তসবীহ-মালা দিয়ে তসবীহ গুনছে। তিনি তা নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। অতঃপর একজন পুরুষের নিকট দিয়ে পার হওয়ার সময় দেখলেন, সে কাঁকর দিয়ে তসবীহ গুনছে। তিনি তাকে লাথি মেরে বললেন, 'তোমরা আগে বেড়ে গেছ! অন্ধকার বিদআতে সওয়ার হয়েছে। আর ইলমে মুহাম্মাদ ﷺ-এর সাহাবীদেরকেও হার মানিয়েছ!' (আর-রদ্দু আলাল লামই ৫৯পৃঃ)
তসবীহ-মালার ব্যাপারে আপত্তি করেছেন কুফার ফকীহ ইব্রাহীম নাখঈ (রাহিমাহুল্লাহ)। তিনি নিজ মেয়েকে তসবীহ-মালা তৈরি করার ব্যাপারে মহিলাদের সহযোগিতা করতে নিষেধ করতেন। (ইবনে আবী শাইবাহ ৭৬৭০নং)
অনেকে অভিযোগ ক'রে বলেন, আঙ্গুল গোনাতে ভুল হয়ে যায়। আর মালা গুনলে তসবীহর সংখ্যাটা ঠিক থাকে।
উত্তরে বলা যায়, যে তসবীহর সংখ্যাই শরীয়তে আসেনি, তা কোন সংখ্যা দ্বারা সীমাবদ্ধ করা বিদআত। অন্যথা যে তসবীহ সংখ্যা শরীয়তে আছে তা শরীয়ত অনুযায়ী আঙ্গুল দিয়ে গুনতে গিয়ে যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে ২/১ টি তসবীহ বেশি বা কম হয়েই যায়, তাহলেও নিয়ত অনুসারে নির্ধারিত সওয়াবই পাওয়া যাবে। আর তাতে কোনও ক্ষতি হবে না। পরন্তু এই ভুল থেকে বাঁচতে গিয়ে অন্য একটি ভুল করা বৈধ হবে না। শরীয়তে তসবীহ গণনার সবচেয়ে বেশি যে সংখ্যা বর্ণিত হয়েছে, তা হল একশ'। আর হাতের পাঁচটি আঙ্গুল দিয়ে তা গণনা করা আদৌ কঠিন নয়।
পক্ষান্তরে তসবীহ-মালা ব্যবহারে বিভিন্ন ক্ষতিও রয়েছে। যেমনঃ-
একঃ তসবীহ-দানা গোনার ফলে আঙ্গুল গোনার সুন্নত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
দুইঃ তসবীহ-দানা ব্যবহার করাতে 'রিয়া' (লোকপ্রদর্শন) হতে পারে। আর তা হলে তসবীহ পড়ার আমলটাই বরবাদ হয়ে যায়।
এ ছাড়া আপনি দেখতে পাবেন, অনেকে সেই মালা গলায় ব্যবহার করে।
অনেককে দেখবেন, কাজ করতে করতে, কথা বলতে বলতে অথবা শুনতে শুনতে মালা গুনতে থাকে!
তাদের অনেককে সালাম দিলে ইশারায় সালামের উত্তর দেয় এবং বুঝাতে চায় যে, সে তসবীহ গোনাতে ব্যস্ত।
সুতরাং বলাই যায় যে,
                      وكل خير في اتباع من سلف * * * وكل شر في ابتداع من خلف
সলফদের অনুসরণেই রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। আর খলফদের বিদআতে রয়েছে যাবতীয় অকল্যাণ। (সিঃ যয়ীফাহ ৮৩নং হাদীসের বিশ্লেষণ দ্রঃ)
তাছাড়া তসবীহ-মালা ব্যবহারে সাদৃশ্য রয়েছে তাদের, যারা জপমালা ব্যবহার করে। আর আমাদের শরীয়ত বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন ও অনুকরণ করতে নিষেধ করেছে।
(বইঃ করুণাময়ের করুণাপ্রাপ্ত)

Post a Comment

0 Comments