Recent Tube

দ্বীনি প্রশ্নোত্তর।

বিভিন্ন এপ্স/সফটওয়ার কিংবা গুগল এর মাধ্যমে হাদিসের মান যাচাই করার হুকুম কী  ?? 

___________________

ভূমিকা :-

  কি আর বলবো । এখন সমগ্র ইলম-কালাম সকলের হাতে হাতে। হাদিসের মান যাচাই করতে এক মিনিট ও সময় লাগে না। এতোটা দ্রুত সবকিছু জানা যায়। বিষয়টা খুব ভালো লাগার না ? দেখবেন, আপনি কোন একটা দালিলিক লেখা দিলেন। হুটহাট করে দু'একজন এসে স্কিন শর্ট সহ হাদিসের মান বলে দিচ্ছে৷ দেখে মনে হবে , আহ কতো বড় মুহাদ্দীস ! তাদের সোর্স কি ? বিভিন্ন এপ্স/ সফটওয়্যার বা গুগল । 

[[ তাহলে বিভিন্ন এপ্স/সফটওয়ার বা গুগল এর হাকিকত জেনে নিন ]]

  মূল বিষয়ে অবতারণ এর আগে একটা পয়েন্ট স্মরণ করে দিতে চাই। কোর'আন বাদে পৃথিবীতে যতো জ্ঞান আছে, যেমনঃ তাফসীর, আকিদা,ফিকাহ কিংবা জাগতিক যে কোন বিষয় ৷ প্রত্যেক কিছুতেই মোটামুটি মতানৈক্য আছে ৷ 

  সেই ধারাবাহিকতায় ইলমুল হাদীস নিয়েও মুহাদ্দিসীনে কেরামের মধ্যে বিশাল ইখতেলাফ আছে৷ যেমন ধরুন ঃ একজন মুহাদ্দীস একটা হাদীসকে সহীহ বলেছেন। অপরজন হয়তো এটাকে সহীহ/ হাসান বলেছেন। এরকম বিষয় ইলমুল হাদীস অনেক আছে। 

  ধরুন, বুখারী ও মুসলিম শরীফের কথা । হাদিস গ্রহণে উভয়ের দর্শন ভিন্ন ছিলো। ইমাম বুখারী রাঃ উনার সহীহ গ্রন্থে ৭০৫৩ টি হাদিস এনেছেন। ইমাম মুসলিম রাঃ উনার সহীহ গ্রন্থে ৭২৮২ টি হাদিস এনেছেন। 

  হাদিস গ্রহণের উভয়ের দর্শন কিছুটা ভিন্ন ছিলো। ইমাম বুখারীর দর্শনে এমন অনেক হাদিস জইফ হয়েছে, যা আবার ইমাম মুসলিমের নিকট সহীহ হয়েছে৷ এই দর্শনের কারণে উভয়ের নিকট সম্মিলিত সহীহ হাদিস হয়েছে ( মুত্তফাকুন আলাইহি) মাত্র ২৩২৬ টি৷ 

আসুন, একটু হিসাব করি - 

বুখারীর হাদিস - ৭০৫৩ 
মুসলিমের হাদিস - ৭২৮২
_______________________
মোট হাদিস - ১৪৩৩৫,
একটু ভেবে দেখুন, বুখারী ও মুসলিম মিলে মোট হাদিস হলো - ১৪,৩৩৫ টি। তন্মধ্যে উভয়ের দর্শনে মিল হয়েছে ( মুত্তাফাকুন আলাইহী) মাত্র ২৩২৬ টি। 

আলহামদুলিল্লাহ

  হাদীস গ্রহণের উভয়ের দর্শন ভিন্ন হলেও মুসলিম উম্মাহ এই ঐক্যমতে পৌঁছেছেন যে, কোর'আন এর পরেই বিশুদ্ধ গ্রন্থ হিসেবে বুখারী ও মুসলিম শরীফ রয়েছে৷ এই দুই গ্রন্থের হাদীস নিয়ে তেমন কেউ প্রশ্ন তুলে নাই। 

  তবে বুখারী শরীফের হাদীস নিয়ে ইমাম আলবানী রাঃ কিছুটা প্রশ্ন উত্তাপন করেছেন। উনার দর্শনে বুখারী ও মুসলিম শরীফের কিছু হাদীস জইফ রয়েছে। তবে, উনার পরবর্তী মুহাদ্দীসগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। উনার বুখারী ও মুসলিমের কিছু সংখ্যক হাদিসকে জইফ সাব্যস্ত করা মুহাদ্দিসীনে কেরাম গ্রহণ করেন নাই। 

  [[ ফতোয়াটা দেখে নিনঃ- ১ম কমেন্টে দিলাম ]] 

