Recent Tube

মনোকথন-৩; ৷ জিয়াউল হক।


                       মনোথন-৩
    
  কেবলমাত্র হতবিহ্বল ও উদ্ভ্রান্ত হবার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে কোন কথা ছিল না। বরং বিশ্বের বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করে দিয়েছে। অনেক গবেষক ও বিজ্ঞানীরা বিভ্রান্ত হবার পাশাপাশি কোটি কোটি মানুষকেও বিভ্রান্ত করেছেন। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হলে তারা এক সময় পথ খুঁজে পান, পথ দেখানোর মতো বুদ্ধিজীবি ও গবেষক এবং চিন্তাশীল ব্যক্তিদের অনুসরণের মাধ্যমে তারা এক সময় নিজেদের ভূলগুলোকে শুধরে নিতে পারেন। 

  কিন্তু একটি সমজের বুদ্ধিজীবী, চিন্তাশীল ও গবেষক শ্রেণির মানুষ যখন বিভ্রান্ত হন, তখন প্রকৃত অর্থেই বিপদটা পুরো সমাজের প্রত্যেকের জন্যই ভয়ানক হয়ে দেখা দেয়। কারণ তখন এমন আর কেউ অবশিষ্ঠ থাকেন না, যিনি বা যারা জাতিকে সঠিক পথটা দেখাবেন। এরই ধারাবাহিকতায় ঐ সমাজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও ঠিক একই ভুলের ভেতর দিয়েই তাদের জীবন শুরু করে।

  তাই মনের ঠিকানা পরিচয়, উৎস, কর্মপদ্ধতি ভালো মন্দের ধরন জানতে যদি ভুল হয়, তা হলে আসলেই বিপদটা অনেক বড়ো এবং দীর্ঘমেয়াদি। এতো বড়ো যে, নিজেকেই চেনা হয় না, জানাও হয় না। নিজের ভালো মন্দই ঠিকমতো বুঝতে ও জানতে পারে না মানুষ, সে পরিবার পরিজন ও সমাজবাসীর ভালো মন্দকে কিভাবে চিনবে ও জানবে?

   কাজেই নিজেকে চেনা ও জানা, নিজের মনের ভালো মন্দ থাকা না থাকার বিষয়টা জানা নারী পুরুষ প্রতিটি মানুষের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে ব্যক্তি মানুষের মন ও তার কার্যপরিধি, ভালো মন্দের ব্যাপারে অন্ধকারে সে পুরো বিশ্বজগত, বিশেষ করে, তার আশে পাশে প্রতিটি মানুষের ভালো মন্দ ও কল্যাণ অকল্যাণের ব্যাপারেই অন্ধকারে থাকতে বাধ্য।  
    ঠিক এটাই ঘটে চলেছে আধুনিক মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে। আধুনিক মনোবিজ্ঞান এমনসব ধ্যান ধারনার উপরে নিজেদের মৌলিক ধারনাকে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে, যে তার ভেতরেই ভ্রান্তির বীজ লুকায়িত রয়েছে। ফলে সকল সদিচ্ছা আর আন্তরিকতা নিয়ে বসরের পর বসর ধরে গবেষণা করেও তারা মানসিক রোগের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোন সফলতা অর্জন করতে পারেনি। প্রযুক্তির অকল্পনীয় উন্নয়ন, অর্থ ও সম্পদের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে পেরেছে, জনবলেরও তেমন কোন কমতি নেই, প্রচুর সংখক গবেষক দিন রাত নিরলসভাবে গবেষণায় লিপ্ত রয়েছেন, কিন্তু কোন কিছুতেই যেন কিছু হয়ে উঠছে না। 

    বিশ্বের কোন কোন উন্নত দেশসমূহ তাদের বার্ষিক বাজেটে মানসিক রোগ গবেষণা ও চিকিৎসার পেছনে সর্বাধিক অর্থ বরাদ্দ করেছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে  গবেষকদের সকল ধরনের সুবিধা ও প্রণোদনা নিশ্চিত করেছে, এমনকি, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে আলাদা মন্ত্রণালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছে। এর পাশাপাশি নতুন নতুন ঔষধ উদ্ভাবন হয়েছে, কিন্তু এতোকিছুর পরেও মানসিক রোগের সফল ও স্বার্থক চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিদারুণভাবে বিশ্ব ব্যর্থ হয়েছে। 

