Recent Tube

ইসলামী পুনর্জাগরণ সমস্যা ও সম্ভাবনা ৭ম পর্ব; ইউসুফ আল কারজাভী।





 
 ইসলামী পুনর্জাগরণ সমস্যা ও  
  সম্ভাবনা।
                           ৭ম পর্ব;


৪. রূপকের ওপর গুরুত্ব প্রদান

         বর্তমান ও অতীতে অনেক গোঁড়ামি ও ভুল বোঝাবুঝির মূল কারণ হলো স্পষ্ট ভাষণের প্রতি উপেক্ষা করে রূপক অর্থের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া। রূপক আয়াত হচ্ছে যেগুলোর গূঢ় অর্থ আছে। আক্ষরিক অর্থই শেষ কথা নয়। আর সুস্পষ্ট আয়াত হচ্ছে পরিষ্কার স্বচ্ছ দ্ব্যর্থহীন যার অর্থ বুঝতে বেগ পেতে হয় না। কুরআনুল করীম বলছে: “তিনিই তোমার কাছে এই কিতাব পাঠিয়েছেন, যার কতক আয়াত সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন; এগুলো কিতাবের মূল অংশ আর অন্যগুলো রূপক। যাদের অন্তরে সত্য লংঘন প্রবণতা রয়েছে শুধু তারাই ফিত্ না এবং ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে যা রূপক তার অনুসরণ করে। আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ এর ব্যাখ্যা জানেন না।” (৩:৭)

     প্রচীন বিদাতী ও গোঁড়া লোকেরা এই রূপক আয়াতগুলোকে চূরান্ত প্রমাণ বলে মনে করেছে। তারা স্পষ্ট মৌলিক বক্তব্যগুলোকে উপেক্ষা করেছে। বর্তমান চরমপন্থীরাও তাই করেছে। বিভিন্ন বিষয়ে তারা এর আলোকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাল-মন্দ, শত্রু-মিত্র ও কাফির-ঈমানদার নির্ধারণ করেছে। ফলে এক মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। সতর্ক পর্যালোচনা ও পরীক্ষা- নিরীক্ষা ছাড়া কেবল রূপক আয়াতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া জ্ঞানে অগভীরতা ছাড়া আর কিছু নয়। আল-খাওয়ারিজ এভাবে আত-তাকফিরের ফাঁদে পড়েছিলো। তারা তো সকাল মুসলমানকে কাফির বলে মনে করতো কেবল নিজেরা ছাড়া। ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েই তারা হযরত আলীর (রা) বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, অথচ তারা তাঁরই সহচর ও সৈনিক ছিলো। তাদের মত পাথর্ক্যের মূল কারণ ছিল আমীর মুয়াবিয়ার সাথে হযরত আলীর (রা) আপোস রফা। হযরত আলী (রা) সৈন্যদের সঙহতি ও মুসলমানদের জীবন রক্ষার জন্যে এ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। কিন্তু আল-খাওয়ারিজ কুরআনের আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা দিয়েআপোস অগ্রাহ করে। আয়াতটি হচ্ছে... “আল্লাহ ছাড়া কারো আদেশ দেয়ার ক্ষমতা নেই।” (১২:৪০০)

     আলী (রা) তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি দিয়ে জবাব দিলেন, “একটি সত্য বাণী বাতিলের জন্যে ব্যবহৃত।” বস্তুত সকল আদেশ ও কর্তৃত্ব কেবল আল্লাহ্ র জন্যে- এর অর্থ এই নয়- মানুষ ছোটখাট ব্যপারে শরীয়াহর কাঠামোয় থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) আল-খাওয়ারিজের যুক্তি খন্ডন করেছেন। আপোস - সমঝোতা ইত্যাদি অনুমোদন করে কুরআনে যেসব আয়াত রয়েছে তিনি সেগুলোর উল্লেখ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ স্বামী-স্ত্রীর সমঝোতা সংক্রান্ত আয়াতে বলা হয়েছে: “তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশংকা করলে তোমরা তার পরিবার থেকে একজন ও স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিশ নিয়োগ করবে; তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন।” (৪:৩৫)
কোনো হজ্জযাত্রী হজ্জের পোশাকে শিকার করলে সালিশরা তার ব্যাপারেও মীমাংসা করে দিতে পারে এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে। কুরআন বলছে:

    “হে মানদারগণ! ইহরামে থাকাকালে তোমরা শিকার জন্তু বধ করো না; তোমাদের মধ্যে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে তা বধ করলে তার বিনিময় হলো অনুরূপ গৃহপালিত জন্তু যার ফয়সালা করবে তোমাদের মধ্যে দু’জন ন্যায়বান লোক-বিনিময়ের জন্তুটি কা’বায় পাঠাতে হবে কুরবানীরূপে অথবা তার কাফফারা হবে দরিদ্রকে খাওয়ানো কিংবা সমসংখ্যক সিয়াম পালন করা যাতে সে আপন কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে পারে।” (৫:৯৫)

     অতএব কুরআন ও সুন্নাহকে গভীরভাবে ও সতর্কতার সাথে অনুধাবন না করলে বিপথগামী হওয়ার আশংকাই সমধিক। বাড়াবাড়ি ও অগভীর জ্ঞানের ফাঁদে পড়ে আজকাল এক শ্রেণীর লোক খারিজীদের মতে শরীয়াহর তাৎপর্য সঠিকভাবে বোধগম্য না হওয়ার দুণই এরূপ গোঁড়ামির উদ্ভব হয়ে থাকে। অন্যদিকে গভীর জ্ঞানের অধিকারী লোক কখনোই হঠকরী আচরণ করতে পারে না। কুরআন-হাদীস সঠিক প্রেক্ষাপটে অধ্যয়ন করলে এর সুসংলগ্ন ও সুমহান অর্থ অনুবাধন করা অসম্ভব নয়। আর এর বিপরীত পন্থায় কুরআন পাঠের অর্থ হবে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ভাষায় তাদের মতো “যারা কুরআন তিলাওয়াত করে কিন্তু অর্থ তাদের হৃদয়ে স্পর্শ করে না।”

     সম্ভবত এর মানে এই দাঁড়ায়- আল্লাহ ভাল জানেন- তাদের মৌখিক তিলাওয়াত শারীরিক কসরতের মতো যা কখনো হৃদয়কে প্রভাবিত করে না। এই কথাটি পূর্বে উদ্ধৃত “জ্ঞান ছিনিয়ে নেয়া” সংক্রন্ত হাদীসটির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

    এ সংক্রান্ত ব্যাখ্যার সাথে হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-এর ব্যক্তব্যের সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়। আবু উবায়েদের ফাযায়েলে কুরআন ও ইবরাহীম আত-তায়িমীর বর্ণনার ভিত্তিতে সাঈদ আবনে মনসুরের ব্যাখ্যায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি বলেন: “একদা একাকী বসে থাকার সময় উমর ইবনে খাত্তাব (রা) বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, যারা এক রাসূলের অনুসরণ করে এবং কিবলার দিকে মুখ করে নামায পড়ে তারা কেন মতভেদে লিপ্ত হয়। উমর (রা) তখন ইবনে আব্বাস (রা)-কে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “এই উম্মাহ কেন মতভেদে লিপ্ত হয় যখন তারা এক রাসূল (সা) ও এক কিবলাহ্‌র অনুসারী?” (সাঈদ-এর সাথে “এবং একই কিতাব” কথাটি যোগ করেছেন)। ইবনে আব্বাস (রা) জবাব দিলেন: “আল-কুরআন নাযিল হয়েছে এবং আমরা তা পাঠ করে ঐশী বাণীর মর্ম উপলব্ধি করেছি। কিন্তু এমন লোক আসবে যারা কুরাআন তিলাওয়াত করবে অথচ এর শানে নুযূল ও বক্তব্য বিষয় উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হবে। ফলে তারা বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দেবে এবং মতানৈক্যে জড়িয়ে পড়বে।”

       ইবনে আব্বাসের (রা)-এর জবানীতে সাঈদ আরো বলেন, “প্রতিটি গ্রুপের একটি মত থাকবে, তারপর মতবেদ থেকে সংঘাত সৃষ্টি হবে।” কিন্তু সেখানে উপস্থিত উমর ও আলী (রা) তাঁর এই অশুভ ব্যাখ্যা পছন্দ করলেন না এবং তাকে ভৎসনা করলেন। কিন্তু ইবনে আব্বাস (রা) চলে যাওয়া মাত্র তার মনে হলো যে, তার কথায় কিছু সত্য থাকতে পারে। তিনি তাকে ডেকে পাঠালেন এবং তার কথার পুনরাবৃত্তি করতে বললেন, সতর্ক বিবেচনার পর উমর (রা) ইবনে আব্বাস (রা)-এর সাথে একমত হলেন।

     আশ-শাতিবী লিখেছেন: ইবনে আব্বাস (রা) সঠিক ছিলেন। যখন এক ব্যক্তি একটি সূরা নাযিলের কারণ জানে তখন সে এটাও বুঝতে পারে যে, এর ব্যাখ্যা ও উদ্দেশ্য কী। কিন্তু এ সম্পর্কে অজ্ঞতার ফলে তারা ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মতভেদে লিপ্ত হয় এবং তাদের মতামতের পেছনে শারীয়াহর কোনো সমর্থন না থাকায় তারা বিভ্রান্ত হয়। এর একটি নযীর পাওয়া যায় ইবনে ওয়াহাবের বর্ণনায়: বাকির জিজ্ঞেস করলেন নাফিকে, “ইবনে উমর (রা) আল-হারুরিয়াদের সম্পর্কে কি চিন্তা করেন? (আল-খাওয়ারিজিকে আল-হারুরিয়াও বলা হয়। কারণ তারা হারাওয়া নামক একটি স্থানে দেখতে পান)। জবাব দিলেন, “ তিনি তাদেরকে খুব খারাপ লোক বলে মনে করেন। কুফফার সংক্রান্ত আয়াত তারা ঈমানদারদের ওপর প্রযোজ্য করে।” সাঈদ এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, আল-খাওয়ারিজ যেসব রূপক আয়াতের অপব্যাখ্যা দেয় তাদের মধ্যে রয়েছে: “আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই সত্য প্রত্যাখ্যানকারী।” (৫:৪৪) এর সাথে তারা জুড়ে দেয় এই আয়াতটি, তথাপি কাফেররা স্বীয় পালনকর্তার সংগে অন্যকে সমতুল্য করে। (৬:১)

     সুতরাং তারা এই উপসংহার টানে যে, কোনো শাসক যদি ন্যায়পরায়ণতার সাথে শাসন না করে সে কুফরী করে। আর যে কুফরী করলো সে অন্যকে আল্লাহর সাথে শরীক করলো। অতএব সে শিরক করলো। আর এই ভুল বিচারের ভিত্তিতে তারা অন্যকে মুশরিকুন বলে ঘোষণা করে, তাদের সাথে যুদ্ধ করে এবং হত্যা করে। আবনে আব্বাস (রা) এই ধরনের অপব্যাখ্যা ও ভ্রান্ত ধারণার বারুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছিলেন। আর এর উৎপত্তি হয় ওহীর অর্থ বুঝতে অক্ষমতার দারুন।

    নাফি বলেন, যখনি ইবনে উমর (রা)-কে আল-হারুরিয়াদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হতো তিনি বলতেন: “তারা মুসলমানদেরকে কুফফার ঘোষণা করে, তাদের রক্তপাত ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্তির অনুমোদন কের; তারা নারীর ইদ্দাহর সময় তাকে বিয়ে করে এবং স্বামীর বর্তমানে বিবাহিত মেয়েদের বিয়ে করে। আমি জানি না তাদের চেয়ে আর কে আছে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায়।” (শাতিবী, আলইতিসাম),
৫. বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা

  চরমপন্থীদের জ্ঞানের অগভীরতার আরেকটি লক্ষণ হচ্ছে তারা ভিন্ন মতাবলম্বীর কথা শুনতে মোটেও রাজী থাকে না কিংবা কোনোরকম আলোচনায় বসতে চায় না। তাদের অর্থাৎ গোঁড়াদের মত যে অন্যের মতের আলোকে বিশ্লেষণ করে গ্রহণ বা বর্জন করা যেতে পারে তাও তারা স্বীকার করে না। তারা বিশেষজ্ঞ আলিমদের কাছ থেকে কোনো শিক্ষা পায়নি। বই-পুস্তক, সংবাদপত্র ইত্যাদি হচ্ছে তাদের স্বল্প জ্ঞানের একমাত্র উৎস। এগুলো আলোচনা পর্যালোচনার সুযোগও পায় না। ফলে তারা যা পড়ে তা থেকে ইচ্ছামতো সিদ্ধান্তে পৌঁছে। সুতরাং তাদের পড়া ও সিদ্ধান্তে যে ভুল হবে তাতে আর সন্দেহ কী! কেউ কোথাও কখনো তাদের মতো যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা করলেও এগুলোর প্রতি কেউ তাদে দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। আশ-শারূয়াহ বুঝতে হলে যে নির্ভরযোগ্য আলিমদের শরণাপন্ন হওয়া উচিত সে প্রয়োজনীয়তাও তারা স্বীকার করে না।কোনো মুসলিম তরুণ যদি একা একা এরূপ প্রচেষ্টা চালায় তবে তা হবে আনাড়ি সাঁতারুর মতো গভীর পানিতে ঝাঁপ দেয়া।বিশেষজ্ঞদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছাড়া শারীয়াহর জ্ঞান পূর্ণ হতে পারে না, বিশেষ করে সেসব ক্ষেত্রে যেগুলো নিয়ে মতভেদ আছে। এ কারণে আমাদের অভিজ্ঞ আলিমরা তাদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন যারা বিষয়বস্তু উপলব্ধি ছাড়াই কেবল কুরআনের হাফিজ হয়েছেন কিংবা কিছু বইপত্র পাঠ করে যাদের অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্কর হয়েছে।

    এক শ্রেণীর এই তরুণদের বিভ্রান্তির জন্যে পেশাদার আলিম ও পন্ডিতরা বহুলাংশে দায়ী। তারা মনে করে এই আলিমরা শাসকগোষ্ঠীর সাথে হাত মিলিয়েছে। তাই তারা শাসকদের নির্যাতন, নিপীড়ন ও শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপের বিরোধীতা করার সাহস হারিয়ে ফেলেছে, বরং তারা মুনাফিকের মতো শাসকদের গর্হিত কাজের প্রশংসা ও সমর্থন করে। অথচ বাতিলকে সমর্থন না করে অন্তত তাদের নিশ্চুপ থাকাই নিরাপদ ছিল। সুতরাং তরুণরা বর্তমান এরূপ আলিমদের পরিবর্তে অতীতের আলিমদের অধিকতর নির্ভরযোগ্য মনে করলে অবাক হবার কিছু নেই। একাবর আমি তাদেরকে এ ব্যপারে জিজ্ঞেস করলে তারা পরিষ্কার বলেছে, “নির্ভরযোগ্য আলিম আমরা পাব কোথায়? যারা আছে তারা তো শাসকদের ক্রীড়নক। তাদের মর্জি-মাফিক ফতোয়াবাজীতে ব্যস্ত। শাসক যখন সমাজতন্ত্রী হয়, আলিমদের দৃষ্টিতে তাই ইসলামী; শাসক যদি হয় পুঁজিবাদী, পুঁজিবাদও তখন হয় ইসলামী! তাঁরা ফতোয়া দেন শত্রুর সাথে সন্ধি হারাম; কিন্তু শাসক যখন যুদ্ধ ঘোষণা করেন তখন তাদের জন্যে দোয়া করেন। “তারা আল্লাহ্ যা নিষিদ্ধ করেছেন তা হালাল করতে পারে।” (৯:৩৭)

    এসব আলিম মসজিদ ও গীর্জা এবং মুসলিম পাকিস্তান ও হিন্দু ভারতকে সমান চোখে দেখে। আমি এর জবাব দিয়েছি এভাবে: “ব্যপারটি সাধারণ সত্যে পরিণত করা উচিত নয়। নিশ্চয় এমন আলিমও আছেন যারা বাতিলের নিন্দা করেন, নির্যাতন রুখে দাঁড়ান, একনায়কদের সাথে আপোস করেন না ভয়-ভীতি ও প্রলোভন সত্ত্বেও। এসব আলিমদের অনেককে কারাবরণ করতে হয়েছে। তারা নির্যাতিত হয়েছেন। এমনকি ইসলামের জন্যে শাহাদত বরণ করেছেন।”
   সেই তরুণটি এটা স্বীকার করলেও বলল, “নেতৃত্ব ও ফতোয়া দেয়ার ক্ষমতা এখনো ঐ শাসকদের হাতে,

   আলিমদের নয়-এরাই হচ্ছে তথাকখিত পথবিচ্যুত আলিম।”
অবশ্য এটা কেউ স্বীকার করতে পারেন না যে, ঐ যুবকটি যা বলেছে তা অনেকাংশে সত্য। নেতৃত্ব-অভিভাবকত্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত এসব “প্রখ্যাত” “আলিম” সরকারের বন্ধকী পণ্যে পরিণত হয়েছেন এবং ইচ্ছে মতো ব্যবহৃত হচ্ছেন। এ ধরনের আলিমদের জানা উচিত সত্য সম্পর্কে নীরব থাকা বাতিল সমর্থনের শামিল। দুটোই শয়তানী কাজ। একবার মিসরীয় টেলিভিশনে “পরিবার পরিকল্পনা” ও “জন্মনিয়ন্ত্রন” অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণকারী একজন সুপরিচিত মুসলিম বুদ্ধিজীবী তো প্রশ্নই করে বসলেন, এই বিতর্কের উদ্দেশ্য কী, বিরোধীতা না সমর্থন-যাতে তিনি নিজের গা বাঁচিয়ে বক্তব্য রাখতে পারেন। বিতর্কের চেয়ারম্যান ঐ পণ্ডিতের প্রশ্ন শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। অথচ এর আগের আলিমরা মত প্রকাশে নির্ভীক ছিলেন, কারো পরোয়া করতেন না। আল্লাহ্ এদের ওপর রহম করুন! এদেরই একজন মিসর সরকারের একজন প্রভাবশালী সদস্যকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, “যে ব্যক্তি কাজের খোঁজে পা বাড়ায় তার ভিক্ষের হাত বাড়াবার দরকার পড়ে না।” সমসাময়িক আলিম বা পণ্ডিতরা এ থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদেরকে নিঃসন্দেহে জ্ঞান-সমৃদ্ধ করতে পারেন।

      এখন আলিমদের জ্ঞানগরিমা এতোই সঙ্কীর্ণ যে, তরুণ মুসলমানরা তাদের সংস্পর্শে এসে হতাশ হয়ে পড়ে। এ ধরনের একজন আলিম একবার একটি পত্রিকায় লিখলেন, পিতা ও পুত্রের লেনদেনে যেহেতু কোনো সুদের ব্যাপার থাকতে পারে না। কিন্তু পিতা ও পুত্রের তুলনা দিয়ে তিনি যে যুক্তি খাড়া করেছেন তা বিতর্কিত। মোটকথা এসব আলিম বিভিন্ন বিষয়ে সর্বসম্মত প্রামাণিক সূত্র বাদ দিয়ে দুর্বল সনদের হাদীস দিয়ে নিজেদের যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে চান। এগুলো সাধুতা সত্যতার খেলাফ। মুসলিম তরুণরা স্বভাবতই এসব কাণ্ড কারখানা দেখে হতাশ হয়ে পড়ে। কোনো কোনো আলিম অনেক সময় সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জিত হতে পারে এমন কাজও করে বসেন। এগুলো সচেতন তরুণদের নযর এড়াতে পারে না। আরেকটি ঘটনা।একবার মিশর সরকার বিভিন্ন ইসলামী গ্রুপের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে তাদের অনেক সদস্যকে বন্দী করেন। একজন সুখ্যাত আলিম প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা দিলেন, ইসলামী গ্রুপকে আল্লাহ্ পরিত্যাগ করেছেন। তার যুক্তি ছিল, তাঁরা যদি সঠিক পথের অনুসারী হতেন তবে আল্লাহ্‌র রহমতে তাদেরকে পুলিশ বা সৈন্য কেউই পরাজিত করতে পারতো না। হক ও বাতিলের এরূপ অদ্ভুত বিচার সম্পূর্ণরূপে ইসলাম বিরোধী। ইসলামের দৃষ্টিতে সত্যের সংগ্রামীদের বিজয় লাভে কতকগুলো শর্ত আছে। সেই শর্ত পূরণ না হলে তাদের পরাজিত হওয়া অপ্রত্যাশিত নয়। অন্যদিকে পরিস্থিতির আনুকূল্যে বাতিলের বিজয় অর্জিত হলেও তা চিরস্থায়ী হতে পারে না, কিছুদিন টিকে থাকতে পারে মাত্র। সমকালীন ইতিহাসে এর অনেক জাজ্জল্যমান নযীর আছে। সবচেয়ে বড় কথা, এখন সত্য ও মিথ্যা বা হক বাতিলের দ্বারা জয়-পারজয় নির্ধারিত হয় না। জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় বৃহৎ শক্তিবর্গের হস্তক্ষেপ। আরবদের উপরে ইসরাঈলের ‘বিজয়’-এর একটি অত্যুজ্জ্বল নযীর।

    আমরা কি জানি না, আতাতুর্ক ও তার দুষ্টচক্র মুসলমান জনগণ ও আলিমদের কী নির্মমভাবে দমন করেছে? খিলাফতের পাদপীঠ থেকে কিভাবে ইসলাম বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষতা জবরদস্তি তুর্কী জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে! এখন বলুন, এ দু’পক্ষের মধ্যে কারা হক আর কারা বাতিল? সম্পতি একটি মুসলিম দেশে “পরিবার আইন” প্রবর্তনের বিরোধী বহু শ্রদ্ধাভাজন আলিমের উপর নির্যাতন চালানো এবং মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। অথচ ঐ পরিবার আইন সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী। সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাচারী সরকার সন্ত্রাসী কায়দায় ঐ আইনের বিরোধী জনসাধারণ ও আলিমকে স্তব্ধ করে দেয়। এর অর্থ কি এই যে, সরকারের পদক্ষেপ সঠিক ‌ছিল, আর শাস্তিপ্রপ্ত আলিমরা ভ্রান্ত? আরেকটি মুসলিম দেশে অমুসলিম সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু মুসলমানদের উপর শাসন চালায়। সেখানে সরকার বিরোধী তৎপরতা দমনের জন্যে প্রায় প্রতিদিন হাজার হাজার মুসলমান নর-নারীকে গ্রেফতার করা হয় এবং নিপীড়ন চালানো হয়। তদুপরি যেসব দৃঢ়চেতা মুসলমান যুলুম সহ্য করে টিকে থাকে তাদের উপর হালাকু ও চেঙ্গিস খানের মতো হিংস্র কায়দায় নির্যাতন চালানো হয় আর তাদের সামনে তাদের কন্যা, বোন বা স্ত্রীদের ধর্ষণ করা হয়।

    বস্তুত ইতিহাসে তথা ইসলামের ইতিহাসে মুসলমানদের ওপর এমন নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলার বহু নযীর আছে। হুসাইন ইবনে আলী (রা) পরাজিত হয়েছেন এবং ইয়াজিদ ইবনে আমীর মুয়াবিয়া তাঁর পবিত্র দেহকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। পরিণামে বনু উমাইয়া বহুকাল শাসন করেছে; কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বংশধাররা তাদের হাত থেকে নিষ্কৃত পাননি, এমনকি আব্বাসীয়দের শাসনামলেও নয়। এ থেকে কি এটাই প্রমাণিত হয় যে, ইয়াজিদের কার্যকলাপ সঠিক ছিল আর হযরত হুসাইন (রা)-এর অনুসৃত পন্থা বাতিল? হে আল্লাহ, আপনি এদের যুলুমের সাক্ষী, এদের হাত থেকে উম্মাহকে রক্ষা করুন!

     আরো ঘটনা আছে। কয়েক বছর পর বিজ্ঞ ও সাহসী সেনাপতি আবদুল্লাহ ইবনে ইউসুফ অনারবী হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের হাতে পরা জিত হয়েছিলেন; পরে হাজ্জাজ আরেকজন মহান মুসলিম সেনাপতি আবদুর রহমান ইবনে আল-আসাস এবং সাঈদ ইবনে জুবায়ের, আশশাবী, মুতরিয়াসহ একদল বিশিষ্ট আলিমকে হত্যা করে। এগুলো ছিল উম্মাহর জন্যে বিরাট ক্ষতি, বিশেষ করে সাঈদ ইবনে জুবায়ের সম্পর্কে ইমাম আহমদ (র) বলেন, তিনি এমন এক সময় নিহত হলেন যখন তাঁর খুব প্রয়োজন ছিল। প্রসঙ্গত একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়: “আল্লাহর কসম! হিংস্র নেকড়ে যদি আমাদের ছিন্নভিন্ন করে তবুও আমরা আমাদের সত্য বিশ্বাস ও তোমাদের মিথ্যাবাদিতা সম্পর্কে সংশয়ী হবো না।” ইবনে জুবায়ের ও তার সঙ্গী-সাথীরা মক্কায় অবরুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন: “আল্লাহর শপথ! সৎ মুত্তাকীদের কেউ অবনত করতে পারবে না যদি গোটা পৃথিবীও তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় আর বিপথগামীরা কখনোই যথার্থ সম্মান পাবে না যদি তাদের কপালে চন্দ্রও উদিত হয়। এসব উক্তি কুরআনে বর্ণিত নবীদের ঘটনাবলীর সাথে সংগতিপূর্ণ। কুরআন বলছে: “তবে কি যখনি কোনো রাসূল এমন কিছু এনেছে যা তোমাদের মনঃপূত নয় তখনই তোমরা অহংকার করেছে আর কতককে অস্বীকার করেছে এবং কতককে হত্যা করেছ!” (২:৮৭) এমন একজন নবীদের মধ্যে ছিলেন হযরত যাকারিয়া (আ) ও তাঁর পুত্র ইয়ারিয়া (আ)। এই নবীদের হত্যা এবং তাদের শত্রুদের সাফল্যকে কী পূর্বোক্তদের ভূমিকাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে? আমরা কুরআনুল করীমে আসহাবুল উখদুদের ঘটনাও জানি। তারা ঈমানদারদের জলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে সেই বীভৎস্য দৃশ্য উপভোগ করতো: “এবং অন্য কোনো কারণে নয়, কেবল তারা সর্বশক্তিমান ও সকল প্রশংসার যোগ্য আল্লাহ্ কে বিশ্বাস করতো বলেই (কাফিররা) তাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে।” (৮৫:৮)

    কুরআন শরীফে বলা হয়েছে, ঈমানদারদের কখনো কখনো বিপদাপদের মধ্য দিয়ে পরীক্ষা করা হয় এবং বেঈমানদেরকে সাময়িক সাফল্য দিয়ে প্রলুব্ধ করা করা হয়। আল্লাহ বলেন: “মানুষ কি মনে করে আমরা ঈমান এনেছি এ কথা বললেই তাদেরকে পরীক্ষা না করে ছেড়ে দেয়া হবে? তাদের পূর্ববর্তীদেরও আমি পরীক্ষা করেছিলাম; আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দেবেন কারা সত্যবাদী ও কারা মিথ্যাবাদী।” (২৯:২-৩)

    ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের পর নিম্মোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়: “যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে তবে অনুরূপ আঘাত তাদেরও তো লেগেছে। মানুষের মধ্যে এই দিনগুলোর আমি পর্যায়ক্রমে আবর্তন ঘটাই, যাতে আল্লাহ মুমিনদেরকে জানতে পারেন এবং তোমাদের মধ্য থেকে কিছু লোককে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন।” (৩:১৪০)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, “...আমি তাদেরকে এমনভাবে ক্রমে ক্রমে ধরব, তারা তা বুঝতেও পারবে না।” (৬৮:৪৪),

চলবে.....।

Post a Comment

0 Comments