  মোদ্দাকথায়, আমরা জানলাম যে, হাদিসের মান যাচাইয়ে সকল মুহাদ্দিসীনের দর্শন ও তাহকীক সমান ছিলো না। ইমাম বুখারী ও মুসলম রাঃ এর দর্শনও সমান ছিলো না। আবার উভয়ের সাথে ইমাম আলবানী রাঃ এর দর্শনও মিল ছিলো না৷ 

  এবার আসি মূল আলোচনায় - 

    আমাদের দেশে বাংলা অনুবাদকৃত হাদিসের এপ্লিকেশন বা সফটওয়্যারে যে তাহকীক বা হাদিসের মান অর্থাৎ হাদীসের পাশে ছোট্ট করে দেওয়া আছে ____ সহীহ / জঈফ / হাসান ইত্যাদি । এগুলা কার তাহকীক ?? এগুলা মুহাদ্দিসীনে কেরামের ঐক্যমতের তাহকীক বা বিশ্লেষণ ?? নাকি একজন ব্যক্তির ?? 

   একজন ব্যক্তির হলে তো সমস্যা। আমি আগেই আলোচনা করেছি যে, একটা হাদিস একজনের কাছে সহীহ হলে আবার আরেকজনের কাছে জইফ হতে পারে। ইমাম বুখারীর নিকট সহীহ হলে আবার আলবানীর নিকট জইফ হতেই পারে। এই ক্ষেত্রে সাধারণ পাঠকের হুকুম কী ?? 

  [[ এটাই বক্ষমান লেখার মূল থীম ]] 

  আশাকরি, সম্মানীত বুদ্ধিমান পাঠক আমার প্রধান উৎসটা বুঝতে পেরেছেন। এবার বলি, বাংলা ভাষায় অনুবাদকৃত হাদিসের যেসব এপ্লিকেশন / সফটওয়্যার আছে, প্রায় সবগুলাতেই ইমাম আলবানি রাঃ এর তাখরীজ বা বিশ্লেষণ রয়েছে। ইমাম আলবানী রাঃ যেসব হাদিসকে সহীহ বলেছে, তাই সহীহ বলা হয়েছে। ইমাম আলবানি যেসব হাদীসকে জইফ বলেছেন, সে সবকেই জঈফ বলা আছে। 

  অথচ, আমরা উলুমুল হাদীস ( Prophetic Science) পর্যালোচনা করে দেখতে পাই যে, হাদিসের মান যাচাইয়ে ইমাম আলবানি রাঃ এর সাথে পূর্বের ও পরের অসংখ্য মুহাদ্দিসীনে কেরামের সংঘর্ষ রয়েছে৷ এমন অনেক হাদিস পেয়েছি, যা ইমাম নববী বা ইবনে হাজার আসকালানী রাঃ হাসান সাব্যস্ত করলেও ইমাম আলবানি রাঃ জইফ সাব্যস্ত করেছেন। পরবর্তীতের মধ্যে আরবের শায়খ আওয়ামাহ ও আমাদের দেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দীস মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেবের গবেষণায় ইমাম আলবানী রাঃ এর অনেক তাখরীজ ভুল সাব্যস্ত হয়েছে৷ অর্থাৎ, ইমাম আলবানী রাঃ এর অসংখ্য হাদীস তাখরীজে বা মান যাচাইয়ে ক্রুটি-বিচ্যুতি ছিলো, যা পূর্ব্ববর্ত্তীদের লেখায় ও পরবর্তীতের গবেষণায় বেরিয়ে আসছে৷ 

  → চলুন, কিছু উদাহরণ দেখে নেই। 

  আমি পূর্ব্ববর্ত্তী বা পরবর্তী কোন মুহাদ্দিসীনে কেরামের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে যাবো না। আমি ইমাম আলবানী রাঃ এর হাদিসের তাহকীকেই ইতি থাকবো। এমন অনেক হাদীস আছে, যা তিনি একটা কিতাবে সহীহ বলেছেন ; আবার অন্য কিতাবে জইফ বলেছেন। তার বিপরীতটাও আছে। আসুন, দু'একটি উদাহরণ দেখে নেই। 

 এক নং হাদীস - 

حديث : أيما رجل كشف سترا فأدخل بصره قبل أن يؤذن له فقد أتى حدا لا يحل له أن يأتيه .

  হাদীসটিকে ইমাম আলবানি রাঃ " গা-য়াতুল মারাম " গ্রন্থে জইফ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন (৪২৩) । আবার একই সনদ ও হাদিস " সিলসিলাতু আহাদিসিস সাহিহাহ " গ্রন্থে সহীহ সাব্যস্ত করেছেন ( ৩৪৬৩) । 

দুই নং হাদিস - 

حديث : " أوتي موسى الألواح ، وأوتيت المثاني " .