     দু:খজনক এই বাস্তবতাকে বিশ্বের কোন বিজ্ঞানী,  চিকিৎসক, কোন গবেষক বা কোন প্রতিষ্ঠানই অস্বীকার করেন না। লজ্জাজনক এ ব্যর্থতার পেছনে কারণ একটাই, তারা মনের রুপ ও প্রকৃতি, তার উৎস, কর্মপদ্ধতি নিয়ে পুরোপুরি ভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হয়ে রয়েছে।  

    মানসিক রোগের চিকিৎসা, পূনর্বাসন ও গবেষণায় নিয়োজিত প্রতিটি চিকিৎসক, বিজ্ঞানী ও গবেষক সবার আগে নিজেরাও এক একজন মানুষ। তাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠজনই মানুষ হয়েও মানুষের, তথা, নিজেদের সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করে বসে আছেন। সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টিজগতের সাথে নিজেদের আত্মিক, মানসিক, জাগতিক ও পারলৌকিক সম্পর্ককে অস্বীকার করেছেন। এই অস্বীকৃতিই তাদেরকে বিপথে চালিত করেছে। 

     আধুনিক বিশ্বে মানুষের মনস্তত্ত ও সাইকোলোজি চর্চার একাডেমিক রসদ যে সব মনোবিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবদের লেখনি ও গবেষণাকর্মের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হচ্ছে, তাদের অধিকাংশই নিরেট নাস্তিক ছিলেন। ফলে তারা মানুষ সৃষ্টির আদি রহস্য ও তার নৈতিক, দার্শনিক দিকটিকে বেমালুম অস্বীকার করে গিয়ে মানুষের মনোজগত নিয়ে একধরনের কল্পিত হাইপোথিসিসের উপরে ভিত্তি করে তাদের তথাকথিত গবেষণাকে প্রতিষ্ঠিত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছেন।

     এইসব বিজ্ঞানীরা মানুষের আচরণ ও মনোজগতকে বিশ্লেষণ ও অনুধাবন করার জন্য বানর, শিম্পাঞ্জি, ইঁদুর এরকম নানা পশুর উপরে নানাবিধ পরিক্ষা নিরিক্ষা চালিয়ে সেইসব প্রাণিদের মস্তিস্কে, তথা, ব্রেনকোষ এবং আচরণের ক্ষেত্রে যে সব পরিবর্তন দেখেছেন, তার আলোকে মানুষের আচরণকে ব্যখা করার হাস্যকর এক চেষ্টা করেছেন। 

     ফলত তাদের সকল আন্তরিকতা, সকল প্রচেষ্টাকে ভন্ডুল করে দিয়েছে। আর তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই মানসিক রোগের চিকিৎসা ও পূনর্বাসন কার্যক্রমের ফলাফলের ক্ষেত্রে।  চিকিৎসা কার্যক্রমে সফলতার সংখ্যাতাত্তিক তথ্য উপাত্ত বিচার করলেই সেটা ধরা পড়ে।   

    বিগত ২০০৭ সালে আমেরিকার সাইকোলোজিক্যাল এসোসিয়েশনের এক জরিপে দেখা গেছে যে, সাধারণ মানুষের চেয়ে সাইকোলোজিস্টরা ধর্মের প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে থাকেন বেশি। সাধারণ মানুষ যেখানে শতকরা ১৫জন ধর্মকে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না, সেখানে মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে এই হার হলো শতকরা ৪৮ জন। (১)  
 
    আবার সাইকোলোজিস্টদের মধ্যে আল্লাহ, ইশ্বর, গড এরকম যে কোন নামেই হোক না কেন সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার প্রবণতাও অনেক বেশি। সাধারণ মানুষ যেখানে শতকরা ৫ জন সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাসী নাস্তিক হয়, সেখানে এর বিপরিতে সাইকোলোজিস্ট, তথা, মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে এই হার হলো শতকরা ২৫ জন। (২)    

     এই বাস্তবতার আলোকে আমরা যখন মনের ঠিকানা ও সঙ্গা এবং মনের রোগের চিকিৎসা (যখন প্রয়োজন হবে এবং যার জন্য প্রয়োজন হবে) নিতে একজন সাইকোলোজিস্টের কাছে যাবো, তখন আমরা শংকিত না হয়ে পারি না। বিশ্বজুড়ে মানসিক রোগের কার্যকর চিকিৎসার ক্ষেত্রে যে সীমাহীন ব্যর্থতা বিদ্যমান তার অন্যতম কারণও এখানেই নিহিত রয়েছে।
--------------------------------- 
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments