Recent Tube

কুরআন ও হাদীসের আলোকে মহামারী, গজবের কারণ ও করণীয় এবং বাঁচার উপায়। শামীম আজাদ।


কুরআন ও হাদীসের আলোকে মহামারী, গজবের কারণ ও করণীয় এবং বাঁচার উপায় 
--------------------------------

    মহান আল্লাহ তাআ'লা মানবজাতি সৃষ্টি করে আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে ভূষিত করেছেন।  

    আর এ সৃষ্টির সেরা জীব যদি তার আসল মালিককে ভুলে যায় এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ অমান্য করে, তাহলে তার মালিক তার প্রতি শুধু অসন্তুষ্টই হন না, বরং তাকে শাস্তি দিতে বাধ্য হন। 

  তবে আল্লাহ তায়ালা যেহেতু অতিশয় মেহেরবান ও দয়ালু, তাই তিনি তাত্ক্ষণিক শাস্তি প্রয়োগ করেন না। 

    তিনি অবকাশ দেন, বারবার সুযোগ দেন। তা ছাড়া আমাদের প্রিয় নবী (সা.) আল্লাহ তায়ালার কাছে এ দোয়া করেছিলেন যে তাঁর উম্মতকে যেন আগেকার উম্মতের মতো শাস্তি তথা মানবাকৃতিকে বানর, শূকর ইত্যাদির আকৃতিতে রূপান্তর, পাথরের বৃষ্টি, ভূমি উল্টিয়ে দেয়ার মতো কঠিন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিনষ্ট করা না হয়।

عَنْ خَبَّابِ بْنِ الأَرَتِّ قَالَ: صَلَّى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلاَةً فَأَطَالَهَا فَقَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ صَلَّيْتَ صَلاَةً لَمْ تَكُنْ تُصَلِّيهَا؟ قَالَ: أَجَلْ إِنَّهَا صَلاَةُ رَغْبَةٍ وَرَهْبَةٍ إِنِّي سَأَلْتُ اللَّهَ فِيهَا ثَلاَثًا فَأَعْطَانِي اثْنَتَيْنِ وَمَنَعَنِي وَاحِدَةً، سَأَلْتُهُ أَنْ لاَ يُهْلِكَ أُمَّتِي بِسَنَةٍ فَأَعْطَانِيهَا، وَسَأَلْتُهُ أَنْ لاَ يُسَلِّطَ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ غَيْرِهِمْ فَأَعْطَانِيهَا، وَسَأَلْتُهُ أَنْ لاَ يُذِيقَ بَعْضَهُمْ بَأْسَ بَعْضٍ فَمَنَعَنِيهَا.
وَفِيْ رِوَايَةٍ وَسَأَلْتُهُ أَنْ لَا يَلْبِسَهُمْ شِيَعًا وَيُذِيقَ بَعْضَهُمْ بَأْسَ بَعْضٍ فَمَنَعَنِيهَا

 খাব্বাব বিন আরাত্ত (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

     একদা আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদেরকে নিয়ে খুব লম্বা নামায পড়লেন। লোকেরা বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনি এমন নামায পড়লেন, যা আগে পড়তেন না।’ তিনি বললেন, “হ্যাঁ, এটি ছিল আগ্রহ ও ভীতির নামায। আমি এতে আল্লাহর নিকট তিনটি জিনিস প্রার্থনা করলাম। কিন্তু তিনি আমাকে দু’টি জিনিস দান করলেন এবং একটি জিনিস দিলেন না। আমি প্রার্থনা করলাম, তিনি যেন আমার উম্মতকে দুর্ভিক্ষ-কবলিত করে ধ্বংস না করেন, তিনি আমাকে তা দিলেন। আমি চাইলাম, তিনি যেন আমার উম্মতের উপর কোন পর-শত্রুকে আধিপত্য না দেন, তিনি আমাকে তা দিলেন। আমি চাইলাম, তিনি যেন আমার উম্মতের মাঝে গৃহদ্বন্দ্ব না রাখেন, তিনি আমাকে তা দিলেন না।” 
তিরমিযী ২১৭৫, নাসাঈ, আহমাদ ২১০৫৩, মিশকাত ৩/২৫০

    অন্য এক বর্ণনায় আছে, “আমি চাইলাম, তিনি যেন তোমাদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে এক দলকে অপর দলের নিপীড়নের আস্বাদ  গ্রহণ না করান, কিন্তু তিনি আমাকে তা দিলেন না।” (সহীহহুল জামে’ ২৪৩৩)

মহামারীর কারণ:

    কোনো জাতির মাঝে আল্লাহর অবাধ্যতা বেড়ে গেলে, অবাধে সবাই পাপাচারে লিপ্ত হলে আল্লাহ্‌ নানানভাবে শাস্তি তাদের দেন। ভূমিকম্প, ঝড় তুফান, জলোচ্ছ্বাস, মহামারি ইত্যাদি। অশ্লীলতা, জঘন্য পাপ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে এই আযাবগুলো আসে। অতীতেও পাপাচারের শাস্তি হিসেবে মহামারি প্রাদুর্ভাব ঘটেছে।

  আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার জন্য  

  فَبَدَّلَ الَّذِينَ ظَلَمُواْ قَوْلاً غَيْرَ الَّذِي قِيلَ لَهُمْ فَأَنزَلْنَا عَلَى الَّذِينَ ظَلَمُواْ رِجْزاً مِّنَ السَّمَاء بِمَا كَانُواْ يَفْسُقُونَ
অতঃপর যালেমরা কথা পাল্টে দিয়েছে, যা কিছু তাদেরকে বলে দেয়া হয়েছিল তা থেকে। তারপর আমি অবতীর্ণ করেছি যালেমদের উপর আযাব, আসমান থেকে, নির্দেশ লংঘন করার কারণে।  
সূরা বাকারাঃ ৫৯

  দ্বীনের ব্যাপারে উদাসীনতা

 আল্লাহ তাআ'লা বলেন, 
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ خَرَجُواْ مِن دِيَارِهِمْ وَهُمْ أُلُوفٌ حَذَرَ الْمَوْتِ فَقَالَ لَهُمُ اللّهُ مُوتُواْ ثُمَّ أَحْيَاهُمْ إِنَّ اللّهَ لَذُو فَضْلٍ عَلَى النَّاسِ وَلَـكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يَشْكُرُونَ
‘তুমি কি তাদের দেখনি যারা মৃত্যুভয়ে হাজারে হাজারে স্বীয় আবাসভূমি ত্যাগ করেছিল। অতঃপর আল্লাহ তাদের বলেছিলেন, তোমাদের মৃত্যু হোক। তারপর আল্লাহ তাদের জীবিত করেন।'
সূরা বাকারাঃ ২৪৩

   আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, ‘তারা সংখ্যায় ছিল চার হাজার। মহামারির ভয়ে তারা পালিয়ে ছিল। তারা বলেছিল, আমরা এমন ভূমিতে যাব যেখানে মৃত্যু নেই। অতঃপর তারা এক স্থানে একত্র হলো। তখন আল্লাহ তাদের ওপর মৃত্যুর ফরমান জারি করেন।’ [তাফসির ইবনে কাসীর]

  দায়িত্ব পালনেও অবহেলা

যখন কোনো জাতির ওপর আযাব আসে, তখন শুধু পাপীরাই এতে আক্রান্ত হয় না। বরং মহামারি শুরু হলে নেক বান্দারাও আক্রান্ত হয়। দ্বীনি দায়িত্ব পালনে অবহেলা করা,  নেক কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে বাঁধা প্রদান করা ছেড়ে দেয়ার কারণে এই আযাব আসে।  
আল্লাহ তাআ'লা বলেন,  

فَلَوْلاَ كَانَ مِنَ الْقُرُونِ مِن قَبْلِكُمْ أُوْلُواْ بَقِيَّةٍ يَنْهَوْنَ عَنِ الْفَسَادِ فِي الأَرْضِ إِلاَّ قَلِيلاً مِّمَّنْ أَنجَيْنَا مِنْهُمْ وَاتَّبَعَ الَّذِينَ ظَلَمُواْ مَا أُتْرِفُواْ فِيهِ وَكَانُواْ مُجْرِمِينَ 
‘অতএব তোমাদের পূর্বের প্রজন্মসমূহের মধ্যে এমন প্রজ্ঞাবান কেন হয়নি, যারা জমিনে ফাসাদ করা থেকে নিষেধ করত? এমন লোক কমই ছিল, তাদের আমি বাঁচিয়ে নিয়েছিলাম। যালিমরা বিলাসিতার পেছনে পড়ে ছিল এবং তারা ছিল অপরাধী।’ 
সূরা হুদঃ ১১৬

إِسْحَاقُ أَخْبَرَنَا حَبَّانُ حَدَّثَنَا دَاوُدُ بْنُ أَبِي الْفُرَاتِ حَدَّثَنَا عَبْدُ اللهِ بْنُ بُرَيْدَةَ عَنْ يَحْيٰى بْنِ يَعْمَرَ عَنْ عَائِشَةَ زَوْجِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّهَا أَخْبَرَتْنَا أَنَّهَا سَأَلَتْ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَنْ الطَّاعُونِ فَأَخْبَرَهَا نَبِيُّ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَنَّه“كَانَ عَذَابًا يَبْعَثُهُ اللهُ عَلٰى مَنْ يَشَاءُ فَجَعَلَهُ اللهُ رَحْمَةً لِلْمُؤْمِنِينَ فَلَيْسَ مِنْ عَبْدٍ يَقَعُ الطَّاعُونُ فَيَمْكُثُ فِي بَلَدِه„ صَابِرًا يَعْلَمُ أَنَّه“لَنْ يُصِيبَه“إِلاَّ مَا كَتَبَ اللهُ لَه“إِلاَّ كَانَ لَه“مِثْلُ أَجْرِ الشَّهِيدِ تَابَعَهُ النَّضْرُ عَنْ دَاوُدَ.

  নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর স্ত্রী ‘আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

    তিনি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে প্লেগ রোগ / মহামারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তখন আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে জানান যে, এটি হচ্ছে এক রকমের আযাব। আল্লাহ যার উপর তা পাঠাতে ইচ্ছে করেন, পাঠান। কিন্তু আল্লাহ এটিকে মুমিনদের জন্য রহমাত বানিয়ে দিয়েছেন। অতএব প্লেগ রোগে /মহামারীতে কোন বান্দা যদি ধৈর্য ধরে, এ বিশ্বাস নিয়ে আপন শহরে অবস্থান করতে থাকে যে, আল্লাহ তার জন্য যা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন তা ছাড়া আর কোন বিপদ তার উপর আসবে না; তাহলে সেই বান্দার জন্য থাকবে শহীদের সাওয়াবের সমান সাওয়াব। দাঊদ থেকে নাযরও এ রকম বর্ণনা করেছেন।(আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩১৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২১০)
বুখারী ৫৭৩৪

 
   মানুষ পাপ করতে করতে যখন পাপের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখনই আল্লাহর শাস্তি নাজিল হয়। পাপিষ্ঠ ফেরাউনকে আল্লাহ তায়ালা তখনই ধরেছেন, যখন সে নিজেকে রব বলে দাবি করেছে। 

আল্লাহ তাআ'লা ইরশাদ করেন : 
اذْهَبْ إِلَى فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى
‘হে মুসা! তুমি ফেরাউনের কাছে যাও, সে অত্যন্ত উদ্ধত হয়ে গেছে।’ 
সূরা ত্বহাঃ ২৪, সূরা নাযিয়াতঃ ১৭

নমরুদকে আল্লাহ তাআ'লা তখনই শাস্তি দিয়েছেন, যখন সে নিজেকে প্রভু বলে দাবি করেছে। 

নমরুদ কয়েদীদের কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিতো কাউকে মুক্ত করে দিত তারপর বলতো আমিই মারি আমিই বাঁচাই, আমিই তোমাদের রব।
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِي حَآجَّ إِبْرَاهِيمَ فِي رِبِّهِ أَنْ آتَاهُ اللّهُ الْمُلْكَ إِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّيَ الَّذِي يُحْيِـي وَيُمِيتُ قَالَ أَنَا أُحْيِـي وَأُمِيتُ قَالَ إِبْرَاهِيمُ فَإِنَّ اللّهَ يَأْتِي بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ فَبُهِتَ الَّذِي كَفَرَ وَاللّهُ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ 
তুমি কি সে লোককে দেখনি, যে পালনকর্তার ব্যাপারে বাদানুবাদ করেছিল ইব্রাহীমের সাথে এ কারণে যে, আল্লাহ সে ব্যাক্তিকে রাজ্য দান করেছিলেন? ইব্রাহীম যখন বললেন, আমার পালনকর্তা হলেন তিনি, যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। সে বলল, আমি জীবন দান করি এবং মৃত্যু ঘটিয়ে থাকি। ইব্রাহীম বললেন, নিশ্চয়ই তিনি সুর্যকে উদিত করেন পূর্ব দিক থেকে এবার তুমি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উদিত কর। তখন সে কাফের হতভম্ব হয়ে গেল। আর আল্লাহ সীমালংঘণকারী সম্প্রদায়কে সরল পথ প্রদর্শন করেন না।  
সূরা বাকারাঃ ২৫৮

অনুরূপভাবে আদ, সামুদ প্রভৃতি জাতিকে তাদের সীমাহীন পাপাচারের কারণে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। 

وَ اُتْبِعُوْا فِیْ هٰذِهِ الدُّنْیَا لَعْنَةً وَّ یَوْمَ الْقِیٰمَةِؕ اَلَاۤ اِنَّ عَادًا كَفَرُوْا رَبَّهُمْؕ اَلَا بُعْدًا لِّعَادٍ قَوْمِ هُوْدٍ۠
শেষ পর্যন্ত এ দুনিয়ায় তাদের ওপর লানত পড়েছে এবং কিয়ামতের দিনেও। শোনো! আদ তাদের রবের সাথে কুফরী করেছিল। শোনো! দূরে নিক্ষেপ করা হয়েছে হূদের জাতি আদকে।
সূরা হুদঃ ৬০

وَّ عَادًا وَّ ثَمُوْدَاۡ وَ اَصْحٰبَ الرَّسِّ وَ قُرُوْنًۢا بَیْنَ ذٰلِكَ كَثِیْرًا
এভাবে আদ ও সামূদ এবং আসহাবুর রাস ও মাঝখানের শতাব্দীগুলোর বহু লোককে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।
সূরা ফোরকানঃ ৩৮

وَ كَمْ مِّنْ قَرْیَةٍ اَهْلَكْنٰهَا فَجَآءَهَا بَاْسُنَا بَیَاتًا اَوْ هُمْ قَآئِلُوْنَ
কত জনপদ আমি ধ্বংস করে দিয়েছি। তাদের ওপর আমার আযাব অকস্মাত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রাতের বেলা অথবা দিনের বেলা যখন তারা বিশ্রামরত ছিল।
সূরা আরাফঃ ৪

وَلَقَدْ أَخَذْنَا آلَ فِرْعَونَ بِالسِّنِينَ وَنَقْصٍ مِّن الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ
তারপর আমি পাকড়াও করেছি-ফেরাউনের অনুসারীদেরকে দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে এবং ফল ফসলের ক্ষয়-ক্ষতির মাধ্যমে যাতে করে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।  
সূরা আরাফঃ ১৩০

فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمُ الطُّوفَانَ وَالْجَرَادَ وَالْقُمَّلَ وَالضَّفَادِعَ وَالدَّمَ آيَاتٍ مُّفَصَّلاَتٍ فَاسْتَكْبَرُواْ وَكَانُواْ قَوْمًا مُّجْرِمِينَ 
সুতরাং আমি তাদের উপর পাঠিয়ে দিলাম তুফান, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ ও রক্ত প্রভৃতি বহুবিধ নিদর্শন একের পর এক। তারপরেও তারা গর্ব করতে থাকল। বস্তুতঃ তারা ছিল অপরাধপ্রবণ।  
সূরা আরাফঃ ১৩৩

বনি ইসরাইলরা আল্লাহর কিতাব তাওরাতকে অস্বীকার, উত্তম জিনিস তথা মান্না ও সালওয়ার পরিবর্তে খারাপ জিনিস তথা ভূমির উৎপন্ন জিনিস চাওয়া, আমালেকা সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আল্লাহর অগণিত নিয়ামত ভোগ করেও অকৃতজ্ঞ হওয়ার কারণে চির লাঞ্ছনা ও আল্লাহর ক্রোধে পতিত হয়েছে। 

আগের নবীদের এসব কাহিনী পবিত্র কুরআনে আলোচনা করে আল্লাহ তাআ'লা এটিই বোঝাতে চেয়েছেন যে, যদি উম্মতে মুহাম্মদী (সা.)ও তাদের মতো পাপাচারে লিপ্ত হয়, তবে তাদের পরিণতিও অনুরূপ হবে এবং একই ভাগ্য বরণ করতে হবে। 

মহান আল্লাহ তাআ'লা বলেন, 

ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُم بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ

‘স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ 
সূরা রূমঃ ৪১

قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِن قَبْلُ كَانَ أَكْثَرُهُم مُّشْرِكِينَ

‘বলুন, তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং দেখ তোমাদের পুর্ববর্তীদের পরিণাম কি হয়েছে। তাদের অধিকাংশই ছিল মুশরিক।’ 
সূরা রূমঃ ৪২

وَمَا أَصَابَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ
"তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তা তো তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক অপরাধ ক্ষমা করে দেন"। 
সূরা আস শুরাঃ ৩০

অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে 
وَإِن تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ فَإِنَّ الْإِنسَانَ كَفُورٌ
‘যখন তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদের উপর বিপদ-আপদ আসে (মানুষের ব্যক্তিগত বা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কর্মদোষে সাধারণত বিপদ-আপদ ঘটে) তখন মানুষ হয়ে পড়ে অকৃতজ্ঞ’। 
সূরা শূরাঃ ৪৮

পবিত্র কুরআনে আরও ইরশাদ করেন যে,

مَّا أَصَابَكَ مِنْ حَسَنَةٍ فَمِنَ اللّهِ وَمَا أَصَابَكَ مِن سَيِّئَةٍ فَمِن نَّفْسِكَ
"কল্যাণ যা তোমার হয় তা আল্লাহর নিকট হতে এবং অকল্যাণ যা তোমাদের হয় তো তোমার নিজের কারণে"। 
সূরা আন নিসাঃ ৭৯

হযরত নূহ (আ:) হইতে হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর পূর্ববর্তী নবী ও রাসূলগণের উম্মতের উপর যেসব আল্লাহর গজব নাজিল হয়েছে তা সেসব উম্মতগণের অন্যায়-অপকর্ম ও আল্লাহর অবাধ্যতার কারণেই হয়েছে।
হযরত নূহ (আ:) তাঁর উম্মতগণ তাঁকে অস্বীকার করে নানা ধরণের অপকর্মে লিপ্ত হলে আল্লাহপাক তাদেরকে গজব দিয়ে ধ্বংস করেন।

পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন যে,

وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ فَلَبِثَ فِيهِمْ أَلْفَ سَنَةٍ إِلَّا خَمْسِينَ عَامًا فَأَخَذَهُمُ الطُّوفَانُ وَهُمْ ظَالِمُونَ
"আমি তো নূহকে তার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করেছিলাম। সে তাদের মধ্যে পঞ্চাশ কম হাজার বছর (৯৫০ বছর) অবস্থান করেছিল। অতঃপর প্লাবন তাদেরকে গ্রাস করে।কারণ তারা ছিল চরম সীমালঙ্গনকারী"। 
সূরা আনকাবুতঃ ১৪

হযরত নূহ (আ:) এবং উম্মতগণের মধ্যে যারা তাঁর অনুসারী ছিল তাদের উপর আল্লাহ গজব নাজিল করেননি বা তাদেরকে ধ্বংস করেননি।
ইরশাদ হচ্ছে 
فَأَنجَيْنَاهُ وَأَصْحَابَ السَّفِينَةِ وَجَعَلْنَاهَا آيَةً لِّلْعَالَمِينَ
"অতঃপর আমি তাঁকে (নূহকে) এবং যারা নৌকায় আরোহণ করেছিল তাদেরকে রক্ষা করলাম এবং বিশ্বজগতের জন্য ইহাকে করলাম একটি নিদর্শন"। 
সূরা আনকাবুতঃ ১৫

হযরত নূহ (আ:) তাঁর উম্মতের মধ্যে যারা অবাধ্য ও অপকর্মে লিপ্ত ছিল তাদেরকে আল্লাহপাক গজব দ্বারা ধ্বংস করেছিলেন।
এর দ্বারা প্রমাণ হলো,আল্লাহর অবাধ্যতা ও সীমাহীণ অন্যায়-অপকর্মে লিপ্ত হলে আল্লাহর গজব আসে।

আ’দ,সামুদ,লুত (আ:) এর সম্প্রদায়,শুয়াইব (আ:) এর সম্প্রদায় তাদের নবীদেরকে অস্বীকার করায় এবং লাগামহীণ পাপে লিপ্ত হওয়ার কারণে আল্লাহপাক তাদেরকে গজব দ্বারা ধ্বংস করেছিলেন। সূরা শু’আরা (১০৫-২০৯)

গজবের দ্বারা পাপীদের ধ্বংসের কথা পবিত্র কুরআনে বার-বার উল্লেখ করা হয়েছে মানুষকে সতর্ক করার জন্য।
ব্যক্তিগত, সামাজিক ভাবে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অপকর্ম করার কারণে পূর্ববর্তী জাতিকে যে গজব দ্বারা ধ্বংস করেছিলেন সে সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন,

وَقَارُونَ وَفِرْعَوْنَ وَهَامَانَ وَلَقَدْ جَاءهُم مُّوسَى بِالْبَيِّنَاتِ فَاسْتَكْبَرُوا فِي الْأَرْضِ وَمَا كَانُوا سَابِقِينَ.  فَكُلًّا أَخَذْنَا بِذَنبِهِ فَمِنْهُم مَّنْ أَرْسَلْنَا عَلَيْهِ حَاصِبًا وَمِنْهُم مَّنْ أَخَذَتْهُ الصَّيْحَةُ وَمِنْهُم مَّنْ خَسَفْنَا بِهِ الْأَرْضَ وَمِنْهُم مَّنْ أَغْرَقْنَا وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيَظْلِمَهُمْ وَلَكِن كَانُوا أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ
আমি কারুন, ফেরাউন ও হামানকে ধ্বংস করেছি। মূসা তাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে আগমন করেছিল অতঃপর তারা দেশে দম্ভ করেছিল। কিন্তু তারা জিতে যায়নি। আমি প্রত্যেককেই তার অপরাধের কারণে পাকড়াও করেছি। তাদের কারও প্রতি প্রেরণ করেছি প্রস্তরসহ প্রচন্ড বাতাস, কাউকে পেয়েছে বজ্রপাত, কাউকে আমি বিলীন করেছি ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছি নিমজ্জত। আল্লাহ তাদের প্রতি যুলুম করার ছিলেন না; কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি যুলুম করেছে।
সূরা আনকাবুতঃ ৩৯-৪০

