Recent Tube

বাংলাদেশে ইসলামের ভবিষ্যৎভবিষ্যতের ইসলাম। মুফতি মুহীউদ্দীন কাসেমী


  
  

   বাংলাদেশে ইসলামের ভবিষ্যৎ
    ভবিষ্যতের ইসলাম।
                       ---  মুফতি মুহীউদ্দীন কাসেমী।

   বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির বয়স অর্ধশতক হয়ে গেছে। স্বাধীনতার সময় থেকে আজ পর্যন্ত এই দেশে ইসলামের অবস্থা কেমন ছিল, তা আমাদের চোখের সামনে। আজকে ইসলামের কী অবস্থা, তাও আমরা জানি। ব্যকিত্গত পর্যায়ে দীন ও ইসলামের চর্চা হলেও এবং গাণিতিক সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে ইসলাম সংক্ষিপ্ত হতে হতে বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে। 
তিন জায়গায় ইসলামের অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থা : 
 ১. রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। ইসলামের কোনো বিধানই কার্যকর নয়। বরং ইসলামবিরোধী পৌত্তলিক কর্মকাÐে ভরপুর। 

  ২. রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণীর নাগরিকদের জীবনে। যাদের হাতে রাষ্ট্রের নাটাই, যারা উচ্চশিক্ষিত, যারা আমাদের বিচারক, তারা নামকাওয়াস্তে মুসলমান। মূর্তি ইস্যুতে কিছুটা প্রমাণ আমরা দেখেছি। তাদের কাছে ইসলামের রীতিনীতি সামাজি আচারে সীমিত। ইসলামের কষ্টিপাথরে তাদেরকে ‘মুসলিম’ বলা মুশকিল। বছরে দুইবার নামায পড়লেও তাদের ঈমান প্রশ্নবিদ্ধ। জিয়াউর রহমান ও বঙ্গবন্ধুর জন্য মসজিদে দোয়ার পাশপাশি মন্দিরে , গির্জায় ও ভিন্ন ধর্মের উপাসনালয়ে প্রার্থনা হয়। এর দ্বারা অনেক মানুষের বিশ্বাস হয়ে গেছে, সৃষ্টিকর্তার কাছে সব ধর্মই গ্রহণযোগ্য। এদের বাহিরে কিছু নামধারী ধর্মীয় গোষ্ঠীর মাঝেও এই আকিদা রয়েছে। যেমন আটরশী, দেওয়ানবাগী, সুরেশ্বরী ইত্যাদি। এটাকে ফিতনায়ে ইরতিদাদ বলে আখ্যায়িত করতে পারেন। তাদের সাথে মিশলে ও একটু গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে ফিতনায়ে ইরতিদাদের ব্যাপকতা ও গভীরতা সম্পর্কে অনুমান করতে পারবেন। ওয়াজ মাহফিলের শ্রোতা আর জুমুআর নামাযের মুসুল্লি দেখে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার সুযোগ নেই। 

   ৩. শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামের কিছুই নেই। জেনারেল শিক্ষার মতোই আলিয়া শিক্ষাব্যবস্থা। সিলেবাসে ভালো কিছু থাকলেও বিবিধ কারণে সেখানের শিক্ষার্থীরা ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোও শিখতে পারে না। যারা শিখে তারা ব্যক্তিগতভাবে অথবা ভালো কিছু প্রতিষ্ঠানে পড়ার কারণে হয় কিংবা আগে কওমিতে পড়ার কারণে শেখা হয়। আপনি আশ্চর্য হবেন প্রথম বিভাগে কামিল পাশ মাওলানাদের কুরআন তেলাওয়াত শুদ্ধ হয় না শতকরা ৮০%। সিলেবাসে কুরআন শুদ্ধ করার কোনো গুরুত্ব নেই। আর সিলেবাসের ভেতরের অবস্থা তো অত্যন্ত শোচনীয়। 

     সামনের অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে
উপরের তিন ক্ষেত্রেই ইসলামের অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে। এলিটদের মাঝে ইরতিদাদ ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। বাংলাদেশের এক নায়িকা কোলকাতার এক হিন্দু নায়ককে বিয়ে করেছে। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। ভারতের ঢেউ এখানেও আছড়ে পড়ছে। তাদের মতো হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ মুসলমান এভাবে দীনহীন হয়ে যাচ্ছে, হয়ে যাবে। 
রাস্তায় রাস্তায় ভাষ্কর্যের নামে মূর্তি বসবে, অশ্লীতা ব্যাপক হবে, তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর সাথে সংসার বাড়বে, অন্য ধর্মের লোকদের সাথে বিয়ে বাড়বে, শরিয়তের নিয়মে মেনে বিয়ে হবে না, লিভ টুগেদার বাড়বে, এভাবে জারজে দেশ সয়লাব হয়ে যাবে। 
রাষ্ট্রীয় আইনকানুনে ইসলামের নামমাত্রও থাকবে না। নারীরা পুরুষের সমান অধিকারের আইন পাশ হবে; যদিও বাস্তবে পাবে না। ২০২২ সন থেকে নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামবিরোধী সিলেবাস আরও বাড়বে। ধর্মীয় শিক্ষা কাটছাট করতে করতে হাঁটুর ওপর উঠে গেছে। আরও ওপরে উঠবে। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বাড়তেই থাকবে। সুদের ব্যাপকতা বাহ্যিক দীনদারদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়বে। 