 হাদিসটিকে ইমাম আলবানী রাঃ " জামে " গ্রন্থে জইফ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন ( ২১০৯) । আবার একই সনদ ও হাদিসকে " সহীহ " গ্রন্থে সহীহ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন ( ২৮১৩) । 

 সম্মানিত পাঠক, 
ইমাম আলবানি রাঃ এর হাদিস যাচাইয়ে পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ বিষয়ের মাত্র দু'টা উদাহরণ দিয়েছি। পোস্ট দীর্ঘ হয়ে যাওয়ার আশংকায় আর দেই নাই। কিন্তু, সমসাময়িক বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিসীনে কেরাম এমন ৫০০+ হাদিস বের করেছেন। যা এক জায়গায় ইমাম আলবানী রাঃ জইফ বলেছেন, আবার আরেক জায়গায় সহীহ বলেছেন। বা তার বিপরীতে বলেছেন। 

আল-ইয়াজুবিল্লাহ! 
আমার মোটেও এই পোস্টের উদ্দেশ্য না যে, ইমাম আলবানী রাঃ এর ভুলগুলা তুলে ধরা । আমি এই বিভাগের ছাত্রও না৷ কেবল এ কথা বুঝানো উদ্দেশ্য যে, আলবানী রাঃ এর অসামান্য খেদমত ছিলো। উম্মাহ তা থেকে কিয়ামত পর্যন্ত ফায়দা উপভোগ করবে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, তাঁর তাহকীক বা হাদিসের মান যাচাই ১০০% সঠিক ও সকল মুহাদ্দিসীনে কেরামের ঐক্যমত রয়েছে। 

এবার চিন্তা করুন - 

বিভিন্ন ব্লগ /এপলিকেশন/ সফটওয়্যারে যে হাদিসের একক মান দেওয়া হয়েছে, তা কি সব ঠিক ?? খুদ আলবানি রাঃ এর তাখরীজেও তো ভিন্নতর রয়েছে৷ তাছাড়া, অন্যান্য মুহাদ্দিসদের সাথে বিরোধ আছেই তো ৷ এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন সোস্যাল মাধ্যমে ঘুরিয়ে বেড়ানো হাদিসের মানকে শতভাগ সত্য/ নিরেট ধরে নেওয়া যায় কোন যুক্তিতে ? কেউ যদি কোন একটা হাদিসকে সহীহ বলে আর আপনি যদি আপনার মোবাইল এপলিকেশনে তা জইফ দেখতে পান, তাহলে আল্লাহকে ওয়াস্তে তর্কে জড়াবেন না। মনে করবেন, হয়তো এখানে মুহাদ্দিসীনে কেরামের মতানৈক্য আছে৷ একজন আলিম অবশ্যই বহু কিতাব পাঠ করে লিখা পোস্ট করেন আর আপনি হয়তো একটা এপ্লিকেশন যাচাই করে মন্তব্য করেন। আলিমের অধায়্যন আর আপনার অধ্যায়নে রাত-দিন তফাৎ আছে। আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝার তাওফীক দান করুক ! 

সর্বশেষ, কয়েকটি টিকা বলে যাই -

১. বিভিন্ন এপ্লিকেশন / সফটওয়্যারে বর্ণিত হাদিসের মান শতভাগ সত্য ও মুহাদ্দিসীনে কেরামের ঐক্যমতে নয়। তাই গভীর ও তাত্ত্বিকভাবে যাচাই-বাছাই করে আমল করতে হবে৷ 

২. হাদিসের মান যাচাইয়ে মুহাদ্দিসীনে কেরামে দর্শন এক নয়৷ সকলের গবেষণাও এক নয়। 

৩. ইমাম আলবানি রাঃ এর তাহকীকে সকল মুহাদ্দিসগণ সন্তুষ্টি নয়। খুদ উনার নিজের তাহকীকেই পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ রয়েছে। 

৪. সোস্যাল মাধ্যমে হাদিসের মান দেখে কোন বিজ্ঞ আলিমের সাথে ঝগড়াঝাঁটি করতে নাই। 

৫. হাদিসের মান যাচাইয়ে কেবল সোস্যাল মাধ্যম এর উপর নির্ভর করতে নাই। উলুমুল হাদীস ও বিভিন্ন বই-পুস্তক অবশ্যই জানতে হলে পড়তে হবে৷ 

৬. আমি এসব এপ্স পাঠ কর‍তে নিরুৎসাহিত করছি না আল্লাহর শপথ। জাস্ট, একথা বুঝাতে চাচ্ছি  - এপ্সের মান নির্ণিয়ই ফাইনাল বা সর্বসম্মত না। 
__________________
শায়েখ Abdul Karim Al-Madani হাফিজাহুল্লাহ্ 
শারীয়াহ বিভাগ, মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় ।

Post a Comment

0 Comments