দূর্ভিক্ষ খরা শীলাবৃষ্টি মহামারী পানিতে নিমজ্জন অগ্নিকান্ড বন্যা এডিস মশা ডেঙ্গু এসব হচ্ছে আল্লাহর গজবের অন্তর্ভুক্ত।
এসব আল্লাহর গজব আসে মানুষের লাগামহীণ পাপের কারণে।
মানুষের অপরাধের কারণে আল্লাহর গজব নাজিল হয় সত্য কিন্তু সবচেয়ে বেশি গজব নাজিল হয় সমাজপতি বা শাসকগোষ্ঠীর অপরাধের কারণে। দূর্বল লোক বা অধীনস্থ লোকের পাপের কারণে আল্লাহর গজব নাজিল হয় না।

আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলেনঃ
لَمْ تَظْهَرْ الْفَاحِشَةُ فِي قَوْمٍ قَطُّ حَتَّى يُعْلِنُوا بِهَا إِلَّا فَشَا فِيهِمْ الطَّاعُونُ وَالْأَوْجَاعُ الَّتِي لَمْ تَكُنْ مَضَتْ فِي أَسْلَافِهِمْ
‘যখন কোনো কওমের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা তা প্রকাশ্যেও করতে শুরু করে তবে তাদের মাঝে দুর্ভিক্ষ ও মহামারি ব্যাপক আকার ধারণ করে, যা তাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে ছিল না।’ 
ইবনু মাজাহ, আসসুনান ৪০১৯

عَنْ اَنَسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم لَيَكُوْنَنَّ فِى هذِه الْاُمّةِ خَسْفٌ وقَذْفٌ وَمَسْخٌ وذلِكَ اِذَا شَرِبُوْا الْخُمُوْرَ واتَّخَذُوْا القَيْنَاتِ وَضَرَبُوْا بِالْمَعَازِفِ.
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত
নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যখন আমার উম্মত নেশাদার দ্রব্য পান করবে, গায়িকাদের নিয়ে নাচ-গানে মত্ত হবে এবং বাদ্যযন্ত্র নিয়ে ব্যস্ত হবে তখন অবশ্যই তিনটি ভয়াবহ বিপদ নেমে আসবে- 
(১) বিভিন্ন এলাকায় ভূমি ধসে যাবে 
(২) উপর থেকে অথবা কোন জাতির পক্ষ থেকে যুলুম অত্যাচার চাপিয়ে দেওয়া হবে 
(৩) অনেকের পাপের দরুণ আকার-আকৃতি বিকৃত করা হবে। আর এ গজবের মূল কারণ তিনটি। 
(ক) মদ পান করা 
(খ) নায়িকাদের নিয়ে নাচ-গানে মত্ত হওয়া 
(গ) বাদ্য যন্ত্রের প্রতি আগ্রহী হওয়া।
হাদিসে কুদসী

عَن عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ قَالَ: أَقْبَلَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ يَا مَعْشَرَ الْمُهَاجِرِينَ خَمْسٌ إِذَا ابْتُلِيتُمْ بِهِنَّ وَأَعُوذُ بِاللهِ أَنْ تُدْرِكُوهُنَّ لَمْ تَظْهَرِ الْفَاحِشَةُ فِى قَوْمٍ قَطُّ حَتَّى يُعْلِنُوا بِهَا إِلاَّ فَشَا فِيهِمُ الطَّاعُونُ وَالأَوْجَاعُ الَّتِى لَمْ تَكُنْ مَضَتْ فِى أَسْلاَفِهِمُ الِّذِينَ مَضَوْا وَلَمْ يَنْقُصُوا الْمِكْيَالَ وَالْمِيزَانَ إِلاَّ أُخِذُوا بِالسِّنِينَ وَشِدَّةِ الْمَؤُنَةِ وَجَوْرِ السُّلْطَانِ عَلَيْهِمْ وَلَمْ يَمْنَعُوا زَكَاةَ أَمْوَالِهِمْ إِلاَّ مُنِعُوا الْقَطْرَ مِنَ السَّمَاءِ وَلَوْلاَ الْبَهَائِمُ لَمْ يُمْطَرُوا وَلَمْ يَنْقُضُوا عَهْدَ اللهِ وَعَهْدَ رَسُولِهِ إِلاَّ سَلَّطَ اللهُ  عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ غَيْرِهِمْ فَأَخَذُوا بَعْضَ مَا فِى أَيْدِيهِمْ وَمَا لَمْ تَحْكُمْ أَئِمَّتُهُمْ بِكِتَابِ اللهِ وَيَتَخَيَّرُوا مِمَّا أَنْزَلَ اللهُ  إِلاَّ جَعَلَ اللهُ  بَأْسَهُمْ بَيْنَهُمْ

ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “হে মুহাজিরদল! পাঁচটি কর্ম এমন রয়েছে যাতে তোমরা লিপ্ত হয়ে পড়লে (উপযুক্ত শাস্তি তোমাদেরকে গ্রাস করবে)। আমি আল্লাহর নিকট পানাহ চাই, যাতে তোমরা তা প্রত্যক্ষ না কর।
   যখনই কোন জাতির মধ্যে অশ্লীলতা (ব্যভিচার) প্রকাশ্যভাবে ব্যাপক হবে, তখনই সেই জাতির মধ্যে প্লেগ এবং এমন মহামারী ব্যাপক হবে যা তাদের পূর্বপুরুষদের মাঝে ছিল না।
 যে জাতিই মাপ ও ওজনে কম দেবে, সে জাতিই দুর্ভিক্ষ, কঠিন খাদ্য-সংকট এবং শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের শিকার হবে।
   যে জাতিই তার মালের যাকাত দেওয়া বন্ধ করবে, সে জাতির জন্যই আকাশ হতে বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হবে। যদি অন্যান্য প্রাণীকুল না থাকত, তাহলে তাদের জন্য আদৌ বৃষ্টি হত না।
   যে জাতি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে, সে জাতির উপরেই তাদের বিজাতীয় শত্রুদলকে ক্ষমতাসীন করা হবে; যারা তাদের মালিকানা-ভুক্ত বহু ধন-সম্পদ নিজেদের কুক্ষিগত করবে।
   আর যে জাতির শাসকগোষ্ঠী যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহর কিতাব (বিধান) অনুযায়ী দেশ শাসন করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি তাদের মাঝে গৃহদ্বন্দ্ব অবস্থায়ী রাখবেন।” (বাইহাকী, ইবনে মাজাহ ৪০১৯, সহীহ তারগীব ৭৬৪)

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে সমাজের সবাই তো অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, পাপ বা অন্যায় কাজে লিপ্ত নয়। তাহলে ব্যাপক হারে মহামারী ছড়িয়ে পড়ার কারণ কি? এর জবাব নিন নিম্নে বর্ণিত হাদীস থেকে।
আবূ বাকর সিদ্দিক (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছিঃ 
إِنَّ النَّاسَ إِذَا رَأَوْا الْمُنْكَرَ لَا يُغَيِّرُونَهُ أَوْشَكَ أَنْ يَعُمَّهُمْ اللَّهُ بِعِقَابِهِ 
"যখন লোকেরা অন্যায়-পাপ কাজ হতে দেখে তা পরিবর্তন বা সংশোধন করবে না তখন যে কোন মুহুর্তে আল্লাহর শাস্তি তাদের সবাইকে গ্রাস করবে।" (জামে তিরমিযী হাঃ ২১৬৮, ৩০৫৭, সুনান আবু দাউদ হাঃ ৪৩৩৮, সুনান ইবনে মাজাহ হাঃ ৪০০৫, মুসনাদে আহমদ হাঃ ০১, ১৭, ৫৪, শব্দগুলো ইবনে মাজাহ থেকে নেওয়া।

শুধু মাত্র হাদীসেই নয়, পবিত্র কুরআনেও এমন কথা বলা হয়েছে। মহান অাল্লাহ তা'য়ালা বলেন,
وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً ۖ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ.
আর তোমরা সেই ফিতনাকে ভয় কর যা তোমাদের মধ্য থেকে বিশেষভাবে শুধু অত্যাচারী বা অন্যায়কারীদের উপরই আপতিত হবে না (বরং ব্যাপক ভাবে সবার উপর আপতিত হবে)। আর জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ আযাব প্রদানে কঠোর। (সূরা আনফালঃ০৮/২৫)
.
সৎকাজের আদেশ প্রদান এবং অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখার চেষ্টা পরিহার করাই হল এই ফিতনা বা মহামারীর কারণ । ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ আল্লাহ মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন তারা নিজের এলাকায় কোন অপরাধ ও পাপ কর্ম হতে না দেয়। কারণ, যদি তারা এমন না করে, অর্থাৎ সামর্থ্য থাকা সত্বেও অপরাধ ও পাপকৰ্ম অনুষ্ঠিত হতে দেখে তা থেকে বারণ না করে, তবে আল্লাহ স্বীয় আযাব সবার উপরই ব্যাপক করে দেন (তাফসীরে তাবারী)।

এ বিষয়টি পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রমাণিত, পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন,

وَإِذَا أَرَدْنَا أَن نُّهْلِكَ قَرْيَةً أَمَرْنَا مُتْرَفِيهَا فَفَسَقُواْ فِيهَا فَحَقَّ عَلَيْهَا الْقَوْلُ فَدَمَّرْنَاهَا تَدْمِيرًا

যখন আমি কোন জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি তখন তার অবস্থাপন্ন লোকদেরকে উদ্ধুদ্ধ করি অতঃপর তারা পাপাচারে মেতে উঠে।তখন সে জনগোষ্টীর উপর আদেশ অবধারিত হয়ে যায়। অতঃপর আমি তাকে উঠিয়ে আছাড় দেই।
সূরা বনী ইসরাইলঃ ১৬

উক্ত আয়াত দ্বারা দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত,দূর্বল লোক বা অধীনস্থ লোকের অপরাধের কারণে আল্লাহর গজব নাজিল হয় না; বরং ক্ষমতাবানদের অপরাধের কারণে দেশের উপর,আমজনতার উপর আল্লাহর গজব নাজিল হয়।
প্রশ্ন হলো, শাসকের পাপের কারণে শাসিত বা আমজনগণ শাস্তি পাবে কেন?
এ স্পষ্ট জবাব হাদিসে রয়েছে,

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “আমাদের মধ্যে সৎ লোকগণ থাকা অবস্থায়ও আমরা কি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবো?” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বলেছিলেন, “হ্যা, যখন খারাপের পরিমান বৃদ্ধি পায়”। 
মুসলিম