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিএনপি ও লীগের বাহিরে তৃতীয় কারও ক্ষমতায় যাওয়ার আপাতত সম্ভাবনা দেখা যায় না। গেলে সেনাবাহিনী। বঙ্গবন্ধু, জিয়া, এরশাদ, খালেদা ও বর্তমান প্রাইম মিনিস্টার মুসলিম পরিবারে বেড়ে উঠেছেন, মুসলিম কৃষ্টিকালচারে অভ্যস্ত। কিন্তু তাদের আগামী প্রজন্মের মাঝে দীনের সামান্য বুঝও নেই। আপনি চিন্তা করুন, তারেকের মেয়ে প্রাইম মিনিস্টার হলে ইসলাম ও মুসলমানদের অবস্থা কেমন হবে? লন্ডন ও আমেরিকা থেকে তারা দেশে এসে রাষ্ট্রের লাগাম ধরবে। শুধু একটু কল্পনা করুন, কিছুটা হলে আঁচ করতে পারবেন। 
এক কথায় বলা যায়, বাংলাদেশে ইসলামের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত শোচনীয়। দিনদিন এ হাদিস বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন : 
بَدَأَ الْإِسْلَامُ غَرِيبًا، وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ غَرِيبًا، فَطُوبَى لِلْغُرَبَاءِ
(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৪৫)

এখন করণীয় কী?
এভাবেই চলতে থাকবে? আর কতদিন এভাবে চলবে? জাহেলিয়্যাত ও ইরতিদাদ আমাদের ওপর চেপে বসেছে, দিনদিন ফেতনা বাড়ছেই। ফেতনা বন্ধ করতে চাইলে উপরের তিনো জায়গায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এদেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হতে হবে খাঁটি মুসলিম। শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলাম এবং রাষ্ট্রের আইনকানুনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। তজ্জন্যে প্রয়োজন ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
“তোমরা আল্লাহর রজ্জু আঁকড়ে ধরো, বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩)

অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে : 
وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ وَاصْبِرُوا إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ
“ তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো; তবে নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না। বিবাদ করলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে। তোমরা সবর করো; নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা সবরকারীদের সঙ্গে রয়েছেন।” (সূরা আনফাল, আয়াত : ৪৬)
তাফসিরে তাবারিতে এসেছে : 
وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا أَيْ وَلَا تَخْتَلِفُوا فَتُفَرَّقُوا وَتَخْتَلِفَ قُلُوبُكُمْ فَتَفْشَلُوا، يَقُولُ: فَتَضْعُفُوا وَتَجْبُنُوا
অর্থাৎ তোমরা নিজেরা বিবাদে জড়ালে ও বিচ্ছিন্ন হলেই দুর্বল ও ভীতু হয়ে যাবে। 
আক্রমণ হয় দুর্বলের ওপর, সবলের ওপর না। সবলের ওপর আক্রমণ করতে হাজারবার চিন্তা করতে হয়। আর দুর্বলকে মারার পর চিন্তা হয় যে, আরও শোচনীয় ভাবে মারা যেত। 

‘মুসলিম’ সীমানা কতুটুক?
অধুনা আমরা মুসলিম বলতে কেবল নিজেদের ঘরানার লোকদেরই মনে করি। অথচ রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘মুসলিম’ এর সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তিনি ইরশাদ করেন :
مَنْ صَلَّى صَلاَتَنَا وَاسْتَقْبَلَ قِبْلَتَنَا، وَأَكَلَ ذَبِيحَتَنَا فَذَلِكَ المُسْلِمُ الَّذِي لَهُ ذِمَّةُ اللَّهِ وَذِمَّةُ رَسُولِهِ، فَلاَ تُخْفِرُوا اللَّهَ فِي ذِمَّتِهِ
“যে ব্যক্তি আমাদের ন্যায় নামায আদায় করে, আমাদের কিবলামুখী হয় আর আমাদের জবাই করা প্রাণী খায়,  সে-ই মুসলিম, যার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুল জিম্মাদার। সুতরাং তোমরা আল্লাহর জিম্মাদারিতে খিয়ানত করো না।” (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৯১)

যে মুসলিম সে-ই তোমার ভাই, সে-ই তোমার সহযোগী। তার হাত ধরো, হাতে হাত রাখো, দুই হাতের পর চার হাত হবে, চার হাতের পর ছয় হাত হবে, এভাবে কোটি কোটি হাত হয়ে যাবে। যাদেরকে রুখার সাধ্য শয়তানের দোসরদের নেই। 

ইসলাম নয়, ইনসাফের রাজনীতি আবশ্যক
ইকামতে দীন বা খেলাফত প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি নামে ইসলাম কায়েমের অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। নিয়ত সহিহ থাকলে অবশ্যই আল্লাহ তাআলা সেগুলোর জাযা দান করবেন। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে বিশ্ব প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে ইসলামের নাম বাদ দিয়ে রাজনীতি করা দরকার। পশ্চিমবঙ্গে আব্বাস সিদ্দিকি স্টাইলে। ইসলামের নাম শুনলে শয়তানের দোসররা কাজ করতে দিবে না। তাছাড়া ইসলামের নামে আমরা বিচ্ছিন্ন। ইসলামের নামে এতগুলো দল ভোট চাইলে মানুষজন কাকে ভোট দিবে? জামায়াতের লোকজন কম নয়, তাদের বাহিরে অন্যান্য ইসলামী দলের শক্তিমত্তা কম হলেও হনগণ তাদেরকে ইসলামের প্রতিনিধি মনে করে। উপরন্তু ইসলামপন্থীরা নিজেদেরকে রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্য হতে পারেনি জনগণের দৃষ্টিতে। 

তাই দুটি কাজ করা যেতে পারে :
১. ইসলাম নয়, ইনসাফের নামে রাজনীতি করতে হবে। তখন মাসলাক, মাশরাব, আকিদা ইত্যাদির নামে বিভাজন থাকবে না। কাছাকাছি চিন্তার দলগুলো আগামী ২০/৩০ বছরের পরিকল্পনা হাতে নিতে পারে। যে অঞ্চলে যে দল শক্তিশালী সেখানে তারা প্রার্থী দিবে। এভাবে সংসদীয় আসনগুলো বণ্টিত হয়ে কাজ চলতে থাকবে। শুধু রাজনৈতিক ঐক্য হবে। যার যার আকিদা তার তার কাছে থাকবে। অমুক আকিদা বাদ দিতে হবে, এসব বলে কখনোই ঐক্য সম্ভব না। ঐক্য করতে হবে নিজেদের স্বার্থে। নইলে ইসলাম নিয়ে চলার কোনো অধিকার পাবেন না। জুলুম ও অত্যাচারের স্টিমরোলার চলবেই। যেই রশি মোল্লার গলায় ঝুলছে তা আমার গলায় ঝুলবে। যে মামলায় সাঈদীকে ফাঁসানো হয়েছে, সেই মামলা দিয়েই মামুনুল হক ও ফয়জুল করীমদের ফাঁসানো হবে। 
২. যারা পাবলিক ফিগার আছেন, যাদের কথা শুনার জন্য লাখ লাখ মানুষ জমা হন, তারা সরাসরি নির্বাচনে দাঁড়াবেন না। তাদের মনোনী জেনারেল শিক্ষিত; বিশেষত এডভোকেট ও ব্যারিস্টারদের নির্বাচনে দাঁড় করানো হবে। মাওলানা মামুনুল হক, মাও. ফয়জুল করীম, আজহারী ও আব্বাসী সাহেবদের সরাসরি নির্বাচনে যাওয়া উচিত হবে না নানা কারণে। 

তাদের কাজ হবে জনগণের অধিকারগুলো নিয়ে কথা বলা। সরকারের ও সরকারি লোকদের জুলুম, অত্যাচার ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাচার নিয়ে কথা বলা। শুধু দীনি  বিষয় নয়, পার্থিব বিষয় নিয়ে কথা বলবেন। সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কথা বলবেন। বাংলাদেশে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়েও কিভাবে এত এত পদ ও সুযোগ পাচ্ছেন, ডকুমেন্টসহ তুলে ধরবেন। এর ফলে জনমত গঠন হবে। 

এখন কথা থেকে যাবে, নির্বাচনে দাঁড়ালেই কি হবে, ভোট তো তাহাজ্জুদের সময়েই হয়ে যাবে। এটারও সমাধান আছে। 

শয়তানের দৃষ্টিতে মূল সমস্যা ইসলামে, আল্লাহ ও রাসুলের বিধানে। তাই শয়তান নিজ চেলাদের সবসময় ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে লাগিয়ে রাখে। আমরা যদি এখনও শয়তানের দোসরদের বিরুদ্ধে কার্যকর কিছু করতে না পারি তাহলে আগামী দশ বছর পর ইসলামের করুণ অবস্থা হবে। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে দেখতে পারব, আজকের লেখা যারা পড়বেন তাদের মাঝেও অনেকে বেঁচে থাকবেন আশা করি, তখন কথা হবে। 

বুখারা, সমরকন্দে এখানের চেয়ে বেশি আলেম ওলামা ছিল, বড় বড় আলেম ছিল, ইলমের চর্চা ছিল, মসজিদ মাদরাসা ছিল, তবুও সেসব দেশ হাতছাড়া হয়ে যায়। আমরা কিছু করতে না পারলে এখানের অবস্থাও তেমনই হবে।
---------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ আলোচক ও দাঈ। 


Post a Comment

0 Comments