وَعَنْ جَابِرٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: "أَوْحَى اللهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلٰى جِبْرِيْلَ عَلَيْهِ السَّلَامُ: أَنِ اقْلِبْ مَدِينَةَ كَذَا وَكَذَا بِأَهْلِهَا قَالَ: يَارَبِّ إِنَّ فِيهِمْ عَبْدَكَ فُلَانًا لَمْ يَعْصِكَ طَرْفَةَ عَيْنٍ". قَالَ: "فَقَالَ: اقْلِبْهَا عَلَيْهِ وَعَلَيْهِمْ فَإِنَّ وَجْهَهٗ لَمْ يَتَمَعَّرْ فِىْ سَاعَةٍ قَطُّ
জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেনঃ আল্লাহ মহীয়ান-গরীয়ান জিবরীল (আ.)-কে আদেশ করেন যে, অমুক শহর বা জনপদটিকে সেটার বাসিন্দাসহ উল্টিয়ে দাও। তখন জিবরীল (আ.) বললেনঃ হে প্রভু! ঐ জনপদে তোমার অমুক বান্দা রয়েছে, যে এক মুহূর্ত তোমার নাফরমানি করেনি। রাসূল সাঃ বললেনঃ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তার ও তাদের সকলের ওপর শহরটিকে উল্টিয়ে দাও। কারণ ঐ ব্যক্তির মুখমণ্ডলে পাপীদের পাপাচার দেখে আমার সন্তুষ্টির জন্য এক মুহূর্তের জন্যও পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ- সে পাপীদের পাপ এক মুহূর্তের জন্যও মলিন হয়নি’।
মিশকাতুল মাসাবীহ ৫১৫২

আল্লাহর গজব থেকে বাঁচতে হলে প্রকাশ্যভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে।
আপদ-বিপদ ও আল্লাহর গজব আসে অপরাধের কারণে বিশেষ করে শাসকদের অপরাধের কারণে। 

করণীয়:

(১) হাদীসে বর্ণিত মহামাারির কারণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো প্রতিকারের চেষ্টা চালানো। উপরোক্ত হাদীসে অশ্লীলতার ব্যাপক সয়লাব হওয়াকে মহামারির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং অশ্লীলতায় সয়লাব হয়ে যাওয়া প্রতিটি দেশ ও জাতির সচেতন হওয়ার সময় এসেছে। 

(২) বেশি বেশি তাওবা ও ইস্তিগফার করা। কারণ তাওবা বালা-মুসিবত দূর করে দেয়। 

আল্লাহ বলেন, 
وَلَقَدْ أَرْسَلنَآ إِلَى أُمَمٍ مِّن قَبْلِكَ فَأَخَذْنَاهُمْ بِالْبَأْسَاء وَالضَّرَّاء لَعَلَّهُمْ يَتَضَرَّعُونَ
‘আর আমি তোমাদের পূর্বেকার জাতিসমূহের কাছে বহু রাসূল পাঠিয়েছি। অতঃপর (রাসূলগণকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কারণে) তাদেরকে অভাব-অনটন ও রোগ-শোক দ্বারা পাকড়াও করেছি, যাতে তারা বিনীত হয়।’ 
সূরা আনআমঃ ৪২

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতেনঃ 
"‏ اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ وَالْجُنُونِ وَالْجُذَامِ وَمِنْ سَيِّئِ الأَسْقَامِ ‏"‏ ‏
“হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই শ্বেত, উন্মাদনা, কুষ্ঠ এবং সমস্ত দুরারোগ্য ব্যাধি হতে। ”
সুনানে আবু দাউদঃ ১৫৫৪

(৩) মহামারী কবলিত ভূমিতে অবস্থা করলে সেখান থেকে বের হওয়া যাবে না, বরং সবর করতে হবে। কারণ সবাই যদি মহামারী কবলিত এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়, তাহলে আক্রান্তদের সেবাযত্ন করার কেউ থাকবে না। তাই ব্যাপকভাবে নিজ পরিবার-পরিজন ও সমাজের মানুষদের ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া উচিত নয়। তবে অবশ্যই পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 

أَبُو الْيَمَانِ حَدَّثَنَا شُعَيْبٌ عَنْ الزُّهْرِيِّ حَدَّثَنَا عَامِرُ بْنُ سَعْدِ بْنِ أَبِي وَقَّاصٍ أَنَّهُ سَمِعَ أُسَامَةَ بْنَ زَيْدٍ يُحَدِّثُ سَعْدًا أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم ذَكَرَ الْوَجَعَ فَقَالَ رِجْزٌ أَوْ عَذَابٌ عُذِّبَ بِهِ بَعْضُ الْأُمَمِ ثُمَّ بَقِيَ مِنْهُ بَقِيَّةٌ فَيَذْهَبُ الْمَرَّةَ وَيَأْتِي الْأُخْرَى فَمَنْ سَمِعَ بِهِ بِأَرْضٍ فَلاَ يُقْدِمَنَّ عَلَيْهِ وَمَنْ كَانَ بِأَرْضٍ وَقَعَ بِهَا فَلاَ يَخْرُجْ فِرَارًا مِنْهُ

উসামা ইব্‌নু যায়দ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

তিনি সা‘দ (রাঃ)-কে বলেন - একদিন রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহামারী সম্পর্কে আলোচনার সময় বললেনঃ এ একটি শাস্তি, কতক জাতিকে এ দ্বারা শাস্তি দেয়া হয়েছে। তারপর এর কিছু অংশ বাকী রয়ে গেছে। তাই কখনো এ চলে যায় আবার কখনো তা ফিরে আসে। যখন কেউ কোন এলাকায় মহামারীর কথা শুনবে তখন যেন সে সেখানে না যায়। আর যে কেউ এমন এলাকায় থাকে যেখানে এর আক্রমণ ঘটেছে, তখন সে যেন সেখান থেকে পালিয়ে বের হয়ে না আসে।(আধুনিক প্রকাশনী- ৬৪৯০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৫০৩)
সহিহ বুখারী ৬৯৭৪

(৪) আল্লাহর ফয়সালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে এবং আল্লাহ যে তাদের শহীদের সওয়াব দান করবেন সে ব্যাপারে আশা রাখতে হবে।
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللّهِ ﷺ: «الطَّاعُونُ شَهَادَةٌ لِكُلِّ مُسْلِمٍ». (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ত্বা’উন (মহামারী)’র কারণে মৃত্যু মুসলিমদের জন্য শাহাদাতের মর্যাদা।  
বুখারী ২৮৩০, ৫৭৩২, মুসলিম ১৯১৬, আহমাদ ১৩৩৩৫, সহীহ আত্ তারগীব ১৩৯৯, সহীহ আল জামি‘ আস্ সগীর ৩৯৪৭, মিশকাতুল মাসাবিহ ১৫৪৫

(৫) যদি মহামারী এলাকা থেকে দূরে থাকে তবে মহামারি এলাকার আশেপাশে যাবে না।

حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ، حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ زَيْدٍ، عَنْ عَمْرِو بْنِ دِينَارٍ، عَنْ عَامِرِ بْنِ سَعْدٍ، عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم ذَكَرَ الطَّاعُونَ فَقَالَ ‏ "‏ بَقِيَّةُ رِجْزٍ - أَوْ عَذَابٍ أُرْسِلَ عَلَى طَائِفَةٍ مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ فَإِذَا وَقَعَ بِأَرْضٍ وَأَنْتُمْ بِهَا فَلاَ تَخْرُجُوا مِنْهَا وَإِذَا وَقَعَ بِأَرْضٍ وَلَسْتُمْ بِهَا فَلاَ تَهْبِطُوا عَلَيْهَا ‏"‏ ‏.‏ قَالَ وَفِي الْبَابِ عَنْ سَعْدٍ وَخُزَيْمَةَ بْنِ ثَابِتٍ وَعَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ عَوْفٍ وَجَابِرٍ وَعَائِشَةَ ‏.‏ قَالَ أَبُو عِيسَى حَدِيثُ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ ‏.‏

উসামা ইবনু যাইদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

মহামারী প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আলোচনা করলেন এবং বললেনঃ যে গযব বা শাস্তি বানী ইসরাঈলের এক গোষ্ঠীর উপর এসেছিলো, তার বাকী অংশই হচ্ছে মহামারী। অতএব, কোথাও মহামারীর দেখাদিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থানরত থাকলে সে জায়গা হতে চলে এসো না। অপরদিকে কোন এলাকায় এটা দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থান না করলে সে জায়গাতে যেও না।
জামে' আত-তিরমিজি ১০৬৫

মহামারী থেকে বাঁচার মোক্ষম উপায়

ইবনে কাছির (রহ.) বর্ণনা করেন, ৪৭৮ হিজরীতে (১০৮৫ সাল) ইরাক্ব, সিরিয়া এবং হিজাজের সর্বত্র প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হয়। সংক্রমণ এতটাই মারাত্মক ছিল যে গৃহপালিত পশু ও অন্যান্য বন্যপশু মারা যাচ্ছিল। আক্রান্ত অঞ্চলে দুধ ও মাংসের অভাব দেখা দিল। আকাশে যুক্ত হল কালো মেঘের ঘনঘটা ও তীব্র বজ্রপাত। ঝড়ো হাওয়ায় গাছগুলো উপড়ে যাচ্ছিল। সবাই মনে করল, কিয়ামত বুঝি এসেই পড়েছে।

আব্বাসী খলিফা আল-মুক্বতাদি বি আমিরিল্লাহ এই দুমুখী গজব থেকে মুক্তির জন্য সবাইকে নিষিদ্ধ কাজগুলো ছেড়ে দেওয়ার আদেশ করলেন, সাথে ভালো কাজের নির্দেশ দিলেন। গানবাজনার যন্ত্রপাতি ও মদের বোতলগুলো ভেঙে ফেলতে আদেশ করলেন। খারাপ লোকদেরকে এলাকা থেকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিলেন। এতে করে খুব দ্রুতই প্লেগ চলে গেল। পরিস্থিতি ঠান্ডা হল।

(আল বিদায়াহ ওয়াল নিহায়াহ, ১৩/২১৬)

আল্লাহর গজব থেকে বাঁচতে হলে প্রকাশ্যভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে।
আপদ-বিপদ ও আল্লাহর গজব আসে অপরাধের কারণে বিশেষ করে শাসকদের অপরাধের কারণে। তাই আল্লাহর গজব থেকে মুক্তির জন্য সকল প্রকার পাপ বর্জন করা আমাদের সকলের উচিত। মহান আল্লাহ তাআ'লা আমাদের সকলকে বুঝার তাওফীক দান করুন, মুমিনদের হালাল রুজির ব্যবস্থা করে দিন।
আল্লাহ তাআ'লা আমাদের সকলকে সঠিক বুঝ দান করুন। সকল অশ্লীল পাপকর্ম, কুফুরী কার্যক্রম থেকে হেফাজত করুন। 
কফুরী রাষ্ট্র শক্তি ধ্বংস করে একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র দান করুন।
"‏ اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ وَالْجُنُونِ وَالْجُذَامِ وَمِنْ سَيِّئِ الأَسْقَامِ ‏"‏ ‏
“হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই শ্বেত, উন্মাদনা, কুষ্ঠ এবং সমস্ত দুরারোগ্য ব্যাধি হতে। ”
আল্লাহুম্মা আমিন।

Post a Comment

0 Comments